Sunday, April 26, 2020

কিটের কাহিনী - কেন যে কাজ করার সময় কাজ করে না !? 
(করোনা বিজ্ঞানের খুচরো খবর-৮)


''কত বার বলতে হবে??? আমি জানতে চাই কতবার আমাকে বলতে হবে যে চাইলেই ইচ্ছেমত কিট (kit) পাওয়া যায় না? আগে থেকে প্ল্যান করতে হয়...''

বছর কয়েক আগের কথা।  আমরা ৫-৬ জন থুম মেরে দাঁড়িয়ে আছি।  আমার পিএইচডি গাইড (নামকরা মলিকুলার মাইক্রোবায়োলজিস্ট - যেমন নামডাক, তেমন বাজখাঁই হাঁকডাক) সবার ওপর রাগে ফেটে পড়েছেন।

যে কথাটা বলছেন সেটা অবশ্য নতুন নয়।  আর তাই ওঁর রাগ justified ছিল।  আজ বুঝি কত বেশি justified . একেই বলে অভিজ্ঞতা।...

স্যার আবার গলা তুললেন, '' আমি হাজার বার বলেছি সায়েন্স কেমিক্যাল আর কিট অর্ডার বাজারে বা শপিং
মলে যাওয়া নয়। গেলাম-ঘুরলাম-কার্ড দিলাম-জিনিস তুলে আনলাম তা নয়। ও ভাবে হয় না। তাই যে experiment বা টেস্ট  করার প্ল্যান হচ্ছে সেটা অন্তত ১-২ মাস আগে থেকে প্ল্যান করে আমাকে জানাবে।  তখন বিভিন্ন কোম্পানি ওয়েবসাইট ঘেঁটে নিজের প্রয়োজন বুঝে, কোটেশন চাইতে হবে।  তারপর সেটা যাবে, উত্তর আসবে , কথাবার্তা হবে , তারপর দেখেশুনে অর্ডার করা হবে, একাউন্টস ডিপার্টমেন্ট জানবে, ওদিকে কোয়ালিটি চেক করে পাঠাবে  সে জিনিস প্লেনে আসবে , কাস্টমস পেরোবে (তাদেরও বলে রাখতে হবে), ডেলিভারি হবে ....'

সিনিয়র হিসেবে আমাদের জানা কথা, স্যার জুনিয়রদের জন্যে বেশি করে বলে চললেন , ''...তারপর সেই কিট ল্যাবে এসে পৌঁছলে সেটা চেক করবে তোমরা, ভাল হলে ভাল, খারাপ হলে সঙ্গে সঙ্গে রিপোর্টিং, আবার replacement. আর এসবে টাইম দিতে হয়। 'উঠলো বাই তো কিট চাই' করলে গন্ডগোল হবেই।ওরাও লাভের জন্যে তাড়াতাড়ি চেক না করে পাঠাতে পারে  ......

'কিন্তু স্যার ওরা ভুল করলে আমাদের কি দোষ ?', এক সহকর্মী একটু ডিফেন্ড করার চেষ্টা করলো।

স্যারের ইয়র্কারে স্টাম্প ছেৎরে গেল, 'টেস্ট কে করছে? তুমি না ওই কোম্পানি? এক্সপেরিমেন্ট কার? টাকা কার? তোমার না ওদের? তোমার। তাহলে দায়ও বেশি তোমার।  আর তাই আগে থেকে প্ল্যান করার দায়িত্ব তোমারই।  ...(স্যারের গলা আরো চড়ে গেল) - আরে বাবা! তাড়াহুড়ো করে জিনিস কিনলে ভুল হবার চান্স থাকে কি না? ঠকে যাবার চান্স বেশি হয় কি না ??? আর এখানেও সেই একই জিনিস। ....তখন টাকা নষ্ট, সময় নষ্ট, পন্ডশ্রম। যেটা হড়বড় করে হয় না, সেটা হয় না। ....এটা সরকারি টাকা , ফালতু নষ্ট করার নয়।  ....  মনে থাকবে  ...??!!'

মানুষ ঠেকে শেখে। আজ এত বছর পরে স্যারের সেই 'জ্ঞান' বারবার মনে পড়ছে আমাদের অনেকের। সপ্তাহ দুই তিন ধরে এই নিয়ে বন্ধুমহলে আলোচনাও চলছে। বলাবলি করছিলাম , 'যা আসছে কিটগুলো কাজ করলে হয়।....', আমি আগের একটা ব্লগে লিখেওছিলাম।  সবাই আশা করে আছি , বিজ্ঞানীরাও।  কিন্তু যেটুকু ট্রেনিং আছে তাতে জানি চাওয়া/না-চাওয়া/ ইচ্ছে /অনিচ্ছে/আশা / হতাশা এগুলো সব আমাদের মানবলোকের ইমোশন।  এর সঙ্গে না-মৃত-না-জীবিত করোনাভাইরাস ও কঠিন বৈজ্ঞানিক সত্যের প্রায় কোনো সম্পর্ক নেই। আর বিজ্ঞান ছাড়াও এটা তো অনেকটা ডিমান্ড-সাপ্লাই'র সোজা ব্যাপার।  ফেব্রুয়ারি আর মার্চে যদি ভারত রেডি হতে শুরু করত, ppe কিনত, export বন্ধ রাখত আর প্রোডাকশন বাড়িয়ে ফেলত, আরো অনেক কিট অর্ডার করে রাখতো তাহলে আজ কি এই অবস্থা হত ? আজ তো গন্ডগোল হবেই। ওই একই কিট সারা পৃথিবী কিনতে চাইছে। আর প্রোডাকশন যদিও বা বাড়ে তার একটা লিমিট আছে। তাই এই অবস্থায় সাপ্লাই-এ দেরি হওয়া স্বাভাবিক, কোয়ালিটি খারাপ হওয়া স্বাভাবিক,  ট্রান্সপোর্টের সময় ঠিকঠাক স্টোর হচ্ছে কি না (অনেক কিছুই ঠান্ডায় রাখতে হয় ) তাই বা কে জানে , দামও বেশি পড়তে প্রায় বাধ্য।স্যারের কথায়, '' যেটা হড়বড় করে হয় না, সেটা হয় না''!

