Tuesday, May 31, 2022



 স্কুল খুলুক, সঙ্গে হাওয়া বাতাস খেলুক ক্লাসঘরে

('এই সময়' সংবাদপত্রে প্রবন্ধ - ২২শে সেপ্টেম্বর, ২০২১) 



   সোজাসাপ্টা অপ্রিয়  সত্য হল যে স্কুল আগামী সপ্তাহে খুলুক কিংবা দু-মাস পরে কিংবা সামনের বছর মে-জুনে - রাজ্যে যখনই স্কুল খুলবে স্কুলপড়ুয়াদের মধ্যে করোনা-সংক্রমণ বাড়বে। এটাই স্বাভাবিক। এমনকি যদি সব স্কুলপড়ুয়াদের ভ্যাকসিন দেওয়া শেষ করে স্কুল খোলা হয় তাহলেও ওদের মধ্যে ইনফেকশন বাড়বে। কারণ ভ্যাকসিনের মূল কাজ গুরুতর অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে ভর্তি এবং মৃত্যু ঠেকানো; সংক্রমণ থামানো নয়। তাছাড়া, যে করোনাভাইরাস অফিস-ক্লাসরুম-ব্যাঙ্ক-মল'র বাতাসে ঘুরে বেড়াচ্ছে তাকে কোন উপায়ে ছোটদের (বা প্রাপ্তবয়স্কদের) নাকে-মুখে  ঢোকা ১০০% বন্ধ করবেন? তাই সংক্রমণ হতেই থাকবে, এবং  ঠাণ্ডা লাগা (common cold), ইনফ্লুয়েঞ্জা, হাম, যক্ষ্মা যেমন চিরকাল হয় এই সংক্রমণও আমদের জীবনে 'স্বাভাবিক' হয়ে উঠবে। হ্যাঁ, আমরা জীবনবিজ্ঞানের এমন এক আশ্চর্য যুগের বাসিন্দা যে একটি আনকোরা নতুন জিবানু আবিষ্কার হবার এক বছরের মধ্যেই দেশে-বিদেশে সুস্পষ্ট প্রমাণ পাওয়া যাচ্ছে যে টিকাকরণ সম্পূর্ণ হলে আইসিইউ কেস এবং মৃত্যু অনেক কমে যাচ্ছে।

    তবে, সবচেয়ে অপ্রিয় সত্য এই যে চতুর্থ জাতীয় সেরোসার্ভে'র ফলাফল বলছে যে ৬-১৭ বছর বয়সীদের অন্তত ৬০%র শরীরে করোনা-অ্যান্টিবডি পাওয়া গেছে। অর্থাৎ, গত দেড় বছরে স্কুল বন্ধ রেখে, বাচ্ছাদের 'মিশিস না, খেলিস না' করেও আমরা বাবা-মা-অবিভাবকরা করোনাভাইরাসকে ঠেকাতে ব্যর্থ হয়েছি। না হলে ৬০-৭০% ঘরবন্দি স্কুলপড়ুয়া'র শরীরে ভাইরাস ঢুকল কি করে? অবশ্য, এতে আতঙ্কিত হবার কিছু নেই। কারণ ছোটদের ক্ষেত্রে ভ্যাকসিন ছাড়াই আছে আশার আলো। গত দেড় বছরে একাধিক গবেষণা পরিষ্কার দেখিয়েছে যে শিশু ও কিশোরদের সংক্রমণ হয় এবং ওদের থেকে অন্যদের মধ্যে ভাইরাসও ছড়ায়। কিন্তু, ০-১৭ বছর বয়সীদের মধ্যে অসুস্থতার মাত্রা খুবই কম। আমেরিকা, ইউরোপ, ভারত সর্বত্র এই trend দেখা যাচ্ছে, এবং সাম্প্রতিক গবেষণা থেকে বিজ্ঞানীরা বুঝতেও পারছেন  যে অসুখ বাড়ীর বড়দের ঘায়েল করে সে কেন ছেলেমেয়েদের ছুঁয়েও তেমন কিছু করে না। এই জন্যেই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে করোনায় মৃতদের মধ্যে মাত্র ০.০০-০.২৭%র বয়স ০-১৮ বছরের মধ্যে। আমাদের দেশেও সরকারি হিসেবে যে সাড়ে চার লক্ষ অতিমারীতে প্রাণ হারিয়েছেন তার মধ্যে ছোটদের সংখ্যা মাত্র ~১৫০০ (০.৩৩%)। একই 'স্বস্তিদায়ক' হিসেব আমাদের রাজ্যের বুলেটিন থেকেও পাওয়া যায়। বেশিরভাগ ছেলেমেয়ে বা তাদের অবিভাবকরা টেরও পায়নি তার সংক্রমণ হয়েছে (সেই জন্যেই আমাদের অজান্তে ৬০-৭০% ভারতীয় শিশু ও কিশোর আক্রান্ত হয়েছে)। আমাদের সৌভাগ্য যে যে প্রকৃতি রুষ্ট হয়ে আমাদের করোনাভাইরাস 'বান মেরেছে' সেই প্রকৃতিই মানব শিশু ও কিশোর (অর্থাৎ স্কুলপড়ুয়াদের) দিয়েছে এই জিবানুর বিরুদ্ধে লড়াই করার সহজাত 'extra' ইমিউনিটি । এই বৈজ্ঞানিক জ্ঞানে আত্মবিশ্বাসী হয়ে আজ ১৭৫টি দেশে স্কুল খুলে গেছে!

  এখন আমাদের প্রধান লক্ষ্য হল স্কুল খোলা হলেও যেন সংক্রমিতের সংখ্যা কম থাকে। কিন্তু, আমাদের মত জনবহুল রাজ্যে, যেখানে ক্লাসে অন্তত ৪০-৫০ জন ছাত্রছাত্রী, সেখানে শুধু সহজাত-সুরক্ষা, ভ্যাকসিন আর মাস্কের ভরসায় থাকলে তো চলবে না; বিশেষত যখন বড়দেরই টিকাকরণ শেষ করতে অন্তত মাস ছয়েক লাগবে এবং অনেক 'বীরশ্রেষ্ঠ' থুতনিতে মাস্ক রাখতে বদ্ধপরিকর।

    এখানেও প্রকৃতি আমাদের সহায়। কিছু ইনফেকশন হবেই, কিন্তু একটি সহজ উপায়ে আমরা স্কুল চত্বরে সংক্রমণের মাত্রা অনেক কমিয়ে দিতে পারি।  আলাদা খরচও নেই।  কি উপায় ? - সব ক্লাসের সব জানলা-দরজা সারাক্ষন খুলে রাখা। হ্যাঁ, indoor ventilation এবং হওয়া-বাতাস চলাচল হল এই ভাইরাসকে আটকাতে আমাদের অন্যতম বড় অস্ত্র। কারণ, কোরোনাভাইরাস বায়ুবাহিত। এই সংক্রমণ কি করে ছড়ায় সে বিষয়ে বিজ্ঞানীমহলে অতিমারী'র প্রথম কয়েক মাসে মতান্তর দেখা গিয়েছিল। কিন্তু, এখন সবাই নিঃসন্দেহ যে সংক্রমিত ব্যক্তির নিঃশ্বাস-প্রশ্বাসের সময় যে এয়ারোসল (জলের ক্ষুদ্র কণা, 'ড্রপলেট নিউক্লি' ও বলা হয়) বেরোতে থাকে সেইই হল করোনাভাইরাসের বাহন। সবচেয়ে মুশকিল হল যে এই ভাইরাস-ভরা এয়ারোসল (বিজ্ঞানীরা নতুন নামকরণ করেছেন 'virosol') বেশ কয়েক ঘণ্টা হাওয়ায় ভেসে বেড়ায়। তাই, যদি ক্লাসে একজন ছাত্রও আক্রান্ত থাকে ওই ক্লাসের অন্যান্যদের (কাছে বসুক বা দূরে) নিঃশ্বাসের সঙ্গে ভাইরাস-ভরা এয়ারোসল ভেতরে টেনে নেবার চান্স অনেক বেশী। সেই জন্যেই ক্লাসরুমের জানলা-দরজা খুলে রেখে সিলিং-ফ্যান 'অন' করে  ভাইরাস-ভরা এয়ারোসল বের করে দেওয়া উচিত। ঠিক যেমন একটি বন্ধ ঘরে কেউ সিগারেট খেলে নিঃসৃত ধোঁয়া'র গন্ধ কয়েক ঘণ্টা ধরে নাকে আসে, কিন্তু জানলা-দরজা খুলে দিলে সেই ধোঁয়ার বেরিয়ে যায়।

এও মনে রাখা আবশ্যক যে সংক্রমণ একটিমাত্র ভাইরাস কণার কম্ম নয়।  কোন মানুষের নাকের ভেতর ও শ্বাসনালীতে ঠিকঠাক সংক্রমণ করতে একটি মিনিমাম সংখ্যার ভাইরাস লাগে। মাইক্রোবায়োলজি'র পরিভাষায় একে বলে ভাইরাস-ঘনত্ব বা viral load। আর এই ভাইরাস-ঘনত্ব কমিয়ে দিয়ে সংক্রমণের মাত্রা কমাতে চাইলে?  জানলা-দরজা খুলে ব্যাপন (diffusion) বাড়িয়ে দিতে হবে যাতে ক্লাসরুমের ভেতরের ভাইরাস দ্রুত বেরিয়ে যায়।

  মোদ্দা কথা, স্কুলপড়ুয়াদের সংক্রমণ আটকাতে সব শ্রেণীকক্ষে(এবং স্কুলের  টয়লেটে) ভাল ventilation অপরিহার্য। বিদেশে এর জন্যে ক্লাসরুমে সেন্সর এবং হেপা-ফিলটার বসছে। আমাদের দেশের স্কুলে ওসব পাওয়া যাবে না বলাই বাহুল্য, এবং হয়ত প্রয়োজনও নেই। তার চেয়ে অনেক সহজ হল ventilation expertরা যেন প্রত্যেকটি স্কুল পরিদর্শন করে কি ভাবে হওয়া-বাতাস চলাচল আরো ভাল করা যায় সে বিষয়ে পরামর্শ দেন। যেমন, যেসব ক্লাসরুমে প্রয়োজনের তুলনায় কম জানলা সেখানে হয়ত ঘুলঘুলি এবং exhaust ফ্যান লাগাতে হবে। শুধু স্কুল নয়, টিউটোরিয়ালদেরও একই ভাবে indoor ventilationর ওপর জোর দিতে হবে।

 আর ব্যাপারটা শুধু স্কুলপড়ুয়াদের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়। গত ৭-৮ মাসে এই 'ভাইরাসের বাহন এয়ারোসল' ব্যাপারটা বোঝা গেছে বলেই বিজ্ঞানীরা বুঝতে পেরেছেন কেন সারা পৃথিবীতে ৯০% করোনা সংক্রমণ মূলত ইনডোর পরিবেশ (যেমন বাড়ীর ভেতর, অফিস, দোকান, রেস্তরাঁ, ভিড় যানবাহন, মেট্রোরেল) থেকেই হয়েছে । কারণ, রাস্তাঘাটে বা ফাঁকা, জানলা-খোলা বাস/ট্যাক্সি/ট্রেনে হাওয়ার পরিমান ও বাতাসের গতিবেগ এয়ারোসলদের মানুষের নাক-মুখের চারপাশে সহজে জমতে দেয় না। কিন্তু, যে কোন ইনডোর পরিবেশ (বিশেষত যেখানে অনেক লোকের যাতায়াত এবং এসি চলছে বলে জানলা-দরজা বন্ধ) সেখানে এই সুবিধে নেই। এখানে একজন asymptomatic করোনা-আক্রান্ত কয়েক মিনিট থাকলেও তাঁর নিঃশ্বাস-নিঃসৃত এয়ারোসল বহুক্ষণ ওই বদ্ধ হাওয়ায় ঘুরপাক খেতে থাকে (তিনি সেখান থেকে চলে যাবার পরেও) এবং অনেকে সংক্রমিত হতে পারেন। এই জন্যেই asymptomaticরা কোভিড-১৯র প্রধান বাহক এবং স্কুলে না গিয়েও ৬০-৭০% ভারতীয় স্কুলপড়ুয়া করোনা-আক্রান্ত হয়েছে।

এসব কোন কঠিন বিজ্ঞান নয়, একদম সাধারণ জ্ঞান। কিন্তু, দুঃখজনক ব্যাপার হল যে বিজ্ঞানী মহলের বাইরে এই গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নিয়ে সতর্কবার্তা প্রায় শোনাই যায় না। শুধু আমাদের দেশে না, এ ব্যাপারে বিদেশেও গতবছর কম চর্চা হয়েছিল। এই দেরির জন্যে অবশ্য কিছুটা WHOর প্রাথমিক গাইডলাইন দায়ী। অথচ indoor ventilationএ জোর না দিয়ে হাজার সানিটাইজ করলেও কাজের কাজ কিছু হবে না। কারণ এক বছরের ওপর গবেষণা করে বিজ্ঞানীরা এখন অনেকটাই নিশ্চিত যে বায়ুবাহিত করোনাভাইরোস রাস্তাঘাট/ বাড়ী বা অফিসের মেঝে/ দেওয়াল / টেবিল / চেয়ার / বেঞ্চি / টাকাপয়সা / জামাকাপড় ইত্যাদি  থেকে সংক্রমণ করে না। অবশ্য, সব কিছু সানিটাইজ করা এখন একটি 'সামাজিক অভ্যাসে' দাঁড়িয়ে গেছে বলে হয়ত এক্ষুনি এটা ছাড়া যাবে না, কিন্তু বিজ্ঞান-সম্মতভাবে ইনফেকশন কমাতে চাইলে ভ্যাকসিন ও মাস্কের পাশাপাশি ঘরে/ ক্লাসে / অফিসে / ব্যাঙ্কে/ মলে / দোকানে-বাজারে হাওয়া-বাতাস চলাচলের ওপরেই মূল জোর দিতে হবে। এত চেষ্টা করেও সংক্রমণ যে সেভাবে বাগে আসছে না তার বড় কারণ হল আমাদের এই 'বজ্র আঁটুনির ফস্কা গেরো' ।

 
তবে আশার কথা এই যে বিজ্ঞানের অগ্রগতি'র সঙ্গে সামঞ্জ্যস্য রেখে ইদানীং অনেক দেশের নিয়মাবলী স্কুল ও বাড়িতে হওয়া-বাতাস চলাচলের ওপরে জোর দিয়েছে। এমনকি আমাদের স্বাস্থ্যমন্ত্রকের নতুন নিয়মাবলীও ছবি দিয়ে dos and donts বোঝানো হয়েছে। কিন্তু, জনমানসে প্রচার যে খুব বেশী হয়নি সেটা অনস্বীকার্য। সেই জন্যেই স্কুল-কলেজ খোলার আগে এই ব্যাপারে বিজ্ঞানভিত্তিক-পরিকল্পনা খুবই জরুরী। বিশেষত যখন একদম সাম্প্রতিক গবেষণা আভাস দিচ্ছে যে সময়ের সাথে বিবর্তিত হয়ে করোনাভাইরাসের নতুন বংশধরদের বায়ুবাহিত হবার ক্ষমতা বৃদ্ধি পাচ্ছে।


 



Wednesday, August 18, 2021

 ১৮ই অগস্ট ..... 

রহস্য নেই, আছে শ্রদ্ধা। 

আজাদ হিন্দ সর্বাধিনায়ক ও অফিসাররা - 
এ.সি. চ্যাটার্জি, মোঃ জমন কিয়ানি আর হাবিবুর রহমান'র সঙ্গে নেতাজি, ১৯৪৪।

'হাসান ! হাসান কোথায়?'

