Sunday, May 31, 2020

পশ্চিমবঙ্গের করোনা লড়াই - 
মে মাসের পরিসংখ্যান বলছে উন্নতি করেছে, কিন্তু  ....
(করোনা বিজ্ঞানের খুচরো খবর - ১০)

আপনাদের হয়েছে কিনা জানিনা, কিন্তু আমি সকাল সন্ধ্যে টিভিতে ওই 'ডাকাত পড়েছে রে '-মার্কা করোনা'র খবর দেখে (দেখিও না, কিন্তু কানে তো ঢুকছে) বিরক্ত হয়ে গেছি।এমন করে হেঁড়ে গলায় হেডলাইনে বলে যেন কোন করোনা আক্রান্ত একজন দাগী অপরাধী! আর তারপর যেন কম্পিটিশন - কে কত সংখ্যা বলতে পারল আজ। যেন আইপিএল'র খেলা হচ্ছে, রান বাড়ছে।ব্যাস, হয়ে গেল, আর কোন তথ্য নিয়ে আলোচনা নেই।আর সেই অবৈজ্ঞানিক horror story-type উপস্থাপনা দেখে সবাই ভয়ে জুজুবুড়ি হয়ে শুরু করল 'কি হবে কি হবে' ! ভয়ে হার্টফেল করে যাবার জোগাড় !   লক্ষ্য করে দেখবেন, এর জন্যে কিন্তু লোকজন  বেশ বেশি ভয় পেয়ে আছেন।

তাই ভাবলাম,  রাজ্যের covid পরিস্থিতির তথ্য একটু খুঁটিয়ে দেখা যাক। যতটা সম্ভব চলিত ভাষায় লিখে আপনাদের সঙ্গে শেয়ার করা যাক। তথ্য সব তো পাবলিক ডোমেনেই আছে। অবশ্য, আমি স্টাটিস্টিশান নই, এপিডেমিওলোজিস্টও নই, সেই M.Scর সময়ে এপিডেমিওলজি পড়েছিলাম বটে, এখন কিছুটা ভুলেও গেছে।  তাই বেশি ডিটেলে যাব না। কিন্তু কিছুটা তো বের করে সহজভাবে আপনাদেরও সঙ্গে শেয়ার করাই যায়। তারপর বিশ্বাস-অবিশ্বাস-যুক্তি-তর্ক-গপ্পো, আমার লেখার মধ্যে আমরা- ওরা রাজনীতি খোঁজা আপনার ব্যাপার। সে করবেন করুন, আমার কিছু বলার নেই ।আমার 'নেই কাজ তো খই ভাজ' কাজ হল পশ্চিমবঙ্গের covid-১৯ সংক্রান্ত কিছু তথ্য  শেয়ার করা।

১. গত মাসের মাঝামাঝি অভিযোগ ওঠে যে রাজ্যে টেস্ট অনেক কম হচ্ছে। এই নিয়ে প্রচুর চাপানউতোর চলে, রোগ চাপার অভিযোগ আসে, অকেজো কিট সাপ্লাই হয়েছে সেটা কিছুটা স্বীকারও হয়,  '১৮ না ৫৭' নিয়ে চেঁচামিচি চলে, ইত্যাদি। তারপর এক মাস কেটে গেছে। দেখা যাচ্ছে, ৩০শে  এপ্রিল অবধি রাজ্যে টেস্ট হয়েছিল ১৬,৫২৫, আর আজ ৩০শে মে টেস্ট হয়েছে ১ লক্ষ ৮৫ হাজারের কিছু বেশি। এবং যেখানে এক মাস আগে টেস্ট হত দিনে ৪০০-৫০০, সেখানে আজ ৯,০০০র বেশি পরীক্ষা হচ্ছে (ছবি ১)। এমনকি উমপুন্ সাইক্লোনের দিনেগুলিতেও ৪-৫ হাজার পরীক্ষা হয়েছিল।উন্নতি অনস্বীকার্য।
ছবি ১: ৪ঠা মে থেকে ৩০শে মে অবধি রাজ্যে প্রতিদিন কত করে করোনা পরীক্ষা হচ্ছে।  
ল্যাবের সংখ্যাও বেড়েছে।  ৪ঠা মে ১৬টি ল্যাব টেস্ট করছিল, আর আজ করছে ৪০টি।  এদের মধ্যে সিংহভাগ সরকারি।এবং তাই, গত মাসে যেখানে পশ্চিমবঙ্গে টোটাল টেস্টের সংখ্যা প্রায় সব রাজ্যের তুলনায় কম ছিল, আজ টেস্টের পরিসংখ্যানে এই রাজ্য চড়চড় করে ওপরের সারিতে উঠে এসেছে  (ছবি ২)। প্রসঙ্গত বলি, গত মাসে যখন কয়েকজন বন্ধুকে বলেছিলাম যে কম টেস্ট হচ্ছে bad science and bad public relations তখন তারা বেশ চোটে গেসল।  আজ এই প্রশংসনীয় উন্নতি দেখলে জানি তাদেরও ভালো লাগবে। 
ছবি ২: বিভিন্ন রাজ্যে সব মিলিয়ে কত করোনা পরীক্ষা হয়েছে।  

২. এর সুফল ও পেয়েছেন  রাজ্যবাসী।  কারণ, গত এক মাসে positive/test ratio (অর্থাৎ কটা টেস্ট হল আর তার মধ্যে কটা পসিটিভ এল ) ৫.০১% থেকে নেমে হয়েছে ২.৬৪% (ছবি ৩). এর থেকে দুটি ব্যাপার conclude করা যেতে পারে।  এক, আগে  মূলত রুগী (এবং গুরুতর অসুস্থ রুগী) এবং তাঁর কাছাকাছি যাঁরা আছেন তাদের পরীক্ষা হচ্ছিল।  তাই পসিটিভ বেশি ছিল। কিন্তু,  এখন আক্রান্ত খোঁজার জন্যে টেস্ট আরো বাড়ানো হয়েছে এবং খুব সম্ভবত মহারাষ্ট্র, গুজরাটের ও দিল্লীর মত এখনো এখানে ভাইরাস  সমাজে খুব বেশি ছড়িয়ে পড়েনি। তাই, অনেকের জ্বর সর্দি কাশি হলেও টেস্ট করলে দেখা যাচ্ছে তিনি নতুন করোনা ভাইরাস দ্বারা আক্রান্ত নন, রেসাল্ট নেগেটিভ আসছে আর ওই ratio কমে যাচ্ছে।
ছবি ৩: পশ্চিমবঙ্গে কত টেস্ট হয়েছে তার মধ্যে করোনা আক্রান্ত (পসিটিভ) ক'জন?  মে মাসের হিসেবে। করোনা আক্রান্তের % বেশি হলে গ্রাফ উর্ধমুখী, কমতে থাকলে নিম্নগামী। 

৩. উল্লেখযোগ্য যে মে মাসের গোড়ায় রাজ্যের এই ratio ভারতের গড় ratioর থেকে  বেশি ছিল।   কিন্তু মাসের ১৪-১৬ তারিখ নাগাদ থেকে তা কমেতে শুরু করে এবং আজ সেটা ন্যাশনাল গড়ের তুলনায় অনেকটাই কম -২.৬৪% vs ৬.৫% (ছবি ৪) ।
ছবি ৪:  পশ্চিমবঙ্গে আর ভারতে কত টেস্ট হয়েছে তার মধ্যে করোনা আক্রান্ত (পসিটিভ) ক'জন?  মে মাসের হিসেবে। করোনা আক্রান্তের % বেশি হলে গ্রাফ উর্ধমুখী, কমতে থাকলে নিম্নগামী। 

শুধু তাই নয়, বেশি পরীক্ষা হবার ফলে গত একমাসে এই রাজ্যের tests per million (অর্থাৎ প্রতি দশ লক্ষ জনসংখ্যার কতজনের টেস্ট হয়েছে) সেটাও লাগাতার বৃদ্ধি পেয়েছে (ছবি ৫)।  সোজা কথায়, পশ্চিমবঙ্গের তুলনায় ভারতের অনেক রাজ্যে করোনা-আক্রান্ত  সংখ্যা বেশ বেশি, এবং পশ্চিমবঙ্গে 'খুব কম পরীক্ষা হয়েছে তাই আক্রান্তের সংখ্যা পাওয়া যাচ্ছে না' এই অভিযোগ আর আগের মত অতটা খাটে না।  অবশ্য, এর মধ্যে কিছু টেস্ট আছে যেগুলি যাঁরা আক্রান্ত তাঁদের re-টেস্ট করার সময় করা হয়েছে। শুনেছি, চিকিৎসাধীন থাকার সময় দুটি টেস্ট করা হয়।কিন্তু exact re-test সংখ্যা আমার পক্ষে জানা সম্ভব নয়। যাই হোক, এতে কোন সন্দেহ নেই যে আগের থেকে অনেক বেশি টেস্ট হয়েছে এবং তা সত্ত্বেও এই পরিসংখ্যান রাজ্যের পক্ষে আশাব্যাঞ্জক।

ছবি ৫: প্রতি ১০ লক্ষ্য জনসংখ্যায় কতজনের করোনা পরীক্ষা হল? এই রাজ্যের মে মাসের হিসেবে।উন্নতি করেছে।   

৪. বিজ্ঞানী, টেস্ট সেন্টারের কর্মী, ডাক্তার, চিকিৎসাকর্মী, কর্পোরেশনের কর্মী (যাঁরা রোজ এখন বাড়ি-বাড়ি গিয়ে খোঁজ নিচ্ছেন) - এঁদের সবার যৌথ প্রচেষ্টা যে গত মাসের 'পথ ভোলা পথিক' attitude থেকে পশ্চিমবঙ্গকে ফিরিয়ে এনেছে তা অবশ্যই প্রশংসনীয়। তবে, এতে আত্মতুষ্টি'র কোন কারণ নেই। তার একটি কারণ  - রাজ্যের tests per million বাড়লেও অন্য অনেক রাজ্যের তুলনায় তা এখনো কম (ছবি ৬)।
ছবি ৬: প্রতি ১০ লক্ষ্য জনসংখ্যায় কতজনের করোনা পরীক্ষা হল? সব রাজ্যের পরিসখ্যান।   

এর একটা কারণ অবশ্য রাজ্যের জনসংখ্যা - আয়তনে ছোট রাজ্য হলেও, এবং জনসংখ্যা বৃদ্ধির হারে দেশের মধ্যে সবচেয়ে কম হলেও, মোট জনসংখ্যা'র বিচারে পশ্চিমবঙ্গ ভারতের চতুর্থ। তাছাড়া, বেশ কিছু রাজ্য টেস্ট বিষয়ে গোড়া থেকেই সচেতন ছিলেন, এবং তাই তাঁরা আজ tests per millionএ এগিয়ে। সে তো ভালোই। এক সূত্রে গাঁথা আমরা সবাই,  আর ভাইরাসের গতি-প্রকৃতি বুঝতে  সবার রেসাল্ট সবার কাজে আসছে - প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ ভাবে। কিন্তু, যতটা সম্ভব কম খরচে নিপুন ভাবে অনেক টেস্ট করে যেতেই হবে।  ভাইরাস কোথায় আছে সেটা দেখতে এই টেস্ট হল আমাদের 'চোখ'। এও মনে রাখতে হবে টেস্ট হল 'টেস্টিং এবং ট্রেসিং'র অন্তর্গত। epidemiologyর নিয়ম অনুযায়ী টেস্ট করলে কম সংখ্যক টেস্টেও একটি রাজ্য করোনা যুদ্ধে বেশি সফল হতে পারে - বেস্ট প্রমান এখন কেরলা।

৫. আচ্ছা, টেস্ট তো হচ্ছে - কিন্তু সংখ্যা তো বেড়েই চলেছে? রাজ্যে কতজন করোনা আক্রান্ত ? টা আমাদের সবারই একটা বড় প্রশ্ন।  এবং এই মিথ্যে-সোশ্যাল মিডিয়ার যুগে কতরকম গাঁজা যে ঘুরে বেড়াচ্ছে তার ইয়ত্তা নেই।  দেখুন,প্রথমেই বলে রাখা ভাল যে এই সংখ্যা সঠিক ভাবে কেউ জানে না , জানলে তো টেস্ট করতেই হত না। কিন্তু,বিজ্ঞানভিত্তিক কিছুটা আন্দাজ করা যায়।কোথা থেকে ? অনেকভাবে theoretical modeling করা যায়, কিন্তু একটা সোজা উপায় হল  করোনায় আক্রান্ত হয়ে কতজন মারা গেছেন সেই হিসেব থেকে।

প্রশ্ন ১:  দেশে যতজন আক্রান্ত  তাঁদের মধ্যে কত শতাংশ মারা গেছেন (করোনা-আক্রান্ত আর co-morbidity যোগ করে )? উত্তর - ২.০৫% . 
প্রশ্ন ২: সব রাজ্যে কি এই একই  শতাংশ প্রাণ হারিয়েছেন? উত্তর - না।  কোন কোন রাজ্যে ১% র কম লোক মারা গেছেন।  কোথায় সেই সংখ্যায় জাতীয় গড় ২% আশেপাশে, কোথাও ৩% র ওপরে। ব্যতিক্রম দুটি রাজ্য - গুজরাট এবং পশ্চিমবঙ্গ, যাঁদের দুজনেরই covid-19 mortality rate (i.e. death/positives) ৬% র বেশি।  গুজরাটে কি হয়েছে সেই আলোচনায় যাব কিনা, কিন্তু এই  রাজ্যের আরেকটা পরিসংখ্যান দিই - 

৪ঠা মে - রাজ্যে টোটাল আক্রান্ত ১২৫৯ জন, মারা গেছেন ১৩৩ জন।  mortality rate ১০.৫%. 
১১ই  মে - রাজ্যে টোটাল আক্রান্ত ২০৬৩ জন, মারা গেছেন  ১৯০ জন।  mortality rate ৯.২ %. 
১৮ই মে - রাজ্যে টোটাল আক্রান্ত ২৮৪৫ জন, মারা গেছেন  ২৪৪ জন।  mortality rate ৮.৬ %. 
২৫শে মে - রাজ্যে টোটাল আক্রান্ত ৩৮১৬ জন, মারা গেছেন  ২৭৮ জন।  mortality rate ৭.২ %. 
৩০শে মে (গতকাল)- রাজ্যে টোটাল আক্রান্ত ৫১৩০ জন, মারা গেছেন  ৩০৯ জন।  mortality rate ৬ %. 