বলতে বাধ্য হচ্ছি, এসব চলবে। তাই ওই নিয়ে বেশি কাঁদুনি গেয়ে লাভ নেই। প্রশ্ন হচ্ছে -  কোনো লং টার্ম সল্যুশন আছে? হয়ত আছে। দেখুন, সোজা করে বলার চেষ্টা করি। একটি কিট বলতে বোঝায় কিছু কেমিক্যালের সমষ্টি।সাত-আটটা কেমিক্যাল। ছোট ছোট টিউবে ভরা থাকে, আর টিউবগুলো একসঙ্গে একটা বাক্সে বা প্যাকেটে থাকে। যেমন রিয়েল টাইম RT-PCR করতে লাগে রিভার্স ট্রান্সক্রিপ্টেস আর ট্যাক পলিমারেস দুটি এনজাইম , চারটে dNTP, ট্রিস বাফার, বিশুদ্ধ জল, ট্যাকম্যান ফ্লুরেসেন্ট প্রোব, আরো টুকিটাকি। যখন টেস্ট করা হয় তখন সেগুলো পর পর মিশিয়ে চট করে শুরু করে দেওয়া যায়।  মানে ওই রান্না করতে হলে নিজে না বেটে যদি সব প্যাকেটের মশলা, বা আদাপেস্ট টুক করে কড়ায় দিয়ে দিলেন। অনেকটা সেই রকম সুবিধে।কিন্তু, তার মানে এই নয় যে কিট অপরিহার্য। কোম্পানির নামকরা গুঁড়োমশলা বা আদা-রসুন পেস্ট না থাকলে কি রান্না হয় না? তেমনি কেমিক্যালগুলো কিট ছাড়াও পাওয়া যায়, এবং  অভিজ্ঞতাসম্পন্ন বিজ্ঞানীরা কিট ছাড়াও একই রিয়াক্সন করতে পারেন। কেমিক্যালগুলো  দরকার।
কিয়াজেন কোম্পানির কিট 
আমাদের দেশে এইসব কেমিক্যাল মূলত বাইরে থেকে আসে। দেশে যে কিছু তৈরী হয় না তা নয়, তবে ভালো কোয়ালিটির জিনিস আজও বাইরে থেকে আসে।  এটাই চলে আসছে - কেন এতগুলি বিশ্ববিদ্যালয় আর ইনস্টিটিউট, এত বায়োটেক কোম্পানি এদিকে নজর দেননি সেটার সম্ভবত কোন সদুত্তর নেই। সে যাই হোক, আজ বিপদের দিনে যদি কোন রাজ্যের উনিভারিসিটি, ইনস্টিটিউট আর কোম্পানির বিজ্ঞানীরা এক হবার সুযোগ পেতেন, এবং তাঁদের আর্থিক সুবিধে দেওয়া হত, তাহলে অন্তত বেশ কয়েকটা কেমিক্যাল বানানো যাবে না এটা হতে পারে না। মনে রাখবেন ভারতের নামকরা বিজ্ঞানীরা অনেকেই পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ উনিভার্সিটি থেকে বিজ্ঞান শিখে এসেছেন। পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ বিজ্ঞান জার্নালে তাঁদের একাধিক গবেষণাপত্র প্রকাশিত হয়েছে। জ্ঞান ও অভিজ্ঞতা তাঁদের প্রচুর - আন্তর্জাতিক বিজ্ঞানের লর্ডস মাঠে তাঁরা সেঞ্চুরি হাঁকিয়ে এসেছেন। সুতরাং, এক হয়ে বসলে, সুযোগ দেওয়া হলে,  বেশ কয়েকটা কেমিক্যাল বানাতে পারবেন এতে কোন সন্দেহ নেই।  আর যে দু-একটা প্রযুক্তিগত কারণে দেশে করা সম্ভব হত না সেগুলো ইম্পোর্ট করতে হবে। এসব হবে কি হবে না সে তো পরের কথা, তবে এটা বলতে পারি করলে খরচ অনেক কমে যেত। বিদেশী ব্র্যান্ডেড কম্পিউটারের  থেকে assembled কম্পিউটার কেনা যেমন শস্তা এটা অনেকটা সেইরকম ব্যাপার।

তাছাড়া যেমন বিভিন্ন কোম্পানির মোবাইল বা টিভি বা গুঁড়ো সাবান মোটামুটি এক হলেও অল্পস্বল্প তফাৎ থাকে, তেমনই বিভিন্ন কোম্পানির কিটের মধ্যে কিছু তফাৎ থাকে। থাকবেই।  আর সেই জন্যে প্রতিটা কিটের গুণমান আলাদা করে মাপতে হয়। না হলে যে রিয়াক্সন এতদিন দিব্যি হচ্ছিল, সেটা নতুন কিটে কাজ করা বন্ধ করে দেয়।  পসিটিভ হয়ে যায় নেগেটিভ!  আসলে নেগেটিভ নয়, বিজ্ঞানের পরিভাষায় false নেগেটিভ।এবার বোঝো ঠ্যালা। তখন আবার নতুন করে সব চেক কর রে, আগাপাস্তলা কোয়ালিটি দেখ রে - সময় নষ্ট,  পরিশ্রম, ওদিকে আসল রুগীদের টেস্ট জমে যাচ্ছে ! কিন্তু, একটাই স্টেডি সাপ্লাইয়ের ব্যবস্থা হলে সেই ঝামেলা বাইপাস হয়ে যায়। আর যাঁরা টেস্ট করছেন আর যাঁরা কেমিক্যাল তৈরী করছেন তারা একই রাজ্যে বা পাশাপাশি রাজ্যে হলে তাদের মধ্যে কথাবার্তা, আলোচনা rapport অনেক better হত।  ধরুন, কোন একটা কেমিক্যাল কাজ করছে না বলে সন্দেহ, দ্রুত কথা বলে নেওয়া যেত।  আর তার দুদিন পরে শুধু ওই বিশেষ কেমিক্যালটাই চলে এল, গোটা কিট কিনতে হল না। একই টিমের লোক কাছাকাছি থাকলে আর ভালো যোগাযোগে হলে যা হয়, আর কি। কোয়ালিটির তফাৎ হবে না ? হতে পারে, গুনগত মানে  বিশ্বের একদম শ্রেষ্ঠ কেমিক্যাল নাও হতে পারে।  কিন্তু মোদ্দা কথা হচ্ছে ঠিকঠাক রেসাল্ট দিচ্ছে কি না।দিলেই তো হল। ....

এ অসুখ যে চট করে যাবার নয় বুঝতেই পারছেন। ভ্যাকসিন আসবে, এন্টিভাইরাল আসবে, কিন্তু সেসব তো ম্যাজিক বা তুকতাক নয় - কিছুটা সময় তো দিতেই হবে। তাই কিট বা কেমিক্যাল আমাদের লাগবেই। কতদিন আর বিদেশের মুখাপেক্ষী হয়ে থাকবেন? তারাই বা সবসময় নিজেদের দেশ ছেড়ে আমাদের হয় কোয়ালিটি জিনিস দেবে কে গ্যারান্টি দিয়েছে? তাই শুরু করলে আজ নয়, কিন্তু মাস খানেকের মধ্যে বেশ কিছুটা এগোনো যাবে। হয়তো এমন একদিন এল যেদিন সেই কেমিক্যাল অন্য রাজ্যদেরও সরবরাহ করা গেল। রাজ্যের নামও হল , কিছু আর্থিক লাভও হল। ইচ্ছে থাকলে উপায় হয়, অন্তত কিছুটা তো হয়। ....

এই হল ব্যাপার। আর কি বলব ? এখানে রিয়েল টাইম RTPCR কিটের কথা আলোচনা করেছি। আন্টিবডি টেস্ট কিট আলাদা হলেও ওপরের সব কথাই কম বেশি প্রযোজ্য। আর জানেনই তো, দুদিন ব্যবহারের পরে এখন সারা দেশে ওই কিট দিয়ে টেস্ট স্থগিত রাখা হয়েছে।

সবাই ভাল থাকবেন।  সুস্থ থাকবেন। আবার কথা হবে।



(ছবি : https://www.qiagen.com/in/products/discovery-and-translational-research/pcr-qpcr/real-time-pcr-enzymes-and-kits/probe-based-one-step-qrt-pcr/quantitect-probe-rt-pcr-kit/?clear=true#orderinginformation)








  

Tuesday, April 21, 2020


ভাইরাস কি ফিনিক্স পাখি যে ডেডবডি থেকে উড়ে বেরিয়ে আসবে? 
(করোনা বিজ্ঞানের খুচরো খবর -৭)


নন্দন: কিরে ? মুখটা এরকম থমথমে কেন? ....