রাত ৮-৮.৩০. ১৮ই অগস্ট , ১৯৪৫। তাইহোকুর (আজকের তাইপেই, তাইওয়ানের রাজধানী) নানমন সামরিক হাসপাতালের ইমার্জেন্সি ওয়ার্ড।

সকালের প্লেন ক্রাশে তিন জন মারা গেছেন - পাইলট, সহকারী পাইলট আর জেনারেল শিডিআ।  আহতদের মধ্যে যিনি সবচেয়ে বেশি দগ্ধ -  যাঁকে জাপানি সৈনিকরা পরিচয় দিয়েছে, 'ইনি ফিল্ড মার্শালের থেকেও উঁচু পদাধিকারী' - সেই মহাযোদ্ধা মানুষটি তাঁর বহুদিনের সেক্রেটারিকে ডাকছেন। 

হাবিবুর রেহমান ও আহত, হাতের আঙ্গুল কিছুটা পুড়ে গেছে। তিনি, উঠে এসে বললেন,

'হাসান এখানে নেই, নেতাজি। আমি হাবিব। '

গোটা শরীর ব্যান্ডেজে ঢাকা, মাথা থেকে পা পর্যন্ত burnol র মতো মলম লাগানো, ঠোঁট ভয়ঙ্কর ভাবে  ফুলে উঠেছে, তবু অতি কষ্টে নেতাজি সুভাষ চন্দ্র বসু বললেন, 'হাবিব, আমি বুঝতে পারছি আমার সময় ফুরিয়ে আসছে  .... শেষ দিন অবধি আমি দেশের স্বাধীনতার জন্যে লড়েছি। দেশের মানুষকে বোলো যে ভারত শীঘ্রই স্বাধীন হবে '

দেশবাসীর উদ্দেশে এই তাঁর শেষ কথা।  কিছুক্ষন পর দোভাষী নাকামুরাকে বলেন, 'ঘুমোতে পারলে ভালো হয় '  , তারও কিছু পরে  ব্যাথা কমাবার জন্যে মরফিন চাইলেন। নাকামুরা বর্ণনায় আছে, 'উনি কয়েকবার 'মিজু ' শব্দটি বললেন' ( 'মিজু ', অর্থাৎ জাপানি ভাষায় জল।  অবশ্য 'মিজু ' না হয়ে 'মেজো ' বা 'মেজদা 'ও হতে পারে  ....কে জানে, বিদায়বেলায় হয়ত পিতৃপ্রতীম মেজদা শরৎ চন্দ্র বসুকে ডেকেছিলেন  ) ..... আর তারপর, ডাক্তারদের সব চেষ্টা ব্যর্থ করে, রাত ৯টা নাগাদ শরীরটা প্রচন্ড কাঁপুনি দিলো, আর তারপর একেবারে  স্থির হয়ে গেল।  সুভাষ চন্দ্র বসুর জীবনব্যাপী সংগ্রাম শেষ হলো।  হাবিবুর পাশে বসে দোয়া করলেন। হাসপাতালের জাপানি কর্মীরা নিহত যোদ্ধার স্মৃতির উদ্দেশ্যে এক বৌদ্ধ মন্ত্র পাঠ করলেন।  

নানমন সামরিক হাসপাতাল, তাইহোকু। ১৯৪৬র ছবি. এখন নতুন বাড়ি তৈরী হয়েছে। 

.....

১৫ দিন পর, নেতাজির চিতাভস্ম একটি সাদা কাপড়ে মোড়া চৌকো কাঠের বাক্সে টোকিওতে পৌঁছলো। দিন কয়েক সেটি রাখা হলো ইন্ডিয়ান ইনডিপেনডেন্স লীগের কর্ণধার রামমূর্তির বাড়িতে। আজাদ হিন্দের বাছাই করা চল্লিশজন 'টোকিও boys ' - যাদের নেতাজি সন্তানসম স্নেহ করতেন - তাঁরা পালা করে গার্ড দিলেন। আর শুরু হলো একটি জাপানি মন্দিরের খোঁজ,   যেখানে চিতাভস্ম সসম্মানে রক্ষিত থাকবে।

টোকিও শহরতলিতে ম্যহজি নামের একটি মন্দির আছে।  যুদ্ধের সময় নেতাজি সেখানে একবার প্রার্থনা-সভায় যোগ দিয়েছিলেন। তাই, সেখানেই প্রথম যাওয়া হলো।  কিন্তু , প্রধান পুরোহিত রাজি হলেন না - কারণ নেতাজি জন্মসূত্রে বিদেশী ।  একটু হতাশ হয়েই আজাদ হিন্দ ও জাপানি অফিসাররা রাস্তায় বেরিয়ে এলেন। আর তারপর ওই একই রাস্তার ওপর অবস্থিত আরেকটি মন্দির - নাম রেনকোজি মন্দির - ঢুকে পড়ে একই অনুরোধ করলেন।

রেনকোজির প্রধান পুরোহিত 'রেভারেন্ড ' মোচিজুকি এক কোথায় রাজি হয়ে গেলেন, এবং 'সুভাষ চন্দ বোস ' নাম লেখা বাক্সটি স্বসম্মানে মন্দিরের পবিত্রতম অভ্যন্তরে প্রতিষ্ঠা করলেন। ১৮ই সেপ্টেম্বর ১৯৪৫ রেনকোজিতে  বৌদ্ধ মতে 'funeral service ' হল। 

নেতাজির অস্থী গ্রহণ করে রেনকোজির পবিত্রতম 'গর্ভগৃহে' স্থাপন করেন 
প্রধান পুরোহিত রেভারেন্ড মোচিজুকি

  ....

গত ৭৬ বছর ধরে  'রেভারেন্ড ' মোচিজুকি (১৯৭৯ সালে প্রয়াত), তাঁর পুত্র (যিনি এখন মন্দিরের প্রধান পুরোহিত) এবং অন্যান্য পুরোহিতরা পরম যত্ন ও শ্রদ্ধার সঙ্গে ভারতের সেই অনন্য সন্তানকে সম্মান জানিয়ে এসেছেন। তাঁদের বিশ্বাস যে বীর যোদ্ধার বিদেহী আত্মা তাঁদের মন্দিরের সম্মানিত অতিথি। তাই, প্রতি বছর , নিয়ম করে নেতাজির জন্যে memorial service হয়।  নিহোনশু নামের একটি জাপানি পানীয় নেতাজি পছন্দ করতেন বলে সেটিও 'তাঁকে' অর্পণ করা হয়।  ভারতবাসী তাঁদের কাছে চিরঋণী। 

দেহাবসান হয়েছে, কিন্তু বীরশ্রেষ্ঠ যোদ্ধার এখনো আমাদের মন্দিরের সম্মানিত অতিথি - এই বিশ্বাস নিয়ে আজও জাপানি পুরোহিতরা নেতাজির বাৎসরিক স্মরণ করেন। 


বর্তমানে রেনকোজি মন্দিরের প্রবেশ ও অভ্যন্তর। 
গর্বগৃহে সোনার ক্যাস্কেট-র নেতাজির অস্থী (ওপরে);
বাইরে নেতাজির আবক্ষ মূর্তি (নীচে)

 বহু দশক ধরে ভারত সরকারের পররাষ্ট্র মন্ত্রক  রেনকোজি মন্দিরকে আর্থিক ভাবে সহায়তা করে এসেছেন - যাতে  নেতাজির স্মৃতি রক্ষনার্থে কোনো ত্রটি না থাকে। জাপান যাত্রা'র সময়ে নেহরু, রাজেন্দ্র প্রসাদ, ইন্দিরা, বাজপেয়ী অনেকেই মন্দিরে গিয়ে শ্রদ্ধা নিবেদন করেছেন। 


রেনকোজি মন্দিরে শ্রদ্ধা নিবেদন করছেন অটলবিহারী বাজপেয়ী (২০০১) এবং ইন্দিরা গান্ধী (১৯৭০)

একইসঙ্গে জাপানিরা বহুবার অনুরোধ করেছেন যে ভারত যেন নেতাজিকে 'ফিরিয়ে নিয়ে যায়।' নেতাজি কন্যা অনিতাও একই ইচ্ছে প্রকাশ করেছেন।

এ সব কথা উঠলে দুম করে excited হলেও বাঙালিদের এ বিষয়ে জ্ঞান সাধারণত 60 বছর পরে গঠিত মুখার্জি কমিশনের মধ্যেই সীমাবদ্ধ। কিন্তু, জানা উচিত যে একটি-দুটি নয়,  ১৯৪৫ থেকে ২০০৫ অবধি এই বিষয়ে  ১৩টি তদন্ত হয়েছে। শুধু স্বাধীন ভারত নয়, মিত্রশক্তি, ব্রিটিশ সরকার, মার্কিন সেনাবাহিনী, ইন্ডিয়ান ইন্ডেপেন্ডেন্স লীগ, জাপান সরকার, নেতাজির জীবনীকার ঐতিহাসিক লেওনার্ড গর্ডন ও সুগত বসু  এবং সাংবাদিক হারিন শাহ সবাই এ বিষয়ে তদন্ত করেছেন। 

বিশদ তথ্য দিতে হলে আলাদা প্রবন্ধ হয়ে যাবে। আর তাছাড়া এ বিষয়ে ভাল গবেষণাভিত্তিক  রচনা বেরিয়েওছে। তাই এখানে এই ১৩টি তদন্তের কথা summarize করে দিলাম। 

দেশী বিদেশী তদন্তের ফলাফল।  সব মিলিয়ে ১৩টি তদন্ত 


 

বুঝতেই পারছেন একাধিক দেশের তদন্ত'র ফলাফল দ্যার্থহীন ভাবে একই ফলাফল জানাচ্ছে। দুঃখ পেলেও মেনে নিতে হবে। জানি, এ তথ্য অত্যন্ত বেদনাদায়ক,  এবং এমন মহাজীবনের ক্ষেত্রে কেমন যেন anti climax.  আর বহু দশক ধরে নানারকম গুজব চলে আসছে( ভ্যাকসিন কাজ করছে কিনা তা নিয়ে যেমন আজকাল কতকিছু whatsappএ ভেসে আসে!)  তাই,  মেনে নেওয়া সহজ নয়। 

তবে  একটা প্রশ্ন করাই যায় -  তর্কের খাতিরে যদি ধরেও নিই যে ভারত সরকার তথ্য চাপছিল, তাহলেও কেউ বলবেন কেন ব্রিটিশ মার্কিন ও সোভিয়েতরা (এবং যুদ্ধত্তোর আমেরিকা-বন্ধু জাপান) তাদের ধুরন্ধর শত্রু নেতাজিকে বারবার খুঁজে হয়রান হয়ে 'মিথ্যে রিপোর্ট বানাবেন'? আর ৭৫ বছর পরেও বিশ্বব্যাপী সব সরকার সেই কথাই বলে চলবেন??? .... 

আর 60 বছর পরে গঠিত মুখার্জি কমিশন (ততদিনে একজন মাত্র সাক্ষী জীবিত) একমত না হলেও নতুন তথ্য পেশ করতে পারেনি, রিপোর্টে বেশ কিছু অসঙ্গতি ধরা পড়ায় গ্রাহ্য হয়নি। (বিশদে পড়তে পারেন) 

আরো কিছু তথ্য দিয়ে শেষ করি।  

১. মার্চ-২০১৬তে কেন্দ্রীয় সরকার লোকসভায় জানিয়েছেন ১৯৯৭-২০১৬র মধ্যে নেতাজি সংক্রন্ত ২৩২৪টি ফাইল  প্রকাশ করা হয়ে গেছে, আর কোন দফতরে কিছু unclassified  নেই। এর মধ্যে বহু ফাইল digitized করা হয়েছে, websiteএ গিয়ে পড়তে পারেন। 

২. ব্রিটেন, আমেরিকা, রাশিয়া সরকারি ভাবে জানিয়েছে তাদের হাতে আর কোনো ফাইল নেই।

 ৩. জাপান জানিয়েছে প্রায় সব ফল প্রকাশিত, এবং অবশিষ্ট তিনটি ফাইল তারা তাঁদের বিশ্বযুদ্ধ-সংক্রান্ত নীতি মেনে যথাসময়ে প্রকাশ করবে । উল্লেখ্য, জেনারেল শিডিআ'র মত উচ্চপদস্থ সেনাপতি যে সেদিন বিমান দুর্ঘটনায় মারা গিয়েছিলেন তা নিয়ে জাপানের কোন সন্দেহ নেই। ও দেশের সরকারি রেজিস্ট্রি তাই বলছে।

৪. ভারত আরেকবার দেখতে অনুরোধ করতে, জুলাই 2019এ রাশিয়া আবার জানিয়েছে যে তাদের archives এ আর কোন তথ্য নেই।

৫. এক ব্যক্তির RTI র জবাবে কেন্দ্রীয় সরকার পরিষ্কার জানিয়েছেন  তাঁরা তথ্য ও তদন্তের ভিত্তিতে কি বিশ্বাস করেন। এই যে  - 

২০১৭র RTIকে কেন্দ্রীয় উত্তর 

অর্থাৎ, শুধু কংগ্রেস সরকার নয়, ঘটা করে শেষ ৩০০ ফাইল প্রকাশ করে বর্তমান কেন্দ্রীয় সরকারও এ বিষয়ে একমত। বলাই বাহুল্য, এ বিষয়ে নেহরু/গান্ধী/স্তালিন'র বিরুদ্ধে অকাট্য কোন তথ্য পাওয়া গেলে অন্তত নরেন্দ্র মোদী তাঁদের ছেড়ে কথা বলতেন না ।

সব মিলিয়ে, একথা পরিষ্কার যে  'রহস্য-রোমাঞ্চর' আর কোনো স্থান নেই। কিন্তু, এমনই হতভাগ্য দেশ যে তুচ্ছ রাজনৈতিক ও পারিবারিক ডামাডোলে আর শেষ হয় না। আর তাই, যে  মহামানবকে জাপানি সেনাপতিরা 'সত্যিকারের স্যামুরাই ' ও গান্ধীজি 'prince among  patriots ' বলে অভিহিত করেছিলেন,  তাঁর অন্তিম পার্থিব চিহ্ন এখনো একটি  gold-plated casketএ রয়ে গেছেন, দূর জাপানের ছোট্ট মন্দিরে।

The last salute .   
সায়গনে অবতরণের সময়, ১৭ই অগস্ট ।পরের দিন তাইহোকু থেকে take off র কয়েক সেকেন্ড পরে  
এই মিৎসুবিশি Ki -২১ বিমানটি ভেঙে পরে।  


রেফারেন্স :

নেতাজি সংক্রান্ত একাধিক সমাদৃত বই - 

বসু বাড়ী - শিশির কুমার বসু;  His Majesty's Opponent - সুগত বসু; Nehru and Bose: Parallel Lives- রুদ্রানশু মুখোপাধ্যায়Brothers against the Raj - লিওনার্ড গর্ডন; The Forgotten Army - পিটার ফে; The Springing tiger - হিউ টয়ে; 

 National Archives of India প্রকাশিত 'Netaji files' - http://www.netajipapers.gov.in/,

https://thewire.in/history/netaji-subhas-chandra-bose-disappearnce-part-one

https://en.japantravel.com/tokyo/renkoji-temple/1231 (রেনকোজির বর্তমান ফটো)

https://thewire.in/history/netaji-subhas-chandra-bose-japan-plane-crash

Tuesday, August 3, 2021

 পশ্চিমবঙ্গের sentinel surveyর  ফলাফল  

গত মাসের মাঝামাঝি , যখন দেখা যায় যে করণের দ্বিতীয় ঢেউ বেশ কিছুটা স্থিমিত, তখন রাজ্যের স্বাস্থ মন্ত্রক ঘোষণা করেন যে তাঁরা একটি sentinel survey শুরু করবেন যাতে করোনাভাইরাস  রাজ্যের কোথায় কিভাবে কতটা ছড়াচ্ছে সে বিষয়ে বেশ কিছুটা তথ্য জানা যায়। এর ফলে আগে থেকেই তৈরী হওয়া যাবে। কোথাও অতিমারী বেড়ে ওঠার ছোট্ট প্রবণতা দেখা গেলেও সেখানে দ্রুত ব্যবস্থা নেওয়া যাবে।

সম্প্রতি সেই সার্ভে'র প্রথম দফার কিছু ফলাফল সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে। সেগুলি নিয়ে অল্প কিছু বিশ্লেষণ আপনাদের সামনে তুলে ধরতে চাই।  

ফলাফল ১: ভ্যাকসিনের সাফল্য। 

ছবি ১: সেন্টিনেল সার্ভে'র রিপোর্ট। খবরের কাগজে

সার্ভে পরিষ্কার দেখাচ্ছে যে ভ্যাকসিন কোরোনাকে আটকাতে ভালোই কাজ করছে। বর্তমান সংবাদপত্রের রিপোর্ট অনুযায়ী 'সেন্টিনাল সার্ভেতে ৪২৭৬ জন নিজেদের টিকাকরণ সংক্রান্ত তথ্য সমীক্ষাকারীদের জানিয়েছিলেন। দেখা গিয়েছিল, এই ৪২৭৬ জনের মধ্যে টিকা নেননি বলে জানান ৩৬৫৩ জন। আর টিকা নিয়েছিলেন ৬২৩ জন। টিকা না নেওয়া এই ৩৬৫৩ জনের মধ্যে কোভিড হয়েছিল ৪৩ জনের। অন্যদিকে টিকা নেওয়া ৬২২ জনের মধ্যে কোভিড হয়েছিল মাত্র একজনের। তুল্যমূল্য বিচার করে দেখা যায়, টিকা নিলে ৮৬.৪ শতাংশ প্রতিরোধী ক্ষমতার অধিকারী হচ্ছেন মানুষজন'। 

