Showing posts with label OUR PAST AND OUR HERITAGE. Show all posts
Showing posts with label OUR PAST AND OUR HERITAGE. Show all posts

Monday, January 4, 2021

নেতাজি সুভাষ চন্দ্র বসু'র ১২৫তম জন্মবার্ষিকী নিয়ে অনেক কিছু তো হচ্ছে। কিছু ভাল, কিছু ঘোলা হবে বলাই বাহুল্য। সে হোক, আমি আমার কথা বলি। দেখুন, অনেকেই জানেন যে  ইতিহাসের ফর্মাল ছাত্র না হয়েও আমি ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রাম নিয়ে বেশ কিছুটা পড়াশোনা করেছি এবং গত কয়েক বছরে একাধিক রচনা প্রকাশিত হয়েছে। এবং, সেই পরিপ্রেক্ষিতে সুভাষ চন্দ্র 'র রাজনৈতিক সংগ্রাম জানার ও বোঝার চেষ্টা করেছি।  
তাই, ভাবছি, এই ১২৫তম জন্মবার্ষিকী উপলক্ষে  আগে-প্রকাশিত লেখাগুলি এবং নতুন কিছু লিখলে এখানে 'পুনঃপ্রকাশিত' করি। আজ 'নেতাজি সিরিজের' প্রথম রচনা। 
এ বছর অগস্ট মাসে 'ইতিহাস তথ্য ও তর্ক' ফেসবুক পত্রিকায় প্রকাশিত। 


 সর্বভারতীয় জাতীয়তাবাদ ও আজাদ হিন্দ সরকার 

২১শে অক্টবর ১৯৪৩, সিঙ্গাপুরের ক্যাথে থিয়েটার প্রেক্ষাগৃহে নেতাজি সুভাষ চন্দ্র বসু আনুষ্ঠানিক ভাবে আর্জি হুকুমাত-ই-আজাদ হিন্দ (অর্থাৎ, স্বাধীন ভারতের অস্থায়ী সরকার ; the Provisional Government of Free India) প্রতিষ্ঠা করেন, এবং তিনদিন পরে ব্রিটিশ সাম্রাজ্য ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেন। আধুনিক ভারতের ইতিহাসে এই ঘটনাপঞ্জী বহু সমাদৃত । সংবিধানের প্রথম volumeএ আজাদ হিন্দ যেমন নন্দলাল বসুর দ্বারা চিত্রিত, তেমনই এর উদযাপনে একাধিক ডাকটিকিট প্রকাশ হয়েছে। সর্বোপরি, লক্ষ লক্ষ্ ভারতবাসী আজও পরম শ্রদ্ধায় এই ইতিহাস স্মরণ করেন।

আর্জি হুকুমাত-ই-আজাদ হিন্দ (অর্থাৎ, স্বাধীন ভারতের অস্থায়ী সরকার) আনুষ্ঠানিক ঘোষণা করছেন নেতাজি।  ২১শে অক্টবর। মঞ্চে ক্যাপ্টেন লক্ষী স্বামীনাথন সহ অন্যান্য আজাদ হিন্দ মন্ত্রী ও অফিসাররা।
(অধ্যাপক সুগত বসু'র থেকে প্রাপ্ত ছবি)   


ভারতীয় সংবিধানের স্বচিত্র সংস্করণে আজাদ হিন্দ সংগ্রামকে স্মরণ। নন্দলাল বসু অঙ্কিত, ১৯৫০। বর্তমানে সংসদ ভবনের লাইব্রেরীতে হিলিয়াম কক্ষের মধ্যে সংরক্ষিত। 

আজাদ হিন্দ সরকারের ২৫তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীতে ভারতের ডাকটিকিট। ১৯৬৮। 

কিন্তু, এও অনস্বীকার্য যে নেতাজি আজ 'দেবতার' মত পূজিত হলেও আজাদ হিন্দ সরকার গঠনে কি ধরণের চিন্তাভাবনা,পরিকল্পনা ও কাজ প্রকাশ পেয়েছিল তা অনেকাংশে সাধারণ মানুষের অজানা । কিন্তু প্রামাণ্য গ্রন্থের তো অভাব নেই। লিওনার্ড গর্ডন থেকে সুগত বসুর মত নামকরা ঐতিহাসিকদের লেখা জীবনী রয়েছে, শাহনাওয়াজ, এস. এ. এয়ার ও শিশির বসুর স্মৃতিকথা আছে; নেতাজির নিজের লেখা দুটি বই, বেশ কয়েক ভলিউম চিঠি ও ভাষণ সংকলিত আছে। আগ্রহী ছাত্রছাত্রী ও গবেষকের কাছে নেতাজি সম্মন্ধে তথ্য-ভিত্তিক ঐতিহাসের অভাব হবে না। অবশ্য, এই স্বল্প পরিসরে বিস্তারিত আলোচনা করা সম্ভব নয়। কিন্তু তাও, কিছু তথ্য উপস্থাপন করে আমরা তাঁর অসামান্য দূরদৃষ্টিশক্তি ও 'সব ভারতবাসীকে নিয়ে চলার' আদর্শ অনুধাবন করতেই পারি।

প্রতীক (symbols) দিয়েই শুরু করা যাক। যে কোন রাজনৈতিক আন্দোলন ও পরিচয়ে (identity) প্রতীক'র গুরুত্ব আছেই; না হলে জাতীয় পতাকায় অশোকচক্র অথবা রামকৃষ্ণ মিশনের প্রতীকে রাজহংস স্থান পেত না। ঠিক তেমনই আজাদ হিন্দ সরকারের symbolismএ একটু নজর দেওয়া যাক।

১। জাতীয় পতাকা - তিরঙ্গা , মাঝখানে গান্ধীবাদী চরকা। ১৯২০ থেকে যে জাতীয় গণআন্দোলন শুরু হয়েছিল তার প্রধান প্রতিবাদী প্রতীক ছিল এই ত্রিবর্ণরঞ্জিত পতাকা এবং ও চরকা (ওপরের ছবি) ।পরের দুই দশকে আপামর ভারতবাসী এই দুই প্রতীককে নিজেদের হৃদয়ে স্থান দিয়েছিলেন। তাই, দেশের বাইরে গঠিত আজাদ হিন্দ যে দেশের অভ্যন্তরীণ আন্দোলনের এক extension সে কথা সহযোদ্ধা ও বিপক্ষ , দেশ ও জগৎ, সবার কাছে প্রমান করতে নেতাজি বদ্ধপরিকর ছিলেন।১,২ 
রণাঙ্গনের পথে আজাদ হিন্দ সেনা।  জাতীয় পতাকা লক্ষ্য করুন। 


উল্লেখ্য ,এই পতাকা ব্যবহৃত হয় দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায়। তার আগে , জার্মানিতে ইন্ডিসচ লিজিওন (Indisch Legion -ভারতীয় রেজিমেন্ট, যা জার্মান সেনাবাহিনীর সঙ্গে যুক্ত ছিল) পতাকা ছিল তিরঙ্গা; কিন্তু, চরকা'র বদলে সেখানে ছিল আক্রমণে উদ্ধত বাঘ(springing tiger) । মহীশুরের 'বাঘ' টিপু সুলতানের প্রতীক স্থান পেয়েছিলো সুভাষচন্দ্রের পরিকল্পিত প্রথম পতাকায় । যেন, এক ইংরেজ সাম্রাজ্য -বিরোধী বীর নৃপতিকে আরেক বীর নেতার সম্মান (১৭৯৯এ টিপু ইংরেজদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে প্রাণ হারান। ভারতীয় রাজাদের মধ্যে এমন 'সম্মান' দুর্লভ; স্বাভাবিকভাবেই স্বাধীনতা সংগ্রামীদের তিনি 'কাছের মানুষ' ছিলেন। এছাড়াও 'টিপুর বাঘ' আজাদী সৈন্যদের insignia ( কাঁধে বা হাতে উনিফর্মের ওপর পড়া সামরিক পরিচয়চিহ্ন) শোভা পেত।

১৯৪২এ জার্মানিতে ইন্ডিসচ লিজিওন'র পতাকা উত্তোলন।  

তিরঙ্গা ও টিপুর বাঘ: ইন্ডিসচ লিজিওন'র shoulder-piece, জার্মানি, ১৯৪২।  



আজাদ হিন্দের আর কি কি প্রতীক ছিল?
২. জাতীয় নীতিবাক্য (motto): ইত্তেফাক-ইতমাদ-কুরবানী। উর্দুতে একতা- বিশ্বাস - ত্যাগ। আজাদ হিন্দের সংগ্রামের মন্ত্র।৩,*
কলকাতার 'নেতাজি ভবনে' সিঙ্গাপুরের আজাদ হিন্দ মেমোরিয়ালের রেপ্লিকা। (ছবি : লেখক)

৩। জাতীয় অভিবাদন (স্লোগান): 'জয় হিন্দ'।

৪। জাতীয় সঙ্গীত:সাব সুখ চেইন (সহজ হিন্দুস্তানিতে 'জন গণ মন') ।

এই তিনটি প্রতীকের মধ্যেই নেতাজির জাতীয়বাদী পরিকল্পনা প্রকাশ পায়। সুভাষচন্দ্র যে বিশেষভাবে উর্দু ও হিন্দুস্তানী (সহজ হিন্দি ও উর্দু মিশ্রনে যে ভাষা) ভালোবাসতেন সে কথা শিশির বসুর 'বসুবাড়ি' গ্রন্থে উল্লেখিত। কংগ্রেস সভাপতি থাকাকালীন তাঁর এক পন্ডিতজি-শিক্ষক ছিলেন যিনি সভাপতির সঙ্গে দূর প্রদেশেও যেতেন। ট্রেনেই চলত 'ক্লাস' । শুধু তাই নয়, কোন সভা বা মিটিংয়ে কেউ উর্দু বা হিন্দুস্তানিতে বক্তব্য রাখলে সুভাষচন্দ্র মন দিয়ে শুনতেন এবং ভাল শব্দ চয়ন করে নিজের বক্তৃতায় ব্যবহারের চেষ্টা করতেন । তবে ব্যক্তিগত পছন্দ-অপছন্দের ওপরে ছিল এমন একটি ভাষামাধ্যম'র আশা যেটা আজাদ হিন্দের অনেককে এক সূত্রে বেঁধে ফেলবে। যেমন 'জয় হিন্দ' স্লোগান। নেতাজির সেক্রেটারি, সাবমেরিনে সহযাত্রী ও স্নেহভাজন আবিদ হাসান (যিনি পরে ডেনমার্ক ও মিশরে ভারতের রাষ্ট্রদূত নিযুক্ত হন) লিখেছেন যে নেতাজি তাঁকে একটি 'সব ভারতীয়ের কাছে গ্রোহনযোগ্য' অভিবাদন ঠিক করতে বলেন। আবিদ প্রথমে ভেবেচিন্তে এসে বলেন যে 'হ্যালো' বেশ ভালো একটি অভিবাদন। নেতাজি দিয়েছিলেন এক ধমক ! ব্যর্থ হয়ে আবিদ আবার চেষ্টা করতে থাকেন, এবং তখন তাঁর নজরে আসে যে আজাদ হিন্দ ক্যাম্পে অনেকেই বলে 'জয় রামজি কি '। এই ধর্মীয় অভিবাদনকে ভিত্তি করেই আবিদ প্রথমে লেখেন 'জয় হিন্দুস্তান কি '; কিন্তু সেটা বড্ড বড় শোনাচ্ছিল বলে ছোট করতেই 'জয় হিন্দ' একটি আশ্চর্য ধ্বনিমাধুর্য নিয়ে চলে আসে। নেতাজিও খুশি হন।সেই শুরু, আজও তার জনপ্রিয়তা অম্লান