চন্দন (মোবাইল দেখতে দেখতে) : এই একটা বিচ্ছিরি খবর  .....

নন্দন: আরে দূর! বলছি এত মোবাইলে সারাক্ষন করোনা করোনা করিস না।  শরীর খারাপ হবে।

চন্দন: না না। সেটা আজকাল কমিয়ে দিয়েছি।  কিন্তু এই খবরটা বড্ড বাজে রে - চেন্নাইতে একজন ডাক্তার , নাম ডঃ সাইমন হারকিউলিস, মারা গেছেন, তাঁকে কবর পর্যন্ত দিতে দিল না লোকজন।  ফ্যামিলি, বন্ধুবান্ধব , এমনকি পুলিশকে লোকজন মারতে এসেছে। পরে অনেক রাত্রে বন্ধুরা সমাধিস্থ করেছে। ....এই দ্যাখ, জুনিয়র ডাক্তার কাঁদতে কাঁদতে বলছে - এই কি এঁর মত সেবা-নিবেদিত মানুষের প্রাপ্য ছিল ? ....

নন্দন: কি বলব ভাই। ....থালা বাজিয়ে যে সত্যি শ্রদ্ধা অনেকেরই আসে না বুঝতেই তো পারছিস।  চাপের মুখে দূর্দিনে যে বন্ধু সেই আসল  .....

চন্দন: কিন্তু, এরকম তো রোজ দেখছি।  এই তো যে দমদমের ভদ্রলোক মারা গেলেন দিন দশেক আগে - নিমতলায় তাঁর দাহ হচ্ছিলো না। ....কালকেও তো খবরে দেখলাম নর্থ বেঙ্গলে কোন জায়গায় যেন একজনকে কবর দিতে গিয়ে লোকজনের কি রাগ  .....ভাঙচুর  .....

নন্দন: অত্যন্ত অন্যায়। ক্রিমিনাল  অভদ্রতা।  ....আর এর মূলে আছে চূড়ান্ত অজ্ঞতা।

চন্দন: আচ্ছা, সত্যি কি ভাইরাস ডেড বডি থেকে ছড়ায়?

নন্দন: তাই কখনো হয় ? এতো সামান্য BSc বা এমনকি হাইস্কুলের বিদ্যে একটু ভাবলেই দেখা যাবে এটা হতে পারে না।

চন্দন: একটু খুলে বল।

নন্দন: দেখ, একেই ভাইরাস জিনিসটা বড্ড ছোট, তার ওপর জড় আর প্রাণের মাঝখানে অবস্থিত একটি অদ্ভুত জিনিস।  তার ওপর আমাদের এই 'সব বিষয়ে সব কিছু জানি' সমাজে আসলে যে কোন জিনিস সম্পর্কে জ্ঞান খুবই কম। আর তাই, যে আমরা দিব্বি সকাল বিকেল পাড়ায় আড্ডা মারছি, 'আমি তো বড় রাস্তা দিয়ে যাবো না, টুক করে গলি দিয়ে ঘুরে আসবো' বলে একটু ফাঁকা রাস্তায় বেড়িয়ে  আসছি, সেই আমরা কোনো মৃতদেহ দেখলে 'ওরে গেল গেল' করে উঠছি।  যেন ডেডবডি থেকে  লক্ষ লক্ষ কোটি কোটি ভাইরাস লাফিয়ে লাফিয়ে কিলবিল করে বেরিয়ে এসে আমাদের এই 'ধন ধান্যে পুষ্পে ভরার' তেরোটা বাজিয়ে দেবে!!!

চন্দন: হা হা হা  ...

নন্দন: হাসির কথা না। আগে কুষ্ঠ বা ওলাউঠো রুগীকে দেখলে যা করা হত এটা  তার repeat কি না , না কি আমাদের এই জাতপাত-বিদীর্ন দেশের রন্ধ্রে-রন্ধ্রে ঢুকে যাওয়া cool অমানবিকতার আরেকটা নিদর্শন তা সমাজতাত্ত্বিকরাই বলতে পারবেন। তবে এটা যে বিজ্ঞানের ডিগ্রীধারী ভরা দেশে বেশ বেমানান সেটা বলতে পারি।  

চন্দন: প্রশ্ন হল - কোন মৃতদেহ থেকে কোরোনাভাইরাস সংক্রমণের সম্ভাবনা আছে কি?

নন্দন: দেখ, উত্তর দিতে হলে আমার সেই 'ভাইরাস হল প্রকৃতির পেনড্রাইভ' উপমায় ফেরত যাই (এই সিরিজের দ্বিতীয় লেখা)। লিখেছিলাম - 'করোনাভাইরাসের এনভেলপের মূলত দুটো কাজ। এক, ভেতরের RNAকে রক্ষা করা, ঠিক যেমন পেনড্রাইভের কভার ভেতরের চিপ, কন্ট্রোলারকে রক্ষা করে, একসঙ্গে রাখে। দুই, এনভেলপ থেকে বেরিয়ে থাকা পায়ার মত স্পাইক প্রোটিন  মানুষের দেহকোষের সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপন করে। কোরোনাভাইরাসের স্পাইক প্রোটিন হল পেনড্রাইভের USB কনেক্টর আর আমাদের কোষের মেমব্রেনে বসে থাকা ACE২ রিসেপ্টার  প্রোটিন হল USB পোর্ট। খাপে খাপে লাগলেই ডেটা ট্রান্সফার শুরু। একটু পরে ভাইরাল RNA ক্যাপসিড আর এনভেলপের খোলস ছেড়ে বেরিয়ে আসে কোষের সাইটোপ্লাজমে (cytoplasm), আর এসেই প্লেন হাইজ্যাক করে নেয়। তখন সে কোষকে নিজের সাধারণ কাজকর্ম করতেই দেবে না - হুকুম দেবে 'তুই এখন আমার ক্রীতদাস ! আর সব কাজ বন্ধ করে শুধু আমার জন্যে ভাইরাল প্রোটিন আর RNA বানাবি। ' কোষ তাই করতে বাধ্য হয়, এবং কয়েক ঘন্টা পরে যখন ব্যাগার খেটে খেটে মরে যায় তখন ওর ঝিল্লি ফাটিয়ে বেরিয়ে আসে নতুন কোরোনাভাইরাস প্রজন্ম, তাদের মধ্যেও সেই একই RNA, একই ক্যাপসিড , একই এনভেলপ।  পেনড্রাইভ থেকে ডেটা ট্রান্সফার আর কপি করার মতো হুবহু এক না হলেও অনেকটা মিল অনস্বীকার্য।'

চন্দন: হ্যাঁ, মনে আছে।

নন্দন: তাহলে এবার বল তো - কোনোদিন দেখেছিস যে ডেস্কটপ বন্ধ বা ল্যাপটপের পাওয়ার অফ, অথচ তখনও পেনড্রাইভ data দেখাচ্ছে, data কপি করছে ??? না। এটা যে অসম্ভব সেটা তুইও জানি আমিও জানি। হয় না, হতে পারে না। আর অনেকটা একই কারণে একটি মৃতদেহ থেকে actively লক্ষ্ লক্ষ কোরোনাভাইরাস বেরিয়ে আসতে পারে না।

চন্দন: ওহ হ্যাঁ , তাই তো।  লোকটা তো মরেই গেছে, তার মানে তার কোষগুলোও মরে গেছে।  মরা কোষ থেকে আর নতুন ভাইরাস তৈরী তো হবে না।

নন্দন: exactly ! Cell Biologyর বেশি detailsএ ঢুকবো না। তবে স্কুলপাঠ্যে যেসব জিনিস প্রায় সবাই পড়েছি/ পড়ছি তা টেনে এনে বলি - ভাইরাস যে আক্রান্ত কোষে নিজের বংশবৃদ্ধি করবে, তারপর কোষের সাইটোপ্লাজম, Endoplasmic reticulum, Golgi body, cytoskeleton, vesicles ও membraneএ অবস্থিত প্রোটিনের সাহায্যে বেরিয়ে আসবে এই সব কিছু করতে বেশ কিছুটা এনার্জি লাগে।  ঠিক যেমন পেনড্রাইভ'র কাজ করতে ডেস্কটপ /ল্যাপটপ power on রাখতে হয়।  আর প্রাণীদেহে এনার্জি কোন অনু থেকে আসে আমরা প্রায় সবাই জানি - ATP .