অবশ্য, এটা একেবারে  নতুন খবর নয়। ভ্যাকসিনের কার্যকারিতা নিয়ে ইতিমধ্যেই দেশে-বিদেশে একাধিক প্রমান পাওয়া গেছে। বিজ্ঞানের শ্রেষ্ঠ জার্নাল থেকে শুরু করে অনেক তথ্যসমৃদ্ধ রিপোর্টে বিভিন্ন দেশের এইসব ফলাফল প্রকাশিত হয়েছে ও নানাভাবে বিশ্লেষণ করা হয়েছে, হচ্ছে। ছোট-বড় বহু দেশের ফলাফল দেখে সন্দেহাতীত ভাবে বলা যায় যে প্রায় সব ভ্যাকসিনই গুরুতর কোভিড, icu কেস এবং মৃত্যু'র থেকে সুরক্ষা দিচ্ছে ।আমাদের দেশে ভ্যাকসিন সাপ্লাই'র হাল বেহাল হবার ফলে যদিও রাজ্যে'র বেশিরভাগ মানুষ এখনো ভ্যাকসিন পাননি, তা সত্ত্বেও ভ্যাকসিনের protective effectর একাধিক প্রমাণ পাওয়া গেছে। রাজ্যের এই latest সার্ভে সেই কথাই আবার জানাল। সোজা কথায় ভ্যাকসিন নেওয়ার তিন সপ্তাহ পর থেকে শরীরের রোগ-প্রতিরোধ ব্যবস্থা শক্তিশালী হয়ে ওঠে এবং যদিও বা বায়ুবাহিত করোনাভাইরাস শ্বাসনালি ও ফুসফুসে ঢুকে পড়ে তাহলেও সিরিয়াস অসুখ হবার সম্ভাবনা খুবই কম।  কয়েকদিন জ্বর হতে পারে, দুর্বলতা থাকতে পারে, কিন্তু শ্বাসকষ্ট ও অন্যান্য প্রাণঘাতী অসুখ নিয়ে হাসপাতালে ভর্তির সম্ভাবনা খুবই কম। 

এর থেকে এটাও স্পষ্ট যে যত দ্রুত নাগরিকদের ভ্যাকসিন দেওয়া সম্ভব হবে তত করোনা ভাইরাসের দাপট কমবে। হ্যাঁ, ভাইরাসের নতুন বংশধর ডেল্টা অনেক বেশি ছোঁয়াচে।  কিন্তু ডেল্টা আক্রমণ করলেও ভ্যাকসিন তাকে ঠেকাবে ( সামাজিক মাধ্যম ও 'শোনা কথা' ফলে  অনেকেই  বিভ্রান্ত হয়ে ভাবছেন যে ডেল্টা'র বিরুদ্ধে এই সব টিকা কাজ করবে না।  এসব দুশ্চিন্তা ডাস্টবিনে ছুঁড়ে ফেলে দিন;  গবেষণা পরিষ্কার দেখাচ্ছে ডেল্টা'র বিরুদ্ধে ভ্যাকসিন কার্যকরী।  

ভ্যাকসিন সংক্রান্ত আরেকটি কথা জানিয়ে রাখি। মনে হয়, সবার ভাল লাগবে। একদম সাম্প্রতিক গবেষণা এও দেখাচ্ছে যে এক ডোজ টিকা ও কিন্তু ৬০% র বেশি সুরক্ষা দিচ্ছে। সুতরাং, দ্বিতীয় ডোজ টিকা পেতে দেরি হলেও প্রচন্ড আতঙ্কিত হবেন না।  প্রথম ডোজ ও আপনাকে বেশ কিছুটা প্রটেকশন দিচ্ছে, এবং দেরি হলেও ওটা কাজ করতে থাকবে। 

এই প্রসঙ্গে আমাদের রাজ্যের টিকাকরণ পরিস্থিতি নিয়ে ছোট্ট করে তথ্য দিয়ে দি। 

পশ্চিমবঙ্গে ১৮-বছর-বা-তার-বেশি-বয়স এমন নাগরিকের সংখ্যা আনুমানিক ৭.২ কোটি। সেই হিসেব অনুযায়ী, ২রা অগস্ট অবধি অন্তত এক ডোজ ভ্যাকসিন পেয়েছেন ৩০%  নাগরিক। এর মধ্যে দুটি ডোজ ই পেয়ে গেছেন ১২.২% লোক।  অর্থাৎ ~১৮% এক ডোজ পেয়েছেন, এক ডোজ বাকি। বড়-জনসংখ্যা রাজ্যদের মধ্যে এই টিকাকরণ মোটামুটি ভালোই। যে কলকাতা ও উঃ ২৪ পরগণা এ রাজ্যে অতিমারীর epicentre হয়ে থেকেছে সেখানে টিকাকরণ মন্দ হয়নি। দুই জেলায়  ৫৫% নাগরিক অন্তত এক ডোজ ভ্যাকসিন পেয়েছেন।  টিকার সাপ্লাই মসৃন হলে আরো বেশি লোকজন এর মধ্যে ভ্যাকসিন পেতেন। 

অবশ্য কোন সন্দেহ নেই কলকাতা ও আশে পাশে বেশি, এবং জেলা সদরগুলিতে বেশি টিকাকরণ হয়েছে, গ্রামেগঞ্জে কম। তৃতীয় ঢেউকে ঠেকাতে হলে এই বৈষম্য দ্রুত দূর করা প্রয়োজন। 

ফলাফল ২: উপসর্গহীন করোনা-আক্রান্ত সংখ্যা 

রাজ্যে এমন কতজন আছেন যাঁরা করোনা আক্রান্ত অথচ কোন symptom নেই? এবং সেই জন্যেই তাঁরা নিজেদের অজান্তে অন্যদের মধ্যে সংক্রমণ ছড়িয়ে দিতে পারেন? সেন্টিনেল সার্ভে'র অন্যতম বড় কাজ এই দুই প্রশ্নের উত্তর খুঁজে বের করা।  


ছবি ২: sentinel survey ঘোষণা ও কর্মপরিকল্পনা 

এর জন্যে sentinel সার্ভে রাজ্যের ২৮টি হাসপাতাল short list করে প্রত্যেক হাসপাতাল থেকে ৪০০ জন COVIDর-উপসর্গ-নেই এমন রুগীর দেহ থেকে sample সংগ্রহ করে দেখেছেন যে ক'জনের কোরোনাভাইরাস আছে। ২৩টি জেলা থেকেই হাসপাতাল নেওয়া হয়েছে, যেমন  কলকাতা অঞ্চলের জন্যে  RG Kar হাসপাতালে এই কাজ হয়েছে। সবমিলিয়ে ১০ হাজারের ওপর রুগী নিয়ে এই sampling। নমুনা সংগৃহীত হয় মূলত বিভিন্ন সরকারি হাসপাতালের নন কোভিড ওয়ার্ড  যেমন—চক্ষু, অর্থোপেডিক, স্ত্রীরোগ ও প্রসূতি ইত্যাদি বিভাগ থেকে। কয়েক জন আউটডোর  patient র থেকেও নমুনা নেওয়া হয়েছে । 

ফলাফল দেখুন খবরের কাগজের রিপোর্ট থেকে (ছবি ৩)

ছবি ৩ : সংবাদ পত্রের পাতা থেকে 


এই ফলাফল ও আশাব্যঞ্জক। 'দেখা গেছে রাজ্যের উপসর্গহীন মানুষের মধ্যে গড়ে করোনা ধরা পড়েছে প্রতি ১০০ জনে ১.১ জনের।  অবশ্য, দার্জিলিং, নদীয়া, দুই মেদিনীপুর, বিষ্ণুপুর, আলিপুরদুয়ার ইত্যাদি জেলা ও স্বাস্থ্য জেলা চিন্তায় রেখেছ।'

 প্রশ্ন - এখানে কি একটা sampling bias গন্ডগোল হচ্ছে?   
অনেকেই এই দ্বিতীয় ফলাফল দেখে স্বস্তি পাবেন - যাক বাবা রাজ্যে করোনা নেই।  কিন্তু, বলতে বাধ্য হচ্ছি এই সার্ভে ' র এই second result নিয়ে একটা খটকা লাগছে।

কেন একটু ভেঙে বলি।  লক্ষ্য করুন - এক্ষেত্রে শুধু opthamology, orthopedic, gynecology & obstetrics deptএ যে patientsরা গিয়েছেন তাঁদের থেকে sample নেওয়া হয়েছে। 

আমার প্রশ্ন - সমাজের সর্বস্তরে যেসব মানুষ asymptomatic করোনা আক্রান্ত  হতে পারেন এই ৪-৫টি বিভাগে যাওয়া  রুগীরা কি তাঁদের ভাল representative? শুধু এঁদের  নমুনা সংগ্রহ কি যথেষ্ট ? 

উত্তর - সম্ভবত  না। কারণ, হাসপাতাল ডিপার্টমেন্টে তাঁরাই যান যাঁদের চোখ বা হাড়ে কোন সমস্যা হয়েছে। হয়ত  কোন  fracture হয়েছে।  এমন লোকজনের পক্ষে  কম চলাফেরা করা এবং বেশি সাবধানে থাকা স্বাভাবিক। 

একই ভাবে দেখুন,  Gynecology & obstetrics বিভাগে যে মহিলারা গেছেন তাঁরা  অনেকেই pregnant । আমাদের মত জন সচেতন রাজ্যে, যেখানে প্রসূতি ও শিশু কল্যাণ বিভাগ এমনিতেই যথেষ্ঠ সক্রিয় সেখানে মহিলারা অন্য অনেক জায়গার তুলনায় সাবধানতা অবলম্বন করেন। আর এখন, অতিমারীর দেড় বছর হতে চলল, আজকের দিনে এঁরা আরো বেশী সাবধানে থাকেন। 

বয়সও  একটা factor. হাসপাতালের চোখের বা হাড়ের ডিপার্টমেন্টে সব বয়েসের লোকজন equally যান না।  প্রসূতি বিভাগেও ও সব বয়েসের মহিলা যান না।  

সব মিলিয়ে কোথায় যেন একটা statistical sampling bias নজরে আসছে। সমাজের সর্বস্তরের পরীক্ষা যেন হচ্ছে না।  

অবশ্য, এই সার্ভে নিঃসন্দেহে প্রয়োজনীয়। বেশ কিছুটা তথ্য দিচ্ছে। তবে, এটাই যথেষ্ট নয়। সবচেয়ে বড় কথা-  যেহেতু করোনা indoor অনেক বেশী সংক্রমণ করে এবং কমবয়েশিদের মধ্যে এর প্রকোপ কম তাই তাদের মধ্যেই asymptomatic রুগীর সংখ্যা বেশি হবার সম্ভাবনা। তাই, সমাজের এই indoor working populationএ সার্ভে করা আরও দরকার - যেমন যারা AC  অফিস, ব্যঙ্ক, AC দোকান, টিউটোরিয়াল , চারদিকে ঘেরা বাজারের সঙ্গে কর্মসূত্রে যুক্ত, অথবা ধর্মীয় বা সামাজিক অনুষ্ঠানে গিয়েছিলেন,   অথবা যাঁরা রেগুলার ভিড় বাস, ট্রেন বা শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত ক্যাব বা শাটলে যাতায়াত করে থাকেন । 

এঁদের epidemiologically-relevant survey করলে তবেই সমাজের আসল করোনা-চিত্র ধরা পড়বে। না হলে কিন্তু একটা 'false negative' ব্যাপার হবার সম্ভাবনা থাকছে। মনে হচ্ছে বিপদ নেই, কিন্তু আসলে বিপদ আমাদের অজান্তে কাছেপিঠেই ঘুরঘুর করছে। প্রসঙ্গত, মনে রাখা দরকার কেরালায় যে এত করোনা আক্রান্তের সংখ্যা বাড়ছে তার একটা বড় কারণ ওঁদের সার্ভে খুব ভাল করে হচ্ছে।  

প্রশ্ন উঠতেই পারে - সেন্টিনেল সার্ভে যাঁরা প্ল্যান করলেন তাঁরা কি এই ব্যাপারটা overlook করে গেছেন? এটা বলা মুশকিল। আমার মনে হয় না যাঁরা সার্ভে করেছেন তাঁরা এই biasটা নজর করেননি। হয়ত, ইচ্ছে থাকলেও কিছু করা সম্ভব ছিল না, কারণ, সংবাদমাধ্যমের রিপোর্ট এও জানাচ্ছে যে 'বাড়ি বাড়ি গিয়ে পরীক্ষা করার পরিকাঠামো না থাকায় এবং আর্থিক সমস্যা থাকায় আপাতত হাসপাতালগুলোতে চিকিৎসাধীন রোগীদের পরীক্ষাতেই জোর দেওয়া হবে'। 

তাই নেই-মামা'র-চেয়ে-কানা-মামা সার্ভে করে ভালই করেছেন।কিন্তু, আরো আর্থসামাজিক প্রতিনিধি-ভিত্তিক সার্ভে করলে খুব ভাল হয়।  
---- ----

ছোট্ট একটা সুখবর দিয়ে শেষ করি  - বলতে পারেন ' ফলাফল ৩: সংক্রমণ যখন আশার আলো' দেয়।  

কিছুদিন আগে কলকাতার পার্ক সার্কাসে অবস্থিত 'ইনস্টিটিউট অফ চাইল্ড হেলথ' বাচ্ছাদের পরীক্ষামূলক টিকা'র তৃতীয় পর্যায়ের ট্রায়ালের জন্যে  ১২-১৮ বছর বয়সীদের ভলান্টিয়ার হিসেবে নেবার চেষ্টা করে।  একটাই শর্ত ছিল - কারুর আগে করোনা বা করোনার সিমটম থাকলে চলবে না।  সেই মতোই ৮৫ জন কে নেওয়া হয়। কিন্তু, মূল ট্রায়াল শুরু হবার আগে পরীক্ষা করতে গিয়ে দেখা যায় চমকে ওঠেন ইনস্টিটিউটের বিজ্ঞানীরা। কারণ প্রাথমিক পরীক্ষায় দেখা যায় ৮৫ জনের মধ্যে  ৪৫ জন (অর্থাৎ ৫৩%) র শরীরে আগে থেকেই রয়েছে করোনা ভাইরাস বিরোধী এন্টিবডি ! এ কি ?!!

ছবি ৪: ১২-১৮ বয়সীদের শরীরে আগে থেকেই এন্টিবডি। 


স্বাভাবিক ভাবেই এই কিশোর কিশোরীদের দিয়ে আর ভলান্টিয়ারগিরি করা যাবে না।  আগে থেকেই এন্টিবডি আছে।  কিন্তু টিকাকরণ হয়নি অথচ already শরীরে এন্টিবডি আছে তার একটাই ব্যাখ্যা হয় - এদের সবার সংক্রমণ হয়েছিল, কিন্তু উপসর্গ হীন (বা প্রায়-উপসর্গহীন) ছিল বলে এরা নিজেরা বা বাবা-মা বা বাড়িতে কেউ বুঝতেই পারেনি যে এদের asymptomatic কোভিড হয়েছিল। 

প্রসঙ্গত বলে রাখি কলকাতার এই ফলাফল সরাসরি মিলে যাচ্ছে গত সপ্তাহে প্রকাশিত জাতীয় serosurvey রিপোর্টের সঙ্গে (ছবি ৫) .  
ছবি ৫: জাতীয় সেরোসার্ভের ফলাফল। 

এতে ভাল কি আছে? অবশ্যই আছে।  কারণ দেখা যাচ্ছে বাচ্ছাদের ইনফেকশন হতে পারে, কিন্তু সিরিয়াস অসুখ প্রায় নেইই। সেই জন্যেই দুই সার্ভের হিসেবে এত এত কম বয়সী সংক্রমিত হয়েও গুরুতর অসুস্থ হয়নি।
 
এই ফলাফলও ঠিক নতুন না।  একাধিক দেশে এর প্রতক্ষ্য পরোক্ষ প্রমান পাওয়া যাচ্ছে - বাচ্ছাদের মধ্যে কোভিড সিরিয়াস কেস উল্লেখযোগ্য ভাবে কম। তবে 'তৃতীয় ঢেউ বাচ্ছাদের বেশি ক্ষতি করবে'  এই জনশ্রুতি যখন সবাইকে চিন্তায় রেখেছে তখন এই ফলাফল বেশ কিছুটা স্বস্তি দিচ্ছে বৈকি। বিজ্ঞানীরা এমন কথা অনেকদিনই বলে আসছেন।এবার আরো কিছুটা 'স্বস্তিকর' প্রমান মিলল ।

আজ এই পর্যন্ত।   ভাল থাকবেন। সবাইকে অনুরোধ রইল = মাস্ক পরবেন।  অফিস দোকান ব্যাঙ্ক মল ইত্যাদি জায়গায় জানলা-দরজা খোলা রাখবেন। 

নমস্কার। 


রেফারেন্স:

https://bengali.news18.com/news/coronavirus-latest-news/west-bengal-government-to-start-sentinel-survey-to-fight-covid-surge-rc-627321.html

https://timesofindia.indiatimes.com/city/kolkata/sentinel-survey-to-fight-covid-surge/articleshow/84421746.cms

https://bartamanpatrika.com/home?cid=13&id=308907

https://bartamanpatrika.com/home?cid=13&id=309601

https://timesofindia.indiatimes.com/city/kolkata/cov-antibodies-found-in-50-kids-screened-for-vax-trial/articleshow/84718198.cms

https://bengali.abplive.com/news/kolkata/corona-anitibody-found-in-12-to-18-years-kid-bodies-while-vaccine-trail-in-kolkata-825629



 



Friday, June 25, 2021

সুভাষ - হিটলার স্বাক্ষাৎ - গল্প নয়, ইতিহাস কি বলছে? 