তার মানে পশ্চিমবঙ্গের mortality rate একসময় আজব রকমের বেশি ছিল।  পৃথিবীর সব দেশের average mortality rateর দেড়গুণ! এ আবার হয় নাকি ? তাহলে কি 'পৃথিবীর সবচেয়ে ভয়ানক কোরোনাভাইরাস একমাত্র পশ্চিমবঙ্গেই এসেছে'? না  'এই রাজ্যের চিকিৎসা ব্যবস্থা সবচেয়ে সবচেয়ে সবচেয়ে খারাপ' ??!! এইসব আষাঢ়ে গপ্পো ফেলে দিন, কারন পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে, যবে থেকে টেস্ট সংখ্যার উন্নতি হয়েছে এই রাজ্যে মৃত্যুহারও উল্লেখযোগ্য ভাবে steadily কমেছে। কি ব্যাখ্যা দেবেন? সম্ভবত দুটি - এক, আগে পরীক্ষা মূলত রুগী (এবং গুরুতর অসুস্থ রুগী) এবং তাঁর কাছাকাছি যাঁরা আছেন তাদের টেস্ট হচ্ছিল; তাই positive to death conversion বেশি ছিল।  এখন সামাজিক লেভেলে টেস্ট বেড়ে যাওয়াতে (এবং যেহেতু এই অসুখের ৮০%র বেশি এমনিতেই সেরে যান, ৯০%র বেশি হাসপাতালের ধারেকাছেও যেতে হয় না - এটা ভুললে চলবে না ) করোনা'য় মৃতের টোটাল সংখ্যা বাড়লেও সেই rate নিম্নগামী। দুই,  তাছাড়া, একটি নতুন অসুখ এলে সেটার গতিপ্রকৃতি বুঝতে কিছুটা সময় তো লাগেই। স্বাভাবিক, এত ম্যাজিক নয় রে বাবা, মছলিবাবাও নয় ! তাই, মনে হয়, অনেক প্রতিকূলতা সত্ত্বেও রাজ্যের ডাক্তার ও স্বাস্থকর্মীরা এখন এই লড়াইয়ে আরো experienced হয়ে উঠেছেন। আমরা তাঁদের কাছে ঋণী।

৬. আচ্ছা, রাজ্যে ৬%ই বা কেন? এটাও তো এখনো যথেষ্ট বেশি । সত্যি, এর উত্তর আমার জানা নেই, আর তেমন খুঁটিয়ে পরিসংখ্যান দেখিনি।  তবে , একটা hypothesis দিতে পারি। যাঁরা মারা গেছেন তাঁদের ৬৫% কলকাতাবাসী। এদ্দিনে আমরা জেনে গেছি যে এই অসুখ মূলত বয়স্কদের জন্যে fatal, এবং কলকাতা শহরটা যে অনেকটা 'বৃদ্ধাশ্রম' হয়ে গেছে সেটা কি আমাদের অজানা ? এই সামাজিক পরিস্থিতির সঙ্গে করোনায় মৃত্যুর একটা যোগাযোগ থাকলে অবাক হবেন না।

৬. তাহলে এবার আগের প্রশ্নে ফিরে যাই।  রাজ্যে কতজন করোনা আক্রান্ত?  দেশের মৃত্যুহার ২.০৫% ধরলে  (৩০৯/২.০৫)x ১০০ = ১৫ হাজারের কিছু বেশি।  যদি রাজ্যের মৃত্যুহার ধরে হিসেবে করেন তাহলে (৩০৯/৬)x ১০০ = ৫১৫০ (যে সংখ্যা আজই অতিক্রান্ত হবে, সুতরাং হতে পারে না ) । তার ওপর মহামারীর হিসেবে ঠিক পাটিগণিতের সহজ পথে চলে না। তবে, এই দুই সংখ্যার মাঝামাঝি ধরলে বলতে হয় আজ অবধি হয়ত ১০ হাজার পশ্চিমবঙ্গবাসী আক্রান্ত হয়েছেন। এদের মধ্যে ৫০০০র কিছু বেশি সন্ধান পাওয়া গেছে টেস্ট করে, অনেকে কোয়ারেন্টাইন হয়েছেন, অনেকে হাসপাতালে।  বাকিদের দ্রুত খোঁজাই হল আসল কথা। কারন, তাঁদের মধ্যে ৭০%র বেশি জানেন ও না যে তাঁরা আক্রান্ত।  এবং তাই তাঁরা এই ভাইরাসের মূল ধারক-বাহক।  

৭. এই  বিষয়ে আরেকটা সংখ্যা দেখা যাক। প্রতিদিন কত টেস্ট হয়, এবং তাতে প্রতিদিন কতজন নতুন আক্রান্তের সন্ধান পাওয়া যায়? এই গ্রাফটা দেখুন (ছবি ৭) - Y axisএ positives/tests PER DAY. গ্রাফটা ওঠা-নামা করছে বটে (সেটা স্বাভাবিক, দিনকে দিন variation যে কোন বৈজ্ঞানিক তথ্যেই হয়ে থাকে; না হলেই সন্দেহজনক), কিন্তু মে'র প্রথমদিকে যত জন আক্রান্তের সন্ধান পাওয়া যেত ১০-১১র তারিখের পর থেকে একই সংখ্যার টেস্ট করলেও তার থেকে অনেক কম পাওয়া  গেছে। তার মানে রাজ্য কিন্তু রোগের ছড়িয়ে পড়া কিছুটা হলেও আটকেছে ।
ছবি ৭: প্রতিদিন কত টেস্ট এবং প্রতিদিন কজন নতুন করে আক্রান্ত।  মে মাসের পরিসংখ্যান।  কমছিল, কিন্তু এবার কি সাইক্লোন আর শ্রমিকদের ফেরায় উর্ধমুখী? 

আমার  ধারণা এই ratio আরো নিচে নামতো। বাধ সাধল দুটি ঘটনা - ঘূর্ণিঝড় উমপুন্ আর ক্লান্ত শ্রান্ত শ্রমিকদের অমানুষিক কষ্ট করে বাড়ি ফেরা। মানুষ বিপদের দিনে, খাবার-দাবার থাকার জায়গা, পকেটে পয়সা না থাকলে বাড়ি ফিরবেই; আমি-আপনি হলেও তাই করতাম। আর ঝড় তো আমাদের নাগালের বাইরে।  এই দুই  থেকে করোনা লড়াইয়ে যে ক্ষতি হল তার আন্দাজ সম্ভবত আমরা এই এখন বুঝতে শুরু করব।আশাকরি আমার এই লেখা যেন ভুল প্রমাণিত হয়, তবে লক্ষ্য করুন গ্রাফ কিন্তু আবার অল্প হলেও চড়তে আরম্ভ করেছে  .....অবশ্য এটাও  শুনেছি, যে অনেক জেলায় নতুন টেস্ট সেন্টার তৈরী হচ্ছে। খুবই প্রয়োজনীয় - শুধু কলকাতা-based টেস্টিং তো কমাতেই হবে।  অবশ্য, তার সঙ্গে সংখ্যাও বাড়বে।চিন্তা হওয়া স্বাভাবিক তবে, আঁতকে ওঠার কিছু নেই - দু মিনিট আগেই তো দেখলেন অন্তত আরো ৫০০০ আক্রান্তের সন্ধান পেতে হবে।

৮. জানি, এসব দেখে কেউ কেউ বলবেন এসব তথ্য ভুলভাল।  সেই ক্ষেত্রে তাঁরই প্রমানের দায়িত্ব কেন তথ্যগুলি ভুল, এবং তিনি অন্য কোন data source ব্যবহার করছেন। সে যে বলবে তার ব্যাপার। বিজ্ঞানের ছাত্র হিসেবে সব জিনিসেই আমার একটা healthy skepticism আছে (এই সন্দেহবাতিকের জন্যে আমার রাজনীতি-করা বন্ধুরা বেশ ক্ষেপে যায় ), এবং সারা পৃথিবীই যে নানা ভাবে 'গুপী' দিচ্ছে এটাও অনেকেই সন্দেহ করেছেন। কিন্তু, তাই বলে 'সব বাজে' বলে ফেলে দেব বা শুধু এই রাজ্য মিথ্যে আর সবাই যুধিষ্ঠির প্লাস হরিশ্চন্দ্র তা তো হয় না। তাহলে তো বলতে হয় 'সূর্য পৃথিবীর চারপাশে ঘোরে '।

৯. যাক সে কথা।  যেটা বলে শেষ করি - এর সঙ্গে যোগ হয়েছে লকডাউন চলবে না তুলে নেওয়া হবে এই নিয়ে নানা মতামত।  দেখুন, বেশি কথায় যাব না, কিন্তু ন্যাশনাল লেভেলে লকডাউন খুব যে আশাপ্রদ হয়নি সে তো ৬০০০-৭০০০-৭৫০০-৮০০০ সংখ্যাই বলে দিচ্ছে। কিন্তু, ভাইরাস না কমুক মানুষের রোজগার তলানিতে এসে ঠেকেছে। একটা ছোট্ট রেগুলার মাইনে-পাওয়া ক্লাস ছাড়া এটা সবার ক্ষেত্রে কম-বেশি সত্যি (তাদের ও পুরো মাইনে কতদিন আসবে একটু সন্দেহ আছে, টাকা তো অর্থনীতির-সাইকেলে ঘোরে। সেই সাইকেল বন্ধ হলে আসতেই থাকবে না কি?....) ৭০ দিন হতে চলল , কম তো নয়।  এই অবস্থায় আমরা সবাই 'গণশত্রু' আর 'অশনি সংকেত'র মাঝামাঝি পড়েছি ।  এবার কোন দিকে যাবেন? -

a) লক ডাউন উঠে গেল, রোজগারপাতি শুরু হল,  খাবার-দাবার বেটার হল, কিন্তু কোরোনাও বাড়তে আরম্ভ করল, b) লক ডাউন চলল আরো কয়েক সপ্তাহ বা মাস।  করোনা হয়তো কমল , কিন্তু রোজগার ? আর অনাহার? ...মনে রাখতে হবে, দুর্বল আধপেটা শরীরে রোগ সহজেই বাসা বাঁধে।  তাহলে? .....

অবশ্য আরেকটা option আছে।  তবে সে আর আমি নতুন কি বলব?  সদ্য নোবেলজয়ী বাঙালি অর্থনীতিবিদ এবং অন্যান্য এক্সপার্টরা যা বলছেন সেসব করলে তো খুবই ভাল হয়। .....

পুনশ্চ : একটা গল্প বলি, অনেকেই জানেন অবশ্য ।  ৩০০০ বছর প্রাচীন হোমারের মহাকাব্যে নায়ক উলিসিস'র জাহাজকে সমুদ্রের এমন একটা জায়গা দিয়ে যেতে হয়েছিল যার একদিকে ছিল ক্যারিবিডিস দৈত্য আর অন্যদিকে ছিল স্কাইলা দানব। উলিসিস পড়েছিল ঘোর বিপদে। কারণ,  স্কাইলাকে এড়াতে গেলে ক্যারিবিডিস জাহাজ ডুবিয়ে দেবে, আর ক্যারিবিডিসকে কাটাতে গেলে স্কাইলা ছোঁ মেরে কয়েকজন নাবিককে তুলে নিয়ে খেয়ে ফেলবে। সেখান থেকেই অমর হয়ে গেছে ইংরিজিতে phrase - between Scylla and Charybdis, between devil and the deep sea. উভয় সঙ্কট। ......আমাদের অবস্থা অনেকটা তাই।  ইশশ! ফেব্রুয়ারি মাসে যদি আমরা দেশের ২০টা এয়ারপোর্ট যদি বন্ধ করে দিতাম । .....

ভাল থাকবেন। আর ভাল করে মাস্কটা পড়বেন।  থুতনিতে নয়! ও আবার কি? হাতে হেলমেট ঝুলিয়ে বাইক চালাবার মত ....পাকামি !?

তথ্য:

https://www.covid19india.org/

https://www.wbhealth.gov.in/pages/corona/bulletin

https://ourworldindata.org/







Wednesday, May 20, 2020

কোরোনাভাইরাস - বিবর্তনের আশ্চর্য ফসল না গোপন অস্ত্র ?- দ্বিতীয় কিস্তি 


(আগের ব্লগের থেকে চলছে) ....

চন্দন: ৯৬% তো জেনেটিকালি বেশ ভালো মিল রে !

নন্দন: সে আর বলতে।  এই দিক ওই সব ভাইরাসদের বংশের ডালপালা (ছবি ১)।  লক্ষ্য কর, বাদুড়ের RaTG13 ভাইরাস কিরকম উহানের রুগীদের শরীরে যে নতুন কোরোনাভাইরাস পাওয়া গেসল ঠিক তার পাশেই। একদম নিকট আত্মীয়।
ছবি ১: বিটাকরোনা ভাইরাস বংশ। 
উহানের রুগীদের শরীর থেকে পাওয়া নতুন ভাইরাসের ঠিক পাশেই বাদুড়ের RaTG13 ভাইরাস। Zhou, P. et al (2020)  Nature. 579, 270-273 থেকে নেওয়া। 

চন্দন: তাহলে তো মিলেই গেল।

নন্দন:  না না।  অত অল্পতে বিজ্ঞানীরা সন্তুষ্ট হন না ।  পিকচার অভি বাকি হয়, মেরে দোস্ত। মনে আছে নিশ্চয়ই বললাম যে নতুন কোরোনাভাইরাসের জিনোমের সঙ্গে বাদুড়দের RaTG13 ভাইরাসের জিনোম ৯৬% মেলে, আর ২০০২র প্রথম সার্স ভাইরাসের সঙ্গে ৭৯% মেলে। ভালো কথা, তবে মনে রাখতে হবে এগুলো হচ্ছে পুরো জিনোমের জন্যে গড় বা অ্যাভারেজ সংখ্যা।  মানে, যদি নতুন ভাইরাস আর RaTG13 ভাইরাস দুজনের জিনোমের সাইজ হয় ১০০ নিউক্লিওটাইড তাহলে তাদের মধ্যে ৯৬টা নিউক্লিওটাইড এক , identical.

চন্দন: বুঝেছি। আর নতুন ভাইরাস আর প্রথম সার্স ভাইরাসের মধ্যে ৭৯টা নিউক্লিওটাইড মিলে যাবে।

নন্দন: হ্যাঁ , কিন্তু এবার প্রশ্ন হচ্ছে জিনোমের ওসব জায়গায় কি equally এই মিল থাকবে নাকি কোনো যায় ৯০%, কোনো জায়গায় ৬৫% হবে?  সেটা কিন্তু গড় দেখে বোঝা যাবে না।  একটু তলিয়ে দেখতে হবে।

চন্দন: হুম।  বুঝেছি। ডিটেলে অনেক জিনিস ধরা পড়ে।

নন্দন: ঠিক তাই।  এই গ্রাফটা দেখ (ছবি ২) ।  বেশ সুন্দর, তথ্যসমৃদ্ধ গ্রাফ এঁকেছে।  কি দেখাচ্ছে - নতুন কোরোনাভাইরাসকে ১০০% রেখেছে।  এবার x axis বরাবর দেখে যাচ্ছে অন্য ৪টি বাদুড়ের ভাইরাস আর ২০০২সার্স ভাইরাসের সঙ্গে এর জিনোমের কোথায় কতটা মিল।y axis এ % রেখেছে। সোজা জিনিস, একবার ভাল করে দেখ।  দেখ, ওপরের নীল লাইনটা (যেটা ৯০% র ওপরে চলছে সেটা হল নিকতম আত্মীয়  RaTG13. আর অন্য গোলাপি, খয়েরি, সবুজ হল অন্য বাদুড়ে ভাইরাস। আর লাল হল ২০০২-সার্স।  তাহলে একমাত্র   RaTG13 ছাড়া অন্যদের সঙ্গে কোথাও বেশি কোথাও কম মিল।  ৫৫% থেকে ৮০% র মধ্যে।
ছবি ২: নতুন করোনা র জিনোমের সঙ্গে অন্য ভাইরাল জিনোমের মিল অমিল। স্পাইক প্রোটিনের জিন সবার থেকে আলাদা।  Zhou, P. et al (2020)  Nature. 579, 270-273 থেকে নেওয়া। 

চন্দন: got it . কি সুন্দর গ্রাফটা !