অনেকেই জানেন না যে ভারতের জাতীয় সঙ্গীত হিসেবে 'জন গণ মন' প্রথম আন্তর্জতিক মঞ্চে পরিবেশিত হয় ১৯৪২এ জার্মানির হামবার্গে। নেতাজি ভারত ও ভারতীয় সংগ্রাম সম্পর্কে একটি আন্তর্জাতিক কনফারেন্স'র আয়োজন করেছিলেন। আমন্ত্রিত ছিলেন জার্মানিতে বসবাসকারী নামকরা লোকজন ও বিদেশী কূটনীতিবিদরা। সেখানেই প্রথম হামবার্গের রেডিও অর্কেস্ট্রা 'জন গণ মন' পরিবেশন করেন (youtube ভিডিও আছে ) ৬,৭। ক্ষী স্বামীনাথনের স্মৃতি কথায় আছে যে গানটির সর্বভারতীয় appeal নেতাজির বিশেষ পছন্দ ছিল।তবে যেহেতু মূল গানটি সাধুভাষায় লেখা তাই  নেতাজি দক্ষিন-পূর্ব এশিয়ায় যাবার পরে গানটি বাংলা থেকে সহজ হিন্দুস্তানিতে অনুবাদিত হয় । 'সাব সুখ চৈন কি বারখা বারসে' রচনা করেন আবিদ হাসান ও মুমতাজ হুসেইন এবং সুর দেন ক্যাপ্টেন রাম সিংহ ঠাকুর। স্বাধীন ভারতের ইতিহাসে এ এক উল্লেখযোগ্য অবদান।

১১ই সেপ্টেম্বর, ১৯৪২। হামবার্গে জার্মান-ভারত সোসাইটির উদ্বোধনে নেতাজি। এখানেই প্রথম আনুষ্ঠানিক ভাবে 'জন গন মন' জাতীয় সংগীত হিসেবে পরিবেশিত হয়।  


ভাষা ও লিপি :
ভাষা নিয়ে নেতাজির বৃহৎ চিন্তাভাবনায় কিছু আলোকপাত করা যাক । যেমন, 'আজাদ হিন্দ' পত্রিকা। জার্মানির ফ্রি ইন্ডিয়া সেন্টার থেকে ইংরেজি ও জার্মান দুই ভাষায় প্রকাশিত হত (আজ নেতাজি রিসার্চ ব্যুরোতে সংখ্যাগুলি সংরক্ষিত)।তবে আরো গুরুত্বপূর্ণ ছিল আজাদ হিন্দ রেডিও। সাতটি ভারতীয় ভাষায় দৈনিক সম্প্রচার চলত - হিন্দুস্তানী, বাংলা, তামিল, তেলুগু, গুজরাটি, ফার্সি আর পুশতু আর নেতাজির ইংরেজি আর হিন্দুস্তানি ভাষণ সঙ্গে সঙ্গে তামিলে অনুবাদিত হয়ে পুনঃপ্রচারিত হত ৮,৯।যেমন প্রভিশনাল সরকারের ঘোষণা পত্র ইংরিজি, হিন্দুস্তানি ওঃ তামিল ভাষায় প্রচারিত হয়েছিল । হিসেবটা সোজা - সবার ভাষাকে সম্মান না করলে একসঙ্গে সংগ্রাম হবে কি করে? প্রকৃত নেতার এই বৈশিষ্ট্য - কাউকে দূরে ঠেলে দেন না, সবাইকে নিয়ে চলার চেষ্টা করেন।

তবে শুধু ভাষা নয়, স্বাধীন ভারতে কি ধরণের লিপি ব্যবহার হবে তা নিয়েও নেতাজি পরিকল্পনা করেছিলেন। দেবনাগরী ও আরব-ফার্সি দুই লিপি উপকারিতা স্বীকার করেও তিনি কংগ্রেস সভাপতি রূপে তাঁর বিখ্যাত হরিপুরা কংগ্রেস ভাষণে একটি অভিনব প্রস্তাব করেছিলেন - বলেছিলেন যে রোমান লিপিতে হিন্দুস্তানী একটি সর্বভারতীয় মাধ্যম হতে পারে ১০। এই ব্যাপারে নেতাজির ওপর আধুনিক তুরস্কের জাতির জনক মুস্তাফা কেমাল আতাতুর্ক'র প্রভাব লক্ষণীয় । ১৯২০র দশকে একই ভাবে আতাতুর্ক তুরস্কে রোমান লিপির জন্যে সর্বশিক্ষা অভিযান শুরু করেন । সুভাষ চন্দ্র আতাতুর্ক'র দেশ গঠনের নানারকম পরিকল্পনার গুনগ্রাহী ছিলেন। তাঁর লেখায় ও ভাষণে একাধিকবার এর প্রমান পাওয়া যায় ১১

সেনাবাহিনী - আজাদ হিন্দ ফৌজ

অস্থায়ী ভারত সরকারের সেনাবাহিনীর নামের সঙ্গে আমরা সবাই পরিচিত - ইন্ডিয়ান ন্যাশানাল আর্মি বা আজাদ হিন্দ ফৌজ । সঠিক সৈন্যসংখ্যা নিয়ে দ্বিমত থাকলেও তিনটি সামরিক ডিভিশনে আনুমানিক ৪৫ থেকে ৫০ হাজার আজাদী সৈন্য ছিলেন।এছাড়া আরো পাঁচ ডিভিশন সৈন্য প্রস্তুত হচ্ছিলেন। এর মধ্যে প্রথম INA ডিভিশন'র অধীনস্ত ছিল ইতিহাসে-বিখ্যাত গান্ধী ব্রিগেড, নেহেরু ব্রিগেড ও আজাদ ব্রিগেড ১২,১৩। দেশীয় আন্দোলনের সঙ্গে সংযোগ দেখাতে সদা -আগ্রহী নেতাজি তাঁর প্রধান ব্রিগেডেদের নামকরণ করেছিলেন দেশের সবচেয়ে জনপ্রিয় তিন নেতার নামে #। 

উল্লেখযোগ্য ভাবে কোন 'সুভাষ ব্রিগেড' ছিল না, যদিও প্রথম ডিভিশনের বাছাই করা সৈন্যদের নিয়ে গঠিত একটি গেরিলা রেজিমেন্ট নিজেদের 'সুভাষ ব্রিগ্রেড' বলতে ভালবাসতেন। শাহনওয়াজের স্মৃতিকথায় আছে যে নেতাজি এই নামকরণ বারণ করলেও 'সুভাষ ব্রিগ্রেড' এই ব্যাপারে সর্বাধিনায়কের নির্দেশ মানতে উৎসাহী ছিলেন না ১৩। চার ব্রিগেডই জাপানের ইমফল অভিযানে সাহসী সংগ্রাম করেন। বাহাদুর গ্রুপ নামে একটি কম্যান্ডো দল ছিল। মনিপুরের মৈরাং জাপানি ও আজাদ হিন্দ ফৌজের দখলে আসার পরে ১৪ই এপ্রিল ১৯৪৪ সেই দলের কর্নেল শওকত আলী মালিক সর্বপ্রথম স্বাধীন ভারতের মাটিতে দেশের পতাকা উত্তোলন করেন ১৪। আজ এই দিনটি 'মৈরাং দিবস' হিসেবে উদযাপিত হয়।

মৈরাংয়ে জাতীয় পতাকা উত্তোলন স্মরণে ফলক।  


তবে, আজাদ হিন্দের সবচেয়ে নামকরা উনিট'র নাম বোধয় ঝাঁসির রানী রেজিমেন্ট। লক্ষী স্বামীনাথন (পরে শাহগল) এবং জানকি নাহাপ্পা'র নেতৃত্বে গঠিত ~১০০০ মহিলা সেনাদল। মধ্যবিত্ত শ্রেণী থেকে কয়েকজন হলেও, মূলত এর সদস্যারা ছিলেন নিম্নবিত্ত রবার-প্লান্টেশনে কাজ করা তামিল পরিবারের মেয়ে ১৫। ১৮৫৭'র মহাবিদ্রোহের বীরঙ্গনা রানীর নামাঙ্কিত এই রেজিমেন্ট নেতাজির এক অনন্য পরিকল্পনা। দেশবাসীর ৫০% তো মহিলা; তাঁরা কেন স্বাধীনতা সংগ্রামে যোগ দেবেন না ? এই উপলব্ধি তাঁর জীবনে প্রথম আনেন তাঁর রাজনৈতিক গুরু দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন। মূল সূত্র সেই 'সবাইকে নিয়ে চলা '।

কাজটা অবশ্য সহজ ছিল না। জার্মান ও জাপানের মত ফ্যাসিস্ট গোঁড়া সরকারি চিন্তাভাবনায় এ ছিল অভাবনীয়। হিটলার যেমন সেনাবাহিনীতে মহিলাদের যোগ দেবার তীব্র বিরোধী ছিল ১৬।জাপানেরও কোনো মহিলা সেনাবাহিনী ছিল না ।কিন্তু, সুভাষ চন্দ্র এ বিষয়ে অনড়। দেশের স্বাধীনতা লড়াইয়ে মেয়েদের ডাইরেক্ট ভূমিকা থাকবেই। রানী অফ ঝাঁসি রেজিমেন্টকে জাপানিরা রসদ ও অস্ত্র দিতে বেঁকে বসায় সিঙ্গাপুরের ইন্ডিয়ান ইনডিপেনডেন্স লীগের প্রধান আত্তাভার য়েলাপ্পা এগিয়ে এসে সব ব্যবস্থা করেন  মাস সামরিক ও নার্সিং প্রশিক্ষণের পরে 'রানী'রা বর্মা ফ্রন্টের দিকে যাত্রা করেন । কিন্তু, ততদিনে যুদ্ধের মোড় ঘুরে গেছে। ইঙ্গ-মার্কিন সেনা ও বিমানবাহিনীর কাছে পর্যদুস্ত হয়ে জাপানি ও আজাদ হিন্দ ফৌজ পিছোতে বাধ্য হয়েছেন। রানীদের প্রধান কাজ হয় যুদ্ধে আহত আজাদ হিন্দ সৈন্যদের সেবা সুশ্রষা । বর্মা থেকে রিট্রিট করার সময়, যাতে তারা কোন বেশি বিপদে না পড়েন , তাই নেতাজি নিজে তাদের সঙ্গে বেশ কয়েক দিন হেঁটে বন জঙ্গল পাহাড় পেরিয়ে আসেন। আজ ও বহু ভারতীয় মহিলা ইতিহাসের সেই আশ্চর্য অধ্যায় থেকে অনুপ্রেরণা নিতে পারেন ১৫