(হিটলারের সোভিয়েত ইউনিয়ন আক্রমণের ৮০তম বর্ষ উদযাপিত হচ্ছে কারণ সেটা হয়ে দাঁড়িয়েছিল নাৎসি জার্মানির শেষের শুরু। এই প্রসঙ্গে নেতাজি সুভাষ চন্দ্র বসুর মতামত বেশ ইন্টারেস্টিং। নানা প্রতিকূলতার মধ্যেও তাঁর রাজনৈতিক প্রজ্ঞার পরিচয় দেয় )

২৯শে মে, ১৯৪২। বার্লিন। রাইখ চ্যান্সেলারি (জার্মানির সর্বাধিনায়কের দপ্তর)।

এডলফ হিটলারের সঙ্গে সুভাষ চন্দ্র বসু'র  প্রথম ও শেষ সাক্ষাৎ। এক বছরের বেশি সময় ধরে সুভাষ দেখা  করতে চেয়েছেন। সত্যি বলতে কি (বাঙালিরা হয়তো মনঃক্ষুন্ন হবে  যাবে জেনেও লিখছি ) হিটলার খুব একটা গা করেনি। কেনই বা করবে? সাহায্য তো চাইতে গেছেন সুভাষচন্দ্র , হিটলার তো নয়।  ইউরোপ জয়ী কে? হিটলার , সুভাষচন্দ্র তো নন।

আর  তাছাড়া, হিটলারের racist ইডিওলজিতে ভারতীয়দের কোনো ভাল স্থান  নেই।হিটলারের লেখা বই, ভাষণ শুধু ইহুদি নয়, স্লাভিক, এশিয়াটিক, আফ্রিকানদের প্রতি বিদ্বেষে ভরা।   ব্রিটেনের সঙ্গে যুদ্ধে জড়িয়ে পড়লেও হিটলার এখনো মনেপ্রাণে বিশ্বাস করে যে ভারত, এশিয়া ও আফ্রিকার কালো আদমিদের জন্যে শেতাঙ্গ শাসনিই ভালো - সে ইংরেজ হোক বা জার্মান।

সুভাষচন্দ্র ঘটনাচক্রে ওখানে গিয়ে পড়েছেন বলে নাৎসিরা কিছু সাহায্য করেছে - আজাদ হিন্দ কেন্দ্র  স্থাপিত হয়েছে আজাদ হিন্দ রেডিও সম্প্রচার করছে , ইন্ডিশ লিজিওন গঠিত হয়েছে (যদিও নেতাজি'র অনেক চেষ্টা সত্ত্বেও ~১৭০০০ ভারতীয়  যুদ্ধবন্দীর মধ্যে মাত্র ৪০০০ যোগ দিয়েছে) . বলতে পারেন, নাৎসিরা সুভাষকে হাতে রেখেছেন, যদি ওদের  কাজে আসতে পারেন।   কিন্তু, সুভাষচন্দ্র মূল চেষ্টা ছিল এই  যে ১) স্বাধীন ভারতের অস্থায়ী  সরকারকে হিটলার আনুষ্ঠানিক সীকৃতি দেবে, ২) সেই অস্থায়ী সরকারের ফৌজ জার্মান ও রুশ সেনাবাহিনীর সহায়তায় আফগানিস্তান দিয়ে উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশে প্রবেশ করবে।  সেই ব্যাপারে কাজ খুব একটা এগোয়নি। 

দুঃখের বিষয়, জার্মানি পৌঁছোবার কয়েক মাস পরেই যখন সুভাষ জানতে পারেন যে  হিটলার সোভিএট্ ইউনিয়ন আক্রমন করেছে তখনই তিনি বোঝেন যে আফগানিস্তান দিয়ে তাঁর ঢোকার রাস্তা বন্ধ (নাৎসিরা  লাল ফৌজের ওপর বিজয় নিয়ে নিশ্চিত হলেও ইতিহাস ও রাজনীতির অসাধারণ ছাত্র সুভাষ বুঝতে ভুল করেননি সোভিয়েতরা জার্মানির নাক রগড়ে দেবে !). তাই প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই তিনি জার্মানি ছাড়তে চেয়েছিলেন।  যদি জাপানিদের কাছে যাওয়া যায়।   কিন্তু ঠিকঠাক ব্যবস্থা কিছুতেই হয়নি।  
সুভাষ অবশ্য বসে থাকার পাত্র নন; নানা ভাবে চেষ্টা করে যাচ্ছেন। 

আর তার সঙ্গে এখনো চেষ্টা করছেন সেই ১ নম্বর  - স্বাধীন ভারতের অস্থায়ী  সরকারকে হিটলাররের সীকৃতি। হিটলার দিলেই ইতালি জাপান আর ওদের স্যাটেলাইট দেশগুলি দেবে। 
এবং এই দুই কারণেই - জাপান যাত্রার ব্যবস্থা, আর সরকারকে স্বীকৃতি - জন্যেই আজ হিটলারের সঙ্গে দেখা করতে আসা।  

সুভাষের সঙ্গী দুই বিস্বশ্ত NG স্বামী আর আবিদ হাসান। আর আছেন জার্মান কূটনৈতিক  (ও সুভাষের বন্ধু) আদাম ভন ট্রট, যিনি আজ দোভাষীও বটে ।  জার্মান পক্ষে হিটলার ছাড়া উপস্থিত পররাষ্ট্রমন্ত্রী রিববেনট্রপ এবং সেক্রেটারি কেপলার।  

(হোয়াটসাপে এই সাক্ষাৎ নিয়ে একটা নাটকীয় গাঁজা ঘুরে বেড়ায়। ধ্যাত! ) 

বার্লিনে নেতাজি ও হিটলারের মিটিং। ২৯শে মে, ১৯৪২। পাশে ভন ট্রট। 

যাই হোক, সেই বিখ্যাত ছবি তোলার পরে আলোচনা শুরু।  

সুভাষচন্দ্রই সাহায্যপ্রাথী। তাই হয়তো একটু রং চড়িয়েই হিটলারকে 'সিনিয়র বিপ্লবী ' বলে শুরু করেছিলেন।  তার ফল হল কেলেঙ্কারি। বাতেলা মারার সুযোগ পেয়ে হিটলার একটা লম্বা বক্তৃতা দিয়ে দিলো - যুদ্ধ নিয়ে , পররাষ্ট্রনীতি নিয়ে, রাশিয়ানদের গালাগাল দিয়ে , ভারতের কি করা উচিত , সুভাষের কি করা উচিত - এক  গাদা !!!  আর এদিকে যে সুভাষচন্দ্র  বন্ধু দিলীপ রায়ের সঙ্গে, গান্ধীজির সঙ্গে, জওহরলাল'র সঙ্গে, এমনকি গুরু চিত্তরঞ্জনের সঙ্গে তর্ক-আলোচনা  করেছেন তাঁর গা জ্বলে গেছে এসব একতরফা  বকবক শুনতে শুনতে। কিন্তু, কি করা!  ট্রট আবার ইশারা করে বলছেন - কোনো কথা নয়।  বকছে , বকতে দাও।  

যাই হোক, ঝাড়া অনেকক্ষন জ্ঞান দিয়ে হিটলার একটু থামতে সুভাষ স্বীকৃতির কথাটা আবার তুললেন। 
হিটলার ঠিক সরাসরি উত্তর দিল না।তবে ঘুরিয়ে যা বলল তার মানে দাঁড়ায়  - না, দেব না, কারণ দেবার কোনো মানে হয় না ।  যদি আমার ফৌজ ভারতের দোরগোড়ায় থাকতো তাহলে আপনাদের স্বীকৃতি দেওয়ার মানে হয়।  আপনাদের দেশে একটা আলোড়ন হতে পারে যেটা  আমাদের লড়াইয়ে কাজ দেবে। কিন্তু, কোথায় আমার ফৌজ আর কোথায় ভারত।এখন দিলে  শুধুমাত্র লোকদেখানো হবে....একটু অপেক্ষা করুন। সোভিয়েতদের  কয়েক মাস পরেই হারিয়ে দেব।  তখন আমরা ভারতের অনেক কাছাকাছি। 

হতাশ হলেও সুভাষচন্দ্র এসব গ্যাস খাওয়ার পার্টিই নন।  উপস্থিত সবাইকে অবাক করে বলে দিলেন, 'সময়ই বলবে আপনারা সোভিয়েটদের কত তাড়াতাড়ি হারাতে পারবেন। ...আর আমার মতে , একসঙ্গে পূর্ব ও পশ্চিম দুই ফ্রন্টে লড়াই করে আপনি ঠিক করছেন না।' 

হিটলারের মুখের ওপর এমন কথা কেউ বলেছে কিনা জানা নেই, তবে হিটলার কথাটা সেদিন খুব একটা পাত্তা দেয়নি। 

সুযোগ পেয়ে সুভাষ আরেকটা বোমা ঝেড়ে দিলেন। বললেন, 'আপনার বই মেইন ক্যাম্পফ'এ আপনি ভারতীয়দের 'দুর্বল, মেনিমুখো, অহিংস ' বলে তাচ্ছিল্য  করেছেন। এ আবার কি - আপনি কি ভারত সম্পর্কে কিছুই জানেন না ? ' 

মুখের ওপর এরকম সমালোচনা শুনে হয়তো অবাক হলেও হিটলার এটাও তেমন গায়ে মাখল না।  একটু পাশ কাটিয়ে বললো, 'আরে , আমি বলছিলাম আপনাদের দেশের অহিংস আন্দোলন যেন জার্মানিতে না হয়...'

যাই হোক, হিটলার নিজের আসল কথাটা ভোলেনি। শয়তান হলেও পোড়খাওয়া রাজনৈতিক।  সুভাষ এরপর যখন ভারতের কাছাকাছি জাপানে যেতে চাইলেন, হিটলার বললেন, 'নিঃশ্চই ব্যবস্থা হবে' 
সুভাষ বললেন - একটা প্লেনের ব্যবস্থা করে দিন'.

হিটলার বললো   - না, প্লেনে যাবার বোকামি করবেন না. কোথায় শত্রু গুলি করে নামবে।  আপনার জীবনের দাম অনেক।  প্লেন নয় , আমি সাবমেরিন (জার্মান ভাষায় U-boat ) দিচ্ছি। আপনি ভাস্কো দা গামার সেই পুরোনো রুট দিয়ে যান - তবে সমুদ্রের তোলা দিয়ে।  

মিটিংয়ের মোটামুটি এই শেষ।  

২ বছর ঝুলিয়ে রেখে নাৎসিরা সুভাষচন্দ্রকে তেমন কিছুই সাহায্য করলো না (তাঁর চেষ্টার শেষ নেই)।  
আর ঐতিহাসিকের দিক থেকে দেখতে গেলে  হিটলার অত  ঘুরিয়েপেঁচিয়ে বকবক করে বললেও যা বলেছিলো ঠিক বলেছিলো। নাৎসিদের স্বার্থ আর পরাধীন ভারতের স্বার্থ তো এক নয়। ( শত্রুর শত্রু  'বন্ধু' হতেও পারে আবার 'অল্প চেনাশোনাও' হতে পারে, তাই না?)   

তবে, সুভাষের সাহসী সমালোচনা শুনেও যে রেগে যায়নি সেটা আমাদের একটু সৌভাগ্যই বলতে হবে।  
সেই মিটিং আজ আমাদের favourite ইতিহাস। তবে, সুভাষের নিজের সে  মিটিং খুব একটা পছন্দ হয়নি। স্বাভাবিক।  তাই হিটলারের দপ্তরের বাইরে অপেক্ষারত স্বামী ও হাসান যখন জিজ্ঞেস করেন, 'নেতাজি, কেমন দেখলেন? হিটলার ব্যাটা বললো কি?' সুভাষ একটু রেগেমেগেই বলেন 'একটা বদ্ধ পাগল। আমাদের আফগানিস্তানের ইপির ফকিরের মত।  নিজেই বকে যায়, সামনের জন কি বললো শোনেই না....এর সঙ্গে ৫ মিনিটের বেশি কথা বলা যায় না কি??!!'

রেফারেন্স 

Brothers against the Raj - Leonard Gordon

His Majesty's Opponent - Sugata Bose

গত বছর এই লেখাটি লিখে হোয়াটসাপে বন্ধুদের পাঠিয়েছিলাম। এখান ব্লগে দিলাম। তিহাসের এই ছোট্ট খবরটি ভালো লাগলে, নতুন লাগলে শেয়ার করবেন।

Thursday, June 24, 2021

অবশেষে প্রকাশিত হল ইংল্যান্ডের সেই নতুন টাকা। কিন্তু তাতে জগদীশ চন্দ্র বসু'র ছবি আছে কি ? .....

দু বছরের বেশি ধরে বাঙালি একে অপরকে ফরওয়ার্ড করে আসছে এই পোস্ট। 'গন ভোটে' ইংরেজরা নাকি সিদ্ধান্ত নিয়েছে তাদের দেশের নতুন ৫০ পাউন্ড নোটে ছবি থাকবে বিজ্ঞানাচার্য জগদীশ চন্দ্র বসু'র। বাঙালি খুব খুশি যে 'এতদিন অবহেলিত' মহান বাঙালি বিজ্ঞানীকে অবশেষে কুর্নিশ জানাবে জগৎ সংসার। তাই এই পোস্ট সবাই ফরওয়ার্ড করে ফেসবুক আর হোয়াটস্যাপ সমাজ-মাধ্যম বিশ্বকে সমৃদ্ধ করুন। জয় হে জয় হে জয় হে জয় জয় জয় জয় হে।  

ছবি ১: সমাজ মাধ্যমে যে পোস্ট ঘুরে বেড়ায়।  

অবশেষে সেই দিন এল।  অতিমারীর ডেল্টা ঝাপ্টার দাপটে ইংরেজরা তাদের লকডাউনের মেয়াদ আরো কয়েক সপ্তাহ বাড়িয়ে দিলেও ব্যাঙ্ক অফ ইংল্যান্ড (মানে ওদের দেশের রিসার্ভ ব্যাঙ্কের সমতুল্য কেন্দ্রীয় ব্যাঙ্ক) নতুন ৫০-পাউন্ড'র নোট আনুষ্ঠানিক ভাবে বাজারে আনলেন। সারা পৃথিবীতে খবর ছড়িয়ে পড়ল।  কিন্তু, কি আশ্চর্য! নতুন নোটে জগদীশ চন্দ্র বসু'র ছবি তো নেই ! তাহলে? ছবি আছে আধুনিক কম্পিউটার বিদ্যা'র জনক অ্যালেন টুরিং'র। এবং নতুন নোট রিলিজ হল ২৩শে জুন, অর্থাৎ টুরিং'র ১১০তম জন্মজয়ন্তীতে। এই যে নতুন নোটের ছবি।  

ছবি ২: অ্যালেন টুরিং'র ছবি দেওয়া  নতুন ব্রিটিশ ৫০-পাউন্ড নোট। ( https://www.theguardian.com/money/2021/jun/23/new-50-note-alan-turing-uk-security-features)