চন্দন: আরে তাই তো।  ATP . মনে আছে - কোষের এনার্জি কারেন্সি। ...

নন্দন: একদম।  এই যে খাওয়াদাওয়া করছি , খাওয়াদাওয়া যাতে করতে পারি সেই জন্যে সকাল-বিকেল-রাত্রি রোজগারের চেষ্টা করছি, সেই দুশো বছর আগের ঈশ্বরী পাটনীর 'আমার সন্তান যেন থাকে দুধে ভাতে' থেকে আজকে আমাদের 'মাল কামাতে হবে' সব কিছুর ফাইনাল লক্ষ্য হচ্ছে - ATP তৈরী। কারণ,  ATP থেকে এনার্জি না পেলে আমাদের কোষগুলি কোনো কাজই করতে পারবে না।খুব বেশি simple করে বললে 'যতক্ষণ ATP ততক্ষন জীবন' ..... আর মৃত্যুর প্রায় সঙ্গে সঙ্গে এই ATP তৈরিও প্রায় পুরোটাই বন্ধ হয়ে যায়।

চন্দন: তাই ?

নন্দন: তাই না? ATP কোথায় তৈরী হয়?  কোষের মাইটোকন্ড্রিয়ায়।  আর সেখানে কি লাগে? খাবার থেকে গ্লুকোজ , আর ফুসফুস থেকে অক্সিজেন। অক্সিজেন কে পৌঁছে দেয় ? রক্ত।  রক্ত নিজে যায় কি করে? হার্ট বিট করে চলে তাই, পাম্পের মত।  ডেড বডি'র হার্ট বিট চলতে থাকে????

চন্দন: ওহ তাই তো! হার্ট বন্ধ, মানে রক্ত সাপ্লাই বন্ধ, মানে অক্সিজেন আর পৌঁছবে না , মানে ATP আর হবে না। তাহলে আর নতুন ভাইরাস তৈরী জন্যে এনার্জি পাওয়া যাবে না।

নন্দন: ঠিক তাই।  শুধু তাই না, রক্ত সাপ্লাই বন্ধ হলে কোষ ও কলা (cell and tissues ) অন্য সব সাপ্লাইও বন্ধ হবে।  যা মালমশলা ভেতর আছে তা দিয়ে কিছুক্ষন চলবে, কিন্তু তারপর আর কোষের স্ট্রাকচার বা আধারকে ধরে রাখার ব্যবস্থা ও থাকে না।  আস্তে আস্তে সব নষ্ট হতে থাকে। নতুন ভাইরাস পাবি কোথা  থেকে?

চন্দন: কিন্তু যে ভাইরাস অলরেডি তৈরী হয়ে গেসল?

নন্দন: দেখ, ভাইরাস তৈরী হলেই তো হল না। সাইটোপ্লাজম থেকে সেটা ঝিল্লি অবধি যেতে হবে। মাঝপথে  Endoplasmic reticulum, Golgi body, cytoskeleton, vesicles ইত্যাদির কিছু কাজ আছে একটা পরিপূর্ণ ভাইরাস করতে , বেশ কিছু cellular pathways আছে এবং সেগুলোও এনার্জি টানে। আর এখন আর ATP নতুন করে তৈরী হচ্ছে না।  ফলে পুরো ব্যাপারটাই ফেল করতে থাকে।  
আক্রান্ত কোষের মধ্যে কোরোনাভাইরাস তৈরির প্রক্রিয়া।  
(Reference: Alsaadi AL and Jones IM (2019) Future Virol. pp.275-286)

চন্দন: আচ্ছা। ...

নন্দন: হ্যাঁ, এটা ঠিক যে ফুসফুস আর শ্বাসনালীর কোষগুলি যখন নষ্ট হবে তখন কিছু ভাইরাস ওই ভাঙাচোরা কোষ থেকে বেরিয়ে আসতে পারে। সম্ভবত আসেও।  কিন্তু এটাও ভেবে দেখ, মৃতদেহ তো আর নিঃশ্বাস নিচ্ছে-ছাড়ছে না যে সেই ভাইরাস হুশহুশ করে বেরিয়ে আসবে! তাই মৃতদেহ থেকে droplet ইনফেকশন হবার সম্ভাবনা প্রায় নেইই।  

চন্দন: হ্যাঁ রে, ফালতু ভয় তৈরী হয়েছে বুঝছি।  তাহলে একদম বিপদ নেই বলছিস? ..... 

নন্দন: একটা ব্যাপার আছে। অসুস্থ দেহ যা এখন মৃত তার থেকে নানারকম রস, যেমন কিছুটা লালা, সর্দি, শ্লেষা , রক্ত বেরোতে পারে।  সেই সবে ভাইরাস থাকতেই পারে।  তাই WHO আর স্বাস্থ মন্ত্রক একদম নিয়ম করে দিয়েছেন যে মৃতদেহ গ্লাভস PPE পরে হ্যান্ডেল করতে হবে।  কিভাবে কি করতে হবে ওদের ওয়েবসাইটেই আছে। সেসব নিয়ম পালন ও হচ্ছে। 

চন্দন: তাহলে লোকজন এত ভয় পাচ্ছে কেন? 

নন্দন: হুজুগ। অন্তত WHO অথবা সেন্ট্রাল বা রাজ্য হেলথ মিনিস্ট্রি ওয়েবসাইট দেখলে কাজ হত, তা না করে হোয়াটস্যাপ গাঁজা পড়লে শেয়ার করলে যা হয়। আরে তুই বল না - বডিব্যাগ করে যদি বডি শ্মশানের চুল্লিতে ঢুকিয়ে দেয় তাহলে ৮০০-১০০০ ডিগ্রীতে তাহলে ওই temperatureএ কোন ভাইরাসের বাপের চোদ্দ পুরুষ টিকবে ? এতো সবচেয়ে সোজা কথা ! নিয়ম মত কবর দিলেও কি মাটি থেকে কিলবিল করে ভাইরাস বেরিয়ে আসবে??? পা আছে ওদের???? 

চন্দন: এটা দারুন বলেছিস  .....সত্যি তো    ....আর তা না করে বডি ফেলে রেখে লোকজন ঝগড়া হাতাহাতি করছে।  

নন্দন: বেশি বুদ্ধি হলে যা হয় আর কি !

চন্দন: আপনজনেরা এক একবার শেষ দেখা দেখতে পাবে না ?