রানী অফ ঝাঁসি রেজিমেন্টের কুচকাওয়াজে নেতাজি।  পাশে রেজিমেন্টের নেত্রী ক্যাপ্টেন লক্ষী স্বামীনাথন। 


আজাদ হিন্দ মেডেল ও আজাদ হিন্দ ব্যাঙ্ক
বীর সেনাদের সম্মান জানাতে বেশ কিছু মেডেল চালু করেছিলেন নেতাজি। রণাঙ্গনে সাহসিকতার জন্যে প্রদান করা শের-ই-হিন্দ (ভারতের বাঘ) এবং সর্দার-ই-জং (যুদ্ধে শ্রেষ্ঠ) মেডেল। ক্যাপ্টেন কুঁয়াল সিং ও ক্যাপ্টেন গনেশি লাল শের-ই-হিন্দ মেডেল দিয়ে সম্মানিত হন, শওকত মালিক ভূষিত হয়েছিলেন সর্দার-ই-জং ১৭
আজাদ হিন্দের মেডেল। শের-ই-হিন্দ ও সর্দার-ই-জঙ 


এছাড়া দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ায় বসবাসকারী যে সব ভারতীয়রা আজাদ হিন্দের অসামরিক কাজের নিরলস সংগ্রামী তাঁদের জন্যে ছিল সেবক-ই-হিন্দ মেডেল। যেমন, রেঙ্গুনের ব্যবসায়ী আব্দুল হাবিব মারফানী এবং শ্রীমতি বেতাই নিজেদের সব সম্পত্তি দেশের জন্যে দান করে দেন। নেতাজির অসাধারণ বাগ্মিতা ও আহ্বানে মুগ্ধ ভারতীয় সম্প্রদায় তাঁর হাতে আরো প্রায় কুড়ি কোটি টাকা তুলে দিলে ৫ই এপ্রিল, ১৯৪৪ প্রতিষ্ঠিত হয় 'ন্যাশনাল ব্যাঙ্ক অফ আজাদ হিন্দ' ^। জাপানিরা ব্যাপারটায় খুশি হয়নি, কিন্তু নেতাজি জাতীয় ব্যাপারে সবসময়ই কিছুটা দূরত্ব রাখতে চেষ্টা করতেন। জার্মানি ও জাপান থেকে তিনি যা আর্থিক সাহায্য নিতেন, সেটা জাতীয় ঋণ (ন্যাশনাল loan) হিসেবে নেওয়া হত , স্বাধীনতার পরে ভারত তা মিটিয়ে দেবে এই ছিল বোঝাপড়া। এক্ষেত্রে তিনি জাপানিদের জানিয়ে দিয়েছিলেন স্বাধীন ভারতের যে সব ভূখন্ড স্বাধীন হবে সেখানে প্রথম থেকেই আজাদ হিন্দ মুদ্রা চালু হবে, জাপানি ইয়েন নয় ১৮। এবং এই জন্যে টোকিওর টাঁকশালে মুদ্রিত হয়েছিল আজাদ হিন্দের নতুন টাকারsample নোট। এছাড়া জার্মানিতে মুদ্রিত হয়েছিল আজাদ হিন্দ সরকারের ডাকটিকিট। পরিকল্পনা ছিল যে ভারতের যে সব অঞ্চল থেকে ইংরেজ সরকার হটে যাবে সেখানে আজাদ হিন্দ সরকারের অসামরিক দপ্তর সঙ্গে সঙ্গে কাজকর্ম চালু করবে ১৯। অবশ্য, সমগ্র জাপান-অধিকৃত এশিয়ার সঙ্গে দৈন্দিন কাজকর্মে জাপানি সরকারের ডলার ব্যবহার করতেন আজাদ হিন্দ সরকার। যেমন, ১৯৪৪এ সিঙ্গাপুরের রামকৃষ্ণ মিশনের boys home 'বাল ভবন' নির্মাণে নেতাজি ৫০০০০ ডলার দান করেন ২০
'ন্যাশনাল ব্যাঙ্ক অফ আজাদ হিন্দ' নিজের সম্পত্তি দান করা আব্দুল হাবিব মারফানী 
আজাদ হিন্দ সরকারের পরিকল্পিত টাকার নোট  


আজাদ হিন্দ সরকারের অবশ্য সেভাবে কোনো ভারতীয় ভূখন্ড রাজ্যত্ব করতে পারেননি। জাপান আনুষ্ঠানিকভাবে আন্দামান ও নিকোবর দ্বীপপুঞ্জ নেতাজির হাতে তুলে দিয়েছিল ; নামকরণ হয়েছিল 'শহীদ'' ও 'স্বরাজ'। কিন্তু, আসল প্রশাসন জাপানি কমান্ডারদের হাতেই থেকে গিয়েছিল, এবং তাদের সন্দেহবাতিক ও অত্যাচারে আন্দামানবাসিরা অতিষ্ট ছিলেন। । আজাদ হিন্দ এই নিয়ে বারবার প্রতিবাদ করলেও তেমন ফল হয়নি ২১

পোর্ট ব্লেয়ারে আজাদ হিন্দের পতাকা উত্তোলন, ৩০শে ডিসেম্বর, ১৯৪৩।


ক্যাবিনেট:
এই বিশাল সংগ্রামের হৃদয়-কেন্দ্র ছিল আজাদ হিন্দ ক্যাবিনেট। নেতাজির নিজস্ব মন্ত্রিসভা ও উপদেষ্টাগণ।
ক্যাবিনেটে সদস্য ছিলেন -
সুভাষ চন্দ্র বসু - রাষ্ট্রপ্রধান, প্রধানমন্ত্রী, যুদ্ধ ও বিদেশ মন্ত্রক । **
লেঃ কর্নেল এ সি চ্যাটার্জি (পরে এন. রাঘবন) - অর্থ মন্ত্রক ।
ডঃ: লক্ষী স্বামীনাথন - মহিলা বিষয়ক মন্ত্রক (minister for women affairs )
এ এম সহায় - প্রধান সচিব
এস এ আয়ার - প্রচার ও জন সংযোগ মন্ত্রক।
রাসবিহারী বসু - সর্বোচ্চ উপদেষ্টা (আজাদ হিন্দের সংগ্রাম এবং পুরোনো বিপ্লবীরা যেন একই পথের পথিক)
করিম গিয়ানি , জন থিবি , দেবনাথ দাস, সর্দার ইশার সিংহ, ডি.এম. খান, আত্তাভার য়েলাপ্পা - বর্মা , থাইল্যান্ড, সিঙ্গাপুর এবং হংকং থেকে উপদেষ্টা।
লেঃ কর্নেল জে কে ভোঁসলে , লেঃ কর্নেল গুলজারা সিং , লেঃ কর্নেল শাহ নাওয়াজ খান , লেঃ কর্নেল আজিজ আহমেদ, লেঃ কর্নেল মোহাম্মদ জামন কিয়ানি, লেঃ কর্নেল এন.এস. ভগত, লেঃ কর্নেল এহসান কাদির এবং লেঃ কর্নেল এ.সি লোগানাথান - আজাদ হিন্দ ফৌজের প্রতিনিধি।
এ এন সরকার - আইন বিষয়ক উপদেষ্টা ২২,+
আজাদ হিন্দ ক্যাবিনেট, সিঙ্গাপুর, ১৯৪৩/৪৪.


যেটা বলার অপেক্ষা রাখে না তা হল ক্যাবিনেট গঠনেও ভারতের সব সম্প্রদায় ও প্রদেশের সুস্পষ্ট উপস্থিতি। এবং শুধু উচ্চতম পর্যায়েই নয়। ব্রিটিশ ইন্ডিয়ান আর্মির ধর্ম- ও জাত-ভিত্তিক গঠনের সম্পূর্ণ বিপরীত দিকে গিয়ে আজাদ হিন্দ ফৌজের ক্ষুদ্রতম উনিটেও সব ভারতীয়রা জাত ধর্ম নির্বিশেষে থাকবেন, এই প্রতিদিনের-জাতীয়তাবাদই ছিল নেতাজির আদর্শ ও লক্ষ্য। এর ফলাফল বর্ণনা করেছেন আবিদ হাসান, '' আমাদের মধ্যে ছিলেন বালুচিরা, যেমন ছিলেন অসমীয়া, কাশ্মীরি আর মালায়লীরা, পাঠান এবং শিখ, আর গুজরাটিরা। ভারতের প্রতিটি অঞ্চলের অধিবাসী ছিলেন, ছিলেন প্রতি ধর্ম ও জাতের লোকজন, এবং বড় ডিভিশন থেকে শুরু করে সবচেয়ে ছোট পল্টনের মধ্যেও সবাই হাতে হাত মিলিয়ে কাজ করতেন । এইভাবে প্রত্যেকটি ইউনিট হয়ে দাঁড়িয়েছিল ভারতের একতার প্রতীক।'' ২৩

আবিদ যোগ করতে ভোলেননি, ''আমাদের সবার কিন্তু নিজ নিজ ধর্ম এবং নিজস্ব ভাষা ছিল। কিন্তু, রাজনৈতিক লক্ষে আমরা ছিলাম এক, প্রতিজ্ঞাবদ্ধ এবং অবিভাজ্য ।'' নেতাজি তাঁদের কাউকেই নিজের ধর্ম, সংস্কৃতি, ভাষা ত্যাগ করতে বলেননি। তবে এই সব পরিচয়ের উর্ধে যে দেশের পরিচয়(identity) সেই পরিচয়ের জন্যে একত্র হতে বলেছিলেন। জাতীয় ঐক্যের ব্যাপার সবার ওপরে এবং সেখানে তিনি অনমনীয়। যেমন, রেঙ্গুনের ধনী দক্ষিণ ভারতীয় চেট্টিয়ার সম্প্রদায় ছিলেন আজাদ হিন্দ সরকারের বড় পৃষ্টপোষক। তাঁদের প্রধান মন্দিরে official visit করলে আর্থিক সমর্থন আরো বাড়বে, এটাই অনুমেয়। নেতাজি কিন্তু স্পষ্ট জানিয়ে দেন যে মন্দিরের পুরোহিতগণ যদি তাঁর ক্যাবিনেটের হিন্দু ও ও-হিন্দু সকল মন্ত্রীকে মন্দিরে প্রবেশ করতে দেন তবেই তিনি যাবেন! আমরা- ওরা কোনোমতেই চলবে না। শেষ পর্যন্ত চেট্টিয়ার মন্দির কর্তৃপক্ষ সবাইকে আমন্ত্রণ জানান। হিন্দু-মুসলমান-শিখ-ক্রিস্টান সকল ভারতীয় মিলে সেদিন এক আশ্চর্য জনসমাগম হয়েছিল ২৪