অসভ্য ! বদমাইশ! দুস্টু লোক! বেহায়া! সাহেবগুলো আবার আমাদের লেঙ্গি মারল??!!! তাও আবার পলাশীর যুদ্ধের দিন ২৩শে জুনেই !!! [ লিখতে লিখতে খেয়াল হল আজ যেমন সারাদিন ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি, তেমনি ২৬৪ বছর আগে মুর্শিদাবাদের সেই আমবাগান আর সংলগ্ন মাঠে হেভ্ভি ঝড়বৃষ্টি নেমে 'এডভ্যান্টেজ ক্লাইভ' করে দিয়েছিল। আর তার সঙ্গে তো ছিলই মীরজাফরের 'দলে থেকে মানুষের জন্যে কাজ করতে পারছিলাম না'।]

 তবে এখন যাক সে কথা ! নতুন নোটে বিজ্ঞানীর ছবির কথায় ফেরা যাক। নাঃ! কেউ আচার্য বসুকে জেনেশুনে অপমান করেনি, বাঙালি জাতিকেও লেঙ্গি মারেনি। এই 'পোস্ট পেলেই চোখ-কান বুজে ফরওয়ার্ড করে দিতে হবে' র যুগে আমরাই অতি-উৎসাহী হয়ে মনে রাখিনি যে খবর-টা একবার যাচাই করা উচিত। 

অথচ মূল খবরে কিন্তু গোড়া থেকেই কোন ভুল বোঝাবুঝির সুযোগ ছিল না।২০১৮র নভেম্বরে ব্যাঙ্ক অফ ইংল্যান্ড ঘোষণা করেন যে বছর দু-তিনের মধ্যে তাঁরা  নতুন ৫০ পাউন্ডের নোট বাজারে ছাড়তে চলেছেন। পুরোনো কাগজের নোট বাতিল করে নতুন নোট হবে বিশেষ পলিমারের, যেমন এখনকার অন্যান্য সব ইংরেজ টাকা। কিন্তু , তার সঙ্গে ব্যাঙ্ক কর্ণধাররা এও জানান যে এই নতুন নোটে এমন এক বিজ্ঞানীর ছবি থাকবে যিনি শুধু বিজ্ঞানের কোন এক ক্ষেত্রে অসামান্য দক্ষতার পরিচয় দিয়েছেন তাই নয়, তাঁর অবদান ব্রিটিশ সমাজকেও না না ভাবে প্রভাবিত করেছে। 

পঞ্চাশ পাউন্ড নোটে বিজ্ঞানীর ছবি অবশ্য নতুন না।  যেমন ২০১১য় প্রকাশিত নোটে আছেন এমন একজন যাঁর নাম আমাদের স্কুলবইতে থাকত -  স্টিম-ইঞ্জিনের আবিষ্কর্তা জেমস ওয়াট।  সঙ্গে তাঁর সহযোগী ও পৃষ্ঠপোষক ম্যাথিউ বোল্টন। 


ছবি ৩: ২০১১র ৫০-পাউন্ড নোটে জেমস ওয়াট ও ম্যাথিউ বোল্টন

তবে এবার উল্লেখযোগ্য ভাবে ব্যাঙ্ক জানায় যে জনসাধারনের মতামতকে তাঁরা গুরুত্ব দেবেন - পছন্দের বিজ্ঞানীর নাম নোমিনেট করার জন্যে ওয়েবসাইট খুলে দেওয়া হয়।  ছয় সপ্তাহের মধ্যে জানাতে হবে, তারপর শর্টলিস্ট করবেন বিশেষজ্ঞ কমিটি। 

'বিজ্ঞানের যুগে বিজ্ঞান নিয়ে হুজুগ'  - অনেকটা গঙ্গাজলে গঙ্গাপুজোর মত।  এবং তাই ছয় সপ্তাহ পরে  কমিটি দেখেন যে ২১৪০০০র ওপর ব্রিটিশ নাগরিক ৯৮৯ জন বিজ্ঞানীর পক্ষে মতামত দিয়েছেন! 

অবাক হবার কিছু নেই। নিউটন, ডারউইন , ফ্যারাডে, জেমস ম্যাক্সওয়েল, আলেক্সান্ডার ফ্লেমিং, রবার্ট বয়েল, জন ডাল্টন, রাদারফোর্ড,  এডমন্ড হ্যালি'র মত যুগান্তকারী বিজ্ঞানীদের যদি 'ওঁরা এসবের উর্ধে' বলে লিস্ট থেকে বাদ দেওয়াও  হয়, ইংল্যান্ডে কি স্বনামধন্য বিজ্ঞানীর অভাব আছে? আমাদের ওপর দুশো বছর শাসন করেছে বলে আমাদের স্বাভাবিক 'গজগজ খচখচ মানসিকতা' থাকলেও আধুনিক বিজ্ঞানে ও দেশের অবদান তো অনস্বীকার্য। 

মূল প্রসঙ্গে ফিরে আসি। আসল ব্যাপার হল এই হাজারের ওপর নোমিনেশনে ছিল জগদীশ চন্দ্র বসুর নাম। এবং এখন থেকেই আমাদের 'আমরা বাঙালি' মাতামাতির শুরু। 

ছবি ৪: জনসাধারনের opinion pollএ জগদীশ চন্দ্র বসুর নাম। (https://www.bankofengland.co.uk/-/media/boe/files/banknotes/50-character-selection-names.pdf?la=en&hash=F0CCA0655EEC2788748D885BE036662B574B615E)


     এই 'খবর' যখন এখানে এসে পৌঁছল এক অদ্ভুতুড়ে হুজুগ শুরু হল।  একাধিক কাগজে প্রকাশিত হল। পোস্ট লেখা ও শেয়ার শুরু হল।  কেউ কেউ সঠিক রিপোর্টিং করলেও বেশ কয়েকজন বাঙালি আবেগে সুড়সুড়ি দিতে গিয়ে (অথবা সাংবাদিক নিজেই সুড়সুড়ি খেয়ে) ভুল রিপোর্ট বা হেডিং লিখে বসলেন।  পশ্চিমবঙ্গ, জাতীয়, বাংলাদেশী সংবাদমাধ্যমের কেউ না কেউ এই ভুল করেইছেন । একটি সংবাদমাধ্যম তো আবার ফটোশপ করে ব্যঙ্ক অফ ইংল্যান্ডের আগেই নতুন নোটের ডিজাইন করে ফেলে অধ্যাপক বসুর ছবি বসিয়ে দিল! এটা ঠিক যে বেশ কিছু ওয়েবসাইট পরে সঠিক খবর নিয়ে আসেন। এমনকি 'জগদীশ নোটের' ডিজাইন করা সংবাদমাধ্যম ও জানায় যে 'বসু নন, নতুন নোটে থাকছেন টুরিং' । কিন্তু ততদিনে যা গণ্ডগোল হবার হয়েই গেছে । আর ফেসবুক বা হোয়াটস্যাপ 'ফালতু' কিছু ঢুকলে সেটা যে ঘুরতেই থাকে সে তো আমরা সবাই জানি ( না হলে আর এই বাজারে ট্রোলদের সংসার চলত কি?)  

ছবি ৫:  ব্রিটিশ পাউন্ডে জগদীশ বসু নিয়ে অতি-উৎসাহী সংবাদ মাধ্যম 

    আচার্য বসুর নাম কে বা  কারা দিয়েছিলেন সেটা হয়ত আর জানা যাবে না, তবে সম্ভবত বিলেতে বসবাসকারী কোন বাঙালিই হবেন। তিনি (বা তাঁরা) ভুল কিছু করেননি। গত ১৫০ বছরে জগদীশ চন্দ্র বসুর মত এক্সপেরিমেন্টাল গবেষক কমই এসেছেন। কিন্তু ইংল্যান্ডের বাজার-দোকান-ম'লে যে নোট ইংরেজ জনসাধারণ ব্যবহার করবেন (যদিও দৈনন্দিন কাজকর্মে ৫০-পাউন্ড খুব বেশি চলে না) সেখানে  গত শতাব্দীর একজন ভারতীয় বিজ্ঞানী (যিনি জীবনের কয়েক বছর ওদেশে কাটালেও সেখানে থাকাকালীন তেমন কোন বড় গবেষণা করেননি) তাঁর ছবি ওদের দেশে নোটে শোভা পাবে এটা আশা করা একটু বাড়াবাড়ি। কোন সামাজিক-গণ মানসিকতা থেকে এমন 'আশা' উঠে আসতে পারে এবং লক্ষ লক্ষ 'শিক্ষিত' বাঙালির মনে নির্দ্বিধায় প্রতিষ্ঠা পেতে পারে সেটা মনস্তাত্ত্বিকরাই বলতে পারবেন।  তবে 'আমরাই জগতে গ্রেট গ্রেটার গ্রেটেস্ট, কিন্তু আমাদের কেউ পাত্তা দেয়নি ঠকিয়ে নিয়েছে, এইবার পাত্তা দিচ্ছে কারণ আমরাই জগতে গ্রেট গ্রেটার গ্রেটেস্ট... - এই চিন্তা-টা বহু বাঙালির (এবং ভারতীয়দের) মধ্যে মজ্জাগত। আমার মনে হয় এই  'যাক! এতদিনে JC Bose সন্মান পেলেন' গণ-বিশ্বাস এই মনোভাবেরই প্রসূত। 

    কবে থেকে এই মানসিকতার শুরু ঠিক জানিনা। সম্ভবত, প্রাক-স্বাধীনতা যুগে ইংরেজ racism যখন সত্যি সত্যিই এ দেশের মানুষকে দাবিয়ে রাখার চেষ্টা করত তখন সেই হীনবল দাবিয়ে-রাখা জাতিকে উজ্জীবিত করতেই এই সব 'এমন দেশটি কোথাও খুঁজে' 'পাল্টা' স্লোগানের প্রয়োজনীয় উৎপত্তি। তবে আজ স্বাধীনতার ৭৪ বছর পরেও এগুলো কথায়-কথায় আঁকড়ে ধরে থাকা খুব একটা কাজের মনে হয় না।  তাও করা হতেই থাকে, কেন কে জানে? হয়ত প্রায় এক শতাব্দী অভ্যাসের ফল, অথবা  যেসব কৃতি বাঙালি নিজেদের কর্মক্ষেত্রে উজ্জ্বল স্বাক্ষর রেখেছেন এই মাতামাতি করে তাঁদের  reflected glory  নিজের অপরেও একটু টেনে এনে ফেলা যায়। আর তার সঙ্গে যখন যোগ হয় এই ধরণের অতি-সরলীকরণ রিপোর্টিং তখন তো জল আরো ঘোলা হবেই?

    তবে আন্তর্জাতিক জগৎ তো এর ধার ধারে না, এক্ষেত্রেও ধারেও নি।  এবং তাই যে ১২ বিজ্ঞানী শর্টলিস্ট হলেন তাঁতে নাম নেই জগদীশ চন্দ্র'র।  অথচ সেটা কিন্তু কোন মতেই ভারত-বিরোধী মনোভাবের কারণে নয়। কারণ, ফাইনাল লিস্টে জোতিষ্ক'র মত উজ্জ্বল এক অকালপ্রয়াত তামিল তরুণ  - শ্রীনিবাস রামানুজন। '১২ জন ফাইনালিস্টদের' মধ্যে তাঁর স্থান কারণ রামানুজনের মত গণিতজ্ঞ বিংশ শতাব্দীতে হাতেগোনা, এবং তাঁর মৌলিক গবেষণার  প্রায় সবই  তিনি ইংল্যান্ডে থাকাকালীন করেছিলেন। কি আশ্চর্য - যে নাম নেই তা নিয়ে লাফালাফি , যে ভারতীয় নাম শর্টলিস্ট হয়েছিল তাঁকে নিয়ে কোন কথা নেই? ?  

ছবি ৬: শর্টলিস্ট হওয়া ১২জন দিকপাল। চোদ্দজন বিজ্ঞানীর ছবি আছে কারণ চার্লস ব্যাবেজ এবং এডা লাভলেস, ও উইলিয়াম ও ক্যারোলিন হার্শেল র ছবি নির্বাচিত হলে একসঙ্গে নোটে শোভা পেত।  

    অবশ্য রামানুজনের ছবি শেষ পর্যন্ত নতুন নোটে স্থান পায়নি। যেমন পাননি আধুনিক জীবন বিজ্ঞানের দুই অসামান্যা  - রোজালিন্ড ফ্র্যাংকলিন আর ডরোথি হজকিন। অথবা দু বারের নোবেল বিজয়ী ফ্রেডরিক স্যাঙ্গার বা সর্বজনশ্রদ্ধেয় স্টিফেন হকিং। নির্বাচিত হননি পদার্থবিদ্যার সর্বকালের অন্যতম শ্রেষ্ট জেমস ম্যাক্সওয়েল অথবা পল ডিরাক। একটাই তো নোট - কি আর করা যাবে? তাই , ব্রিটিশ প্রথা ও আইন মেনে নোটের একদিকে রানী দ্বিতীয় এলিজাবেথের ছবি। অন্যদিকে অ্যালেন টুরিং। আধুনিক কম্পিউটার বিজ্ঞানের জনক, যন্ত্রের কৃত্রিম বুদ্ধিসম্পন্নতা ও আরো কত কিছুর দিশারী - যাঁকে অনেকে আইনস্টাইন, টেসলা, এডিসন বা দা ভিঞ্চির মত প্রতিভাধর মনে করেন - সেই অ্যালেন টুরিং। আর টুরিং তো শুধু বিজ্ঞানতপস্বী নন।  তিনি ব্রিটেনের দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের অন্যতম বড় নায়ক। যুদ্ধ জয়ে তাঁর অবদান অনস্বীকার্য। কেন? কারণ, ১৯৪২এ জার্মানির এনিগ্মা কোড break করেছিলেন টুরিং ও তাঁর সহকারী বিজ্ঞানীরা। ফলে, পরের দু বছর জার্মানির যাবতীয় গুপ্ত পরিকল্পনা ও নির্দেশ মিত্রশক্তি'র কাছে আগেই পৌঁছে পাঠোদ্ধার হয়ে যেত। ভবিষ্যতের যন্ত্র, আধুনিক যন্ত্রের artificial intelligence থেকে বাঘ ও  জিরাফদের গায়ে কিভাবে নানা ধরণের ডোরাকাটা দাগ বা ছোপ হয় - সর্বত্র টুরিং'র অবাধ বিচরণ। বিজ্ঞানী তো অনেকেই হন, প্রতি বছর নোবেল ও ৭-৮জন পেয়ে থাকেন, কিন্তু শতাব্দীতে সম্ভবত একজনই টুরিং আসেন। 

অ্যালেন টুরিং নিয়ে লেখার তো শেষ নেই।  আর সত্যি বলতে কি, আমি ওঁর বিষয়ের details  অতটা ঠিক বুঝিনা। তাই বেশি লেখা অনুচিত হবে। তবে, নিচে কয়েকটি তথ্য-সমৃদ্ধ পোস্টের লিংক দিলাম। টুরিং সম্পর্কে জানতে হলে অবশ্য-পাঠ্য। 

তবে,  টুরিং'র ছবি যে আজ ব্রিটিশ পাউন্ডে স্থান পেল এটা শুধু আধুনিক সভ্যতার প্রায় সব কিছুতে তাঁর সব যুগান্তকারী বৈজ্ঞানিক আবিষ্কারের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ প্রভাবের জন্যে নয়। টুরিং'র ছবি দিয়ে এক ধরণের প্রায়শ্চিত্ত করল ব্রিটিশ জাতি। অসামান্য মেধাবী টুরিং সমকামী হয়ে জন্মেছিলেন। জীবনের বিভিন্ন সময়ে একাধিক ব্যক্তির সঙ্গে তাঁর ঘনিষ্টতা ছিল। কিন্তু, এ জানাজানি হবার পরে আজ থেকে ৭০-৮০ বছর আগের, আজকের-তুলনায় অনেক রক্ষণশীল, ইংরেজ সমাজে তাঁর ঠাঁই হয়নি। বিশ্বযুদ্ধ বিজয়ে তাঁর অসামান্য অবদান সত্ত্বেও তিনি অপমানিত হন, আইনত অপরাধী সাব্যস্ত হন এবং তাঁকে 'ঠিক করতে হরমোন থেরাপি' দেওয়া হয়।  এই অপমান সহ্য হয়নি। তাই ১৯৫৪'র এক ভোরবেলা সায়ানাইড মেশানো আপেল খেয়ে তাঁর আত্মহত্যা। বয়স মাত্র ৪২! 