নন্দন: কেন পাবে না? তবে হাত দেওয়া, জড়িয়ে ধরা, আদর করা বারণ। খুবই দুঃখজনক কিন্তু কি করা যাবে বল ? ....দেখ, শোলে'র সেই ডায়লগ -টা মনে আছে? সঞ্জীব কুমার বলছেন, 'samaj aur biradariwale insaan ko akelepan se banchane ke liye bane hai....' একই ব্যাপার  এখানেও - সেই নিয়ম কোনো নিয়মই নয়, যেখানে মনুষত্ব নেই। সেই বিজ্ঞান কোনো বিজ্ঞানই নয়, যেখানে মানুষের জন্যে দরদ নেই।  ...সাবধানে নিয়ম মানলেই হল  .....

চন্দন: তা বটে  .....বিদ্যে বোঝাই বাবুমশাই হয়ে কি লাভ? 

নন্দন: এই দুর্দিনে  যদি নিজেদের মধ্যে বিজ্ঞান সম্মত ভাবে নিজেদের মধ্যে cooperate না করি চলবে? ভাব তো - যদি আমেরিকা ইতালির মত যদি এখানে হয় সবাই কি একে ওপরের গলা টিপতে যাব ? তাতে লাভ হবে, না রুল মেনে পাশে থাকলে কাজ দেবে ? Physical distancing and social unity. 





https://www.indiatoday.in/information/story/coronavirus-death-india-how-handle-covid-19-dead-bodies-1657799-2020-03-20
https://www.wbhealth.gov.in/uploaded_files/corona/COVID19GuidelinesonDeadbodymanagement.pdf
https://thewire.in/rights/chennai-simon-hercules-doctor-covid-19
https://www.futuremedicine.com/doi/pdf/10.2217/fvl-2018-0144



  





Sunday, April 19, 2020

'QUARANTINE' - কথাটির অর্থ।  ইতিহাসের গপ্প 
(করোনা বিজ্ঞানের খুচরো খবর - ৬) 


ইব্ন সিনা -  দশম শতকের খ্যাতনামা জিনিয়াস। চিকিৎসা বিজ্ঞানের অন্যতম জনক।

যাঁর পাঁচ ভলিউমের বই 'আল কানুন ফি আল তিব্ব' (Canon of Medicine) প্রায় ৭০০ বছর আরব ও ইউরোপীয় বিশ্ববিদ্যালের মূল মেডিকেল 'টেক্সট' ছিল।

যে বইয়ে ইব্ন সিনা  Anatomy ও  শারীরবিদ্যার বিশদ বর্ণনা করেছেন ।  লিপিবদ্ধ করেছেন প্রায় ৭৬০টি ওষুধ তৈরীর প্রক্রিয়া।রুগীর প্রস্রাব পরীক্ষা ও নাড়ীর গতিপ্রকৃতি'র ওপর জোর দিয়েছেন। জানিয়েছেন যে একদম দুগ্ধপোষ্য শিশু থেকে বার্ধক্যে পৌঁছনো প্রবীনদের নানা রকম অসুখ সরিয়ে তোলা থেকে সুস্থ জীবনযাপনে কি কি প্রয়োজনীয়।এইসব তিনিই যে প্রথম লক্ষ করেছিলেন তা নয়, তবে এই ব্যাপারে systematic বৈজ্ঞানিক চিন্তাভাবনা অনেকটাই তাঁর আমল থেকে। চিকিৎসাবিজ্ঞানে উন্নতি করতে হলে পরীক্ষামূলক গবেষণা ও পর্যবেক্ষণ যে অপরিহার্য এই আধুনিক বৈজ্ঞানিক ধারণার অন্যতম অগ্রদূত ইব্ন সিনা (প্রাচীন ভারতে চিকিৎসা যথেষ্ঠ উন্নত হলেও এই সময় কেন পিছিয়ে পড়ে তাঁর অসাধারণ বিশ্লেষণ করেছেন আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায়....)

ইব্ন সিনার বড় আবিষ্কার এই যে  কিছু অসুখ যেমন পানীয় জল থেকে আসতে পারে তেমনি কিছু  অসুখ ভিড় জায়গায় বেশি করে ছড়িয়ে পরে, এবং বাইরে থেকে কোন অসুস্থ ব্যক্তি শহরে এলে আরো অনেকে তার সংস্পর্শে এসে আক্রান্ত হয়।

আর তাই, ব্যাকটেরিয়া বা ভাইরাস চোখে না দেখলেও তাদের বিরুদ্ধে লড়াই করার জন্যে তিনি একটি নিয়ম প্রচলন করেন যা আজ, এক হাজার বছর বাদেও , আমাদের জীবন নিয়ন্দ্রণ করছে।বাঁচাচ্ছে। ইব্ন সিনা বিধান দেন যে ছোঁয়াচে রোগ থেকে বাঁচতে হলে '৪০ দিন' আলাদা থাকতে হবে।  ৪০ দিনের এই isolation পিরিয়ডকে তিনি নাম দিয়েছিলেন 'আল আরবা'ইনিয়া। পরের কয়েক শতক সংক্রমণ ঠেকাতে  ছোটোখাটো ভাবে এর ব্যবহার হত মধ্য প্রাচ্য, উত্তর আফ্রিকা ও বাইজেন্টাইন সাম্রাজ্য। 

১৩ শতকে যখন Black Deathরুপী প্লেগের মহামারী ইউরোপে ছড়িয়ে পড়তে শুরু করে, তখন ভেনিসের বণিক সমাজ আনুষ্ঠানিক ভাবে নিয়ম করেন ইব্ন সিনার '৪০ দিনের নিয়ম' পুরো রাজ্যকে মানতে হবে। 'আল আরবা'ইনিয়া তো ফার্সী কথা।৪০ দিন। ইতালিয়ান ভাষায়  সরাসরি অনুবাদ করলে দাঁড়ায় 'Quarantena' [আমাদের পরিচিত ইংরিজি শব্দ quarter, quaterly , quaternaryর সঙ্গে মিল যে আছে সে তো বুঝতেই পারছেন।  সবই ওই 'চার' related ...)

আর তাই আজও আমরা করোনাবাবাজিকে ঠেকাতে quarantine করে চলেছি।


(ছবি: ফেসবুক থেকে নেওয়া)

History of Medicine - the Middle Ages 500-1450 : Kate Kelly
https://www.trtworld.com/magazine/how-ibn-sina-s-work-became-a-guiding-light-for-scientists-facing-contagions-35440
https://en.wikipedia.org/wiki/The_Canon_of_Medicine



 




Thursday, April 16, 2020

সবাই যে 'টেস্ট' 'টেস্ট' করছেন,  কোরোনাভাইরাসের পরীক্ষায় কি করা হয়? 
(চলিত বাংলায়, আড্ডার ছলে...  করোনা বিজ্ঞানের খুচরো খবর - ৫) 


নন্দন: কি রে ব্যাটা, কি করছিস?

চন্দন : এই আর কি.... কাগজ পড়ছি  ....

নন্দন: মুখটা এমন ব্যাজার কেন? চায়ের দোকানের আড্ডা বন্ধ তাই মুড অফ?

চন্দন: সেটা কিছুটা ঠিক বলেছিস।...সামনাসামনি ভাট মারার একটা আলাদা ফিলিং আছে, সেটা ঠিক অনলাইন হয়েও হয় না   .....তাছাড়া  ....

নন্দন: তাছাড়া  ....?