নন্দন: দারুন, এগুলোই শিক্ষণীয়।  আমাদের ছাত্রদের শেখা উচিত, শুধু গাঁতালে আর কপি পেস্ট মারলেই চলে না। কিন্তু একটা জিনিস লক্ষ কর, গ্রাফে একটা জায়গা আছে যেখানে সবার সঙ্গে নতুন কোরোনাভাইরাসের খুব বেশি অমিল।  এমনকি RaTG13র সঙ্গেও একটু অমিল দেখা যাচ্ছে।

চন্দন: দেখেছি।  ওই যে একটা sharp নেমে যাচ্ছে x axis এ ২০০০০ আর ২৫০০০র মধ্যে।

নন্দন: exactly. এবার গ্রাফের ওপরে জিনোমের জিনগুলো সাজানো আছে দেখ।  বক্স বক্স করে।  ওই জায়গাটায় কোন প্রোটিনের জিন দেখছিস?  S বা স্পাইক প্রোটিন।

চন্দন: স্পাইক প্রোটিন মানে তো যেগুলো ওই পায়ার মত ভাইরাস থেকে বেরিয়ে থাকে।  যে ছবিটা রোজ নিউজ চ্যানেলে দেখায়।

নন্দন:  তা তো বটেই। আর ওই স্পাইক হল সেই চাবি যা দিয়ে নতুন কোরোনাভাইরাস ঝট করে আমাদের কোষের আসে ACE ২ তালা খুলে ঢুকে পড়ে। স্পাইক তো সব কোরোনাভাইরাসের থাকে।  কিন্তু নতুন করোনার স্পাইক বাকিদের থেকে আলাদা। উপমা দিলে কেমন হবে বল তো - কোন একটা পরিবারে সবাই মোটামুটি ফর্সা, কিন্তু মাঝারি হাইট ৫.৭- ৫.১০। আর একজন আছে সেও ফর্সা, কিন্তু তার হাইট ৬ ফুট ৩ ইঞ্চি।এটাই হল মজা।

চন্দন: কিন্তু। ..কিন্তু  .... ওর কাছেপিঠের আত্মীয় ভাইরাসে যদি ওইরকম স্পাইক প্রোটিনের জিন না থাকে তাহলে ওটা নতুন করোনা পেল কোথা থেকে?

নন্দন: এইটাই তো কথা। আর তো কোনো ভাইরাস দেখছি না।  তাহলে? এবং তখনই বিজ্ঞানীরা প্রশ্ন তুললেন - নিশ্চয়ই প্রকৃতিতে এমন কোন ভাইরাস আছে যার সঙ্গে এই স্পাইক মিলে যায়।  কিন্তু সেই ভাইরাসের জিনোম আমাদের ডেটাবেসে নেই।

চন্দন: এরকম হতে পারে?

নন্দন: কেন হবে না ? খুব বেশি চান্স।  পৃথিবীতে লক্ষ লক্ষ প্রাণী আছে, কয়েক কোটি ধরণের ব্যাকটেরিয়া আছে, যত ব্যাকটেরিয়া সম্ভবত তার ১০গুন্ ভাইরাস আছে।প্রকৃতির সম্ভার সুবিশাল।  গত কুড়ি বছরে বিজ্ঞানীরা কয়েক হাজার জিনোম সিকোয়েন্স করেছেন বটে, কিন্তু সে তো সিন্ধুতে বিন্দু।

চন্দন: দাঁড়া দাঁড়া।  এই তো দেখলাম বাদুড়ের RaTG১৩ র সঙ্গে ওই স্পাইক জিন ছাড়া খুব মিল।  আবার এখন বলছিস স্পাইক জিন আসবে আরেকটা অজানা ভাইরাস থেকে? একি একি ভাইরাস-ভাইরাস হাইব্রিড নাকি?

নন্দন: হা হা হা হা। অনেকটা ঠিকই ধরেছিস।  এবং এটাও ভাইরাসদের মধ্যে মাঝে মধ্যেই ঘটে। বিজ্ঞানীরা এঁকে বলেন antigenic shift .

চন্দন:  antigenic shift ? তাতে কি হয়?

নন্দন: ব্যাপারটা বেশ অভিনব। কি জানিস, ধর কোন একটা জন্তু আছে।  তার একই কোষে একই সময়ে দুটো আলাদা প্রজাতির ভাইরাস একসঙ্গে ঢুকে পড়েছে।ভাইরাস A আর ভাইরাস B.  just ঘটনাচক্রে এটা হয়ে গেছে। এবার তুই জানিস যে যে কোন কোষে একটা ভাইরাস ঢুকলে সে ওই কোষটাকে হাইজ্যাক করে ফেলে আর হুকুম দে শুধু নতুন ভাইরাস বানাতে।  ভাইরাল জিনোম, ভাইরাল প্রোটিন সব তৈরী হয়।  এবার এক্ষেত্রে কি ? দুটো ভাইরাস ঢুকেছে।  দুজনের প্রোটিন জিনোম তৈরী হচ্ছে একই কোষের মধ্যে।  এমনিতে হিসেবে মত সব ভাইরাস ঠিকঠাক প্যাক হবার কথা, Aর সঙ্গে B মিশে যাবে না।  কিন্তু, ওই মাঝে মাঝে একটু আধটু ভুল হয়ে যায়। A ভাইরাসের জিনোম একটা ছোট্ট অংশ টুক করে B ভাইরাসের জিনোমের সঙ্গে জুড়ে গেল।  একটা হাইব্রিড হয়ে গেল। ধর, এই হাইব্রিডের ৮৮% হল B ভাইরাস কিন্তু একটা ছোট্ট ১২% হল A ভাইরাস (ছবি ৩)।
ছবিটি ৩: Antigenic shift . দুটো আলাদা ভাইরাসের জিনোমের মধ্যে দেওয়া-নেওয়া দিয়ে এক নতুন ভাইরাসের সৃষ্টি। https://microbenotes.com/differences-between-antigenic-shift-and-antigenic-drift/ থেকে নেওয়া।  


চন্দন: যাহ সালা! কি করে হল?

নন্দন: বেশি বলব না।একে বলে homologous recombination. যারা মলিকিউলার বায়োলজি পড়ে তারা জানে। কেমন জানিস?  ধর, জেরক্সের দোকানে পাশাপাশি দু সেট কপি হচ্ছে।দুটোই ১০ পাতার, ৫০টা করে কপি হবে । টোটাল ১০০.   হয়ে গেলে দুটো সেট আলাদা আলাদা করে স্টেপল করে দেবে। এবার দোকানদার এটা করতে গিয়ে  ৪৮টা ঠিক করলেন, কিন্তু ২টো কপিতে এক সেটের ৩ নম্বর পাতা অন্য সেটে ভুল করে ঢুকিয়ে দিয়ে স্টেপল করে দিয়েছেন।

 চন্দন: এটা ভাল দিয়েছিস।

নন্দন: এটা অবশ্য আমি এক জায়গায় সেদিন পড়েছি। উপমাটা খুব ভাল লেগেছিল তাই মনে পড়ে গেল। তাহলে মোদ্দা কথা এমন হতে পারে।  আর রেজাল্ট হল একটা নতুন হাইব্রিড ভাইরাস তৈরী হয়ে যেতে পারে চট  করে।

চন্দন: আচ্ছা, এটা মানুষ বা অন্য প্রাণীতে হয়?

নন্দন: না ভাই। এক ডিম্বাণুতে দুজনের শুক্রাণু ঢুকে গিয়ে হাইব্রিড করে দিলে চাপ হয়ে যাবে।  ভাগ্যিস হয় না। এটা ভাইরাসদের ব্যাপার। ফিরে আসি আমাদের টপিকে - তাহলে প্রশ্ন হচ্ছে স্পাইক জিন কোন ভাইরাস থেকে এল? এইখানে বলে রাখি একটা জিনিস বিজ্ঞানীরা  আগে থেকেই আন্দাজ করেছিলেন - যে নতুন কোরোনাভাইরাস আদতে বাদুড় থেকে আসতে পারে কিন্তু সম্ভবত আরেকটা কোন প্রাণী জড়িত।  এরকম ভাবার কারণ ছিল।  ২০০২র সার্স ভাইরাস প্রথমে বাদুড় থেকে civet নামের ভামবেড়াল , আর তারপর civet থেকে মানুষে এসেছিল।  আর ২০১২র MERS ভাইরাস প্রথমে বাদুড় থেকে উট , আর তারপর উট থেকে মানুষে লাফ মেরেছিল।  তাছাড়া উহানের যে প্রাণী বাজার ডিসেম্বর মাসে অনেকে অসুস্থ হয়ে পড়ে সেখানে অনেক জন্তু জানোয়ার বিক্রি হলেও বাদুড় সেভাবে হয় না।  তাই বিজ্ঞানীরা নিশ্চিত ছিলেন আরেকটা কোনো প্রাণী আছে।

চন্দন: এই প্রাণীটা হচ্ছে প্যাঙ্গোলিন ? তাই তো ? কাগজে পড়েছি।
ছবি ৪: মালায়ান প্যাঙ্গোলিন। https://en.wikipedia.org/wiki/Sunda_pangolin#/media/File:Pangolin_borneo.jpg
নন্দন: হ্যাঁ, মালায়ান প্যাঙ্গোলিন, বৈজ্ঞানিক নাম Manis javanica (ছবি ৪) ।  প্রথম দিকে কিছু metagenomic search (ডিটেল তোর জানার দরকার নেই) করে বিজ্ঞানীদের মনে হয় প্যাঙ্গোলিনের মধ্যে যে ভাইরাস পাওয়া যায় তার সঙ্গে নতুন করোনার মিল অনস্বীকার্য।

চন্দন: আচ্ছা, একটা কথা বল।  এই ভাইরাসের জন্যে প্যাঙ্গোলিনের অসুখ করে না?

নন্দন: করে তো। সেটাই তো পরের ঘটনা।  গত বছর চীনের বন দপ্তর কিছু চোরাশিকারীকে  ধরেছিল যাদের থেকে ২৫টা মালায়ান পঙ্গোলিন পাওয়া গেসল।টেস্ট করে ১৭টার মধ্যে ভাইরাস পাওয়া গিয়েছিল। আর  কয়েক দিনের মধ্যেই,এই ১৭টা প্যাঙ্গোলিন একই রকম ফুসফুস-জনিত অসুখের সিমটম দেখায়।  দেড় মাসের মধ্যে ১৪টা প্যাঙ্গোলিন মরেও যায়।    সেই আক্রান্ত প্যাঙ্গোলিনদের ফুসফুস থেকে যে ভাইরাস পাওয়া যায় তার জিনোমকে নতুন করোনাভাইরাসের সঙ্গে মেলাতে গিয়েই জ্যাকপট! স্পাইক প্রোটিনের সঙ্গে ৯০% র বেশি মিল! এই গ্রাফটা দেখ (ছবি ৫)।  আগের মতোই, তবে এবার প্যাঙ্গোলিন ভাইরাসকে ১০০% (similarity 1) রেখেছে।  এবার x axis বরাবর দেখে যাচ্ছে অন্য ৪টি বাদুড়ের ভাইরাস, নতুন ভাইরাস আর ২০০২সার্স ভাইরাসের সঙ্গে এর স্পাইক প্রোটিনের জিনের কতটা মিল (similarity) । লাল লাইন হল নতুন কোরোনাভাইরাস।  অন্য লাইনগুলো অন্য ভাইরাস। লক্ষ্য কর, ১৪০০-১৫০০ nucleotide positionএ একটা জায়গা আসে যেখানে শুধু লাল লাইনটা মোটামুটি সিধে থাকে, বাকিগুলো ঝপ করে নেমে যায়।
ছবি ৫: নতুন কোরোনাভাইরাসের স্পাইক জীন কেবল প্যাঙ্গোলিন স্পাইক জিনের সঙ্গেই মেলে।  Xiao, K. et al (2020) Nature - online ahead of print থেকে নেওয়া 

চন্দন: দেখেছি।  কিন্তু এর মানে কি?

নন্দন: মানে হল একমাত্র নতুন কোরোনাভাইরাস (লাল লাইন) আর প্যাঙ্গোলিন ভাইরাস র স্পাইক জীন ওই জায়গায় মিলে যাচ্ছে।  বাকি অন্যদের ক্ষেত্রে ওই অঞ্চলটা আলাদা।

চন্দন: তো?

নন্দন: এটাই তো গোয়েন্দাগিরি রে।  সঙ্গে সঙ্গে প্রশ্ন আসে স্পাইক প্রোটিনের ওই জায়গাটার কাজ কি?

চন্দন: স্পাইক প্রোটিনের কাজ তো জানি।  মানুষের কোষে ACE২ প্রোটিনে আটকে যাওয়া।

নন্দন: সে তো বটেই।আগেই বলেছি,  স্পাইক হল চাবি আর ACE ২ হল তালা। কিন্তু এবার প্রশ্ন হচ্ছে, ওই ১৪০০-১৫০০nucleotide position  'চাবি' র কোন অংশ  নির্ধারণ করছে।  সামনে না পেছনে? যে জায়গাটা ভাইরাসে আটকে থাকে? না যেটা ACE২র সঙ্গে খাপে খাপ লেগে যায় ?