    তারপর টেমস দিয়ে কত জল বয়ে গেছে। বিজ্ঞানে প্রায় প্রত্যেক শাখায় টুরিংর আবিষ্কারের প্রভাব বেড়ে চলেছে।  এবং এককালে যা সমাজচ্যুত-করা অপরাধ ছিল তা আজ স্বাভাবিক প্রকৃতি বলে বিজ্ঞান ও সমাজে স্বীকৃত। তাই, টুরিং'র নাম ঘোষণা করার সময়ে ব্যাঙ্ক অফ ইংল্যান্ডের কর্ণধার জানালেন - বিজ্ঞানের এই যুগে আমরা চাই যেন সবাই উপলব্ধি করেন যে একজন মানুষের সবচেয়ে বড় পরিচয় তাঁর গুণাবলী।  তিনি কোথা থেকে এসেছেন, কি তাঁর  মাতৃভাষা, তিনি কোন সমাজের মানুষ, কি তাঁর যৌন্যতা বা তাঁর গায়ের রং কেমন এগুলো আর বিচার্য হতে পারে না।  মানব জাতির কল্যানে কি তাঁর অবদান সেটাই প্রধান ও একমাত্র বিচার্য।  গ্যালিলিও'র মত আজ টুরিং ও বিজয়ী।  

ছবি ৭: ৫০ পাউন্ডের নতুন নোট।  একদিকে রানী, অন্যদিকে তাঁর কিছু আবিষ্কার ও মৌলিক চিন্তাভাবনা শোঃ অ্যালেন টুরিং

    আর জগদীশ চন্দ্র?  ভারতরত্ন বিজ্ঞানী CNR Rao একবার বলেছিলেন 'জগদীশ চন্দ্র হচ্ছেন ultimate scientist. অন্য বিজ্ঞানীরা যন্ত্রপাতি কেমিক্যাল হাতের কাছে পেলে গবেষণা করতে পারেন।  আর জগদীশ চন্দ্র গবেষণা করতেন নিজের হাতে যন্ত্র বানিয়ে'. তাই জগদীশ চন্দ্র আছেন, থাকবেন। আর গ্যারান্টি দিয়ে বলতে পারি বহু বাঙালি এখনো অত্যন্ত নিষ্ঠার সঙ্গে বছরের পর বছর ওই 'ইংরেজ টাকায় বাঙালি বিজ্ঞানী' পোস্ট শেয়ার করেই যাবে।ওই যেমন প্রতি বছর ১২ই জানুয়ারি স্বামী বিবেকানন্দের 'শিকাগো বক্তৃতা' নাম নিয়ে একটা ঢপের রেকর্ডিং  ফরওয়ার্ড হয়ে হয়ে ঘুরে বেড়ায়।স্বামীজীর নাম যা-তা কিছু শেয়ার করলেই যদি দেশপ্রেম ও পুন্য দু পয়েন্ট বাড়ে এই আর কি ! যেমন লোকজন অবলীলায় ভাবতে পারেন যে ভ্যাকসিন নিলে গায়ে চুম্বক হয় এবং দায়িত্ব জ্ঞানহীন হয়ে সেই পোস্ট কিছু সংবাদ মাধ্যম ও সমাজ মাধ্যমে প্রচার ও পেতে থাকে। ....

আর তাছাড়া, জগদীশ চন্দ্র বসু সম্মন্ধে বিভ্রন্তিকর প্রচার তো নতুন কিছু না। এই যে আমরা সব গর্ব করে বলে  বেড়াই, আমাদের স্কুল বইতেও আছে - জগদীশচন্দ্র প্রমান করেছিলেন গাছের  প্রাণ আছে' সেটা কি ঠিক ? সত্যিই কি তাই প্রমান করেছিলেন বসু বিজ্ঞান মন্দিরের প্রতিষ্ঠাতা?  .... হা হা ! সে আরেক অতিসরলীকরণ কাহিনী। আরেকদিন হবে। 

 প্রথমে এই ব্লগে প্রকাশিত। তার একদিন পরে ফেসবুক গ্রুপ 'ইতিহাস তথ্য ও তর্কে' প্রকাশিত।


রেফারেন্স 

https://www.bbc.com/news/business-57554102

https://www.theguardian.com/money/2021/jun/23/new-50-note-alan-turing-uk-security-features

https://www.reuters.com/world/uk/new-british-50-pound-note-with-ww2-codebreaker-turing-enters-circulation-2021-06-22/

https://www.theguardian.com/business/2018/nov/02/new-plastic-50-note-bank-of-england-asks-public-nominate-scientist-ada-lovelace-stephen-hawking

https://www.bankofengland.co.uk/banknotes/50-pound-note-nominations

https://www.bbc.com/news/business-46063097

https://www.bankofengland.co.uk/-/media/boe/files/banknotes/50-character-selection-names.pdf?la=en&hash=F0CCA0655EEC2788748D885BE036662B574B615E

https://www.dailymail.co.uk/news/article-6345913/Bank-England-invites-public-nominate-British-figure-appear-high-tech-currency.html

https://www.independent.co.uk/news/business/news/new-50-note-vote-scientist-stephen-hawking-ada-lovelace-alan-turing-bank-england-a8614026.html

https://www.indiatimes.com/technology/news/new-uk-50-pound-note-may-feature-india-s-sir-jc-bose-who-did-pioneering-work-for-wi-fi-357535.html

https://www.kolkata24x7.com/uk-50-pound-note-may-feature-indias-sir-jc-bose/

https://eisamay.indiatimes.com/nation/jagadish-chandra-bose/articleshow/66818001.cms


https://www.jugantor.com/todays-paper/economics/271367/%E0%A6%A8%E0%A6%A4%E0%A7%81%E0%A6%A8-%E0%A6%AC%E0%A7%8D%E0%A6%B0%E0%A6%BF%E0%A6%9F%E0%A6%BF%E0%A6%B6-%E0%A7%AB%E0%A7%A6-%E0%A6%AA%E0%A6%BE%E0%A6%89%E0%A6%A8%E0%A7%8D%E0%A6%A1-%E0%A6%A8%E0%A7%8B%E0%A6%9F%E0%A7%87-%E0%A6%AC%E0%A6%BE%E0%A6%82%E0%A6%B2%E0%A6%BE%E0%A6%A6%E0%A7%87%E0%A6%B6%E0%A6%BF-%E0%A6%AC%E0%A6%BF%E0%A6%9C%E0%A7%8D%E0%A6%9E%E0%A6%BE%E0%A6%A8%E0%A7%80%E0%A6%B0-%E0%A6%AE%E0%A7%81%E0%A6%96


https://www.bbc.com/news/business-56503741

https://twitter.com/c0nc0rdance/status/1400798442360872960

https://www.facebook.com/groups/elebele.org/posts/396716025072451/

https://www.facebook.com/groups/1803711656387813/posts/4092204797538476/




Monday, January 4, 2021

নেতাজি সুভাষ চন্দ্র বসু'র ১২৫তম জন্মবার্ষিকী নিয়ে অনেক কিছু তো হচ্ছে। কিছু ভাল, কিছু ঘোলা হবে বলাই বাহুল্য। সে হোক, আমি আমার কথা বলি। দেখুন, অনেকেই জানেন যে  ইতিহাসের ফর্মাল ছাত্র না হয়েও আমি ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রাম নিয়ে বেশ কিছুটা পড়াশোনা করেছি এবং গত কয়েক বছরে একাধিক রচনা প্রকাশিত হয়েছে। এবং, সেই পরিপ্রেক্ষিতে সুভাষ চন্দ্র 'র রাজনৈতিক সংগ্রাম জানার ও বোঝার চেষ্টা করেছি।  
তাই, ভাবছি, এই ১২৫তম জন্মবার্ষিকী উপলক্ষে  আগে-প্রকাশিত লেখাগুলি এবং নতুন কিছু লিখলে এখানে 'পুনঃপ্রকাশিত' করি। আজ 'নেতাজি সিরিজের' প্রথম রচনা। 
এ বছর অগস্ট মাসে 'ইতিহাস তথ্য ও তর্ক' ফেসবুক পত্রিকায় প্রকাশিত। 


 সর্বভারতীয় জাতীয়তাবাদ ও আজাদ হিন্দ সরকার 

২১শে অক্টবর ১৯৪৩, সিঙ্গাপুরের ক্যাথে থিয়েটার প্রেক্ষাগৃহে নেতাজি সুভাষ চন্দ্র বসু আনুষ্ঠানিক ভাবে আর্জি হুকুমাত-ই-আজাদ হিন্দ (অর্থাৎ, স্বাধীন ভারতের অস্থায়ী সরকার ; the Provisional Government of Free India) প্রতিষ্ঠা করেন, এবং তিনদিন পরে ব্রিটিশ সাম্রাজ্য ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেন। আধুনিক ভারতের ইতিহাসে এই ঘটনাপঞ্জী বহু সমাদৃত । সংবিধানের প্রথম volumeএ আজাদ হিন্দ যেমন নন্দলাল বসুর দ্বারা চিত্রিত, তেমনই এর উদযাপনে একাধিক ডাকটিকিট প্রকাশ হয়েছে। সর্বোপরি, লক্ষ লক্ষ্ ভারতবাসী আজও পরম শ্রদ্ধায় এই ইতিহাস স্মরণ করেন।

আর্জি হুকুমাত-ই-আজাদ হিন্দ (অর্থাৎ, স্বাধীন ভারতের অস্থায়ী সরকার) আনুষ্ঠানিক ঘোষণা করছেন নেতাজি।  ২১শে অক্টবর। মঞ্চে ক্যাপ্টেন লক্ষী স্বামীনাথন সহ অন্যান্য আজাদ হিন্দ মন্ত্রী ও অফিসাররা।
(অধ্যাপক সুগত বসু'র থেকে প্রাপ্ত ছবি)   


ভারতীয় সংবিধানের স্বচিত্র সংস্করণে আজাদ হিন্দ সংগ্রামকে স্মরণ। নন্দলাল বসু অঙ্কিত, ১৯৫০। বর্তমানে সংসদ ভবনের লাইব্রেরীতে হিলিয়াম কক্ষের মধ্যে সংরক্ষিত। 

আজাদ হিন্দ সরকারের ২৫তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীতে ভারতের ডাকটিকিট। ১৯৬৮। 

কিন্তু, এও অনস্বীকার্য যে নেতাজি আজ 'দেবতার' মত পূজিত হলেও আজাদ হিন্দ সরকার গঠনে কি ধরণের চিন্তাভাবনা,পরিকল্পনা ও কাজ প্রকাশ পেয়েছিল তা অনেকাংশে সাধারণ মানুষের অজানা । কিন্তু প্রামাণ্য গ্রন্থের তো অভাব নেই। লিওনার্ড গর্ডন থেকে সুগত বসুর মত নামকরা ঐতিহাসিকদের লেখা জীবনী রয়েছে, শাহনাওয়াজ, এস. এ. এয়ার ও শিশির বসুর স্মৃতিকথা আছে; নেতাজির নিজের লেখা দুটি বই, বেশ কয়েক ভলিউম চিঠি ও ভাষণ সংকলিত আছে। আগ্রহী ছাত্রছাত্রী ও গবেষকের কাছে নেতাজি সম্মন্ধে তথ্য-ভিত্তিক ঐতিহাসের অভাব হবে না। অবশ্য, এই স্বল্প পরিসরে বিস্তারিত আলোচনা করা সম্ভব নয়। কিন্তু তাও, কিছু তথ্য উপস্থাপন করে আমরা তাঁর অসামান্য দূরদৃষ্টিশক্তি ও 'সব ভারতবাসীকে নিয়ে চলার' আদর্শ অনুধাবন করতেই পারি।

প্রতীক (symbols) দিয়েই শুরু করা যাক। যে কোন রাজনৈতিক আন্দোলন ও পরিচয়ে (identity) প্রতীক'র গুরুত্ব আছেই; না হলে জাতীয় পতাকায় অশোকচক্র অথবা রামকৃষ্ণ মিশনের প্রতীকে রাজহংস স্থান পেত না। ঠিক তেমনই আজাদ হিন্দ সরকারের symbolismএ একটু নজর দেওয়া যাক।

১। জাতীয় পতাকা - তিরঙ্গা , মাঝখানে গান্ধীবাদী চরকা। ১৯২০ থেকে যে জাতীয় গণআন্দোলন শুরু হয়েছিল তার প্রধান প্রতিবাদী প্রতীক ছিল এই ত্রিবর্ণরঞ্জিত পতাকা এবং ও চরকা (ওপরের ছবি) ।পরের দুই দশকে আপামর ভারতবাসী এই দুই প্রতীককে নিজেদের হৃদয়ে স্থান দিয়েছিলেন। তাই, দেশের বাইরে গঠিত আজাদ হিন্দ যে দেশের অভ্যন্তরীণ আন্দোলনের এক extension সে কথা সহযোদ্ধা ও বিপক্ষ , দেশ ও জগৎ, সবার কাছে প্রমান করতে নেতাজি বদ্ধপরিকর ছিলেন।১,২ 
রণাঙ্গনের পথে আজাদ হিন্দ সেনা।  জাতীয় পতাকা লক্ষ্য করুন। 


উল্লেখ্য ,এই পতাকা ব্যবহৃত হয় দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায়। তার আগে , জার্মানিতে ইন্ডিসচ লিজিওন (Indisch Legion -ভারতীয় রেজিমেন্ট, যা জার্মান সেনাবাহিনীর সঙ্গে যুক্ত ছিল) পতাকা ছিল তিরঙ্গা; কিন্তু, চরকা'র বদলে সেখানে ছিল আক্রমণে উদ্ধত বাঘ(springing tiger) । মহীশুরের 'বাঘ' টিপু সুলতানের প্রতীক স্থান পেয়েছিলো সুভাষচন্দ্রের পরিকল্পিত প্রথম পতাকায় । যেন, এক ইংরেজ সাম্রাজ্য -বিরোধী বীর নৃপতিকে আরেক বীর নেতার সম্মান (১৭৯৯এ টিপু ইংরেজদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে প্রাণ হারান। ভারতীয় রাজাদের মধ্যে এমন 'সম্মান' দুর্লভ; স্বাভাবিকভাবেই স্বাধীনতা সংগ্রামীদের তিনি 'কাছের মানুষ' ছিলেন। এছাড়াও 'টিপুর বাঘ' আজাদী সৈন্যদের insignia ( কাঁধে বা হাতে উনিফর্মের ওপর পড়া সামরিক পরিচয়চিহ্ন) শোভা পেত।

১৯৪২এ জার্মানিতে ইন্ডিসচ লিজিওন'র পতাকা উত্তোলন।  

তিরঙ্গা ও টিপুর বাঘ: ইন্ডিসচ লিজিওন'র shoulder-piece, জার্মানি, ১৯৪২।  



আজাদ হিন্দের আর কি কি প্রতীক ছিল?
২. জাতীয় নীতিবাক্য (motto): ইত্তেফাক-ইতমাদ-কুরবানী। উর্দুতে একতা- বিশ্বাস - ত্যাগ। আজাদ হিন্দের সংগ্রামের মন্ত্র।৩,*
কলকাতার 'নেতাজি ভবনে' সিঙ্গাপুরের আজাদ হিন্দ মেমোরিয়ালের রেপ্লিকা। (ছবি : লেখক)

৩। জাতীয় অভিবাদন (স্লোগান): 'জয় হিন্দ'।

৪। জাতীয় সঙ্গীত:সাব সুখ চেইন (সহজ হিন্দুস্তানিতে 'জন গণ মন') ।

এই তিনটি প্রতীকের মধ্যেই নেতাজির জাতীয়বাদী পরিকল্পনা প্রকাশ পায়। সুভাষচন্দ্র যে বিশেষভাবে উর্দু ও হিন্দুস্তানী (সহজ হিন্দি ও উর্দু মিশ্রনে যে ভাষা) ভালোবাসতেন সে কথা শিশির বসুর 'বসুবাড়ি' গ্রন্থে উল্লেখিত। কংগ্রেস সভাপতি থাকাকালীন তাঁর এক পন্ডিতজি-শিক্ষক ছিলেন যিনি সভাপতির সঙ্গে দূর প্রদেশেও যেতেন। ট্রেনেই চলত 'ক্লাস' । শুধু তাই নয়, কোন সভা বা মিটিংয়ে কেউ উর্দু বা হিন্দুস্তানিতে বক্তব্য রাখলে সুভাষচন্দ্র মন দিয়ে শুনতেন এবং ভাল শব্দ চয়ন করে নিজের বক্তৃতায় ব্যবহারের চেষ্টা করতেন । তবে ব্যক্তিগত পছন্দ-অপছন্দের ওপরে ছিল এমন একটি ভাষামাধ্যম'র আশা যেটা আজাদ হিন্দের অনেককে এক সূত্রে বেঁধে ফেলবে। যেমন 'জয় হিন্দ' স্লোগান। নেতাজির সেক্রেটারি, সাবমেরিনে সহযাত্রী ও স্নেহভাজন আবিদ হাসান (যিনি পরে ডেনমার্ক ও মিশরে ভারতের রাষ্ট্রদূত নিযুক্ত হন) লিখেছেন যে নেতাজি তাঁকে একটি 'সব ভারতীয়ের কাছে গ্রোহনযোগ্য' অভিবাদন ঠিক করতে বলেন। আবিদ প্রথমে ভেবেচিন্তে এসে বলেন যে 'হ্যালো' বেশ ভালো একটি অভিবাদন। নেতাজি দিয়েছিলেন এক ধমক ! ব্যর্থ হয়ে আবিদ আবার চেষ্টা করতে থাকেন, এবং তখন তাঁর নজরে আসে যে আজাদ হিন্দ ক্যাম্পে অনেকেই বলে 'জয় রামজি কি '। এই ধর্মীয় অভিবাদনকে ভিত্তি করেই আবিদ প্রথমে লেখেন 'জয় হিন্দুস্তান কি '; কিন্তু সেটা বড্ড বড় শোনাচ্ছিল বলে ছোট করতেই 'জয় হিন্দ' একটি আশ্চর্য ধ্বনিমাধুর্য নিয়ে চলে আসে। নেতাজিও খুশি হন।সেই শুরু, আজও তার জনপ্রিয়তা অম্লান