চন্দন: আচ্ছা, এই টেস্ট জিনিসটা কি বলতো? মানে, এই করোনোভাইরাসের যে টেস্ট হচ্ছে  ....বেলেঘাটার হাসপাতালে। ...খুব কথা হচ্ছে টেস্ট নিয়ে  ....এতে করে কি? রক্ত নিয়ে মাইক্রোস্কোপে দেখে ?

নন্দন (কোনো কাজ নেই, তাই জ্ঞান দেবার চান্স পেয়ে একটু খুশি) : না রে।  ভাইরাস বড্ড ছোট।  এমনি মাইক্রোস্কোপে দেখাও  যাবে না , ইলেক্ট্রন মাইক্রোস্কোপ চাই, কিন্তু এই পরীক্ষায় সে সব লাগে না  ...

চন্দন: তাহলে ? ...

নন্দন: হুম  ....দেখ, আমি একটু সোজা করে বলার চেষ্টা করব , বেশি টেকনিক্যাল জিনিসে ঢুকবো না, কিন্তু তোকে মন দিয়ে শুনতে হবে  ....এখন হোয়াটস্যাপ নিয়ে ঘুটঘুট বন্ধ রাখবি , রাজি ?....

চন্দন: আচ্ছা (এইটা সত্যি জানার ইচ্ছে, মেসেজ না হয় কষ্ট করে পরে দেখা যাবে ) : আচ্ছা, তুই বল. আমি কোন জায়গা না বুঝলে তখনই জেনে নেব।

নন্দন: তাহলে একদম গোড়া থেকে শুরু করা যাক।  জিনিসটা কিন্তু মোটামুটি আমাদের এখনকার ক্লাস ১২র বইতেও কিছুটা পাবি। ....তবে কিছুটা সমন্বয় করতে হবে। ....আচ্ছা, তুই বল, এই টেস্টে যে প্রযুক্তিটা ব্যবহার হয় তার নাম জানিস?

চন্দন: হ্যাঁ  ....এই তো পড়লাম ....PCR না কি যেন ...

নন্দন: হ্যাঁ , PCR বা পলিমারেজ চেন রিয়াক্সন।  তবে একটা বিশেষ ধরণের PCR যার পুরো নাম রিয়েল টাইম রিভার্স ট্রান্সক্রিপটেজ PCR . ছোট কথায় real time RT -PCR

চন্দন: ওরে বাবা! দাঁত খুলে যাবে। ...

নন্দন (ছাত্র পালিয়ে গেলে আর জ্ঞান দেওয়া যাবে না, তাই ব্যস্ত হয়ে বলে উঠলো): আরেঃ ধুস।  সোজা উচ্চারণ real time RT -PCR , আর তাছাড়া দেখবি বিজ্ঞানের মজা হচ্ছে প্রতিটা শব্দের মধ্যেই পুরো টেকনিকটায় কি হয় সেটার আন্দাজ যাওয়া যায়।  পরে নিজেই বুঝতে পারবি। আচ্ছা, একটা কথা বল, খড়ের গাদায় একটা single ছুঁচ খোঁজা সোজা ?  না কি  সেই একই খড়ের গাদায় ছুঁচের একটা বড় বান্ডিল খোঁজা সহজ?

 তাই না?

চন্দন:  অবশ্যই ওই ছুঁচের বান্ডিল খোঁজা সহজ।

নন্দন: exactly. PCR এইটা করতে সাহায্য করে।

চন্দন: একটু খুলে বল প্লিজ

নন্দন: বলছি বলছি। ধর কারুর কোরোনাভাইরাস সংক্রমণ হয়েছে সন্দেহ হল।  তখন একটা  cotton swab (ওই অনেকটা কান পরিষ্কার করার budর মত, তবে অনেক উন্নত কোয়ালিটির জিনিস ) দিয়ে তার নাকের ভেতর থেকে কিংবা গলার ওপর দিক থেকে একটু কোষ হালকা করে চেঁছে নিতে হয়।

চন্দন: লাগে না?

নন্দন: না না  ..... হালকা করে চট করে টেনে নেয়।  আর তখন swabএ ওই ব্যক্তির কিছু কোষ উঠে আসে।

চন্দন: লোকটার কোষ উঠে এল, তাতে কি হবে?

নন্দন: সেটাই তো starting point রে; যে সংক্রমিত তার কোষের মধ্যেই তো ভাইরাস থাকে।সেই  কোষের ঝিল্লি  (cell membrane) ফাটিয়ে ভাইরাস বের করতে হয়।

চন্দন: কেন? কোষ থেকেই কেন? রক্ত থেকে নিলে হবে না?

নন্দন: হবে না তা না, তবে মনে রাখতে হবে যে নতুন কোরোনাভাইরাস নিঃশ্বাস দিয়ে ঢুকে প্রথমে গলার কোষকে সংক্রমিত করে।  ওটাই ওদের মূল entry. গলার কোষের মধ্যে বংশবৃদ্ধি করে ফুসফুসের দিকে ছড়িয়ে পড়ে।  সুতরাং কোন ইনফেকশনকে প্রথমেই ধরতে চাইলে ওইভাবেই করা best.

চন্দন: আচ্ছা, ভাইরাস যদি কোষের মধ্যে না ঢোকে?

নন্দন: ধুস! আগেরদিন তোকে সেই লেখাটা পাঠালাম না? ভাইরাস হল পেনড্রাইভের মত।  পেনড্রাইভ এমনিতে কোনো data, সিনেমা দেখাতে পারে না। তাকে ডেস্কটপ বা ল্যাপটপের পোর্টে গুঁজে দিলে তবেই data কাজ হয়।   তেমনি , ভাইরাসও প্রাণীর কোষের বাইরে থাকলে বংশবৃদ্ধি করতে পারে না।  কোষে ঢুকলে তবেই সেই কোষকে সে হাইজ্যাক করে নিজের মত অনেক অনেক ভাইরাস বানাতে অর্ডার করে।

চন্দন: আচ্ছা, ভাইরাস বংশবৃদ্ধি করে কেন?

নন্দন : যে কারণে মানুষ বংশবৃদ্ধি করে  .....যাতে নির্বংশ  না হয়।  ভাইরাস বলে কি মানুষ নয়?!

চন্দন : আচ্ছা আচ্ছা বল। ...এর পরের স্টেপ বল।

নন্দন: সেই কোষ collect করে, ঠিকঠাক একটা বিশেষ solutionএ swab চুবিয়ে বিজ্ঞানীরা ল্যাবে ফিরে আসেন।  তারপর কোষের ঝিল্লি (cell membrane) ফাটিয়ে ভেতরে যত RNA আছে সব বের করে আনেন।

চন্দন: কি করে এটা করেন?

নন্দন: অত detailsএ তোর কাজ নেই, তবে বলে রাখি যে যেহেতু সেল মেমব্রেন, আর ভাইরাল এনভেলপ, ভাইরাল ক্যাপসিড এ সবই কিছু প্রোটিন আর স্নেহ পদার্থ (লিপিড) দিয়ে তৈরী, তাই Trizol নামের একটি বিশেষ সল্যুশন আছে যা দিয়ে এই সব প্রোটিন আর লিপিড গলিয়ে ভেঙে দেওয়া যায়।

চন্দন: কিন্তু, কোষের মধ্যে তো আরো অনেক জিনিস থাকে।  কোষের নিজের ক্রোমোসোম, তার মধ্যে DNA, তার পর কোষের অন্যান্য অংশ, মাইটোকন্ড্রিয়া, রাইবোসোম, আরো কত কি  - নিজের প্রোটিন, শর্করা, ভিটামিন সব তো থাকবে মিশে। সেগুলো?