চন্দন: ওরে ব্যাটা! ...চুলচেরা বিশ্লেষণ।

নন্দন: একদম।  এটা তো বুঝতেই হবে। আর analysis করে ফল কি বেরোল? দেখা গেল , যে ওই স্পাইকের ওই অঞ্চলটা শুধু যে ACE২ র সঙ্গে bind করে তা নয়, ঠিক ওখানে যে কয়েক অ্যামিনো অ্যাসিড আছে তারা এই খাপে খাপ চাবি-তালা আটকে যাওয়া আর নতুন কোরোনাভাইরাসের আমাদের কোষে ঢুকে পড়ার ব্যাপারে অপরিহার্য।স্পাইকের এই অঞ্চলতার নাম হল Receptor Binding Domain (RBD).  মানে চাবি তো ভালো হতে পারে, একেবারেই চট করে খুলে যায়, আবার অত ভাল নাও হতে পারে, কয়েকবার প্রেসার দিলে তবে তালা খোলে।  কোন চাবি কেমন সেটা চাবির নাকের ডগার খাঁজ ব্যাঁকা শেপ সাইজের ওপর নির্ভর করে।  এখানেও তাই।

চন্দন: বুঝেছি ভাই।  তুই বলতে চাইছিস  অন্য ভাইরাসের  স্পাইক এমন যে ACE২ তালার খাপে খাপ লাগতে একটু মেহনত করতে হয়। কারণ ওদের RBDর অ্যামিনো অ্যাসিড'র তফাৎ আছে। কিন্তু, নতুন কোরোনাভাইরাস আর প্যাঙ্গোলিন ভাইরাসর স্পাইক এত RBDর অ্যামিনো অ্যাসিড এমন ভাবে fine-tuned যে এক সেকেন্ডে তালা খুলে যায়।

নন্দন: হ্যাঁ।  এবং সেই জন্যেই জিনিসটা এতো ছোঁয়াচে।  ২০০২র সার্স ভাইরাস মারাত্মক ছিল, কিন্তু কম ছোঁয়াচে। নতুন কোরোনাভাইরাস অতটা মারাত্মক নয় (৯৫% লোক সেরে যাবে), কিন্তু এই প্যাঙ্গোলিন-মার্ক RBDটা এমন পেয়েছে যে অনায়েসে কোষে ঢুকে পড়ছে।  তাই প্রচন্ড ছোঁয়াচে।

চন্দন: কি বজ্জাত রে!

নন্দন: ভালো, খারাপ, বজ্জাত ভদ্র ব্যাপারই নয় এটা।  ওইসব কথাগুলো মানুষের ব্যবহারের ক্ষেত্রে খাটে। বিবর্তন একটা বায়োকেমিক্যাল খেলা , যার কোনো বিচার বুদ্ধি নেই।  চলছে চলবে।  যাক সে কথা।  তাহলে এখন অবধি রিসার্চ করে কি জানা গেল? এমন একটা নতুন বিটা  করোনাভাইরাস পাওয়া গেছে যার জন্যে অনেকের বাজে রকমের নিউমোনিয়া হয়।  দুই, এর জিনোমের  সঙ্গে ২০০২র সার্স ভাইরাসের মিল ৭৯% কিন্তু বাদুড়ের একটি  কোরোনাভাইরাসের ৯৬% মিল। তিন, একটাই অঞ্চলে বাদুড় ভাইরাস আর নতুন ভাইরাসের মিল কম - স্পাইক প্রোটিনের জিনে।  চার, স্পাইক প্রোটিনের জিনের ভাল মিল পাওয়া গেল একটি প্যাঙ্গোলিন ভাইরাসের স্পাইক জিনের সঙ্গে।

চন্দন: বাবা! তাই বলছেন যে এটা মূলত বাদুড়ে ভাইরাসের মত, কিন্তু ওই একটা অঞ্চল প্যাঙ্গোলিন ভাইরাসের মত। আচ্ছা, বাদুড়ের ভাইরাস থেকে অসুখ হয়?

নন্দন: না, এবং সেটাই কথা।  শুধু বাদুড় ভাইরাস চলে এলে আমাদের মহামারী হত না। সম্ভবত antigenic shift হয়ে প্যাঙ্গোলিন ভাইরাস থেকে ওই স্পাইকজীনের RBD অঞ্চলটা এসেছে বলেই এ এমন ছোয়াঁচে হয়ে উঠেছে।দুটোর RBDর মাত্র একটা অ্যামিনো অ্যাসিড তফাৎ। আর সব এক। প্রকৃতির চিরন্তন ভাঙা-গড়ার খেলা।

চন্দন: আচ্ছা, ভাইরাসটা বাদুড় থেকে প্যাঙ্গোলিনে গেল কি করে? বাদুড় তো প্যাঙ্গোলিন খায় না, প্যাঙ্গোলিন ও  বাদুড় খায় না।

নন্দন: হা হা।  তা খায় না ঠিকই।  তবে দুটো প্রাণীই মোটামুটি একই পরিবেশে থাকে।  দুটোরই বাস চীন ও পূর্ব এশিয়ায়।  দুটোই নিশাচর, পোকা মাকড় খায়, ফল খায়।  একই বনাঞ্চলের প্রাণী। কার ফেলে যাওয়া খাবার কে খেয়েছে, বা কার মল থেকে ভাইরাস কার খাবারে মিশে গেছে। ....খুবই সম্ভব।  এ ভাবেই ভাইরাসরা ঘুরে বেড়ায়।

চন্দন: বাহ্! এটা একটা ভাল ecological ব্যাখ্যা।

নন্দন: হ্যাঁ।  এত বিজ্ঞানীরা লিখেছেন পেপারে।.....কিন্তু আরেকটা ব্যাপার আছে। ....চাবিটার আরেকটা খেল আছে।  সেটাও ফাটাফাটি।

চন্দন:  কি চাবি ভাই এই স্পাইক প্রোটিন।আলী বাবার চিচিং ফাঁক তো এর কাছে কিছুই নয় !

নন্দন: এই ছবিটা দেখ।  আরেকটা রিসার্চ পেপার থেকে নেওয়া।    লক্ষ করে দেখ, স্পাইক প্রোটিনকে বিজ্ঞানীরা দুভাগে ভাগ করেছেন - S1 আর S2. S1এ আছে RBD . দেখেছিস? (ছবি ৬)
ছবি ৬: নতুন কোরোনাভাইরাসের স্পাইক জিনে polybasic cleavage site. অন্য ভাইরাসদের নেই।  Anderson KG et al (2020) Nature Medicine. 26, 450-452 থেকে নেওয়া। 
চন্দন: ঠিক আছে।

নন্দন: S2 দেখ।  কয়েকটা তিনটে দাঁড়ি কাটা আছে। আর স্পাইক প্রোটিনের ওই অঞ্চলটা এনলার্জ করে দেখিয়েছে, একদম তলায় যে row করে অক্ষরগুলো সেগুলো হচ্ছে অ্যামিনো অ্যাসিড'র সারি।  amino acid sequence. দেখ, নতুন করোনা আছে, বাদুড়ের RaTG13 আছে, প্যাঙ্গোলিন ভাইরাস আছে, ২০০২র সার্স ভাইরাস আছে।

চন্দন: দেখেছি।

নন্দন: এবার লক্ষ কর, একটা জায়গা দেখবি যেখানে একমাত্র নতুন করোনা ভাইরাসের সারিতেই পাঁচটা অক্ষর PRRAR, অর্থাৎ পাঁচটা অ্যামিনো অ্যাসিড আছে।  তলার অন্যগুলো, এমনকি প্যাঙ্গোলিন ভাইরাসও খালি, P আছে, আর শেষে R আছে, কিন্তু মাঝখানে খালি।  ব্ল্যাংক, তাই - সিম্বল দিয়ে রেখেছে। এর মানে হল ওই পরপর পাঁচটা অ্যামিনো অ্যাসিড একমাত্র আমাদের নতুন কোরোনাভাইরাসের আছে। আর ওপরে লেখা আছে polybasic cleavage site.

চন্দন: এই polybasic cleavage siteর কাজ কি?

নন্দন: এ হচ্ছে নতুন কোরোনাভাইরাসের স্পাইক প্রোটিনের গোপন অস্ত্র। কি জানিস, অনেক প্রোটিন থাকে যারা তৈরী হয়, কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে নিজে থেকেই active হতে পারে না।  যেমন ধর আমরা সবাই স্কুলের বইতে পড়েছি পেটে আর স্মল ইন্টেস্টাইনে  (ক্ষুদ্রান্ত্রে) পেপসিনোজেন আর ট্রিপসিনোজেন নামের উৎসেচক প্রথমে inactive অবস্থায় নিঃসৃত হয়।  তারপর তাদের একটা ছোট্ট অংশ ছেঁটে ফেলে দিলে সেগুলো active উৎসেচক পেপসিন আর ট্রিপসিন হয়ে ওঠে।  পড়েছিলি মনে আছে?

চন্দন: মনে পড়ছে।  পেটের হাইড্রোক্লোরিক অ্যাসিড পেপসিনোজেনকে পেপসিন করে দেয়।

নন্দন: একশোয় একশো।  ঠিক একই কথা স্পাইক প্রোটিনের ক্ষেত্রে লাগে।এমনিতে ও ACE২ গায়ে আটকাতে পারবে না, তালাও খুলবে না।  কিন্তু আমাদের শরীরের অনেক কোষকলায় Furin  নামের একটি বিশেষ উৎসেচক (enzyme)  পাওয়া যায়, আর Furin ওই PRRAR ঠিক চেনে।  ফুরিন এসে ওই জায়গাটা কুচ করে কেটে দেয় , আর তখনই একটিভ হয়ে ওঠে করোনার স্পাইক।

চন্দন: যেন, একটা স্প্রিংকে চেপে রেখে ছেড়ে দেওয়া হল।

নন্দন: একদম।  একজন বিজ্ঞানী বর্ণনা করেছেন এ হল আমাদের বোতাম-টেপা ফোল্ডিং ছাতার মত. বন্ধ ছিল, কিন্তু বোতাম টিপতেই খুলে গেল।  ছাতা রেডি। ফুরিন অনেক কোষে পাওয়া যায়।  যেমন ফুসফুসে। বুঝতেই পারছিস, কিরকম advantage . কোন মতে নাক দিয়ে মুখ দিয়ে ঢুকতে পারলেই হল।  ACE ২ ও আছে, ফুরিন ও আছে।  চাবি তালা, চিচিং ফাঁক।

চন্দন: অন্য ভাইরাসগুলো তাহলে ঢুকবে কি করে? ওদের তো  polybasic cleavage site নেই।

নন্দন: সেটাই তো।  নেই বলেই তো ওরা হয় কোন রোগ করতে পারে না, কিংবা এতটা ছোয়াঁচে নয়।  একটা মাত্র R আছে, সেটাকে কিছু উৎসেচক চেনে। কিন্তু ওই পজিশনে polybasic cleavage siteর মত এতো চট করে কাটা যায় না।  একটু সময় লাগে।  তাই অন্য ভাইরাস এতো ছোয়াঁচে নয়।  নতুন কোরোনাভাইরাস যে  একটি দারুন RBD ও একটি polybasic cleavage site একসঙ্গে বাগিয়েছে সেটাই ওকে প্রতিযোগিতায় অনেকটা এগিয়ে দিয়েছে। বায়োলজিতে যাকে বলে gain of function.  ভেবে দেখ, ও কিন্তু আমাদেরই দুটো গুরুত্ব পূর্ণ প্রোটিন - ACE২ আর ফুরিন - ব্যবহার করছে আমাদেরই বিরুদ্ধে।

চন্দন: বাবা! ক্ষুদ্র বলিয়া অবজ্ঞা করিও না।  আচ্ছা, অন্য কোন ভাইরাসে এরকম polybasic cleavage site পাওয়া যায়?

নন্দন: যায় বইকি। কিছু ইনফ্লুয়েঞ্জা ভাইরাসে পাওয়া যায়, এবং সেগুলোই বেশি ছোঁয়াচে। ব্যাপারটা নতুন নয়, বলতে পারিস old wine in new bottle. কিন্তু সেই জন্যেই বিজ্ঞানীরা দেখেই চিনতে পেরেছেন।  নতুন কোরোনাভাইরাস প্রকৃতিতে নতুন, কিন্তু ও যে রাস্তা ধরে বিবর্তিত হচ্ছে সেটা নতুন নয়।

চন্দন: কিন্তু, RBD না হয় এসেছে প্যাঙ্গোলিন ভাইরাস থেকে। এই polybasic cleavage site কোন ভাইরাস থেকে এলো?

নন্দন: এইটা খুব ভালো প্রশ্ন, এবং তুই যদি এক সপ্তাহ আগে করতিস উত্তর দিতে পারতাম না।  এখন পারব।  দেখ, এটা ঠিক যে জানুয়ারি থেকে মার্চের মধ্যেই পৃথিবীর অনেক ল্যাবের বিজ্ঞানীরা বুঝে গেছেন RBDটা কি ভাবে কাজ করে, কথা থেকে এলো ইত্যাদি।  কিন্তু ওই polybasic cleavage site কোথা থেকে এল এটা বোঝা যাচ্ছিল না।  খুব সম্ভবত কোন এক অজানা ভাইরাস থেকে, কিন্তু কে সে? কোথায় সে? এই চলছিল খোঁজ।

চন্দন: তা রিসেন্ট কি পাওয়া গেল ?

নন্দন: চীনের ইউনান প্রদেশের প্রায় ২২৭টা বাদুড় থেকে ভাইরাস বের করে তাদের জিনোম সিকোয়েন্স করা হয়েছে।  স্টাডি করা হয়েছে। এবং একটি ভাইরাস পাওয়া গেছে যার নাম দেওয়া হয়েছে RmYN02. এ বেশ মজার ভাইরাস। আমাদের নতুন করোনা ভাইরাসের সঙ্গে মিল আছে, আবার নেই ও।  এক এক যায় মিল, এক এক যায় অমিল।  এর RBD বেশ আলাদা। কিন্তু লক্ষণীয় হল এর S1-S2 জংশনে ঐরকম তিনটে অ্যামিনো অ্যাসিড বসানো আছে।

চন্দন: polybasic cleavage site?

নন্দন: ঠিক তা না।  এখানে আছে PAA. তবে খুব যে দূরে নয় বুঝতেই পারছিস। একটা প্রদেশে মাত্র ২২৭টা  বাদুড় খুঁজলে যদি এই PAA পাওয়া যায়, মোটামুটি নিশ্চিত হয়ে বলা যায় যে আরো কয়েকশো বা এক দু  হাজার বাদুড় বা প্যাঙ্গোলিন খুঁজলেই ওই PRRAR পাওয়া যাবে। দেখবি, মাস খানেক বা তার আগেই বেরিয়ে যাবে। আরে সারা পৃথিবীর বিজ্ঞানীরা প্রচন্ড fast খুঁজে বেড়াচ্ছেন।

চন্দন : কিন্তু এসব হল কি করে ? কখন?