অনেকেই জানেন না যে ভারতের জাতীয় সঙ্গীত হিসেবে 'জন গণ মন' প্রথম আন্তর্জতিক মঞ্চে পরিবেশিত হয় ১৯৪২এ জার্মানির হামবার্গে। নেতাজি ভারত ও ভারতীয় সংগ্রাম সম্পর্কে একটি আন্তর্জাতিক কনফারেন্স'র আয়োজন করেছিলেন। আমন্ত্রিত ছিলেন জার্মানিতে বসবাসকারী নামকরা লোকজন ও বিদেশী কূটনীতিবিদরা। সেখানেই প্রথম হামবার্গের রেডিও অর্কেস্ট্রা 'জন গণ মন' পরিবেশন করেন (youtube ভিডিও আছে ) ৬,৭। ক্ষী স্বামীনাথনের স্মৃতি কথায় আছে যে গানটির সর্বভারতীয় appeal নেতাজির বিশেষ পছন্দ ছিল।তবে যেহেতু মূল গানটি সাধুভাষায় লেখা তাই  নেতাজি দক্ষিন-পূর্ব এশিয়ায় যাবার পরে গানটি বাংলা থেকে সহজ হিন্দুস্তানিতে অনুবাদিত হয় । 'সাব সুখ চৈন কি বারখা বারসে' রচনা করেন আবিদ হাসান ও মুমতাজ হুসেইন এবং সুর দেন ক্যাপ্টেন রাম সিংহ ঠাকুর। স্বাধীন ভারতের ইতিহাসে এ এক উল্লেখযোগ্য অবদান।

১১ই সেপ্টেম্বর, ১৯৪২। হামবার্গে জার্মান-ভারত সোসাইটির উদ্বোধনে নেতাজি। এখানেই প্রথম আনুষ্ঠানিক ভাবে 'জন গন মন' জাতীয় সংগীত হিসেবে পরিবেশিত হয়।  


ভাষা ও লিপি :
ভাষা নিয়ে নেতাজির বৃহৎ চিন্তাভাবনায় কিছু আলোকপাত করা যাক । যেমন, 'আজাদ হিন্দ' পত্রিকা। জার্মানির ফ্রি ইন্ডিয়া সেন্টার থেকে ইংরেজি ও জার্মান দুই ভাষায় প্রকাশিত হত (আজ নেতাজি রিসার্চ ব্যুরোতে সংখ্যাগুলি সংরক্ষিত)।তবে আরো গুরুত্বপূর্ণ ছিল আজাদ হিন্দ রেডিও। সাতটি ভারতীয় ভাষায় দৈনিক সম্প্রচার চলত - হিন্দুস্তানী, বাংলা, তামিল, তেলুগু, গুজরাটি, ফার্সি আর পুশতু আর নেতাজির ইংরেজি আর হিন্দুস্তানি ভাষণ সঙ্গে সঙ্গে তামিলে অনুবাদিত হয়ে পুনঃপ্রচারিত হত ৮,৯।যেমন প্রভিশনাল সরকারের ঘোষণা পত্র ইংরিজি, হিন্দুস্তানি ওঃ তামিল ভাষায় প্রচারিত হয়েছিল । হিসেবটা সোজা - সবার ভাষাকে সম্মান না করলে একসঙ্গে সংগ্রাম হবে কি করে? প্রকৃত নেতার এই বৈশিষ্ট্য - কাউকে দূরে ঠেলে দেন না, সবাইকে নিয়ে চলার চেষ্টা করেন।

তবে শুধু ভাষা নয়, স্বাধীন ভারতে কি ধরণের লিপি ব্যবহার হবে তা নিয়েও নেতাজি পরিকল্পনা করেছিলেন। দেবনাগরী ও আরব-ফার্সি দুই লিপি উপকারিতা স্বীকার করেও তিনি কংগ্রেস সভাপতি রূপে তাঁর বিখ্যাত হরিপুরা কংগ্রেস ভাষণে একটি অভিনব প্রস্তাব করেছিলেন - বলেছিলেন যে রোমান লিপিতে হিন্দুস্তানী একটি সর্বভারতীয় মাধ্যম হতে পারে ১০। এই ব্যাপারে নেতাজির ওপর আধুনিক তুরস্কের জাতির জনক মুস্তাফা কেমাল আতাতুর্ক'র প্রভাব লক্ষণীয় । ১৯২০র দশকে একই ভাবে আতাতুর্ক তুরস্কে রোমান লিপির জন্যে সর্বশিক্ষা অভিযান শুরু করেন । সুভাষ চন্দ্র আতাতুর্ক'র দেশ গঠনের নানারকম পরিকল্পনার গুনগ্রাহী ছিলেন। তাঁর লেখায় ও ভাষণে একাধিকবার এর প্রমান পাওয়া যায় ১১

সেনাবাহিনী - আজাদ হিন্দ ফৌজ

অস্থায়ী ভারত সরকারের সেনাবাহিনীর নামের সঙ্গে আমরা সবাই পরিচিত - ইন্ডিয়ান ন্যাশানাল আর্মি বা আজাদ হিন্দ ফৌজ । সঠিক সৈন্যসংখ্যা নিয়ে দ্বিমত থাকলেও তিনটি সামরিক ডিভিশনে আনুমানিক ৪৫ থেকে ৫০ হাজার আজাদী সৈন্য ছিলেন।এছাড়া আরো পাঁচ ডিভিশন সৈন্য প্রস্তুত হচ্ছিলেন। এর মধ্যে প্রথম INA ডিভিশন'র অধীনস্ত ছিল ইতিহাসে-বিখ্যাত গান্ধী ব্রিগেড, নেহেরু ব্রিগেড ও আজাদ ব্রিগেড ১২,১৩। দেশীয় আন্দোলনের সঙ্গে সংযোগ দেখাতে সদা -আগ্রহী নেতাজি তাঁর প্রধান ব্রিগেডেদের নামকরণ করেছিলেন দেশের সবচেয়ে জনপ্রিয় তিন নেতার নামে #। 

উল্লেখযোগ্য ভাবে কোন 'সুভাষ ব্রিগেড' ছিল না, যদিও প্রথম ডিভিশনের বাছাই করা সৈন্যদের নিয়ে গঠিত একটি গেরিলা রেজিমেন্ট নিজেদের 'সুভাষ ব্রিগ্রেড' বলতে ভালবাসতেন। শাহনওয়াজের স্মৃতিকথায় আছে যে নেতাজি এই নামকরণ বারণ করলেও 'সুভাষ ব্রিগ্রেড' এই ব্যাপারে সর্বাধিনায়কের নির্দেশ মানতে উৎসাহী ছিলেন না ১৩। চার ব্রিগেডই জাপানের ইমফল অভিযানে সাহসী সংগ্রাম করেন। বাহাদুর গ্রুপ নামে একটি কম্যান্ডো দল ছিল। মনিপুরের মৈরাং জাপানি ও আজাদ হিন্দ ফৌজের দখলে আসার পরে ১৪ই এপ্রিল ১৯৪৪ সেই দলের কর্নেল শওকত আলী মালিক সর্বপ্রথম স্বাধীন ভারতের মাটিতে দেশের পতাকা উত্তোলন করেন ১৪। আজ এই দিনটি 'মৈরাং দিবস' হিসেবে উদযাপিত হয়।

মৈরাংয়ে জাতীয় পতাকা উত্তোলন স্মরণে ফলক।  


তবে, আজাদ হিন্দের সবচেয়ে নামকরা উনিট'র নাম বোধয় ঝাঁসির রানী রেজিমেন্ট। লক্ষী স্বামীনাথন (পরে শাহগল) এবং জানকি নাহাপ্পা'র নেতৃত্বে গঠিত ~১০০০ মহিলা সেনাদল। মধ্যবিত্ত শ্রেণী থেকে কয়েকজন হলেও, মূলত এর সদস্যারা ছিলেন নিম্নবিত্ত রবার-প্লান্টেশনে কাজ করা তামিল পরিবারের মেয়ে ১৫। ১৮৫৭'র মহাবিদ্রোহের বীরঙ্গনা রানীর নামাঙ্কিত এই রেজিমেন্ট নেতাজির এক অনন্য পরিকল্পনা। দেশবাসীর ৫০% তো মহিলা; তাঁরা কেন স্বাধীনতা সংগ্রামে যোগ দেবেন না ? এই উপলব্ধি তাঁর জীবনে প্রথম আনেন তাঁর রাজনৈতিক গুরু দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন। মূল সূত্র সেই 'সবাইকে নিয়ে চলা '।

কাজটা অবশ্য সহজ ছিল না। জার্মান ও জাপানের মত ফ্যাসিস্ট গোঁড়া সরকারি চিন্তাভাবনায় এ ছিল অভাবনীয়। হিটলার যেমন সেনাবাহিনীতে মহিলাদের যোগ দেবার তীব্র বিরোধী ছিল ১৬।জাপানেরও কোনো মহিলা সেনাবাহিনী ছিল না ।কিন্তু, সুভাষ চন্দ্র এ বিষয়ে অনড়। দেশের স্বাধীনতা লড়াইয়ে মেয়েদের ডাইরেক্ট ভূমিকা থাকবেই। রানী অফ ঝাঁসি রেজিমেন্টকে জাপানিরা রসদ ও অস্ত্র দিতে বেঁকে বসায় সিঙ্গাপুরের ইন্ডিয়ান ইনডিপেনডেন্স লীগের প্রধান আত্তাভার য়েলাপ্পা এগিয়ে এসে সব ব্যবস্থা করেন  মাস সামরিক ও নার্সিং প্রশিক্ষণের পরে 'রানী'রা বর্মা ফ্রন্টের দিকে যাত্রা করেন । কিন্তু, ততদিনে যুদ্ধের মোড় ঘুরে গেছে। ইঙ্গ-মার্কিন সেনা ও বিমানবাহিনীর কাছে পর্যদুস্ত হয়ে জাপানি ও আজাদ হিন্দ ফৌজ পিছোতে বাধ্য হয়েছেন। রানীদের প্রধান কাজ হয় যুদ্ধে আহত আজাদ হিন্দ সৈন্যদের সেবা সুশ্রষা । বর্মা থেকে রিট্রিট করার সময়, যাতে তারা কোন বেশি বিপদে না পড়েন , তাই নেতাজি নিজে তাদের সঙ্গে বেশ কয়েক দিন হেঁটে বন জঙ্গল পাহাড় পেরিয়ে আসেন। আজ ও বহু ভারতীয় মহিলা ইতিহাসের সেই আশ্চর্য অধ্যায় থেকে অনুপ্রেরণা নিতে পারেন ১৫

রানী অফ ঝাঁসি রেজিমেন্টের কুচকাওয়াজে নেতাজি।  পাশে রেজিমেন্টের নেত্রী ক্যাপ্টেন লক্ষী স্বামীনাথন। 


আজাদ হিন্দ মেডেল ও আজাদ হিন্দ ব্যাঙ্ক
বীর সেনাদের সম্মান জানাতে বেশ কিছু মেডেল চালু করেছিলেন নেতাজি। রণাঙ্গনে সাহসিকতার জন্যে প্রদান করা শের-ই-হিন্দ (ভারতের বাঘ) এবং সর্দার-ই-জং (যুদ্ধে শ্রেষ্ঠ) মেডেল। ক্যাপ্টেন কুঁয়াল সিং ও ক্যাপ্টেন গনেশি লাল শের-ই-হিন্দ মেডেল দিয়ে সম্মানিত হন, শওকত মালিক ভূষিত হয়েছিলেন সর্দার-ই-জং ১৭
আজাদ হিন্দের মেডেল। শের-ই-হিন্দ ও সর্দার-ই-জঙ 


এছাড়া দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ায় বসবাসকারী যে সব ভারতীয়রা আজাদ হিন্দের অসামরিক কাজের নিরলস সংগ্রামী তাঁদের জন্যে ছিল সেবক-ই-হিন্দ মেডেল। যেমন, রেঙ্গুনের ব্যবসায়ী আব্দুল হাবিব মারফানী এবং শ্রীমতি বেতাই নিজেদের সব সম্পত্তি দেশের জন্যে দান করে দেন। নেতাজির অসাধারণ বাগ্মিতা ও আহ্বানে মুগ্ধ ভারতীয় সম্প্রদায় তাঁর হাতে আরো প্রায় কুড়ি কোটি টাকা তুলে দিলে ৫ই এপ্রিল, ১৯৪৪ প্রতিষ্ঠিত হয় 'ন্যাশনাল ব্যাঙ্ক অফ আজাদ হিন্দ' ^। জাপানিরা ব্যাপারটায় খুশি হয়নি, কিন্তু নেতাজি জাতীয় ব্যাপারে সবসময়ই কিছুটা দূরত্ব রাখতে চেষ্টা করতেন। জার্মানি ও জাপান থেকে তিনি যা আর্থিক সাহায্য নিতেন, সেটা জাতীয় ঋণ (ন্যাশনাল loan) হিসেবে নেওয়া হত , স্বাধীনতার পরে ভারত তা মিটিয়ে দেবে এই ছিল বোঝাপড়া। এক্ষেত্রে তিনি জাপানিদের জানিয়ে দিয়েছিলেন স্বাধীন ভারতের যে সব ভূখন্ড স্বাধীন হবে সেখানে প্রথম থেকেই আজাদ হিন্দ মুদ্রা চালু হবে, জাপানি ইয়েন নয় ১৮। এবং এই জন্যে টোকিওর টাঁকশালে মুদ্রিত হয়েছিল আজাদ হিন্দের নতুন টাকারsample নোট। এছাড়া জার্মানিতে মুদ্রিত হয়েছিল আজাদ হিন্দ সরকারের ডাকটিকিট। পরিকল্পনা ছিল যে ভারতের যে সব অঞ্চল থেকে ইংরেজ সরকার হটে যাবে সেখানে আজাদ হিন্দ সরকারের অসামরিক দপ্তর সঙ্গে সঙ্গে কাজকর্ম চালু করবে ১৯। অবশ্য, সমগ্র জাপান-অধিকৃত এশিয়ার সঙ্গে দৈন্দিন কাজকর্মে জাপানি সরকারের ডলার ব্যবহার করতেন আজাদ হিন্দ সরকার। যেমন, ১৯৪৪এ সিঙ্গাপুরের রামকৃষ্ণ মিশনের boys home 'বাল ভবন' নির্মাণে নেতাজি ৫০০০০ ডলার দান করেন ২০
'ন্যাশনাল ব্যাঙ্ক অফ আজাদ হিন্দ' নিজের সম্পত্তি দান করা আব্দুল হাবিব মারফানী 
আজাদ হিন্দ সরকারের পরিকল্পিত টাকার নোট  


আজাদ হিন্দ সরকারের অবশ্য সেভাবে কোনো ভারতীয় ভূখন্ড রাজ্যত্ব করতে পারেননি। জাপান আনুষ্ঠানিকভাবে আন্দামান ও নিকোবর দ্বীপপুঞ্জ নেতাজির হাতে তুলে দিয়েছিল ; নামকরণ হয়েছিল 'শহীদ'' ও 'স্বরাজ'। কিন্তু, আসল প্রশাসন জাপানি কমান্ডারদের হাতেই থেকে গিয়েছিল, এবং তাদের সন্দেহবাতিক ও অত্যাচারে আন্দামানবাসিরা অতিষ্ট ছিলেন। । আজাদ হিন্দ এই নিয়ে বারবার প্রতিবাদ করলেও তেমন ফল হয়নি ২১

পোর্ট ব্লেয়ারে আজাদ হিন্দের পতাকা উত্তোলন, ৩০শে ডিসেম্বর, ১৯৪৩।


ক্যাবিনেট:
এই বিশাল সংগ্রামের হৃদয়-কেন্দ্র ছিল আজাদ হিন্দ ক্যাবিনেট। নেতাজির নিজস্ব মন্ত্রিসভা ও উপদেষ্টাগণ।
ক্যাবিনেটে সদস্য ছিলেন -
সুভাষ চন্দ্র বসু - রাষ্ট্রপ্রধান, প্রধানমন্ত্রী, যুদ্ধ ও বিদেশ মন্ত্রক । **
লেঃ কর্নেল এ সি চ্যাটার্জি (পরে এন. রাঘবন) - অর্থ মন্ত্রক ।
ডঃ: লক্ষী স্বামীনাথন - মহিলা বিষয়ক মন্ত্রক (minister for women affairs )
এ এম সহায় - প্রধান সচিব
এস এ আয়ার - প্রচার ও জন সংযোগ মন্ত্রক।
রাসবিহারী বসু - সর্বোচ্চ উপদেষ্টা (আজাদ হিন্দের সংগ্রাম এবং পুরোনো বিপ্লবীরা যেন একই পথের পথিক)
করিম গিয়ানি , জন থিবি , দেবনাথ দাস, সর্দার ইশার সিংহ, ডি.এম. খান, আত্তাভার য়েলাপ্পা - বর্মা , থাইল্যান্ড, সিঙ্গাপুর এবং হংকং থেকে উপদেষ্টা।
লেঃ কর্নেল জে কে ভোঁসলে , লেঃ কর্নেল গুলজারা সিং , লেঃ কর্নেল শাহ নাওয়াজ খান , লেঃ কর্নেল আজিজ আহমেদ, লেঃ কর্নেল মোহাম্মদ জামন কিয়ানি, লেঃ কর্নেল এন.এস. ভগত, লেঃ কর্নেল এহসান কাদির এবং লেঃ কর্নেল এ.সি লোগানাথান - আজাদ হিন্দ ফৌজের প্রতিনিধি।
এ এন সরকার - আইন বিষয়ক উপদেষ্টা ২২,+
আজাদ হিন্দ ক্যাবিনেট, সিঙ্গাপুর, ১৯৪৩/৪৪.