নন্দন: ঠিক বলেছিস। প্রথমে যখন কোষের ঝিল্লি ফাটিয়ে দেওয়া হয়, তখন শুধু RNA নয়, আরো সবকিছু  যেমন DNA , প্রোটিন, শর্করা, মিনারেল, ভিটামিন, ইত্যাদি  বেরিয়ে আসে। তবে সেটাই স্ট্রাটেজি। সব কিছু বেরিয়ে আসবে, আর তারপর RNA ছাড়া সবকিছু সরিয়ে দেওয়া হবে।  পরে থাকবে বিশুদ্ধ RNA .


চন্দন: কোন যন্ত্রপাতি লাগে না ?

নন্দন: লাগে, তবে খুব আহামরি কিছু না।  মূলত সেন্ট্রিফিউজ বলে একটা যন্ত্র লাগে।  সেটা আধুনিক সব ল্যাবেই থাকে, এমনকি অনেক কলেজের ল্যাবেও পাবি।  আর ক্রোমাটোগ্রাফি column লাগে।  একটা ছোট টিউবের মত, RNA বিশুদ্দ করতে।  এমনিতে সোজা টেকনিক, তবে খুব সাবধানে করতে হয়।

চন্দন: কেন? সোজাই তো মনে হচ্ছে।

নন্দন: সোজা।  তবে ভাইরাসটা খুব ছোয়াঁচে।  তাই একদম সব PPE mask গ্লাভস পরে করতে হয়।  তাছাড়া RNA জিনিসটা বড্ড পলকা। কোষের ভেতরে যতক্ষণ আছে ততক্ষন ঠিক আছে, বাইরে বেরোলেই ঝট করে degrade করে যেতে পারে, ভেঙে ঝুরঝুর হয়ে গেলো।তখন সব পরিশ্রম জলে গেল। তাই খুব সাবধানে হ্যান্ডেল করতে হয়।

চন্দন: এ তো বেশ চাপ  ....

নন্দন: হ্যাঁ , সেই জন্যে RNA নিয়ে কাজ করার সময় সব কিছু খুব বেশি ঝকঝকে পরিষ্কার বিশুদ্ধ রাখতে হয়। না হলে 'সে-যে  নাগাল পেলে পালায় ঠেলে, লাগায় চোখে ধাঁদা' . তবে পরের স্টেজেই  এই RNA থেকে DNA তৈরী করে ফেলা হয়, আর DNA নিয়ে এক্সপেরিমেন্ট করা অনেক সোজা।

চন্দন : RNA থেকে DNA মানে? এই....এইটা আমার মনে আছে।  DNA থেকে RNA হয়, তাকে বলে সেন্ট্রাল ডগমা অফ মলিকুলার বায়োলজি এটা পড়েছিলাম। এখন তুই তো উল্টো বলছিস!?

নন্দন: দেখ, তুইও ঠিক বলেছিস, আর আমিও ঠিক বলেছি। এটা ঠিক যে যখন প্রথম আবিষ্কার হয়েছিল তখন বিজ্ঞানীরা দেখেছিলেন যে একটা লম্বা DNA মলিকিউলের একটা অংশ থেকে RNA তৈরী হয় (যেন অরিজিনাল বই থেকে এক পাতা জেরক্স করলি) . তারপর সেই RNA ব্যবহার করে কোষের রাইবোসোম প্রোটিন তৈরী করে।  এটা আগে আবিষ্কার হয়।  পরে আবিষ্কার হয় যে রিভার্স ট্রান্সক্রিপটেস (Reverse Transcriptase) নামের একটি উৎসেচক (enzyme) আছে যেটা RNA থেকে DNA তৈরী করতে পারে। বিজ্ঞানীরা এখন সেই উৎসেচকটা ল্যাবে ব্যবহার করেন।

3'-GCACCAACAAAGGUUACUUUUGGUGAUGACACUG......UCAAAGUGCCAGCUACAGUUU (RNA )
5'- CGTGGTTGTT →  (ওপরের RNA থেকে তৈরী DNA)

চন্দন: ও, got it. DNA কপি করে  RNA তৈরী হল Transcription, আর RNA কপি করে DNA  তৈরী হল Reverse Transcription. প্রথমটা করে RNA পলিমারেস নামের উৎসেচক আর দ্বিতীয়টা করে রিভার্স ট্রান্সক্রিপটেস।

নন্দন: একশোয় একশো। যাক, তুই মন দিয়ে শুনছিস। good, thanks । হ্যাঁ ,   আর ওই রিভার্স ট্রান্সক্রিপটেস (Reverse Transcriptase) ছোট করলে হয় RT, যেখান থেকে টেস্টের নাম RT-PCR .

চন্দন: আচ্ছা, এই রিভার্স ট্রান্সক্রিপটেস-টা বিজ্ঞানীরা পান কোথায়?

নন্দন: সে অনেক কথা।  originally কিছু ভাইরাস থেকে পেয়েছিলেন।  তবে এখন বায়োটেকনোলজির যুগে ল্যাবে আর ইন্ডাস্ট্রিতে তৈরী করা যায়। আর শুধু এটা না, এখন অনেক অনেক উৎসেচক পাওয়া যায়।  অনেক বিদেশী কোম্পানি আছে, এমনকি দেশি কোম্পানি আছে যারা বিক্রি করে।এসব খুব বড় ব্যবসা রে  ....

চন্দন: তাই বুঝি?

নন্দন: ও বাবা! ডলারের গল্প। বড় বড় কোম্পানিরা কত কিছু পেটেন্ট করে রেখেছে, সেইসব কেমিক্যাল, এনজাইম, কিট বিক্রি করে।  অনেক অনেক টাকার ব্যাপার  .....দেখছিস না এখন কিটের জন্যে কেমন হাহাকার  ....ফেব্রুয়ারি থেকে ভারত ব্যবস্থা করেনি বলে এখন টান পড়েছে  ....যাকগে, সে অন্য কথা।

চন্দন: হ্যাঁ, RNA বেরোল তারপর কি হল?

নন্দন: এইবার হচ্ছে পরপর দুটো রিয়াক্সন।  এক হল যেটা আগে বললাম - রিভার্স ট্রান্সক্রিপটেস দিয়ে RNA থেকে কপি করে DNA করা হয়। এই বিশেষ DNAর বৈজ্ঞানিক নাম হল cDNA বা complimentary DNA. আর এই cDNA দিয়েই করা হবে real time PCR.

চন্দন: cDNAটা পরিশোধিত করতে হবে না?

নন্দন: করলেও হয়, তবে এখন যে টেকনিক বেরিয়েছে তাতে না করলেও চলবে।  তার মানে একটাই ছোট্ট টিউবে রিভার্স ট্রান্সক্রিপ্টেস রিয়াক্সন আর PCR রিয়াক্সন দুটোই করা যাবে।  একই সঙ্গে মালমশলা মিশিয়ে দাও, 'রান্না চাপিয়ে দাও' , ঠিক পরপর হবে। এতে সময় বাঁচে।

চন্দন: দারুন তো।  আচ্ছা, PCR করে লাভটা কি ?