মনে রাখা আবশ্যক, নেতাজি কিন্তু ভগৎ সিং, চদ্রশেখর আজাদ'র মত ঘোষিত-নাস্তিক, কিংবা জওহরলাল নেহরুর মত এগ্নস্টিক ছিলেন না। বিশ্বজননী-রূপে তিনি ঈশ্বরে বিশ্বাস করতেন। যুদ্ধের ভয়ানক ব্যস্ততার মধ্যে সারাদিনের কাজের শেষে অনেক রাত্রে সিঙ্গাপুরের রামকৃষ্ণ মিশনে গিয়ে মিলিটারি পোশাক ছেড়ে একটি সিল্কের ধুতি পরে ঘন্টা দুই ধ্যানমগ্ন হতেন। এই ছিল তাঁর 'রিচার্জ' ২৫। তবে সেটা তাঁর ব্যক্তিগত জীবন। আয়ার'র বর্ণনা থেকে আমরা জানতে পারি , '' একদিনের জন্যেও তাঁকে দেখিনি প্রকাশ্যে, জনসমক্ষে কোনো ধার্মিক আচরণ করতে। তাঁর কর্মই ছিল তাঁর ধর্ম, জীবনের প্রতি মুহূর্ত সংগ্রামের মধ্যে দিয়ে সেই ধর্ম তিনি পালন করতেন''২৬  
 এবং এই জীবনাদর্শ ও বিশ্বব্যাপী অভিজ্ঞতা থেকেই আসে আজাদ হিন্দ সরকারের ঘোষণাপত্রের শেষ অনুচ্ছেদে নেতাজির দ্যর্থহীন ঘোষণা - ''...[স্বাধীন ভারতের অস্থায়ী সরকার] প্রত্যেক ভারতবাসীকে নিজ নিজ ধর্ম পালন করার স্বাধীনতা দিতে অঙ্গীকারবদ্ধ , এবং সবাইকে সমান অধিকার ও সুযোগসুবিধা প্রদান করতেও দ্বায়িত্ববদ্ধ । বিদেশী ঔপনিবেশিক সরকারের দ্বারা প্রতিপালিত সব ভেদ, দূরত্ব ও তফাৎ'র উর্ধে গিয়ে প্রত্যেক ভারতীয়ের সুখ ও সমৃদ্ধির জন্যে সংগ্রাম করা এই সরকারের প্রথম এবং প্রধান কাজ হবে ।'' ২৭

একটি ঘটনা দিয়ে শেষ করি।' His Majesty's Opponent' বইতে পড়েছি।  ১৯৪৫র শেষে যখন লাল কেল্লায় তিন আজাদ হিন্দ অফিসারের মিলিটারি বিচার চলছে তখন কেল্লায় আরো অনেক অফিসার ও সৈন্য বন্ধি ছিলেন। গান্ধীজি একদিন তাঁদের দেখতে যান, কেমন আছেন খোঁজ নেন।  আজাদ হিন্দ সৈন্যরা গান্ধীজির কাছে নালিশ করেন যে 'নেতাজি আমাদের শিখিয়েছিলেন কোন ধর্ম সম্প্রদায়ের বিভাজন রাখবে না।  কিন্তু, এখানে ইংরেজরা সারাক্ষন আমাদের হিন্দু-মুসলমান ভাগ করতে উঠে পড়ে লেগেছে। দেখুন, সকালের চা ও দে দুটো আলাদা 'হিন্দু চা' আর 'মুসলমান চা' লেখা আলাদা কেটলিতে।' মুচকি হেসে গান্ধীজি দেন, 'ওরা দেয় তো দেয় তোমরা মানো কেন?  আজাদ হিন্দ সেনারা জবাব দেন, 'মানি না তো। আমরা দুই কেটলির চা মিশিয়ে নিয়ে তারপর খাই' . জোরে হেসে ওঠেন গান্ধীজি।  বলেন,  'দারুন এই তো চাই ' .

এই চিরন্তন সদুপদেশ আজ হয়তো ভারতবাসীর কাছে বেশি করে প্রাসঙ্গিক।

 সদ্য মুক্তিপ্রাপ্ত আজাদ হিন্দ অফিসার ও সেনারা গান্ধীজিকে জন গন মন গেয়ে শোনাচ্ছেন। বেহালা বাজাচ্ছেন ব্যান্ডমাস্টার  ক্যাপ্টেন রাম সিং ঠাকুর। সম্ভবত লালকেল্লায়। ১৯৪৫/৪৬

------------- ---------------
প্রকাশিত - https://www.facebook.com/groups/1803711656387813/permalink/3230153960410235

টিকা
*সিঙ্গাপুর ছেড়ে যাওয়ার কয়েকদিন আগে নেতাজি তাঁর বিশ্বস্ত অফিসার সিরিল জন স্ট্রেসিকে নির্দেশ দেন, আজাদ হিন্দের শহীদ সৈন্যদের জন্যে একটি স্মৃতিস্তম্ভ তৈরী করতে হবে। অল্প কয়েকদিনেই মধ্যেই সিঙ্গাপুরের সমুদ্রতটে স্ট্রেসি যে সৌধ নির্মাণ করেন তাতে খোদাই করা ছিল এই motto। কিন্তু, চরম অনৈতিকভাবে বিজয়ী মিত্রশক্তি সেই সৌধ ডিনামাইট দিয়ে উড়িয়ে দেয়! বহু দশক পরে সিঙ্গাপুরে বসবাসকারী কয়েকজন ভারতীয় একটি আধুনিক সৌধ করেছেন ; আরেকটি প্রতিরূপ আছে কলকাতার নেতাজি ভবনে।

গান্ধীজি প্রসঙ্গে বলা অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক যে স্বাধীন ভারত কোনোদিন সরকারিভাবে তাঁকে 'জাতির জনক' উপাধি দেয়নি। এই সম্মানের উৎস নেতাজি সুভাষ চন্দ্র বসু'র আজাদ হিন্দ রেডিও ভাষণ(৬ই জুলাই, ১৯৪৪)। শুধু তাই নয়, পুনার জেলে কস্তুরবা গান্ধীর মৃত্যর পরে বেতার ভাষণে নেতাজি সেই অসামান্যা নারীকে 'mother of the Indian people' বলে অভিহিত করেন।

^ সব অনাবাসী ভারতীয় যে টাকা পয়সা দিতে অতটা উৎসাহী ছিলেন না। শেষ পর্যন্ত আজাদ হিন্দ সিদ্ধান্ত নেয় যে অনিচ্ছুকরা ১০% দিলেই হবে।

** তাহলে কি নেতাজি ভারতের প্রথম প্রধানমন্ত্রী? না , কারণ নেতাজি তাঁর ভাষণে নিজেই স্পষ্ট করে দিয়েছেন যে আজাদ হিন্দ হল 'অস্থায়ী সরকার ', এবং ভারত স্বাধীন হবার পরেই এই সরকারের কাজ শেষ। তারপরে কি সরকার গঠিত হবে তা ঠিক করবেন স্বাধীন ভারতের মানুষ।
+ জার্মানি, ইতালি, জাপান ও অক্ষশক্তি-সমর্থিত ৬টি সরকার আজাদ হিন্দকে স্বীকৃতি দিয়েছিল। আয়ারল্যান্ডের রাষ্ট্রপতি ইমন ডি'ভালেরা শুভেচ্ছা বার্তা পাঠিয়েছিলেন।



সহায়ক গ্রন্থ
১,২,৩ - Sugata Bose, His Majesty 's Opponent, 2011, Penguin Books p. 210, 257, 299
৪ - শিশির কুমার বসু, বসুবাড়ি, ১৯৮৫, আনন্দ পাবলিশার্স , পৃ.৮২-৮৩
৫, ৬ - Leonard Gordon, Brothers against the Raj, 1990, Rupa Publications, pp. 459-460; Bose, His Majesty 's Opponent, 2011, Penguin Books pp.210-211
৭ - https://www.youtube.com/watch?v=9Cn34HFZ8tc
৮, ৯ - Leonard Gordon, Brothers against the Raj, 1990, Rupa Publications, p. 454-455; Sugata Bose, His Majesty 's Opponent, 2011, Penguin Books p. 225, 245
১০ - Sugata Bose, His Majesty 's Opponent, 2011, Penguin Books p. 140; Crossroads, being the works of Subhas Chandra Bose 1938-40, published by Netaji Research Bureau, 1962, Asia Publishing House. pp.13-14
১১- Congress President: Speeches, Articles, and Letters January 1938–May 1939, p. 61; Hugh Toye, The Springing Tiger, Jaico Publishing House, p. 179.
১২, ১৩ - Leonard Gordon, Brothers against the Raj, 1990, Rupa Publications, p. 498; Sugata Bose, His Majesty 's Opponent, 2011, Penguin Books pp.251-252
১৪- Sugata Bose, His Majesty 's Opponent, 2011, Penguin Books p.275
১৫, ১৬ - Leonard Gordon, Brothers against the Raj, 1990, Rupa Publications, p. 496-497; Sugata Bose, His Majesty 's Opponent, 2011, Penguin Books p.246-247; William L. Shirer, Rise and Fall of the Third Reich, 1960, Arrow Books, p. 975
১৭ - https://en.wikipedia.org/wiki/Sher-e-Hind ; https://en.wikipedia.org/wiki/Sardar-e-Jung
১৮, ১৯ - Leonard Gordon, Brothers against the Raj, 1990, Rupa Publications, p. 510; Sugata Bose, His Majesty 's Opponent, 2011, Penguin Books p.272-73
২০- https://www.facebook.com/.../permalink/715524075604174/
২১ - Leonard Gordon, Brothers against the Raj, 1990, Rupa Publications, p. 502, Unto Him a Witness, SA Ayer, 1951, Thacker and Co Ltd, p. 249
২২ - Selected speeches by Subhas Chandra Bose, introduction by S.A. Ayer, Publications Division, Ministry of Information and Broadcasting, Government of India. pp. 219-220; Sugata Bose, His Majesty 's Opponent, 2011, Penguin Books p.255
২৩-Sugata Bose, His Majesty 's Opponent, 2011, Penguin Books pp.281-82
২৪ -Sugata Bose, His Majesty 's Opponent, 2011, Penguin Books p.256
২৫-Leonard Gordon, Brothers against the Raj, 1990, Rupa Publications, p.502;
Sugata Bose, His Majesty 's Opponent, 2011, Penguin Books p.253
২৬- Unto Him a Witness, SA Ayer, 1951, Thacker and Co Ltd, p. 269
২৭-Selected speeches by Subhas Chandra Bose, introduction by S.A. Ayer, Publications Division, Ministry of Information and Broadcasting, Government of India. pp. 218-220
------------------ ------------------

Friday, January 1, 2021

  চৈতন্য হওয়া বা না হওয়া ....