নন্দন: ' কি করে' উত্তর হল এটাই তো বিবর্তন। ছোট ছোট variation আর সেই ভিত্তি করে selection. নতুন কোরোনাভাইরাস আদতে একটা বাদুড়ে ভাইরাস। কিন্তু ঘটনাচক্রে mutation আর  recombination antigenic shift করে কিছু unique সিকোয়েন্স পেয়ে গেছে, আর মানুষের কাছে এসে পড়াতে ছড়িয়ে পড়ার সুযোগ পেয়ে গেছে। ওর যা আছে অন্যদের নেই। survival of the fittest.
আর 'কখন'? যা যা বললাম সেটা অনেকটা আমাদের এগিয়ে দিলেও এটা এখনো ১০০% নিশ্চিত নয়।  দেখ, দুটো জিনিস হতে পারে।  হয়,  বাদুড় থেকে প্যাঙ্গোলিন হয়ে আসার পথে এইসব mutation নতুন ভাইরাসে ঢুকেছে। অথবা, দুই, মানুষে ইনফেকশন শুরু গোড়ার দিকে এই সব mutation পেয়ে গেছে। এখন এক আর দুই কোন পথে এসেছে সেইটা আরো অনেক জিনোম ঘেঁটে বিজ্ঞানীরা বোঝার চেষ্টা করছেন। অবশ্য, যে পথেই আসুক মোদ্দা কথা হল  - mutation হয়েছে, আর  mutation থেকে এসেছে variation, কোন কোন ভাইরাসের স্পাইক প্রোটিন নতুন ক্ষমতা অর্জন করেছে আর সেই ভিত্তি করে natural selection তাকে বংশবৃদ্ধির পথে এগিয়ে দিয়েছে।

চন্দন: সব বুঝলাম, অকাট্য যুক্তি।  কিন্তু একটা কথা বল।  আজকের জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং যুগে এসব কি সত্যি কোন বিজ্ঞানীর করা অসম্ভব? তুই তো বলছিস।  একদম আনকোরা নতুন কিছু নয়।  তাহলে কেউ গোপনে কেন করতে পারবে না?

নন্দন: হ্যাঁ। এতক্ষন ধরে যা বললাম সেটা হল গত চারমাসে বিজ্ঞানীরা কি আবিষ্কার করেছেন আর কি conclude করেছেন।  মনে রাখতে হবে এমনি এমনি ভুল ভাল বললে ভয়ানক বদনাম হবে।  পলিটিক্স করলে যা ইচ্ছে বলে পার পাওয়া যায়, বিজ্ঞানে যায় না।  একবার black listএ নাম উঠে গেলে কেউ বিশ্বাস করবে না।  আর তাছাড়া বিজ্ঞানীরা জানেন প্রকৃতির বিশাল সম্ভারের কথা।  সুতরাং সেখানেই প্রথম খুঁজেছেন আর বিজ্ঞানের জানা পথে উত্তর ও পেয়েছেন। তাই দেখবি, ট্রাম্প আর অন্য পলিটিশিয়ানরা যাই বলুক বিজ্ঞানীরা এসব নিয়ে বেশি কিছু বলছেন না।  খালি আমেরিকার ডঃ ফকি বলেছেন এটা ন্যাচারাল ভাইরাস। বেশি বলে লাভ কি? রাজনীতির লোকেরা নিজেদের ধান্দায় চলে। তাই বিজ্ঞান যাই বলুক মানবে না। বয়ে গেল।  তবে হ্যাঁ, বৈজ্ঞানিক দিক থেকে এবার তোর এই প্রশ্নটার উত্তর দেবার সময় এসেছে।

চন্দন: মানে, আমি বলতে চাইছি যে হতেই পারে ন্যাচারাল ভাইরাস। কিন্তু এটাও তো হতে পারে যে কোন গোপন জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং ল্যাবে বাদুড় ভাইরাস, পঙ্গোলিন ভাইরাস থেকে cut n paste করে বানিয়ে ফেলেছে?

নন্দন: জানি তুই এটাই বলবি। দেখ, আমি পর পর কয়েকটা পয়েন্ট বলছি।  এবার তুই ভেবে না কোনটা যুক্তি দিয়ে কাটতে পারবি।
১।  এতে কোন সন্দেহ নেই যে নতুন কোরোনাভাইরাস জিনোমের সিংহভাগ হচ্ছে বাদুড়ে ভাইরাস RaTG13র মত।  ঠিক তো? কিন্তু RaTG13 তো কোন মানুষে কোন অসুখ করে না। তার মানে যদি কেউ গোপনে একটা খুব সংক্রামক মারাত্তক ভাইরাস বানাতে চায়, তাহলে সে নিরীহ, অজানা RaTG13 জিনোম ভিত্তি করে বানাতে যাবে কেন? আরো কত ভাইরাল জিনোম তো আছে, ভাইরাস সম্পর্কে আজকে আমাদের যা জ্ঞানভান্ডার তা তো বিশাল। বেশি দূরে যেতে হবে না, নতুন কোরোনাভাইরাসের আত্মীয় ২০০২র সার্স ভাইরাস বা ২০১২র MERS ভাইরাস নিয়ে করলেও তো হত।  তাই না? তরোয়াল যদি বানাতেই হবে সেটা স্টিল দিয়ে বানাবো, কার্ডবোর্ড দিয়ে বানাতে যাব কেন?

চন্দন : তা বটে। ....

নন্দন: শুধু তাই নয়। ২. এরকম একটা অজানা নিরীহ ভাইরাসকে আদৌ জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ার করে সংক্রামক করা যাবে কি না তারই বা কি গ্যারান্টি? তুই ভাবছিস হয়ে যাবে। ভাবলেই তো হল না।  এটা চেষ্টা করতে বহু মাস থেকে বছর লেগে যেতে পারে। এই ধরনের এক্সপেরিমেন্টকে বলে Reverse genetics এবং সেটা বেশ শক্ত - একটা একটা করে প্রোটিনের জিন বানাতে হবে, তাদের পরীক্ষা করতে হবে এবং তারপর সব জুড়ে আবার দেখতে হবে কাজ হচ্ছে কিনা।  অত্যন্ত সময়সাপেক্ষ কাজ এবং সাফল্য নাও আসতে পারে -  কারণ ওর মূল কাঠামোই দুর্বল। আরে বাবা, যতই চেষ্টা কর একটা ভেড়া কক্ষনো বাঘ হয়ে উঠতে পারবে না।  এবার ভাব - তুই এরকম এক সিক্রেট প্রজেক্টে কাজ করছিস।  অনেক বছর অনেক ডলার খরচ করে শেষে হাতে এল লবডঙ্কা, কারণ গোড়াতেই গলদ ছিল।  এটা কোন ঘোড়েল অস্ত্র ম্যানুফ্যাকচারার করবে তোর মনে হয়? উত্তর একটাই - না।

চন্দন: না, করবে না। করতে হলে ভাল করেই করবে।

নন্দন:  ঠিক।  তবে শুধু RaTG13 কাঠামো নয়। স্পাইক প্রোটিনের RBDও বলে দিচ্ছে এটা একটা ন্যাচারাল প্রোটিন।  মানুষের তৈরী নয়।

চন্দন: কিরকম?

নন্দন: ৩. দ্যাখ, নিশ্চই মনে আছে স্পাইকের RBD হচ্ছে চাবির একদম সামনের অংশটা, যা দিয়ে অনায়াসে ACE২ তালা খোলা যায়। কারণ,  ওখানে ৬টা অ্যামিনো অ্যাসিড আছে যারা এই কাজটা দারুন করতে পারে।

চন্দন: মনে আছে।

নন্দন: এগোবার আগে একটা কথা বলে রাখি। ২০০২ সালে চীনে সার্স মহামারীর পর থেকে এই সব ভাইরাস নিয়ে বিশ্ব ব্যাপি গবেষণা শুরু হয়।  তারপর প্রায় ১৮ বছর কেটে গেছে, অনেক অনেক গবেষণা হয়েছে।  বিজ্ঞানীরা বোঝার চেষ্টা করেছেন কি করে স্পাইক প্রোটিন ACE২ র সঙ্গে লেগে যায়।  যেহেতু দুটোই প্রোটিন, আর প্রোটিন মানেই পরপর সাজানো অ্যামিনো অ্যাসিড, তাই এটা ফাইনালি হল অ্যামিনো অ্যাসিড দিয়ে অ্যামিনো অ্যাসিড চেনার মলিকিউলার  খেলা। বিজ্ঞানীরা ন্যাচারাল ভাইরাস প্রোটিন স্টাডি করেছেন, কম্পিউটারে মডেল করেছেন , পরীক্ষা করেছেন যা রিএকশন দেখছেন সেটাই কি ১০০% বেস্ট না কি ইঞ্জিনিয়ারিং করে প্রকৃতির থেকেও বেটার করা যায়।

চন্দন: প্রকৃতির থেকেও better হয় নাকি?

নন্দন: হতেই পারে। বিবর্তন তো ঠিক ইঞ্জিনিয়ার নয়, যে আগে থেকে ভেবেচিন্তে design করে,  বেস্ট মালপত্র দিয়ে বেস্ট জিনিসটাই সবসময় তৈরী করবে । প্রকৃতিতে অনেক কিছুই চলে তাপ্পি দিয়ে।আগে থেকে আছে, একটু variation হল সেটাই selected হল। একে বলে tinkering, জোড়াতালি দিয়ে চালিয়ে দাও, নতুন করে বানাবার দরকার নেই। মানুষ যেটা স্বজ্ঞানে করে সেটা হল ইঞ্জিনিয়ারিং, আর বিবর্তন হল জোড়াতালি, তাপ্পি দেওয়া tinkerer.

চন্দন : সেটা এক্ষেত্রে কেন ইম্পরট্যান্ট?

নন্দন: এক্ষেত্রে এটা বলা দরকার কারণ বিজ্ঞানীরা এত বছর যখন স্পাইক প্রোটিন নিয়ে গবেষণা করছিলেন তখন বেশ কয়েক বছর আগে এমন একটা স্পাইক ল্যাবরেটরিতে বানিয়ে ফেলেছিলেন যেটা একদম বেস্ট। ওটাই ACE২র  সঙ্গে সবচেয়ে ভাল আটকে যায়। ঠিক যে যে  অ্যামিনো অ্যাসিড দিলে RBD সবচেয়ে ভাল খাপেখাপ লেগে যাবে সেগুলো দিয়েছিলেন, আর ফল ও তেমন পেলেন। যাকে বলে একদম optimized.

চন্দন: তারপর  ?

নন্দন: তাহলে এটা নিশ্চয়ই আশা করা যায় যে যদি কেউ ল্যাবে ওই নতুন কোরোনাভাইরাস বানায় সে ওই ল্যাবে তৈরী বেস্ট স্পাইক নেবে।  তাই তো? স্বাভাবিক। সে তো একটা মারাত্মক বায়োলজিকাল অস্ত্র বানাতে চাইছে , অন্তত তাই তো ডোনাল্ড-ভাই দাবি করছেন।  কিন্তু, বিজ্ঞানীরা দেখলেন নতুন কোরোনাভাইরাসের স্পাইক প্রোটিনের RBD  বেশ ভাল কাজ করে, কিন্তু ওর অ্যামিনো অ্যাসিড গুলো পরিষ্কার আলাদা আর optimized নয়।(ছবি ৭)

চন্দন: তার মানে ওটা ন্যাচারাল, জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং করে তৈরী নয়।?

নন্দন: exactly . যদি ল্যাবে তৈরী হত তাহলে ওই unnatural optimized RBDর মত হত। সত্যি বলতে কি, এমন যে একটা RBD কাজ করতে পারে, আমাদের কম্পিউটার মডেলিং সেটা বের করতেই পারেনি।  কিন্তু বিবর্তনের ক্ষমতা অসীম, মানুষের টেকনোলজি যা পারে না সেটা করে ফেলে। এবারেও পেরেছে।দেখে বিজ্ঞানীরা অবাক - এভাবেও হয় ! এবং এই নতুন ভাইরাস যে ল্যাবে তৈরী নয়, প্রকৃতির ফসল,  এটার পক্ষে খুব বড় প্রমান।

ছবি ৭: কম্পিউটার মডেলিং করে ল্যাবে তৈরী optimized RBD (বাঁদিকে ) আর নতুন কোরোনাভাইরাসের RBD (ডানদিকে) . ACE২ সঙ্গে bind করতে আলাদা আলাদা অ্যামিনো অ্যাসিড  ব্যবহৃত হয়েছে। মানুষের টেকনোলজি আর প্রকৃতি দুটি আলাদা পন্থা নিয়েছে।  Wan, Y. et al (2020)  Journal of Virology. 94, e00127-20 থেকে নেওয়া।  
চন্দন: বাপস ! আশ্চর্য!

নন্দন: সত্যিই আশ্চর্য।  এবং এটাই শেষ নয়।  চার নম্বর বলে শেষ করি - স্পাইক প্রোটিন টা তো বুঝতেই পারছিস প্রোটিন।  কিন্তু ওর সঙ্গে কিছু কার্বোহাইড্রেট লেগে আছে। কিছু অ্যামিনো অ্যাসিড আছে যারা সেই কার্বোহাইড্রেটগুলোকে বেঁধে রেখেছে।  নিচের ছবিটা দেখ- এদের বলে O-linked glycan residues (ছবি ৮).

ছবি ৮: স্পাইক প্রোটিনে O-linked glycan residuesর অবস্থান।  সেই সব অ্যামিনো অ্যাসিড যারা কার্বোহাইড্রেটদের বেঁধে রাখে। Zhou, H. et al (2020) Current Biology. 30, 1-8 থেকে নেওয়া 
চন্দন: এদের আবার কি কাজ ?

নন্দন: আত্মরক্ষা।  ডিফেন্স।  যখন ভাইরাস আমাদের শরীরে ঢোকে তখন তো সম্ভাবনা আছে যে ওকে আমাদের রোগ প্রতিরোধকারী immune system  চিনে ফেলবে, তাই না।  এই কার্বোহাইড্রেট গুলো হচ্ছে নতুন করোনার camouflage. ওকে চিনতে দে না।  immune system ওকে দেখেও দেখতে পায় না , আর ওই ফাঁকে ও ঢুকে পড়ে। এটাও শুধু নতুন কোরোনাভাইরাসেরই আছে।

চন্দন: এটা আবার কোথা থেকে এল ?

নন্দন: সেটা এখনো ঠিক বেরোয়নি, তবে এটাও নতুন কিছু না।  অনেক ভাইরাসের থাকে।  যেটা আসল কথা সেটা হল এই জিনিস কোনোমতেই ল্যাবে করা যেত না।  এরকম  O-linked glycan residues বিবর্তিত হতে হলে সেই প্রোটিন (বা তার ভাইরাসকে) বেশ কিছুদিন কোন এক বা একাধিক স্তন্যপায়ীর মধ্যে থাকতে হবে।  তবে হবে, এমনি এমনি ল্যাবের টেস্টটিউবে হবে না।

চন্দন: কোন স্তন্যপায়ী?

নন্দন: সেটা এখনো কেউ জানে না।  ওই  O-linked glycan residues কবে নতুন করোনা পেল সেটা জানা যায়নি।  তবে বাদুড়, মানুষ, প্যাঙ্গোলিন সবই তো mammal. কারুর না কারুর মধ্যে অবস্থান কালে কোন একটা ভাইরাস এটা  পেয়েছিল।  আর যে পেয়েছে তার অ্যাডভান্টেজ, কারণ তাকে immune system মারতে পারে না, তাই তার বংশ বৃদ্ধি বেশি হয়, তাই সে এখন ছড়িয়ে পড়ছে। বলছি, না বিবর্তনের ক্ষমতা অসীম।  ৪০০ কোটি বছর ধরে এই ভাঙা গড়া খেলা চলছে ভাই।  মানুষ আর কতটুকু করেছে, মানুষও তো ওই খেলারই ফল।  করোনার মত।

চন্দন: আর কিছু ?