যেটা বলার অপেক্ষা রাখে না তা হল ক্যাবিনেট গঠনেও ভারতের সব সম্প্রদায় ও প্রদেশের সুস্পষ্ট উপস্থিতি। এবং শুধু উচ্চতম পর্যায়েই নয়। ব্রিটিশ ইন্ডিয়ান আর্মির ধর্ম- ও জাত-ভিত্তিক গঠনের সম্পূর্ণ বিপরীত দিকে গিয়ে আজাদ হিন্দ ফৌজের ক্ষুদ্রতম উনিটেও সব ভারতীয়রা জাত ধর্ম নির্বিশেষে থাকবেন, এই প্রতিদিনের-জাতীয়তাবাদই ছিল নেতাজির আদর্শ ও লক্ষ্য। এর ফলাফল বর্ণনা করেছেন আবিদ হাসান, '' আমাদের মধ্যে ছিলেন বালুচিরা, যেমন ছিলেন অসমীয়া, কাশ্মীরি আর মালায়লীরা, পাঠান এবং শিখ, আর গুজরাটিরা। ভারতের প্রতিটি অঞ্চলের অধিবাসী ছিলেন, ছিলেন প্রতি ধর্ম ও জাতের লোকজন, এবং বড় ডিভিশন থেকে শুরু করে সবচেয়ে ছোট পল্টনের মধ্যেও সবাই হাতে হাত মিলিয়ে কাজ করতেন । এইভাবে প্রত্যেকটি ইউনিট হয়ে দাঁড়িয়েছিল ভারতের একতার প্রতীক।'' ২৩

আবিদ যোগ করতে ভোলেননি, ''আমাদের সবার কিন্তু নিজ নিজ ধর্ম এবং নিজস্ব ভাষা ছিল। কিন্তু, রাজনৈতিক লক্ষে আমরা ছিলাম এক, প্রতিজ্ঞাবদ্ধ এবং অবিভাজ্য ।'' নেতাজি তাঁদের কাউকেই নিজের ধর্ম, সংস্কৃতি, ভাষা ত্যাগ করতে বলেননি। তবে এই সব পরিচয়ের উর্ধে যে দেশের পরিচয়(identity) সেই পরিচয়ের জন্যে একত্র হতে বলেছিলেন। জাতীয় ঐক্যের ব্যাপার সবার ওপরে এবং সেখানে তিনি অনমনীয়। যেমন, রেঙ্গুনের ধনী দক্ষিণ ভারতীয় চেট্টিয়ার সম্প্রদায় ছিলেন আজাদ হিন্দ সরকারের বড় পৃষ্টপোষক। তাঁদের প্রধান মন্দিরে official visit করলে আর্থিক সমর্থন আরো বাড়বে, এটাই অনুমেয়। নেতাজি কিন্তু স্পষ্ট জানিয়ে দেন যে মন্দিরের পুরোহিতগণ যদি তাঁর ক্যাবিনেটের হিন্দু ও ও-হিন্দু সকল মন্ত্রীকে মন্দিরে প্রবেশ করতে দেন তবেই তিনি যাবেন! আমরা- ওরা কোনোমতেই চলবে না। শেষ পর্যন্ত চেট্টিয়ার মন্দির কর্তৃপক্ষ সবাইকে আমন্ত্রণ জানান। হিন্দু-মুসলমান-শিখ-ক্রিস্টান সকল ভারতীয় মিলে সেদিন এক আশ্চর্য জনসমাগম হয়েছিল ২৪

মনে রাখা আবশ্যক, নেতাজি কিন্তু ভগৎ সিং, চদ্রশেখর আজাদ'র মত ঘোষিত-নাস্তিক, কিংবা জওহরলাল নেহরুর মত এগ্নস্টিক ছিলেন না। বিশ্বজননী-রূপে তিনি ঈশ্বরে বিশ্বাস করতেন। যুদ্ধের ভয়ানক ব্যস্ততার মধ্যে সারাদিনের কাজের শেষে অনেক রাত্রে সিঙ্গাপুরের রামকৃষ্ণ মিশনে গিয়ে মিলিটারি পোশাক ছেড়ে একটি সিল্কের ধুতি পরে ঘন্টা দুই ধ্যানমগ্ন হতেন। এই ছিল তাঁর 'রিচার্জ' ২৫। তবে সেটা তাঁর ব্যক্তিগত জীবন। আয়ার'র বর্ণনা থেকে আমরা জানতে পারি , '' একদিনের জন্যেও তাঁকে দেখিনি প্রকাশ্যে, জনসমক্ষে কোনো ধার্মিক আচরণ করতে। তাঁর কর্মই ছিল তাঁর ধর্ম, জীবনের প্রতি মুহূর্ত সংগ্রামের মধ্যে দিয়ে সেই ধর্ম তিনি পালন করতেন''২৬  
 এবং এই জীবনাদর্শ ও বিশ্বব্যাপী অভিজ্ঞতা থেকেই আসে আজাদ হিন্দ সরকারের ঘোষণাপত্রের শেষ অনুচ্ছেদে নেতাজির দ্যর্থহীন ঘোষণা - ''...[স্বাধীন ভারতের অস্থায়ী সরকার] প্রত্যেক ভারতবাসীকে নিজ নিজ ধর্ম পালন করার স্বাধীনতা দিতে অঙ্গীকারবদ্ধ , এবং সবাইকে সমান অধিকার ও সুযোগসুবিধা প্রদান করতেও দ্বায়িত্ববদ্ধ । বিদেশী ঔপনিবেশিক সরকারের দ্বারা প্রতিপালিত সব ভেদ, দূরত্ব ও তফাৎ'র উর্ধে গিয়ে প্রত্যেক ভারতীয়ের সুখ ও সমৃদ্ধির জন্যে সংগ্রাম করা এই সরকারের প্রথম এবং প্রধান কাজ হবে ।'' ২৭

একটি ঘটনা দিয়ে শেষ করি।' His Majesty's Opponent' বইতে পড়েছি।  ১৯৪৫র শেষে যখন লাল কেল্লায় তিন আজাদ হিন্দ অফিসারের মিলিটারি বিচার চলছে তখন কেল্লায় আরো অনেক অফিসার ও সৈন্য বন্ধি ছিলেন। গান্ধীজি একদিন তাঁদের দেখতে যান, কেমন আছেন খোঁজ নেন।  আজাদ হিন্দ সৈন্যরা গান্ধীজির কাছে নালিশ করেন যে 'নেতাজি আমাদের শিখিয়েছিলেন কোন ধর্ম সম্প্রদায়ের বিভাজন রাখবে না।  কিন্তু, এখানে ইংরেজরা সারাক্ষন আমাদের হিন্দু-মুসলমান ভাগ করতে উঠে পড়ে লেগেছে। দেখুন, সকালের চা ও দে দুটো আলাদা 'হিন্দু চা' আর 'মুসলমান চা' লেখা আলাদা কেটলিতে।' মুচকি হেসে গান্ধীজি দেন, 'ওরা দেয় তো দেয় তোমরা মানো কেন?  আজাদ হিন্দ সেনারা জবাব দেন, 'মানি না তো। আমরা দুই কেটলির চা মিশিয়ে নিয়ে তারপর খাই' . জোরে হেসে ওঠেন গান্ধীজি।  বলেন,  'দারুন এই তো চাই ' .

এই চিরন্তন সদুপদেশ আজ হয়তো ভারতবাসীর কাছে বেশি করে প্রাসঙ্গিক।

 সদ্য মুক্তিপ্রাপ্ত আজাদ হিন্দ অফিসার ও সেনারা গান্ধীজিকে জন গন মন গেয়ে শোনাচ্ছেন। বেহালা বাজাচ্ছেন ব্যান্ডমাস্টার  ক্যাপ্টেন রাম সিং ঠাকুর। সম্ভবত লালকেল্লায়। ১৯৪৫/৪৬

------------- ---------------
প্রকাশিত - https://www.facebook.com/groups/1803711656387813/permalink/3230153960410235

টিকা
*সিঙ্গাপুর ছেড়ে যাওয়ার কয়েকদিন আগে নেতাজি তাঁর বিশ্বস্ত অফিসার সিরিল জন স্ট্রেসিকে নির্দেশ দেন, আজাদ হিন্দের শহীদ সৈন্যদের জন্যে একটি স্মৃতিস্তম্ভ তৈরী করতে হবে। অল্প কয়েকদিনেই মধ্যেই সিঙ্গাপুরের সমুদ্রতটে স্ট্রেসি যে সৌধ নির্মাণ করেন তাতে খোদাই করা ছিল এই motto। কিন্তু, চরম অনৈতিকভাবে বিজয়ী মিত্রশক্তি সেই সৌধ ডিনামাইট দিয়ে উড়িয়ে দেয়! বহু দশক পরে সিঙ্গাপুরে বসবাসকারী কয়েকজন ভারতীয় একটি আধুনিক সৌধ করেছেন ; আরেকটি প্রতিরূপ আছে কলকাতার নেতাজি ভবনে।

গান্ধীজি প্রসঙ্গে বলা অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক যে স্বাধীন ভারত কোনোদিন সরকারিভাবে তাঁকে 'জাতির জনক' উপাধি দেয়নি। এই সম্মানের উৎস নেতাজি সুভাষ চন্দ্র বসু'র আজাদ হিন্দ রেডিও ভাষণ(৬ই জুলাই, ১৯৪৪)। শুধু তাই নয়, পুনার জেলে কস্তুরবা গান্ধীর মৃত্যর পরে বেতার ভাষণে নেতাজি সেই অসামান্যা নারীকে 'mother of the Indian people' বলে অভিহিত করেন।

^ সব অনাবাসী ভারতীয় যে টাকা পয়সা দিতে অতটা উৎসাহী ছিলেন না। শেষ পর্যন্ত আজাদ হিন্দ সিদ্ধান্ত নেয় যে অনিচ্ছুকরা ১০% দিলেই হবে।

** তাহলে কি নেতাজি ভারতের প্রথম প্রধানমন্ত্রী? না , কারণ নেতাজি তাঁর ভাষণে নিজেই স্পষ্ট করে দিয়েছেন যে আজাদ হিন্দ হল 'অস্থায়ী সরকার ', এবং ভারত স্বাধীন হবার পরেই এই সরকারের কাজ শেষ। তারপরে কি সরকার গঠিত হবে তা ঠিক করবেন স্বাধীন ভারতের মানুষ।
+ জার্মানি, ইতালি, জাপান ও অক্ষশক্তি-সমর্থিত ৬টি সরকার আজাদ হিন্দকে স্বীকৃতি দিয়েছিল। আয়ারল্যান্ডের রাষ্ট্রপতি ইমন ডি'ভালেরা শুভেচ্ছা বার্তা পাঠিয়েছিলেন।



সহায়ক গ্রন্থ
১,২,৩ - Sugata Bose, His Majesty 's Opponent, 2011, Penguin Books p. 210, 257, 299
৪ - শিশির কুমার বসু, বসুবাড়ি, ১৯৮৫, আনন্দ পাবলিশার্স , পৃ.৮২-৮৩
৫, ৬ - Leonard Gordon, Brothers against the Raj, 1990, Rupa Publications, pp. 459-460; Bose, His Majesty 's Opponent, 2011, Penguin Books pp.210-211
৭ - https://www.youtube.com/watch?v=9Cn34HFZ8tc
৮, ৯ - Leonard Gordon, Brothers against the Raj, 1990, Rupa Publications, p. 454-455; Sugata Bose, His Majesty 's Opponent, 2011, Penguin Books p. 225, 245
১০ - Sugata Bose, His Majesty 's Opponent, 2011, Penguin Books p. 140; Crossroads, being the works of Subhas Chandra Bose 1938-40, published by Netaji Research Bureau, 1962, Asia Publishing House. pp.13-14
১১- Congress President: Speeches, Articles, and Letters January 1938–May 1939, p. 61; Hugh Toye, The Springing Tiger, Jaico Publishing House, p. 179.
১২, ১৩ - Leonard Gordon, Brothers against the Raj, 1990, Rupa Publications, p. 498; Sugata Bose, His Majesty 's Opponent, 2011, Penguin Books pp.251-252
১৪- Sugata Bose, His Majesty 's Opponent, 2011, Penguin Books p.275
১৫, ১৬ - Leonard Gordon, Brothers against the Raj, 1990, Rupa Publications, p. 496-497; Sugata Bose, His Majesty 's Opponent, 2011, Penguin Books p.246-247; William L. Shirer, Rise and Fall of the Third Reich, 1960, Arrow Books, p. 975
১৭ - https://en.wikipedia.org/wiki/Sher-e-Hind ; https://en.wikipedia.org/wiki/Sardar-e-Jung
১৮, ১৯ - Leonard Gordon, Brothers against the Raj, 1990, Rupa Publications, p. 510; Sugata Bose, His Majesty 's Opponent, 2011, Penguin Books p.272-73
২০- https://www.facebook.com/.../permalink/715524075604174/
২১ - Leonard Gordon, Brothers against the Raj, 1990, Rupa Publications, p. 502, Unto Him a Witness, SA Ayer, 1951, Thacker and Co Ltd, p. 249
২২ - Selected speeches by Subhas Chandra Bose, introduction by S.A. Ayer, Publications Division, Ministry of Information and Broadcasting, Government of India. pp. 219-220; Sugata Bose, His Majesty 's Opponent, 2011, Penguin Books p.255
২৩-Sugata Bose, His Majesty 's Opponent, 2011, Penguin Books pp.281-82
২৪ -Sugata Bose, His Majesty 's Opponent, 2011, Penguin Books p.256
২৫-Leonard Gordon, Brothers against the Raj, 1990, Rupa Publications, p.502;
Sugata Bose, His Majesty 's Opponent, 2011, Penguin Books p.253
২৬- Unto Him a Witness, SA Ayer, 1951, Thacker and Co Ltd, p. 269
২৭-Selected speeches by Subhas Chandra Bose, introduction by S.A. Ayer, Publications Division, Ministry of Information and Broadcasting, Government of India. pp. 218-220
------------------ ------------------

 স্কুল খুলুক, সঙ্গে হাওয়া বাতাস খেলুক ক্লাসঘরে ('এই সময়' সংবাদপত্রে প্রবন্ধ -  ২২শে সেপ্টেম্বর, ২০২১)      সোজাসাপ্টা অপ্রিয়   সত...