আজ কল্পতরু উৎসব। ১৮৮৬ সালে যেদিন অসুস্থ শ্রীরামকৃষ্ণ  ১৪-১৫জন মানসপুত্রকে আনুষ্ঠানিক ভাবে সন্ন্যাসীর পোশাক দিয়ে RKMর nucleus গড়ে দিয়েছিলেন তার উদযাপন।সেদিন তাঁর ব্যবহৃত সেই দুটি কথা 'চৈতন্য হোক'। মানুষর জন্যে এর থেকে বড় আশীর্বাদ হয় কি?

মজার ব্যাপার হল, কোন বিশেষ বিষয়ে এই 'চেতনা' বা  'চৈতন্য' বা 'উপলব্ধি' ব্যাপারটা বেশ ব্যক্তিগত। আমি আমার কথা বলতে পারি।বিজ্ঞানের গবেষক হিসেবে অনেকদিন তো হল। তাই এখন বুঝি যে  নতুন আবিষ্কার বা নতুন তথ্য সমন্ধে পড়া, জানা, চিন্তাভাবনা করা, মনে রাখা এবং প্রয়োজনে recollect করা একটা জিনিস। তার সঙ্গে related অথচ বেশ কিছুটা স্বাতন্ত্র হল সেই বিষয়টা 'উপলব্ধি' বা  'আত্মস্থ' করা। ইংরিজিতে প্রথমগুলি হল  data acquisition আর দ্বিতীয়টা assimilation বা realization ; প্রথমটা না হলে দ্বিতীয়টা হবে না (অন্তত বিজ্ঞানে হবে না) , কিন্তু প্রথমটা হলেই যে দ্বিতীয়টা হতে হবে তার কোন immediate কারণ নেই।এবং কবে কখন কিভাবে হবে তারও ঠিক নেই। তক্ষুনি  হতেও পারে, পরেও হতে পারে, অনেক বছর পরে কোন অভিজ্ঞতার মাধ্যমে সেই চেতনা/উপলব্ধি আসতে পারে। তবে কিছু experience সবসমই এ ব্যাপারে সাহায্য করে। চোখের দেখা একটা দারুন জিনিস; হেভ্ভি উপলব্ধি করায়।  তাই, আজ একটা ঘটনা বলি। আজ যাঁর আশীর্বাদধন্য উৎসব তাঁকে নিয়েই; খুবই সামান্য জিনিস, কিন্তু তার মধ্যেও কিছু লুকিয়ে ছিল কে জানত? 

 মূল ঘটনায় যাবার আগে একটি quote দিয়ে শুরু করি।  অনেকেই এটি একটু  ছোটোভাবে পড়ে থাকবেন। 'During the last century the finest fruit of British intellectual eminence was, probably, to be found in Robert Browning and John Ruskin. Yet they are mere gropers in the dark compared with the uncultured and illiterate Ramakrishna of Bengal, who knowing naught of what we term ‘learning’, spoke as not other man of his age spoke, and revealed God to weary mortals'.

অর্থাৎ, 'ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষে শ্রেষ্ঠ ইংরেজ মনীষী বলতে রবার্ট ব্রাউনিং আর জন রাস্কিন'র কথা আসবে। কিন্তু,বাংলার নিবাসী নিরক্ষর রামকৃষ্ণের তুলনায় ইউরোপের এই শ্রেষ্ঠ পণ্ডিতরা অজ্ঞানী।....'

অনেকে ভাবেন এর রচয়িতা পন্ডিত ম্যাক্স মুলার। না , জার্মান ভারততাত্ত্বিক মুলার শ্রী রামকৃষ্ণে'র জীবনী রচনা করলেও এই লেখাটি ইংরেজ লেখক ভারতপ্রেমিক উইলিয়াম ডিগবাই'র (William Digby) . লেখাটির মধ্যে একটা তথ্যগত ভুল আছে। শ্রীরামকৃষ্ণ নিরক্ষর ছিলেন না। লিখতে-পড়তে পারতেন, তার প্রমান ও রয়েছে। কিন্তু, উইলিয়াম ডিগবাই'র  মূল উপলব্ধি একদম bang on target. কেন এই sentenceটা আনলাম ঘটনা এগোলেই বুঝতে পারবেন।  

William Digby (1849-1904) 

শ্রী রামকৃষ্ণের লেখা ও আঁকা 



আমার বন্ধু রাজেন্দ্র (তেলুগু, একদিকে  তুখোড় বিজ্ঞানী অন্যদিকে দারুন মজার ছেলে) পুজোআচ্চার ব্যাপারে খুবই নিষ্ঠাবান। যে ফ্ল্যাটে পেয়িং-গেস্ট থাকত সেখানে একটা টেবিলে অনেকজন দেবদেবীকে প্রতিষ্ঠা করে রোজ ভাল করে পুজো করে তবে instituteএ আসত। আর এতগুলি মূর্তি ছবি'র মধ্যে ওর 'ফেভারিট' ছিল শিরিডি সাঁইবাবার একটা মূর্তি। মাঝারি সাইজ, পরিচিত স্টাইলে হাঁটুর ওপরে পা তুলে তিনি বসে আছেন।তেমন কিছু আহামরি না আমাদের যেমন চড়কের মেলা হয় তেমন কোন জায়গা থেকে কেনা, কিন্তু অজানা artist  মুখে বেশ স্নিগ্ধ ভাবটা ফুটিয়ে তুলেছিলেন। রাজেন্দ্র'র তো বটেই, আমি যে আমি প্রায় কোন ritual করি না, আমারও ওটা দেখতে খুব ভাল লাগত। 

তা এভাবেই চলছিল। একদিন রাজেন্দ্র'র ব্যাগে একটা প্লাস্টিক সাপ ঢুকিয়ে দিতে বিগ বাজারে তুলকালাম পড়ে গেসল, সিকিউরিটি দৌড়ে এসেছিল কিন্তু যাক সে কথা।  আরেক দিন রাজেন্দ্র কাজে এল একটু দেরি করে এবং দেখি খুব মনমরা। এটা খুব স্ট্রাইকিং কারণ সাধারণত ও  ঢোকা মানে এক-দু মিনিট  হৈ হুলোড় হওয়া। কিন্তু সেদিন চুপ।  একটু পরে জিজ্ঞেস করলাম, 'কি ভাই কোন মেয়ে লেঙ্গি মারল আজ? ' মুখ কাঁচু মাচু করে উত্তর দিল, 'আমার ওই সাঁইবাবার মূর্তিটা পড়ে ভেঙে গেছে।....খুব মন খারাপ।'



এবার আমার থতমত খাবার পালা। কয়েক সেকেন্ড চুপ থেকে তাৎক্ষণিক মনখারাপ কাটিয়ে জিজ্ঞেস করলাম, 'একদম ভেঙে গেছে, টুকরো টুকরো?'

রাজেন্দ্র: না না।  শুধু ঘাড় থেকে মাথা-টা খুলে গেছে। 

আমি: তারপর?

রাজেন্দ্র: টেবিলে রেখে এসেছি।

আমি: ঠিক আছে. Araldite বা ফেভিকল দিয়ে আটকে দিলেই হবে।  

রাজেন্দ্র: না না।  সে আবার কি? তুই না কিছুই বুঝিস না।  নদীতে ভাসিয়ে দিতে হবে।  কাল দেব।  

আমি: এটা একটা কথা হল।  just আটকে দিলেই হবে, এত সুন্দর একটা মূর্তি, তোর ফেভারিট জিনিস। আটকে দে. 

আরো দুয়েকজন সহকর্মী নিয়ম নিষ্ঠাবান হয়ে রাজেন্দ্র'র idea 'ঠিক ঠিক' বলছে দেখে বহু বছর আগে পড়া, মা'র কাছে শোনা শ্রী রামকৃষ্ণের জীবনী থেকে 'ব্রহ্মাস্ত্র' বের করলাম।  বললাম, 

'দেখ, ~১৮৬০-৭০র দশকে দক্ষিণেশ্বরের মন্দিরে রাধাকৃষ্ণ মূর্তির একটি পা খুলে গেসল। মন্দিরের বাকি ব্রাহ্মণ ও মাতব্বররা বিধান দিয়েছিলেন যে এই মূর্তি গঙ্গায় বিসর্জন দিতে হবে।  ...'

রাজেন্দ্র: আমিও তাই তো বললাম। ...

আমি: কিন্তু শ্রী রামকৃষ্ণ যুক্তি দেন, 'রানী রাসমণির জামাই'র পা ভেঙে গেলে তাকে কি জলে ভাসিয়ে দেব বল? না তার fractured পা জোড়া লাগিয়ে দাও? ....যে মূর্তি এত বড় আপনজন তাকে ভাসাবে কেন ? আমায় দাও আমি পা আবার জোড়া লাগিয়ে দিচ্ছি'।  

সবাই থমকে গেছে দেখে আমি বলে চললাম, ' এমন ভালোবাসা-মাখানো অকাট্য যুক্তি কাটবে কে? তাই স্থির হয় মূর্তি থাকবে। আর শ্রী রামকৃষ্ণ সেই মূর্তি নিজে হাতে মেরামত করে দেন।  এ বিষয়ে তাঁর ছোটবেলা থেকেই উৎসাহ, ন্যাচারাল ট্যালেন্ট ছিল ; ভাল মূর্তি গড়তে পারতেন, আঁকতে পারতেন।  ....এ সরানো তাঁর কাছে টেকনিক্যালি ও সোজা।  ব্যাস,  কৃষ্ণ মূর্তি আবার পা ফিরে পেল, যতদূর জানি আজও তা ওখানে পূজিত।  '

গল্প শেষ করে আমি থামলাম। সবাই চুপ. মুখ দেখে বুঝতে পারছি পশ্চিম ভারতীয় মহিলা ও দক্ষিণ ভারতীয় ছেলে কারুরই কথাটা খুব একটা পছন্দ হয়নি, কিন্তু শ্রী রামকৃষ্ণের যুক্তিটা এত বেশি স্ট্রং যে কথা খুঁজে পাচ্ছে না। পাশে বসা উত্তর ভারতীয় ছেলেটি এমন বৈপ্লবিক গল্প'র core হজম করার চেষ্টা করছে।  মনে রাখতে হবে এরা  যে-সে ছেলেমেয়ে নয়।  দেশের শ্রেষ্ঠ পরীক্ষায় পাস্ করে সবচেয়ে নামকরা বিজ্ঞান কেন্দ্রের গবেষক।মগনলালের কথায়  ordinary nehi, extraordinary intelligence। দেশে বিদেশে নানা কনফারেন্সে এরা অনেককে টেক্কা দিয়ে আসে, কিন্তু আজ কথার খেই খুঁজে পাচ্ছে না। আমিও সেই কবে ডিগবাই'র লেখা উক্তিটি পড়েছিলাম During the last century the finest fruit of British intellectual eminence was, probably, to be found in Robert Browning and John Ruskin. Yet they are mere gropers in the dark compared with the uncultured and illiterate Ramakrishna of Bengal.  সেদিন এর সত্যতা উপলব্ধি করলাম বলতে পারেন। .....