নন্দন: আরো কিছু প্রমান আছে।  তবে থাক। এই অনেক।  তাছাড়া উহানের ইনস্টিটিউট অফ ভাইরোলজি পৃথিবীর অন্যতম নামকরা গবেষণাগার।  সারা পৃথিবীর লোক ওখানে collaboration এ কাজ করতে যান।  ওটা বানাতে মার্কিন এবং ফ্রেঞ্চ গবেষকদের হাত আছে।  সেই জায়গায় কেউ কোনোদিন কোন সন্দেহ করেনি, এত বিদেশী কাজ করেছেন অথচ কেউ কোনোদিন কিছু সন্দেহজনক রিপোর্ট করেনি।  ওখানে লুকিয়ে জৈবিক অস্ত্র গবেষণা হবে এসব গাঁজা। তাছাড়া একটা অস্ত্র তখনই ভাল যখন সেটা কন্ট্রোল করা যায়।  দেখতেই তো পারছিস নতুন ভাইরাস কিরকম একটার পরে একটা দেশ ঘায়েল করে দিচ্ছে।  টোটাল-ক্যালানে না হলে এমন অস্ত্র কেউ বানিয়ে সেমসাইড খেতে যায়?!  ওসব আষাঢ়ে গপ্পো, হলিউডের সিনেমায় চলে।

চন্দন: তা বটে।  তাছাড়া একটা কথা আমি অনেক ভেবেছি। চাপাচাপি করতে হলে চীন করতেই পারতো।  ওদের এক-পার্টি শাসক দেশে সেটা করাও যায়।  কিন্তু, চীনের বিজ্ঞানীরা জানুয়ারি মাসেই এই জিনোম ডেটা সারা পৃথিবীর বিজ্ঞানীদের দিয়ে দিয়েছেন, তাই নিয়েই সবাই কাজ করছে।

নন্দন: মোক্ষম দিয়েছিস।  এটা কখনো হতে পারে নিজেরা ভাইরাস বানাবো, আবার সেই ভাইরাসের জিনোম - অর্থাৎ ব্লুপ্রিন্ট - সারা পৃথিবীতে বিলিয়ে দেব ???   পাগল না কি?  ....দেখ, শেষ কথা হল , একদিকে কোনো প্রমান নেই।  অন্যদিকে জীবন বিজ্ঞানের দেড়শো বছরের সম্মিলিত জ্ঞান। আমি যা জানি মোটামুটি অনেক তথ্য তোর সামনে রেখেছি। এবার  কোনটা বিশ্বাস করবি সেটা তোর ব্যাপার।

চন্দন: সে আর বলতে।  ....তবে মানুষের কি কোন হাত নেই?

নন্দন: আছে আছে, নিশ্চয়ই আছে।  সত্যি বলতে কি , কম বেশি আমরা সবাই দোষী। এই যে ভয়ানক পরিবেশ দূষণ চলছে, বন্যপ্রাণী অবাধে চোরা শিকার চলছে, বনের পরে বন কেটে সাফ হয়ে শহর হচ্ছে এই সবকিছুর ফলে আজকে আমাদের সঙ্গে অনেক বেশি জন্তু জানোয়ারদের দেখা হচ্ছে।  হবেই তো, দোষ তো ওদের নয়।  আমরাই তো ওদের বাড়ি ঘর ভেঙে দিয়েছি। কত প্রাণী গত কুড়ি বছরে নিশ্চিহ্ন হয়েছে বল তো ? পুরোনো গবেষণা পত্র, সেমিনারের বক্তৃতা খুলে দেখ,  বিজ্ঞানীরা ১০-১৫ বছর ধরে বলে আসছেন এভাবে চললে নতুন মহামারী অতিমারী আসবেই, কেউ কথা শুনিনি। বিপদ এসেছে। এখন অবস্থা টাইট। আবার তার মধ্যেও নিজেদের বদমাইশি চালু রেখেছি।

চন্দন: আর সমস্যা তো ঠিক অসুখের নয়।  .....

নন্দন: নয় তো। এর থেকে আমাদের যক্ষা, ডেঙ্গি, ম্যালেরিয়া অনেক ডেঞ্জারাস। এই অসুখে তো ৯৫% লোক সেরে যায়।  সমস্যা তো মূল অসুখ নিয়ে নয়,  সমস্যা হচ্ছে গত ২০-২৫ বছরে বহু দেশ সহজলভ্য পাবলিক হাসপাতাল কমিয়ে প্রাইভেট বাড়িয়ে দিয়েছে। এর ফলে বেড কমে গেছে - শুধু আমাদের দেশে নয়, জার্মানি ছাড়া প্রায় পুরো ইউরোপে এই প্রাইভেটগিরি করতে গিয়ে হয়েছে; আমেরিকার কথা তো বাদই দে, চিরকালই সাস্থের ব্যাপারে বাজে ।  এখন বোঝো ঠ্যালা।  বিপদের দিনে বেড নেই, ভেন্টিলেটর কম।

চন্দন: এসব তো মানুষের অপরাধ বটেই।

নন্দন: ঠিক মানুষ বলব না। আমাদের ভয়ানক অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক লোভ।  যা মানুষকে মানুষ জ্ঞান করে না। যা ভুলে যায় যে আমরা টেকনোলজি'র দিক থেকে অনেক উন্নতি করলেও এখনো প্রকৃতির মধ্যেই আছি।বলতে প্যারিস, করোনা'র মাধ্যমে এ যেন প্রকৃতি আমাদের একটা হালকা টোকা মেরে গেল - বলে দিল, ওহে মানুষ, তোমরা আমার মধ্যেই আছো, আমার মধ্যেই থাকবে।



REFERENCES

(তিন কিস্তির এই রচনা লিখতে বেশ কিছু গবেষণা পত্র থেকে মালমশলা নিতে হয়েছে। তলায় তাদের লিস্ট করে দিলাম। মনে রাখবেন নতুন বৈজ্ঞানিক তথ্য আসতেই পারে, বিশেষত প্যাঙ্গোলিন না হয়ে অন্য কোন প্রাণীও হতে পারে। )

1. Anderson KG et al (2020) The proximal origin of SARS-CoV-2. Nature Medicine. 26, 450-452.

2. Wan, Y. et al (2020) Receptor Recognition by the Novel Coronavirus from Wuhan: an Analysis Based on Decade-Long Structural Studies of SARS Coronavirus. Journal of Virology. 94, e00127-20

3. Zhou, P. et al (2020) A pneumonia outbreak associated with a new coronavirus of probable bat origin. Nature. 579, 270-273.

4. Zhang, T. et al (2020) Probable Pangolin Origin of SARS-CoV-2 Associated with the COVID-19 Outbreak. Current Biology. 30, 1-6.

5. Xiao, K. et al (2020) Isolation of SARS-CoV-2-related coronavirus from Malayan pangolins. Nature. online ahead of print in May 2020.

6. Zhou, H. et al (2020) A novel bat coronavirus closely related to SARS-CoV-2  contains natural insertions at the S1/S2 cleavage site of the spike protein. Current Biology. 30, 1-8.

7. Wrapp, D. (2020)  Cryo-EM structure of the 2019-nCoV spike in the prefusion conformation. Science. 367, 1260-1263.

8. Zhang, Y. and Holmes, E. (2020) A Genomic Perspective on the Origin and Emergence of SARS-CoV-2. Cell, 181, 1-5.

9. https://leelabvirus.host/covid19/origins-part1; https://leelabvirus.host/covid19/origins-part2; https://leelabvirus.host/covid19/origins-part3 নিউ ইয়র্কের ইক্যাং স্কুল অফ মেডিসিন, মাউন্ট সিনাইয়ের প্রফেসর বেনহুর লি ল্যাব এই বিষয়ে বেশ সহজের সঙ্গে লিখেছেন। পড়া উচিত।

10. https://microbenotes.com/differences-between-antigenic-shift-and-antigenic-drift/














Saturday, May 16, 2020


 কোরোনাভাইরাস তুমি যে কার? কোন গোপন ল্যাব,না কি প্রকৃতির সম্ভার ?

(করোনা বিজ্ঞানের খুচরো খবর -৯) 


নন্দন: কী রে ? বসে বসে গজগজ করছিস কেন ?

চন্দন: আর পারছি না ভাই।  এ কবে উঠবে বল তো? আর শালা চীনের ওপরে উত্তাল রাগ হচ্ছে।  কিরকম করে ভাইরাস ছেড়ে সবাইকে পথে বসিয়ে দিল দ্যাখ !

নন্দন: ধুস, যত ট্রাম্প-মার্কা বাজে কথা।  

চন্দন: মেকি চীন-দরদ দেখাতে যাস না আমার কাছে, নন্দন। ওরা বহুত  ....

নন্দন: দ্যাখ! আমি চীনের খাই না পরি যে ওদের দরদ দেখাতে যাব? হ্যাঁ, আমার ফোন আর কম্পিউটার মূলত চীনা মাল দিয়ে তৈরী - সে তো জগতে সবার ভাই।  কিন্তু, তাই বলে ওদের ফালতু ডিফেন্ড করতে যাব কেন ?

চন্দন: সেইরকমই শোনাল। ...

নন্দন: দ্যাখ, ট্রাম্পের সঙ্গে বিজ্ঞান ও বিজ্ঞানীদের কিরকম মধুর সম্পর্ক সবাই জানে। চীনও ধোয়া তুলসীপাতা নয়, এবং কেউই নয়। কিন্তু, সেটা তো রাজনীতির প্রশ্ন। তা দিয়ে তো বিজ্ঞান চলে না। সুতরাং মূল প্রশ্ন হচ্ছে - গত চার মাসে নানা দেশের বিজ্ঞানীরা গবেষণা করে এই নতুন ভাইরাসের উৎপত্তি নিয়ে নামকরা জার্নালে কি কি  প্রকাশ করেছেন ? তার থেকে আমরা কি জানতে পারি ? 

চন্দন -তুই বলছিস চীন ল্যাবে ভাইরাস বানায়নি।  

নন্দন: দ্যাখ, আমি কি বললাম না বললাম সেটা কথা নয়।  কথা হচ্ছে এভিডেন্স কি আছে? পক্ষে না বিপক্ষে? ফেলুদা পড়িসনি? 'রয়েল বেঙ্গল রহস্য' - 'আপনি আগে ক্রিমিনাল ঠিক করে তার ঘাড়ে ক্রাইম ফেলার চেষ্টা করেন, আর আমি ক্রাইমের ধাঁচ বুঝে সেই অনুযায়ী অপরাধী খোঁজার চেষ্টা করি।'  সেই একই জিনিস।  

চন্দন: সে তো গোয়েন্দা গল্প। 

নন্দন: বিজ্ঞানীরা তো এক ধরণের গোয়েন্দা। ফেলুদা, ব্যোমকেশ, হোমস, সোনি টিভির ক্রাইম পেট্রল'র পুলিশ অফিসার মতোই তাদের কাজ - বিজ্ঞানের জানা-অজানা নিয়ম দিয়ে অনুসন্ধান করা, এক্সপেরিমেন্ট করে তথ্য বের করা, সেগুলো এনালাইসিস করা, তারপর জনসমক্ষে আনা।  

চন্দন : আচ্ছা, তুইই বল , তোর তো মাইক্রোবায়োলজি ডিগ্রী আছে। বিজ্ঞানীরা কি জানতে পেলেন এই ভাইরাস সম্পর্কে? 

নন্দন: আচ্ছা, বলছি। বিজ্ঞানের জার্নালে যা সব নতুন রিসার্চ পেপার বেরিয়েছে তা থেকে যা বুঝেছি তা সোজা করে বলার চেষ্টা করছি। তবে তার আগে একটা কথা বল - আজ অবধি এমন কোন মহামারী বা ইনফেকশনের কথা শুনেছেন যেটা প্রাকৃতিক নয়? মনে করে দেখ তো । 

চন্দন: যাহ শালা  ...না ঠিক মনে পড়ছে না এখন। ...দেখবো। ...

নন্দন: তুই যতই খোঁজ , আমি বলে দিচ্ছি উত্তরটা ‘না’। সব রোগের জীবাণু ন্যাচারাল। বসন্ত, কলেরা, পলিও, টাইফয়েড, হাম, হেপাটাইটিস, চিকেন পক্স, ফুড পয়েসন , জয় বাংলা, টেটানাস, ম্যালেরিয়া , টিবি, ডেঙ্গু কোনটা ব্যাকটেরিয়া কোনটা ভাইরাস কোনটা পরজীবী-জনিত । কিন্তু প্রতিটা জীবাণূ প্রকৃতির সন্তান, ডারউইনের আবিষ্কার মেনে জৈবিক বিবর্তণের ফসল । আমাদের মতোই এরা সবাই এই নীল গ্রহের বাসিন্দা। 

চন্দন: sure ?

নন্দন: একদম। আলফাল গুগল সাইট না খুলে  তুই সাবজেক্টের বই খুলে দেখ না। আজ অবধি সব ইনফেকশন বা মহামারী ন্যাচারাল জীবাণু দিয়েই হয়েছে। হ্যাঁ, মাঝে মধ্যে মানুষ এদের কয়েকজনকে ব্যবহার করেছে যুদ্ধে। যেমন, সেই প্রাচীন কাল থেকে শত্রুর জলাশয়ে কলেরা রুগীর বডি ফেলে দেওয়া হয়েছে; আমেরিকায় শ্বেতাঙ্গরা রেড-ইণ্ডীয়াণদের বসন্তরুগীদের কম্বল বিক্রি করেছিল আর তারপর সেই সব গ্রাম সাফ হয়ে যেতে সেখানে নিজেদের জমিদারি বাড়িয়ে নিয়েছিল; ২০০১র পরে নাকি কয়েক বার উগ্রপন্থীরা অ্যান্থ্রাক্স জীবাণু চিঠিতে ভোরে দিয়ে কয়েকজনকে খুন করার চেষ্টা করেছে । কিন্তু, সে সবই হল প্রাকৃতিক জীবাণুকে ব্যবহার করে । ল্যাবে-তৈরি জীবাণু ব্যাবহার হয়েছে এমন কোণ প্রমাণ নেই। 

চন্দন চুপ দেখে নন্দন বলে চলে -  এতে অবশ্য অবাক হবার কিছু নেই –প্রাকৃতিক বিবর্তনের ক্ষমতা অসীম। ভুললে চলবে না চারপাশে যত গাছ, আগাছা, মাছ, তিমি মাছ,  পোকা, গুবরে পোকা, মশা, মাছি, সাপ, বেজী, বিছে, কাঁকড়াবিছে, ব্যাঙের ছাতা, ব্যাঙ, কাক, ঘুঘু, চড়াই, হাড়গিলে,  বাঘ, বাঘের মাসী, হারিয়ে যাওয়া ডাইনোসর বা ডোডো পাখি, বাঁদর, মুখপোড়া হনুমান, আমাদের অবলুপ্ত-হওয়া জ্ঞাতি নিয়াণডারথাল বা হোমো ইরেক্টাস এবং আমরা নিজেরা সবাই ওই বিবর্তনের ফল । সামাজিক ভাবে এই সত্য মানতে আজও অনেকের একটু অসুবিধে হতে পারে, কিন্তু, তাতে কী করা যাবে? তুই,আমি, ট্রাম্প মানি বা মানি পৃথিবী সূর্যের চারপাশে ঘুরেছে, ঘুরছে এবং ঘুরবে ।  
চন্দন: কিন্তু  ....

নন্দন: আরেকটা ব্যাপার আছে।এটাও বৈজ্ঞানিক সত্য।  আজ অবধি যত রোগের জিবানু জানা গেছে তাদের একটা বড় অংশ নানারকম জন্ত্র-জানোয়ার থেকেই মানুষের শরীরে প্রথমে প্রবেশ করেছিল, তারপর বংশানুক্রমে এমনভাবে বিবর্তিত হয়েছে যে ওই আগের জন্তুর আর প্রয়োজনই নেই - স্বচ্ছন্দে এক মানুষ থেকে অন্য মানুষে লাফিয়ে যেতে পারে। এ যেন এক দেশ থেকে  অন্য দেশে গিয়ে বসবাস শুরু করা আর তারপর আগের দেশে কোনদিন ফিরে না আসা, কয়েক জেনেরেশান পরে আর অরিজিনাল দেশের সঙ্গে আর কোন যোগাযোগ থাকবেই না 

চন্দন: example দিতে পারবি? 

নন্দন: অবশ্যই।  দুটো বিখ্যাত জিবানুর কথা বললেই ব্যাপারটা পরিষ্কার হবে - এক, যক্ষ্মার জিবানু Mycobacterium tuberculosis।বিজ্ঞানীরা মোটামুটি নিশ্চিত যে গরু/মোষ জাতীয় কোন প্রাণী থেকে এই ব্যাকটেরিয়া'র পূর্বপুরুষ আদিম মানুষের শরীরে প্রবেশ করে। তবে Mycobacterium কবে আদিম মানুষের শরীরে প্রথম আস্তানা গেড়েছিল সে নিয়ে কিছুটা মতবিরোধ আছে - কেউ বলে প্রথম যখন গবাধি পশু পালন করা শুরু হল তখন; কেউ বলেন আরও আগে, যখন আমাদের পূর্বপুরুষরা আফ্রিকার প্রান্তরে দল বেঁধে মোষ-বাইসন শিকার করা শুরু করেন । 

চন্দন: ও আচ্ছা  ....জানতাম না  ....

নন্দন:  অবশ্য ওত দূরের ইতিহাসে গিয়েও কাজ নেই । কারণ দ্বিতীয় জীবাণু হল এইডস ভাইরাস - কালান্তক HIV. এর ইতিহাস আরও রিসেন্ট, আরও সুস্পষ্ট এবং তাই প্রায় নিঃসন্দেহ হয়েই বলা যায় যে বিংশ শতাব্দীর দ্বিতীয় ভাগে Simian Immunodeficiency Virus (SIV)- যেটা শিম্পাঞ্জিদের অসুখ করায়- সেটা কোন ভাবে শিম্পাঞ্জিদের নিকট প্রজাতি মানুষের দেহে প্রবেশ করে। আফ্রিকা থেকে সেই রোগ ছড়িয়ে পরে, আর তার পরে মাত্র ৪০ বছরে  কি মহামারীর আকার নিয়েছে তা সাধারণ মানুষেরও অজানা নয় ।    

চন্দন: শিম্পাঞ্জি থেকে এইডস ভাইরাস এসেছে????

নন্দন: সেটাই তো বলছি।  জন্তু জানোয়ার থেকে ভাইরাস আসেই। এসব নতুন কিছু নয়। তাহলে আমাদের টপিকে ফিরে আসি - কি দাঁড়াচ্ছে ? একদিকে আছে প্রকৃতির জানা-অজানা বিশাল সম্ভার; উল্টোদিকে ঢুঢু গড়ের মাঠ। এই অবস্থায় বিজ্ঞানীরাকোরোনাভাইরাসের উৎপত্তি জানতে কোথায় অনুসন্ধান শুরু করবেন ? নিশ্চয়ই প্রকৃতিই তাঁদের starting point হবে । 

চন্দন: তা বটে।  তারপর  ...

নন্দন : শুরু থেকে শুরু করা যাক । জানুয়ারি মাসের প্রথম দিকে চীনের বিজ্ঞানীরা এই নতুন ভাইরাসের জিনোমের সিকএন্সিং (genome sequencing) করেন।সিকএন্সিং হল একটি রাসায়নিক প্রক্রিয়া যা দিয়ে সাংকেতিক ভাষার পাঠোদ্ধার করা হয় , কোড ব্রেক করা হয় ।

চন্দন: হ্যাঁ।sequencing হল  জিনোমে সাজানো অক্ষরগুলোকে পরপর পড়ে ফেলা। 

নন্দন: very good .  এই প্রসঙ্গে আগেরবার কি বলেছিলাম মনে আছে ?  - গোলাকার ভাইরাসের ভেতরে আছে একটি সুতোর মতো RNA মলিকিউল। এই RNAই হল কোরোনাভাইরাসের জিনোম, অর্থাৎ মূল ডেটা স্টোরেজ আর কন্ট্রোলার।  সোজা কথায় - হেডকোয়ার্টার। এর মধ্যেই  'প্রকৃতির সাংকেতিক ভাষায়' (যার বৈজ্ঞানিক নাম genetic code) কোরোনাভাইরাসের ২৯টি প্রোটিন তৈরীর নির্দেশাবলী লেখা আছে, অনেকটা যেমন আমাদের ছোটবেলার ক্যাসেটের সুতোয় পরপর 'লেখা থাকতো' অনেকগুলি গান।একই ভাবে আমাদের কোষের নিউক্লিয়াসে অবস্থিত ২৩ জোড়া ক্রোমোসোমে আমাদের ২৫০০০র বেশি প্রোটিন তৈরির নিয়মাবলী লেখা আছে। মলিকিউলার বায়লজির নিয়ম মেনে এক্সপেরিমেন্ট করে এই জেনেটিক কোড পড়ে ফেলাকে বলে সিকএন্সিং। 

চন্দন: এটা করে কি লাভ হয়? 

নন্দন: লাভ অনেক। এটাই তো starting point . ভাইরাসের গোপন একাউন্টে কি আছে জেনে ফেলতে যায়।  এক, এই ভাইরাসের কি কি প্রোটিন তৈরি করার ক্ষমতা আছে তা নিয়ে একটা পরিষ্কার আন্দাজ পাওয়া যায়। এটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ কারণ কোষের মধ্যে এই ভাইরাল প্রোটিনরাই ভাইরাসের যাবতীয় কাজ কারবার করে। সুতরাং ভাইরাস'র  বংশবৃদ্ধি আটকাতে হলে এক বা একাধিক ভাইরাল প্রোটিনকে পঙ্গু করতে হবে। শত্রু'র যুদ্ধজাহাজ বা ট্যাঙ্ক-কে যেমন ধ্বংস করতে হলে সেগুলোকে চিনতে পারা চাই, ভাইরাসকে হারাতে হলে তার প্রোটিনদের চেনাও অত্যন্ত প্রয়োজনীয় ।

চন্দন: আর  ....? 

নন্দন : বলছি, একটু ধৈর্য ধর ভাই।  দুই, ঠিক যেমন আমার নিকট আত্মীয়দের সঙ্গে আমার জিনোম বেশি মিলবে, আর তোর আত্মীয়দের সঙ্গে তোর জিনোম বেশি মিলবে (যে জন্যে আজকাল ডীএণএ ফিঙ্গারপ্রিন্টিং করা হয়), তেমনই কোন কোন পুরোনো ভাইরাস এই নতুন করনাভাইরাসের জ্যাঠা-কাকা-দাদু-মামা-বোন-পিসি- ঠাকুমা  সেটা জিনোম সিকএন্সিং করলে বোঝা যায়।

চন্দন :  কেমন করে? 

নন্দন: দ্যাখ, সেটা একটা বড় কেমিক্যাল রিএকশন আছে।  অত তোর জেনে কাজ নেই।  তবে মোদ্দা কথা হচ্ছে পুরো জিনোমের অক্ষরগুলো পড়া হলে সেই তথ্য ডেটাবেসে ঢুকিয়ে দেওয়া হয়। ওখানে store হয়ে থাকে।  আজকের দিনে কম্পিউটার-ভিত্তিক জীবনবিজ্ঞান'র গবেষণা বড় সুবিধে হল ডেটাবেস  থেকে চট করে হাজার হাজার জিনোম'র সিকোয়েন্স পাওয়া যায়। গত ২০-২৫ বছরে এত এত জীবজন্তুর জিনোম সিকোয়েন্স হয়েছে যে প্রায় ইয়ত্তা নেই। আর সেই সব জিনোম ডেটা রাখা থাকে বেশ কিছু নামকরা ডেটাবেসে, যেমন আমেরিকার NCBI (ন্যাশানাল সেন্টার ফর বায়োটেকনোলোজিকাল ইনফরমেশন)।   যদি জানতে চাস  একটি নতুন জিনোমের জ্ঞাতি গুষ্টি কোন কোন জিনোম আছে তাহলে ওইসব ডেটাবেসে বায়ইনফরমাতিক্স (bioinformatics) নিয়ম মেনে খুঁজতে  হবে । 

চন্দন: কি খুঁজবে? একটু বল।  

নন্দন: বেসিক ব্যাপারটা সোজা। একাধিক জিনোম পাশাপাশি ফেলে দেখতে হবে তাদের মধ্যে কোথায় মিল আর কোথায় অমিল।যেমন ধর, এই আমি পর পর তিনটে জিনোমের একটা ছোট্ট অংশ এখানে লিখে দিচ্ছি।  

জিনোম ১: TGTACGTACGGTAGCTATCG....
জিনোম ২: TTTACGTAAGGTAGCTATAG....
জিনোম ৩:TTTACGTAAGCTAATTATAG....

মিলিয়ে দেখ, ১ আর ২র মধ্যে  তিনটে অক্ষরের তফাৎ পাবি ।  ১ আর ৩র মধ্যে ৬টা  অক্ষরের তফাৎ পাবি। তার মানে, ১ আর ২ হল নিকট আত্মীয় ; ১ আর ৩ ও আত্মীয় কিন্তু একটু বেশি দূরের। শাখা প্রশাখা।  

চন্দন: বাহ্। তার মনে যদি মানুষের জিনোম নিয়ে align করি তাহলে দেখব সবচেয়ে বেশী মিল শিম্পাঞ্জি জিনোমের সঙ্গে, তারপর গরিলা, ওরাং উটান, ইত্যাদি। 

নন্দন: একদম। এটা দারুন বলেছিস। দেখা গেছে শিম্পাঞ্জি জিনোমের সঙ্গে আমাদের জিনোমের ৯৬% র বেশি মিল । গোরিলাদের ক্ষেত্রে একটু কম। .... আর নতুন করোনা ভাইরাস কোন ভাইরাস পরিবার থেকে এলো সেটা বুঝতে মোটামুটি একই পন্থা নিয়েছেন বিজ্ঞানীরা।  

চন্দন: আচ্ছা, একটা কথা বল।  এই যে জিনোম ১ আর জিনোম ২ তো একই বংশের দুটি শাখা। এদের পূর্বপুরুষ এককালে এক ছিল।  তাহলে এই তফাৎগুলো হল কি করে? 

নন্দন: হা হা হা। তুই ধাঁ করে সবচেয়ে বেসিক প্রশ্নটা করে ফেলেছিস। উত্তর একটাই - এটাই বিবর্তন। এটাই ডারউইনের থিওরির প্রমান। .....ঠিকই বলেছিস। এককালে একটাই পূর্বপুরুষ জিনোম ছিল; তার থেকে প্রথমে জিনোম ৩ আলাদা হয়ে গেল, তারপর জিনোম ১ আর ২।

চন্দন: কি করে হল?

নন্দন: সেই জিরাফদের যা হয়েছিল মোটামুটি একই ব্যাপার। ধরে, কয়েক লক্ষ বছর আগের একটা প্রাগৈতিহাসিক জিরাফ দম্পতি। আধুনিক জিরাফদের পূর্বপুরুষ হলেও এরা  দেখতে অনেকটা জেব্রাদের মত।  এদের গলার হাইট আধুনিক জিরাফের মত বেশি নয় -  বাবা-জিরাফ আর মা-জিরাফের গলার হাইট ৪.১ ফিট  আর ৩.১০ ফিট।  এরপর  তাদের ৫টা বাচ্ছা হল - এদের গলার হাইট যথাক্রমে ৩.১১, ৪.১, ৪.১, ৪.৩ আর ৪.৪ ফিট। এরা সবাই আফ্রিকার একই অঞ্চলে চরে বেড়ায়, কিন্তু যে বাচ্ছা'র গলা ৪.৪ ফিট সে শুধু ঘাস বা নিচু গাছের পাতা নয়, লম্বা লম্বা গাছের উঁচু ডালের পাতাও বেশি খেতে পারে।  তাতে কি হল? এটা একটা fitness advantage, তার জন্মগত সুবিধে - এবং তাই সে বেশি পুষ্টিকর খাবার পাচ্ছে। বেশি খাবার পেলে শরীর ভালো থাকে, জোর হয়, রোগটোগ কম হয়, অন্যদের সঙ্গে লড়াইয়ে জেতা যায়, বেশি মেয়ে-জিরাফ পটানো যায়।  আর তাই কয়েক বছর পরে দেখা গেল ওরই বেশি বাচ্ছা হল। বায়োলজিতে এটাই success .  যেন অনেকগুলো varietyর মধ্যে প্রকৃতিই 'select করলো' কে বেশি সফল।  

চন্দন: আর মেন্ডেলের ল' মেনে বাচ্ছাগুলো ওর ওই লম্বা গলা পেল। একই পরিবারের লোকের মধ্যে যেমন মিল থাকে।  
নন্দন: ঠিক। তবে শুধু মিল নয়, পরের জেনারেশনেও তফাৎ থাকতে লাগল। কারুর গলার হাইট এবার ৪.৩, কারুর ৪.৫, অন্যদের ৪.৭ বা ৪.৮ ফিট।  বুঝতেই পারছিস এই জেনারেশনেও  ওই আফ্রিকান সাভানায় কার advantage . 