রাজেন্দ্র সেদিন আর এ বিষয়ে বেশি কিছু বলেনি। আর আমিও নিশ্চিত ছিলাম যে যা ডোজ দিয়েছি ও মূর্তি ফেভিকল দিয়ে আটকে দেবে। দুদিন পরে - 

আমিঃ কি রে? মূর্তিটা লাগিয়েছিস?

রাজেন্দ্রঃ না না , পুজো করে বিসর্জন দিলাম তো গতকাল। 

আমি: সে কি???? কেন? 

রাজেন্দ্র: আমাদের বাড়ির পন্ডিত মশাই বললেন যে।  

আমি (সত্যিই বিরক্ত): আর সেদিন যে রামকৃষ্ণ দেবের ঘটনা তা বললাম সেটা তো কাটতে পারলি না? তার বেলা? আপন বলা মূর্তিকে কেউ ফেলে দেয় ? বাড়ির কেউ হলে ফেলে দিতিস?

রাজেন্দ্র: ....সেটা ঠিক। ...কিন্তু কিছু নিয়ম মানতেই হয়। এসব  ব্যাপারে। ....

অনেকদিন আগের ঘটনা। আজ মনে পড়ল।  সেদিন (এবং তারপরে যা পড়েছি, যা দেখেছি) তার থেকে   - 

উপলব্ধি- ১ : শ্রী  রামকৃষ্ণ'র logic কাটে কার সাধ্য? (সত্যি বলতে কি স্বামীজীর কথায় অল্পস্বল্প কিছু loose comment পাওয়া যায়। সেটা দোষ নয়, মহাপুরুষ হলেও কি সব বিষয়ে সর্বজ্ঞ না কি ? আর তাঁর অকাল মৃত্যু'র পরে ইতিহাস বিজ্ঞান কত এগিয়েছে। সব জিনিস তো তাঁর পক্ষে জানা সম্ভব ছিল না।  আর সে ঠিক আছে - সে তো তিনি বলেই গেছেন, যাচাই করে নিবি ) কিন্তু, শ্রী রামকৃষ্ণর জাগতিক বিষয়ে যা জ্ঞান ও উপলব্ধি তা just অকাট্য। 

উপলব্ধি-২: মহাপুরুষরা যাই বলুন, মানুষ সাধারনত আচার-বিচার নিয়েই থাকে। যুগাবতেরর বারণও শোনে না, কায়দা করে অগ্রাহ্য করে।    

--- ---

পুনশ্চ: 

 গত এক-দেড় বছর দেশে ও জগতে যা হয়েছে তা অনেকভাবে অনেক কিছু বেশ উপলব্ধি করিয়েছে। ইতিহাসের বই বা বিজ্ঞানের জার্নালে যা থাকে তাকে live n colour সামনে এনে দেখিয়ে দিয়েছে।    

 রাজেন্দ্র এখন বিলেতে। ফেসবুকে বা whatsapp এ অবশ্য প্রায়ই দেখা আড্ডা হয়।  

Thursday, December 17, 2020

 ইতিহাসের গপ্প: স্বাধীন ভারতের শ্রেষ্ঠ সেনানায়ক 

' আপনি জানেন, পর্তুগালের রাস্তায় রেস্তোরাঁয় আপনার নাম পোস্টার পড়েছে। আপনাকে ধরে দিতে পারলে ১০ হাজার ডলার না কত যেন পুরস্কার দেবে ওদের সরকার।' 

১৯৬১র শেষের দিকের কথা। লিসবন ইত্যাদি ঘুরে ভারতে বেড়াতে আসা এক মার্কিন টুরিস্ট এই 'খবর' দেন।  আর যাঁর নামে ওই দূর দেশে পোস্টার পড়েছিল তিনি সগত সিং। লেফট্যানেন্ট জেনারেল সগত সিং (১৯৯১-২০০১)।  সম্ভবত স্বাধীন ভারতের শ্রেষ্ট, একটিও-লড়াই-না-হারা সেনাপতি। অনেকে তাঁকে ভারতের একমাত্র সামরিক জিনিয়াস বলে থাকেন। ধুরন্ধর বুদ্ধিসম্পন্ন এবং সবসময় নিজের সৈন্যদের সঙ্গে ফ্রন্টে থাকা এমন এক অনন্য সেনানায়ক যাঁর career প্রায় রূপকথার মত।  অথচ আমাদের এই সমাজে ঢিসুম ঢিসুম সিনেমার মারপিট যত পপুলার, ঠিক ততটাই অজানা সগত'র মত আসল আসল যুদ্ধের 'সুপারম্যান'।আজ ১৬ই ডিসেম্বর, বাংলাদেশের স্বাধীনতা দিবসে, ছোট্ট করে তাঁর কথা লিখছি। 

বিকানিরের ছেলে সগত ১৯৪১ এ নিজের রাজ্যের সেনাবাহিনীতে যোগ দিয়ে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে লড়েছিলেন। স্বাধীনতার পরে যোগ দেন ভারতীয় সেনাবাহিনীতে। পদোন্নতি হতে থাকে - ১৯৫৫ তিন নম্বর গুর্খা রাইফেল রেজিমেন্টের কম্যান্ড এবং তারপর ১৯৬১ সালে তাঁকে ৫০ নম্বর প্যারাশুট ব্রিগেডের ভার দেওয়া হয়।এই দ্বিতীয় ব্যাপারটা নজর কাড়ে কারণ সেনাবাহিনীতে এক রেজিমেন্টে ঢুকলে পরে পরিবর্তন খুব একটা হয় না। তার ওপর প্যারাশুট করে যুদ্ধক্ষেত্রে অবতরণ করতে সক্ষম প্যারাশুট ব্রিগেড সেনাবাহিনীর অন্যতম শ্রেষ্ট বাহিনী; তার নেতা হওয়া চাট্টিখানি কথা নয় । কিন্তু সগত চিরকালই outstanding. ৪২ বছর বয়েসে নতুন ট্রান্সফার পেয়ে প্যারাশুট ট্রেনিং পাশ করে ফেললেন রেকর্ড সময়ে। যুদ্ধের প্রস্তুতি নিয়ে প্রতিটা খুঁটিনাটিতে নজর, নিজের বাহিনী ও শত্রু সম্মন্ধে সবকিছু নখদর্পণে রাখা তাঁর অভ্যেস, passion - তাই চলতে লাগল। 

প্যারাশুট রেজিমেন্টের প্রতীক। 

সুযোগ ও এসে গেল দ্রুত। ১৯৬১ সালের ডিসেম্বরে নেহরু সরকার সিদ্ধান্ত নিলেন অনেক ভদ্রতা হয়েছে, এবার সবলে গোয়া'র স্বাধীনতা সংগ্রামকে সাহায্য করতে হবে। পর্তুগিজ উপনিবেশকে আরব সাগরে ফেলে দিতে হবে। উল্লেখ্য ষোড়শ শতকের গোড়া থেকে গোয়া (এবং তার সঙ্গে দমন দিউ ইত্যাদি) পর্তুগিজ কলোনি ছিল। মধ্যযুগে দক্ষিণের একাধিক রাজা সুলতান এবং পরে মুঘলদের সঙ্গে এদের খিটমিট লেগেই থাকত।  ইংরেজ আমলেও তারা নিজেদের স্বাতন্ত্র বজায় রেখেছিল। '৪৭ সালে ভারত স্বাধীন হলে এটা expected  ছিল যে পর্তুগাল এতদূরের উপনিবেশ নিজে থেকেই ছেড়ে দেবে। কিন্তু,  বিংশ শতাব্দীর মধ্যভাগে পর্তুগাল শাসন করত গোঁড়া, উগ্র দক্ষিণপন্থী এস্তদো নোভো সরকার যাদের মত স্বাধীনতা-বিরোধী অত্যাচারী ইতিহাসে খুব কম দেখা গেছে।তাই ৩০/৪০র দশক থেকে ক্রমাগত জনপ্রিয় হওয়া গোয়ার স্বাধীনতা আন্দোলনকে তারা দমন করতে বদ্ধপরিকর ছিল।  যেমন,  RSP নেতা ত্রিদিব চৌধুরী অনেকদিন গোয়ায় কারারুদ্ধ হন । 

যাই হোক,  ঠিক হয় যে ১৭ই ডিসেম্বর পূর্ব দিক থেকে ভারতীয় সেনাবাহিনীর ১৭ নম্বর ডিভিশন পানাজির দিকে এগোবে আর সগত'র ৫০ নম্বর প্যারা ব্রিগেড গোয়ায় উত্তরে অবতরণ গুরুত্বপূর্ণ ব্রিজ, রাস্তা, খাল, কালভার্ট  দখল নিয়ে ১৭ নম্বর ডিভিশন'র কাজ সহজ করে দেবেন।কিন্তু, আসল লড়াই শুরু হবার পরে দেখা যায় না না কারণে মূল ডিভিশন slow হয়ে পড়ছে আর অন্য দিকে সগতের বাহিনী প্রায়-অবিশ্বাস্য গতিতে এগোতে আরম্ভ করেছে। এ যেন এক ভারতীয় রোমেল, যাঁর সঙ্গে তাল রাখতে শত্রু তো বটেই তাঁর নিজের সিনিয়ররা হিমশিম খেয়ে যান। পর্তুগিজ প্রতিরোধ দাঁড়াতেই পারল না, দুদিনের মধ্যে যুদ্ধ শেষ। পানাজিতে প্রবেশ করল ৫০ নম্বর প্যারা ব্রিগেড এবং তার সঙ্গেই উপমহাদেশের ইউরোপীয় শাসনের সমাপ্তি। আমেরিকা ও অনেক ইউরোপীয় দেশ এ নিয়ে প্রচুর কথা শোনালেও ভারতের 'বয়ে গেছে কি করবি কর' attitudeএর সামনে তারা অসহায়। পর্তুগালের রাজধানীতে অবশ্য 'হামলাবাজ দস্যু সগত' কে ধরিয়ে দেবার পোস্টার পড়ে।  

২০শে ডিসেম্বর ১৯৬১র খবর।  গোয়া স্বাধীন। 
--- ---

পরের বড় ঘটনা ১৯৬৫-৬৭ সালের। সগত তখন ১৭ নম্বর মাউন্টেন ডিভিশনের জেনারেল অফিসার কমান্ডিং পদে উন্নত হয়েছেন। পোস্টিং সিকিমের নাথু-লা বর্ডারে। ১৯৬৫ র মাঝামাঝি সেখানেই ঘটনার সূত্রপাত।'৬৫ সালে যখন ভারত পাক সীমান্তে সংঘর্ষ বাড়তে থাকে তখন পাক বাহিনীকে সাহায্য করার জন্যে চীনা ফৌজ সিকিম বর্ডারে সৈন্য সামন্ত নিয়ে চাপ দেওয়া শুরু করে। দাবি করে জেলেপ-লা আর নাথু-লা এই দুই pass (পাহাড়ি রাস্তা) ভারতকে ছেড়ে দিতে হবে। আইন অনুযায়ী দুটোই ভারতের অঞ্চল, কিন্তু একদিকে তখন পাকিস্তানের সঙ্গে যুদ্ধ পরিস্থিতি তাই ভারতীয় সেনাবাহিনী চীনাদের ঘাঁটাতে না চেয়ে অর্ডার দেন 'পিছিয়ে এস' ।  জেলেপ-লা থেকে ভারতীয় সেনারা সরে গেলেও সবাইকে চমকে দিয়ে নাথু-লা থেকে 'যাব না' বলে বেঁকে বসেন সগত।  কারণ, তাঁর হিসেবে একটা ভাল ন্যাচারাল ফ্রন্ট, এবং সেখান থেকে বহুদূর অবধি চীনা ফৌজের পোস্ট ও রাস্তা দেখা যায় ও তাদের ওপরে নজর রাখা যায়।   ওটা হাতছাড়া হওয়া মানে আবার লড়াই লাগলে বিশাল অসুবিধে। নাঃ, সিনিয়ররা যাই বলুন সগত নিজে থেকে এমন প্রয়োজনীয় পোস্ট শত্রুকে তুলে দেবেন না।  

সিকিম সীমান্তের ম্যাপ। নাথু লা অঞ্চল যেখানে ১৯৬৭ সালে লড়াই হয়েছিল।  

চীনারা তখনকার মত ব্যাপারটা হজম করে নেয়।  দু বছর পরে ভারত নাথু-লা'র কাছে কাঁটা তারের বেড়া লাগাতে গেলে গন্ডগোল লাগে। কথা, পাল্টা কথা, এর লাউডস্পিকারে হুমকি, ওদের পাল্টা হুমকি, ধাক্কাধাক্কি চলে, আর তারপর সেপ্টেম্বর মাসে একদিন চীনারা আক্রমন করে। হঠাৎ চীনা মেশিনগানের সামনে পড়ে কয়েকজন ভারতীয় সৈন্য পোস্ট ছেড়ে পিছিয়ে আসতে গিয়ে দেখেন যে রাস্তা আটকে তাদেরই  সেনাপতি সগত। হাতে স্টেন গান।'পালতে চাইলে আমিই তোমাদের গুলি করব, ফিরে চল  - লড়তে হবে'. এটাই সগতের signature. পরিকল্পনা করেন, আবার লড়াইয়ের সময় ছাউনিতে না থেকে ফ্রন্টে নিজের সেনাদের সঙ্গে থাকেন। সেনাপতির confidenceএ উৎসাহী হয়ে ভারতীয় সেনা সত্যি এমন পাল্টা আঘাত হানে যে এবার চীনাদের অবাক হবার পালা। আক্রমণ পাল্টা-আক্রমণ চলতে থাকে। বেশ কিছুটা ক্ষয়ক্ষতি হবার পরে চীনারা তাদের গোলন্দাজ বাহিনীকে ডেকে আনে। কামানের গোলায় বেশ কয়েকজন ভারতীয় সৈন্য নিহত হতে সগত ঠিক করেন 'তবে রে ! আচ্ছা, আমিও কামান বের করছি' ! 

সিকিম সীমান্তে  সগত সিং। ৬০র দশকে।

কিন্তু, এক্ষেত্রে একটা অফিসিয়াল অসুবিধে ছিল।  চীনা সীমান্তে এমনি-এমনি কামান ব্যবহার করা যাবে না। সেটা করতে অনুমতি দিতে পারেন একমাত্র ইস্টার্ন কম্যান্ড'র সেনাপ্রধান মানেকশ। কিন্তু, তিনি আবার তখন দিল্লীতে আর ফোনে যোগাযোগ করা যাচ্ছে না। সগত অবশ্য এইসব ছুটকো নিয়মের ফেড়ে পড়ে নিজের সৈন্যদের বিপদে ফেলার বান্দা নন। নিজের এক্তিয়ার অতিক্রম করে গোলন্দাজ বাহিনীকে অর্ডার দিলেন চীনা পোস্টে কামান চালাতে।শুরু হল একটা ছোটখাট সীমান্ত-যুদ্ধ যা ইতিহাসে 'নাথু লা clash' নামে পরিচিত। কয়েকদিন লড়াই হবার পরে যখন 'যুদ্ধবিরতি' হয় তখন ৩০০-৬০০ চীনা নিহত। ভারতীয় তরফেও কয়েকশো নিহত। কিন্তু সংখ্যা মূল বিষয় কখনোই নয়। সবচেয়ে বড় কথা এই যে '৬২ সালে যাদের এমন নিদারুন পরাজয় হয়েছিল তারাই এবার এমন রুখে দেবে সেটা চীনা ফৌজ হিসেবে ধরেনি। এবার বুঝল এবং তারপর প্রায় ৫২ বছর তারা সেভাবে বর্ডারে সরাসরি লড়াই'র পথ নেয়নি। মোড় ঘুরল ২০১৭র ডোকালাম আর এ বছর লাদাখে। 

--- ---

'সামনে একমাত্র বাধা বলতে এই মেঘনা নদী , এটা পেরোতে পারলেই ঢাকা 'র রাস্তা একদম ফাঁকা ! ....এগোবো? ' 

৯ই ডিসেম্বর ১৯৭১। সাগরের মত চওড়া মেঘনা নদীর পূর্বতটে দাঁড়িয়ে লেফট্যাটেনেট জেনারেল সগত সিং। যুদ্ধ শুরুর আগে থেকে তিনি বলে আসছেন যে পূর্ব পাকিস্তান লড়াইয়ের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ objective হওয়া উচিত  ঢাকা দখল করা । কিন্তু, ইচ্ছে থাকলে অন্য সেনাপতিরা দ্বিধাগ্রস্ত থেকেছেন কারণ দুদিকে দুই সুবিশাল নদী পদ্মা আর মেঘনা থাকায় ঢাকা শহর natural defence পেয়ে গেছে। হাজার হাজার সৈন্য, ট্যাঙ্ক , কামান, রসদ নিয়ে ঠিকঠাক অতিক্রম করা সম্ভব নাও হতে পারে।নদীর ওপারে বসে থাকা পাক সেনা বাধা তো দেবেই তাই অসম্ভব না হলেও দেরি তো হবেই। তাই, প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা, সেনাধ্যক্ষ মানেকশ এবং পূর্বাঞ্চলের সেনাপ্রধান জগজিৎ সিং অরোরারা যে যুদ্ধ-পরিকল্পনা ঠিক করেছেন তাতে পূর্ব পাকিস্তানের বেশ কিছুটা অংশ পাক-মুক্ত করে স্বাধীন বাংলাদেশের সরকারকে আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি দেওয়াই লক্ষ্য হবে। সগতের অধীনস্ত ৪ নম্বর কোর (corps) দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে আগরতলা থেকে বেরিয়ে কুমিল্লা ও মেঘনা নদীর পূর্ব দিকে অঞ্চল দখলে আনতে। ( corps = একাধিক ডিভিশন নিয়ে গঠিত সেনা সমাবেশ, একটি কোরে ৮০ হাজার থেকে ১ লক্ষ সৈন্য থাকতে পারে) . 'মেঘনা অবধি তোমার কাজ, সগত। তার বেশি কিছু করতে যেও না।'

মেঘনা, পদ্মা দিয়ে ঘেরা ঢাকায় পৌঁছোবার রাস্তা। 

সগত তাই করেছেন, এবং যেমন করে থাকেন scheduleর আগেই কাজ শেষ করেছেন। একের পর এক পাক ঘাঁটি জয় করে তার ৪ নম্বর কোর এবং সঙ্গের মুক্তিবাহিনী এখন মেঘনা'র তীরে। আর মেঘনা পেরোলেই ঢাকার রাস্তা খোলা, বাধা দেবার মত তেমন কোন পাক বাহিনী আর নেই। 

পেরোলে মানেকশ আর অরোরা অসন্তুষ্ট হতে পারেন, তবে সে না হয় সগত ম্যানেজ করে নেবেন। বুঝিয়ে বলবেন যে শত্রুর ডিফেন্সে ফাঁকা পেলে গোল দেওয়া তাঁর কাজ।  কিন্তু এই চার হাজার ফুট চওড়া নদী - যার এপার থেকে ওপার দেখা যায় না -  পেরোতে তো হবে, আর পাক সেনা বুদ্ধি করে আশুগঞ্জের ব্রিজ উড়িয়ে দিয়েছে।    

একটাই উপায়। হেলিকপ্টার। জুনিয়রদের বারবার বারণ সত্ত্বেও সগত নিজেই একটি Mi4 হেলিকপ্টারে চড়ে মেঘনা পেরিয়ে বেশ কিছুটা অঞ্চল পরিদর্শন করে আসেন। নিজেই জরিপ করে নেন ঠিক কোথায় কোথায় আকাশ থেকে সৈন্য নামানো যেতে পারে। জুনিয়রদের চিন্তা অমূলক ছিল না। ভৈরব বাজারের কাছে পাক মেশিনগান তাঁর হেলিকপ্টারের জানলা ফুটো করে দিল, কাঁচের টুকরো সগতের মাথা ও হাতে ঢুকে গেল, পাইলটের উরুতে গুলি লাগল। কিন্তু, যা খুঁজছিলেন সেটা দেখতে পেলেন। Drop zones. এখানেই সবার অলক্ষ্যে মেঘনা পেরিয়ে নামবে তাঁর সেনারা। প্ল্যানটা দুর্দান্ত, কিন্তু বিপদ যে নেই তা নয় - সবচেয়ে বড় কথা প্রথম যে কয়েকশো সেনারা নামবে তাদের সঙ্গে কোন ভারী কামান বা ট্যাঙ্ক থাকবে না।  তাই বড় পাক প্রতিরোধের সামনে কোনোভাবে পড়ে গেলে বিপদ। কিন্তু, সগতের হিসেবের মূল কথা হল যে এটা অপ্রত্যাশিত শত্রু ভেবে রেখেছে যে যেহেতু তারা মেঘনার ব্রিজ ধ্বংস করে দিয়েছে, ভারতীয় সেনা নতুন ব্রিজ তৈরী করে তবে এগোবে এবং তার জন্যে অন্তত কয়েকদিন সময় লাগবে। কিন্তু তারা হিসেবেই ধরেনি যে ব্রিজ না বানিয়েও নদী পেরোনো যায়।  