চন্দন: যার গলা ৪.৮ বুঝেছি।  যমজ না হলে ছেলেমেয়েদের মধ্যে ছোট ছোট তফাৎ বা variation থাকবেই  আর তার ওপর ভিত্তি করে ওই পরিবেশে কার বেশি সুবিধে দেখে natural selection হবে । survival of the fittest . প্রকৃতি select করছে ওই পরিবেশে কে better বাঁচবে। যে better বাঁচবে তার ছেলেমেয়ে বেশি হবে।  আর ছেলেমেয়েদের মধ্যে সেই বিশেষত্ব (এক্ষেত্রে গলার হাইট ) প্রকাশ পাবে।  

নন্দন: exactly . বিবর্তনের এই চিরন্তন খেলা গত ৪০০ কোটি বছর ধরে চলছে এবং চলবে। আর তাই কয়েক মিলিয়ন বছর পরে একটা জেব্রা-জাতীয় পূর্বপুরুষ থেকে বিবর্তিত হয়ে এল এক নতুন প্রজাতি (species) আধুনিক জিরাফ - যাদের গলার হাইট এখন ৭ ফিটেরও বেশি। বিজ্ঞানীদের চোখে সেই প্রাগৈতিহাসিক পূর্বপুরুষ আর উত্তরপুরুষ আধুনিক জিরাফ একই পরিবারের প্রাণী।দুজনের গলাতেই একই ধরণের হাড় আছে, কিন্তু  বিবর্তনের রাস্তায় চলতে চলতে সেই সব জিরাফ তনয় advantage পেয়েছে যাদের গলার হাড় অল্প হলেও লম্বা ছিল। আর তাই আজ , আধুনিক জিরাফ আফ্রিকার প্রান্তরে ওই লম্বা লম্বা গাছগুলির মগডালের পাতাও  খেতে পারে, যেটা ওদের পূর্বপুরুষ কোনো মতেই পারতো না।  আধুনিক জিরাফ অর্জন করেছে  - যাকে বলে একটা gain-of-function. 
বিবর্তন ফসল - আজকের আফ্রিকায় আধুনিক জিরাফ 
চন্দন: কিন্তু ধর, ওই লম্বা লম্বা গাছগুলো মরে গেল। তাহলে তো লম্বা গলার অ্যাডভান্টেজ রইলো না।  

নন্দন: হতেই পারে। প্রকৃতি পাল্টাতে থাকে।  যদি গাছগুলো সব মরে যায়, তাহলে বলতে হবে পরিবেশ পাল্টে গেছে। এবার এই নতুন পরিবেশে জিরাফের কোন বাচ্ছা বেশি সফল হবে, সেই খেলা শুরু হবে।বলছি না, প্রকৃতির সবকিছু - প্রাণী ও প্রাণহীন - সারাক্ষন ছোটছোট করে পাল্টাতে থাকে। তাই এই বিবর্তন কখনো থামে না। 

চন্দন: কিন্তু তাতে তো ওই প্রাণীগুলো মরে যাবে, নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে।  

নন্দন: যাবে তো যাবে। প্রকৃতির কিচ্ছু যায় আসে না। গত ৪০০ কোটি বছরে কত প্রাণী এল আর গেল, কিছু যায় আসে কি? এই তো ডাইনোসররা এতো কোটি বছর রাজ্যত্ব করে হারিয়ে গেছে। আমাদের পূর্বপুরুষ হোমো ইরেক্টাস, বা জ্ঞাতি নিয়ান্ডার্থালরা হারিয়ে গেছে।  গেছে তো গেছে। পৃথিবীর কিছু যায় আসে? আরে পৃথিবীর  তো প্রাণ বা উপলব্ধি নেই যে 'ভাল খারাপ লাগবে'। এটা শুনতে একটু নিষ্ঠুর মনে হয় - কিন্তু nature is supremely indifferent. 

চন্দন: হমমম। ...কিন্তু, এই variation হয় কি করে? আর এর সঙ্গে জিনোমের কি সম্পর্ক? 

নন্দন: ভাল বলেছিস। answer is  জিনোম হচ্ছে বাড়ির প্ল্যান, আর সেই প্ল্যান দিয়ে ফাইনালি তৈরী হয় প্রাণীর শরীর। সুতরাং শরীরে যা ছোট ছোট তফাৎ দেখছিস (জিরাফের ক্ষেত্রে গলা) সেটা হচ্ছে কারণ প্রতি জেনারেশনে জিনোমে ছোট ছোট তফাৎ হতে থাকে। বলতে প্যারিস জিনোমের বিবর্তন চলতেই থাকে। ছোট ছোট তফাৎ জমতে থাকে। যেখানে এককালে A ছিল সেটা G হয়ে যায়, যেখানে ৫ লক্ষ্ বছর আগে T ছিল সেটা A হয়ে যায়।  আর যেহেতু জিনোম হচ্ছে প্রোটিন তৈরির কোড, তাই জিনোমের ছোট ছোট পরিবর্তন মানে শরীরে কোষে যে প্রোটিন তৈরী হয় তাতেও ছোট ছোট চেঞ্জ জমতে থাকে, এবং তাদের ক্ষমতাও অল্প অল্প করে পাল্টাতে থাকে। অনেক সময়ই এরকম পাল্টে যাওয়া ক্ষতিকারক হতে পারে , হয় ও।  কিন্তু কালেভদ্রে এমন একটা টুক করে পরিবর্তন হয় যে ওই environmentএ সেটা একটা advantage দেয়। তখন যে ব্যক্তিবিশেষের শরীরে ওই তফাৎটা হয়েছে তার সুবিধে হতে পারে।  survival of the fittest . 

চন্দন: বুঝলাম। শরীরে বিবর্তন হচ্ছে আসলে প্রোটিনের কাজের বিবর্তন আর সেটা সম্ভব যদি জিনোমে বিবর্তন হয়, কারণ জিনোমের নির্দেষ অনুযায়ী প্রোটিন তৈরী হয়।  ....ok . কিন্তু জিনোম পাল্টায় কেন? 

নন্দন: তুই আজ মুডে আছিস। দারুন interact করছিস। আবার ভাল প্রশ্ন।  উত্তর হচ্ছে - এটা জিনোমের একটা ধর্ম।  ....বুঝলি না তো? খুব সোজা করে বললে, এক জেনারেশন থেকে অন্য জেনারেশনে যখন তৈরী হয় তখন জিনোম কপি করতে হয়।  এই কপি করার সময়ে কিছু কিছু অক্ষর ভুল কপি হয়ে যায়। সবসময় হয় না, কিন্তু মাঝে মাঝে হয়ে যায়। হয়ত জিনোমে সব মিলিয়ে ৭০০টা A ছিল।  ৬৯৮টা হুবহু কপি হল , কিন্তু একটা A ভুল করে G হয়ে গেল, আরেকটা A হয়ে গেল T  . এবং এই যে হল, বিবর্তনের খেলা শুরু হল। 

চন্দন: ভুল কপি হয় কেন ? 

নন্দন: এটাও বস্তুর একটা ধর্ম। প্রাণীদেহের অনুসেচকদের (enzyme) ধর্ম।  সব কাজ করে, দারুন করে, কিন্তু মাঝে মধ্যে দু-একটা ভুল হয়ে যায়। ব্যাপারটা কেমন জানিস, ধর বিরাট কোহলি যতই ভাল খেলুক, সেঞ্চুরি হাঁকাক, ছয় মারুক কিন্তু ইনিংসে একটা-দুটো শট একটু লুজ খেলা হয়ে যেতেই পারে। সেটা ঠিক দোষ নয়, হতেই পারে। না হলে তো জীবনে কোনোদিন আউট হতো না।  একই জিনিস মলিকিউলদের দুনিয়ায়। জিনোম কপি করার সময়ে মাঝে মধ্যে একটু আধটু ভুল হয়ে যায়।   

চন্দন: শুরু করেছিলাম করোনাভাইরাস দিয়ে  ....কোথায় যে তুই গেলি ?

নন্দন: আরে এটা না বললে হত ? এটাই তো ফাউন্ডেশন।  ঠিক আছে, তাহলে ভাইরাসে ফিরি।  প্রকৃতিতে কোন একটা (বা একাধিক) ভাইরাস ছিল, কোন এক প্রাণীতে। আগে একটা ব্লগে লিখেছিলাম যে ভাইরাসরা যখন কোন কোষে ঢোকে ওরা ওই কোষ হাইজ্যাক করে নিয়ে নিজেদের কপি বানাতে শুরু করে। তারপর একসময় ওই কোষের ঝিল্লি ফাটিয়ে বেরিয়ে আসে আর পাশের কোষকে আক্রমণ করে।  এই চলতে থাকে, এই হল ইনফেকশন।  

চন্দন: বুঝেছি।  তুই এবার বলতে চাইছিস যে ওই যে ভাইরাস কপি তৈরী হয় সেই সময় কিছু কপিতে ছোট ছোট ভুল ঢুকে যায়। 
ছবি ২:  যখন এত নতুন ভাইরাস তৈরী হচ্ছে, তখন কয়েকজনের মধ্যে জিনোম অল্প করে পাল্টে যাচ্ছে। 
 নন্দন: একদম।  ১০০য় ১০০. আর এই ছোট ছোট 'ভুল' (বিজ্ঞানের পরিভাষায় mutation) থেকেই আবার খেলা শুরু হয় জৈবিক বিবর্তনের। এবং এই করোনা বাবাজির ক্ষেত্রে কোন একটা কপিতে এমন কিছু mutation  জিনোমে জমে গেছে যার ফলে ও  এখন আর ওই প্রাণীতে আবদ্ধ থাকে না।  ও টুক করে লাফিয়ে চলে আসতে পেরেছে মানুষের মধ্যে, অনায়াশে ঢুকে পড়তে পারে আমাদের কোষে।

চন্দন: লাভটা কি? 

নন্দন: লাভ বলে লাভ।  একটা নতুন প্রজাতি  - মানুষ। যার এত এত কোষ।আর যে এখনো ওকে প্রতিরোধ করতে পারে না। এতো বাম্পার লটারির বাবা।জিরাফের মগডালের পাতা পাবার মত । ভাইরাসের বংশবৃদ্ধির অফুরন্ত আধার।  এ যেন  সেই পিজারো আমেরিকায় গিয়ে পড়েছে - আর গিয়ে দেখে ইনকাদের সোনার সাম্রাজ্য আছে, এল ডোরাডো আছে, কিন্তু ওদের কোনো বন্দুক কামান নেই।  ব্যাস, আর কি ! লুঠ। 

চন্দন : তা নতুন কোরোনাভাইরাসের জিনোম অন্য ভাইরাল জিনোমদের পাশাপাশি ফেলে sequence alignment করে কি পাওয়া গেল ? 

নন্দন: জানুয়ারি মাসের গোড়ায় যখন উহানের রুগীদের শরীর থেকে পাওয়া ভাইরাস বের করে তাদের জিনোম পাঠোদ্ধার হল প্রথমেই যেটা নিশ্চিত করে জানা গেল সেটা হল এটা একটা নতুন কোরোনাভাইরাস।  ইলেক্ট্রন মাইক্রোস্কোপে দেখে আগেই মনে হয়েছিল, এবার sure হওয়া গেল।  দুই, আজ অবধি যত করোনা ভাইরাস জানা আছে (যেমন আমাদের সাধারণ সর্দি ও মাঝে মাঝে কিছু কোরোনাভাইরাসের জন্যে হয় ) বিজ্ঞানীরা নানা হিসেবে মিলিয়ে তাদের চারটি বড় genusএ  (plural : genera ) ভাগ করেছেন - আলফা-কোরোনাভাইরাস , বিটা-কোরোনাভাইরাস, গামা-কোরোনাভাইরাস ও  ডেল্টা-কোরোনাভাইরাস। এর মধ্যে গামা আর ডেল্টা ভাইরাসরা সাধারণত পাখিদের আক্রমণ করে,  আর আল্ফ়া আর বিটা স্তন্যপায়ীদের শরীরে রোগ বানায় ।  এক্ষেত্রেও দেখা গেল যে নতুন কোরোনাভাইরাস বিটা genus র অন্তর্গত।  শুধু তাই নয়, ২০০২তে যে SARS ভাইরাস (এখন বলা হচ্ছে SARS classic) মহামারী করেছিল সেও বিটা genusর মেম্বার  এবং  তার জিনোমের সঙ্গে এই নতুন ভাইরাসের ভাল রকম মিল আছে - প্রায় ৭৯% . সেই জন্যে নতুন কোরোনাভাইরাসের নাম দেওয়া হল SARS-CoV-২. 

চন্দন: তাহলে মানুষকে আক্রমণ করে এই দুটো কোরোনাভাইরাস?

নন্দন: না। সব মিলিয়ে ছটা। দুটো আল্ফ়া - নাম HCoV-NL63 আর  HCoV- 229E, আর দুটো বিটা - নাম  HCoV-OC43 আর  HCoVHKU1. এই চারটে ইনফেক্ট করলে হালকা সর্দি ঠান্ডা-লাগা জ্বর হয়, সিরিয়াস কিছু না।  কিন্তু অন্য দুটো বিটা  ভাইরাস মারাত্মক। এক হল ২০০২র SARS classic আর একটা হল ২০১২র Middle East Respiratory Syndrome (MERS ) . এ দুটো থেকে ইনফেকশন হলে সেটা অনেক বেশি সাংঘাতিক। সাত নম্বর হল আমাদের নতুন কোরোনাভাইরাস - SARS-CoV-২. 

চন্দন: কিন্তু এটা এল কথা থেকে? SARS classic থেকে বিবর্তিত হয়ে? 

নন্দন: না।  দুটোর মধ্যে মিল থাকলেও অত মিল নেই যে সরাসরি এক বংশের ভাইরাস।  সেটা বিজ্ঞানীরা দেখেই বুঝে যান।  তবে কার সঙ্গে বেশি মিল সেটা বেশি খুঁজতেই হল না।  ডেটাবেসেই ছিল।  আরেকটা বিটা কোরোনাভাইরাস যার বৈজ্ঞানিক নাম RaTG13 . 

চন্দন : কিন্তু, এটা কোন প্রাণীর ভাইরাস? বিটা যখন তখন নিশ্চয়ই কোনো স্তন্যপায়ী।  

নন্দন: yes boss . এক আশ্চর্য স্তন্যপায়ী জীব।সুকুমার রায় যাকে বাংলা সাহিত্যে অমর করে দিয়েছেন একটি লাইন দিয়ে - 'বাদুড় বলে ওরে ভাই সজারু, আজকে রাতে দেখবে একটা মজারু'। 

চন্দন: বাদুড়? কোন বাদুড়? 

নন্দন: ২০১৩ সালে চীনের ইউনান প্রদেশে Rhinolophus affinis প্রজাতির একটি বাদুড় থেকে বিজ্ঞানীরা ভাইরাস বের করে স্টাডি করেছিলেন।  সেই রেজাল্ট ডেটাবেসে ভরা ছিল।  দেখা গেল নতুন কোরোনাভাইরাসের সঙ্গে এই বাদুড় ভাইরাস RaTG13র ৯৬% সাদৃশ্য।
  

.... (চলবে)  













 স্কুল খুলুক, সঙ্গে হাওয়া বাতাস খেলুক ক্লাসঘরে ('এই সময়' সংবাদপত্রে প্রবন্ধ -  ২২শে সেপ্টেম্বর, ২০২১)      সোজাসাপ্টা অপ্রিয়   সত...