ব্যাস। আর দেরি নয়।  ৯-১০ ডিসেম্বরের ভোর রাত্রে'র অন্ধকারে তৈরী হল ইতিহাসে বিখ্যাত 'মেঘনা হেলি ব্রিজ'। সাধারণ সেতু নয়, নদী পেরোতে একাধিক হেলিকপ্টার। প্রায় সাধ্যের অতীত কাজ করে বিমানবাহিনীর ১৪টি Mi4 হেলিকপ্টার পাইলটরা ৩১১ নম্বর ব্রিগেডের সৈন্যদের মেঘনা পার করিয়ে রায়পুরের কাছে নামিয়ে দিলেন। হতভম্ব পাক সেনারা প্রতিরোধ করতেই পারল না। রায়পুর দখলে এলে আবার হেলিকপ্টার করে নরসিংহি। সগতের নির্দেশে ৭৩ নম্বর ব্রিগেড এবার নৌকো আর ভেলা করে নদী পেরিয়ে গেল। উভচর PT-৭৬ ট্যাঙ্কগুলি মেঘনার গভীর জলে নামতে পারবে কি না সন্দেহ ছিল।  সগত নির্দেশ দেন, 'জলে নেমে চলতে শুরু কর। আটকে গেলে ওদিক থেকে টেনে তুলব' . তাই হল।  কয়েকটা ট্যাঙ্ক জলে আটকে গেলে সেনা ও মুক্তিবাহিনীরা সেগুলো টেনে তুললেন। মেঘনার পশ্চিম তীরে পাক সেনাদের প্রতিরোধ সেখানেই শেষ। ৩০০০ সৈন্য ও বেশ কিছু ভারী সরঞ্জাম নিয়ে ঢাকার পথে সগতে'র সেনা। 

মেঘনা হেলি ব্রিজ: ৯-১০ ডিসেম্বর ভোরবেলা ভারতীয় হেলিকপ্টার নদী পেরোতে চলছে। 

কথিত আছে, তাঁর সেনাবাহিনী  সফল ভাবে মেঘনা পেরিয়েছে শুনে ইন্দিরা গান্ধী অফিস থেকে ছুটে বেরিয়ে এসে নিজে  commuications roomএ গিয়ে সগতকে অভিনন্দন জানান।(অসামান্য কর্মদক্ষতার জন্যে ভারত সরকার ১৯৭২ সালে সগত সিংকে পদ্মভূষণ প্রদান করেন।) জেনেরাল অরোরা একটু অখুশি হয়েছিলেন কেন সগত প্ল্যান থেকে বেরিয়ে এমন ঝুঁকি নিয়ে কাজ করেছেন। সগত নাকি বলেছিলেন, 'জাগ্গি, তুমি  চেয়েছিলে আমি ভাল রেসাল্ট দেব। আর আমি তোমায় A + দিয়েছি।' 

-- ---

ভাবছেন এমন real life heroর  কথা শুনিনি ? তা বটে; কি জানেন আমাদের এই আষাঢ়ে সিরিয়াল আর আজগুবি সিনেমার দেশে যুদ্ধ/সৈন্য/দেশপ্রেম/ নিয়ে একটা অতিনাটকীয় জগাখিচুড়ি হয়।জোর গলায় চেঁচালেই যেন দেশপ্রেম হয়ে গেল, যুদ্ধে জেতা হয়ে গেল। আসলে সামরিক সংগ্রাম যে একটি ঠান্ডা মাথার প্রফেশন,  detailed পরিকল্পনা যে তার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অংশ, দেশের রাজনৈতিক উদ্দেশ্য'র সঙ্গে তার অঙ্গাঙ্গী যোগাযোগ এটা আমরা অনেকেই খেয়ালে রাখি না।আর  তাই, সগত সিং'র মত ধূর্ধষ মগজাস্ত্র-সম্পন্ন সেনাপতি আমাদের জনচেতনা থেকে বাদ পড়ে গেছেন। কিন্তু তাঁর একটা ছবি আমরা সবাই দেখেছি। স্বাধীন ভারতের খুব বিখ্যাত ফটোগ্রাফ। ১৬ই ডিসেম্বর বিকেলে ঢাকায় জেনারেল নিয়াজির আত্মসমর্পণ। বাংলাদেশ স্বাধীন। ছবিতে নিয়াজির ঠিক পেছনে দাঁড়িয়ে লেফট্যাটেনেট জেনারেল সগত সিং। সেদিন আলাপ-পরিচয়ের পরে বিজিত নিয়াজী সগতকে বলেছিলেন, 'করেছেন কি ?'

  আজ শেষ করলাম। ভাল থাকবেন।

১৬ই ডিসেম্বর, ১৯৭১। রেসকোর্স ময়দান, ঢাকা। শেখ মুজিব যেখানে স্বাধীন বাংলাদেশ গঠনের ডাক দিয়েছিলেন সেখানে পাক বাহিনীর আত্মসমর্পণ। লেঃ জেনারেল অরোরা ও জেনারেল নিয়াজির পেছনের সারিতে দাঁড়িয়ে আছেন (বাঁ দিক থেকে)  ভাইস এডমিরাল কৃষ্ণান, এয়ার মার্শাল দিওয়ান , লেঃ জেনারেল  সগত সিং ও লেঃ জেনারেল  জেকব। 

ডিসেম্বর ১৯৭১র শেষে ঢাকায় পাক অফিসারদের আনুষ্ঠানিক অস্ত্রসমর্পণে বক্তব্য রাখছেন লেঃ জেনারেল সগত সিং।পাশে লেঃ জেনারেল গন্ধর্ব নাগরা। ভিডিও দেখতে পারেন - https://www.youtube.com/watch?v=WN9aRP-TW0E 


ব্লগে প্রকাশিত হবার পরে 'ইতিহাস তথ্য ও তর্ক' ফেসবুক পত্রিকায় প্রকাশিত - https://www.facebook.com/groups/1803711656387813/permalink/3573697649389196/

রেফারেন্স : 

https://thedailyguardian.com/the-forgotten-general-who-never-lost-a-war/

https://abpunch.com/2020/05/26/lt-gen-sagat-singh-a-veritable-superhero/

https://en.wikipedia.org/wiki/Parachute_Regiment_(India)

https://www.livehistoryindia.com/history-daily/2020/12/05/sagat-singh

https://www.sify.com/news/remembering-lt-gen-sagat-singh-on-his-birth-centenary-news-columns-thprpwhjbhbdg.html

https://theprint.in/past-forward/how-india-gave-china-a-bloody-nose-close-to-doklam-50-years-ago/38330/

https://www.rediff.com/news/special/general-sagat-singh-the-creator-of-bangladesh/20161208.htm

Saturday, September 26, 2020

 A SEA OF KNOWLEDGE, AN OCEAN OF WARMTH...



Born 200 years ago on 26th september, 1820, Ishwarchandra Bandopadhyay (honorifically titled and popularly recalled as 'Vidyasagar' ) was a Bengali polymath whose wide-ranging academic and social efforts resulted in -
1. modernization of the Bengali alphabet and printing type/font,
2. popularization of the Bengali text and simplification of sentence-construction in bengali, as a means of communication alternative to pedantic Sanskrit , and
3. establishment and nurturing of several schools for girls, often with his own money.
However, in collective memory, Vidyasagar is largely remembered for his strong lobbying of the colonial govt in favour of enacting the Hindu remarriage act of 1855, as a means to improve the legal/social status of widows. A keen observer with a mighty heart and unparalleled tenacity, Vidyasagar noticed how socio-religious conventions would 'condemn' widows to a lifelong bondage of austerities after the death of their (often much-older) husbands . Tagged as inauspicious, they would be demoted as in-house labourers who must work extra hard every day and eat only frugal meals as part of endless lists of penances, and also be easy prey for sexual harassment . A no-nonsense man whose only beacon was humanity, Vidyasagar made it his mission to end this oppression.
Much like the social activists of today's India, Vidyasagar - an outstanding Sanskrit scholar but non-ritualistic (probably agnostic) brahmin - ran into severe opposition from the brutally orthodox sections of Bengali society for his efforts. While Vidyasagar's petition gathered 987 signatories, the orthodoxy's counter-petition collected 36,763 signatures! By sheer votes, Vidyasagar would have lost 37-times! The Company govt however took an enlightened legal view and it was passed. Of course, Vidyasagar was slandered, ostracized and there was at least one attempt on his life....Interestingly, his unflinching secular stand in public matters and well-known criticism of religious orthodoxy makes it difficult for religion-based politics to make him a icon even today....
Vidyasagar's efforts did not directly change the lot of lakhs of widows (cos, after all, society is kind-of autonomous from what the law says...) , but certainly contributed to the ideals of liberalism of the Bengali Renaissance and are still fondly held as a moral-compass by millions. In his latter life, Vidyasagar - embittered by personal problems and glaring social hypocrisies - left 'elite calcutta' and found solace among the Santhals of rural bengal....
In today's Bengali society, Vidyasagar is a 'modern-day god', seated on the same pedestal as Tagore, Vivekananda, Nazrul, Chittaranjan, Rammohan and Netaji. Every bengali child starts his/her education with a copy of Vidyasagar's 'barnaparichay' - which has been inducted into the formal 'hate khori' (alphabet-writing) ceremony! To put it bluntly, most bengalis today havent read much of Tagore, but everyone has read Vidyasagar. For the last century and half, he has been the first of our teachers. And, just like the man himself, the textbooks have almost zero religion and rituals. They are a unique combo of simple essays and stories on kindness, honesty and ethics that every child should learn.



But its not only the textbook. Vidyasagar-anecdotes (not always historically authentic) are a staple part of Bengali growing-up. He is habitually garlanded at least once a year, irrespective of whether we have imbibed his core ideals or not ! Hence, it is no wonder that the wanton destruction of his statue during the buildup to last year's elections triggered an especially strong outrage in Calcutta. If nothing else, it showed his enduring popularity in the collective Bengali mindset.
A superb biopic from 1950, starring Pahari Sanyal in his most famous role, is a must-watch. In our times, such a movie would have been banned for the faithful depiction of how Vidyasagar had 'hurt our sentiments'. do watch it, if you havent.


(pics: the www)

 স্কুল খুলুক, সঙ্গে হাওয়া বাতাস খেলুক ক্লাসঘরে ('এই সময়' সংবাদপত্রে প্রবন্ধ -  ২২শে সেপ্টেম্বর, ২০২১)      সোজাসাপ্টা অপ্রিয়   সত...