নন্দন: ওইটাই তো আসল রে ! ওটা না করলে জানাই যাবে না ভাইরাল RNA কোষগুলোর মধ্যে ছিল কি ছিল না।

চন্দন: RNA থেকে তো সব cDNA হয়ে গেলো ? তাহলে?

নন্দন: তাই তো।দেখ, সোজা হিসেবে। প্রথমে কোষ থেকে RNA বেরিয়েছিল। ঠিক?

চন্দন:  ঠিক।

নন্দন: সেই কোষ যদি কোনো সুস্থ লোকের হয়, তাহলে তাতে শুধু কোষের নিজের RNA থাকবে।  আর যদি করোনা আক্রান্তের হয় তাহলে তাতে কোষের নিজের RNA থাকবে আবার তার সঙ্গে ভাইরাল RNAও থাকবে। ঠিক আছে?

চন্দন: বোঝা গেল।

নন্দন: এবার মনে করে দেখ, আমরা যখন কোষ ফাটিয়ে RNA বানালাম কোনো তফাৎ করি নি।  যা RNA বেরিয়েছে, সব একসঙ্গে নিয়ে নিয়েছি।  যাকে বলে Total RNA . আর সেইটা দিয়েই  রিভার্স ট্রান্সক্রিপ্টেস রিয়াক্সন করেছি।  তার মানে সুস্থ কোষ থেকে যে cDNA তৈরী হয়েছে সেটা শুধু মানব কোষের নিজস্ব RNAর কপি, আর যে কোষে ভাইরাস ছিল , সেই কোষ থেকে তৈরী cDNA হল কোষের  নিজস্ব RNA প্লাস ভাইরাল RNAর কপি।  বোঝা গেল ?

চন্দন: তারপর  ....?

নন্দন: এই cDNA দিয়ে real time PCR করা হবে।  মূল ব্যাপারটা হল PCR. খুব প্রচলিত টেকনিক, সারা পৃথিবীতে use হয়। হাই স্কুলের বইতেও থাকে এখন, bsc msc তো বটেই। আজকের দিনে দারুন অভিনব কিছু নয়, কিন্তু সত্যি যেন ম্যাজিক।

চন্দন: ধুর শালা  .....পয়েন্টে আয় না ? PCR কি করে সেটা বল।

নন্দন:  ব্যাপারটা কি জানিস, কোষের মধ্যে হাজার হাজার আলাদা ধরণের RNA ছিল. হয়তো সব মিলিয়ে ২ লক্ষ RNA মলিকিউল, কিন্তু সবগুলো এক নয়, অনেক ধরণের।  কোন একটা RNA হয়ত ১৫০ মলিকিউল ছিল, অন্য কোন RNA হয়তো ১০ হাজার মলিকিউল ছিল, আরেকটা RNA হয়ত ২৭০০ ছিল, যেটা যতটা দরকার।  আর ধরে ভাইরাল RNAও ৫০০ কপি ছিল।

চন্দন: তো....?

নন্দন: সেটাই তো।  এই ২ লাখের ভিড়ে ৫০০ ভাইরাল RNA খোঁজা যে চাপ বুঝতেই পারছিস। এ খড়ের গাদায় ছুঁচ খোঁজা। ব্যাপারটা বেশ চাপের, তাই না?

চন্দন: হুম

নন্দন: কিন্তু ধরে যদি ওটা যদি একটা ছুঁচ না হয়ে ছুঁচের বড় বান্ডিল হত ? তাও আবার বান্ডিলটা লাল কাপড়ে মোড়া। তাহলে খুঁজে পেতে নিশ্চয়ই সুবিধে হত।  PCR ঠিক সেটাই করে।  যে ভাইরাল RNA থেকে তৈরী cDNA মাত্র ৫০০ কপি ছিল শুধু সেটারই কয়েক কোটি কপি বানিয়ে দিতে পারে।  বাড়িয়ে বলছি না।  কয়েক কোটি !!!

চন্দন: বলিস কি? ....তাহলে তো চেনা যাবেই !

নন্দন: এটাই তো।  PCR এমনই একটা শক্তিশালী টেকনোলজি যেটা শুধুমাত্র একটা DNA মলিকিউল পেলেও তার থেকে কয়েক কোটি হুবহু কপি বানিয়ে দিতে পারে। বুঝতেই পারছিস, এবার যে কোন কোষ থেকে যে RNA পাওয়া গেল তাতে ভাইরাল RNA ছিল কি না সেটা বোঝা কেমন সোজা হয়ে যেতে পারে। কি?

চন্দন: এতো ফাটাফাটি জিনিস গুরু  .....আচ্ছা, করতে কতক্ষন লাগে?

নন্দন: কয়েক ঘন্টা।  খুব বেশি হলে।  আর চাইলে এক সঙ্গে অনেকগুলো রিয়াক্সন করা যায়।

চন্দন: আচ্ছা, এই কপি হয় কি করে সেটা তো বললি  না ? খুব জটিল না কি?

নন্দন: না না, বেশ সোজা, এবং সেটাই এর beauty. তোর এখনো মনে আছে কি না জানিনা তবে ক্লাস ১২র বইতে যে DNA রেপ্লিকেশন (প্রতিলিপিকরণ) চ্যাপ্টার-টা এটা অনেকটা সেটাই।  একটাই তফাৎ -  জীবনবিজ্ঞানের বইতে যেটা পড়া হয় সেটা ঘটে জ্যান্ত কোষের মধ্যে, আর PCR হয় ছোট্ট টিউবের মধ্যে ল্যাবের যন্ত্রে।  আদতে ব্যাপারটা একই।

চন্দন: আচ্ছা  .....

নন্দন: তুই জানিস, DNA মলিকিউল হল একটা পলিমার।  হাজার হাজার এমনকি লক্ষ লক্ষ নিউক্লিওটাইড মনোমার পর পর জুড়ে তৈরী হয় এই লম্বা সুতোর মতো DNA strand বা তন্ত্র। আর দুটো DNA strand একে অপরকে পেঁচিয়ে করে ফেলে সেই বিখ্যাত Double Helix অর্থাৎ , দ্বিতন্ত্রী হেলিক্স। যেন একটা পেঁচালো সিঁড়ির মত। Strandদুটোর বাইরের দিকে ডিঅক্সিরাইবোস শর্করা আর ফসফেট অনু, আর ভেতর দিকে 'বেস' . চার ধরণের বেস পাওয়া যায় - A,  T , G আর C . বিশেষত্ব হচ্ছে, এক strandর A ঠিক খাপে খাপ লেগে যায় অন্য strandর T র সঙ্গে, আর এক strandএ যদি এক জায়গায় G থাকে উল্টো দিকের strandএ ওই পজিশনে C থাকবেই, আর দুটোই খাপে খাপ লেগে যাবে।

চন্দন: হ্যাঁ মনে পড়ছে  এবার  ....

নন্দন: মানে, এরকম করে চোখের সামনে ভাসিয়ে নে - DNA হল একটা প্যাঁচালো সিঁড়ি, যার দুটো হ্যান্ডেল শর্করা আর ফসফেট দিয়ে তৈরী, আর বেসগুলো জুড়ে গিয়ে হয় সিঁড়ির ধাপগুলো।
(ছবি: কলকাতার ভারতীয় জাদুঘরে DNA double helixর মডেল )

চন্দন: আচ্ছা, ভেরি গুড।  আর মনে পড়েছে - বেসগুলোকে ধরে আছে হাইড্রোজেন বন্ড।

নন্দন: পারফেক্ট।  ১০০য় ৯০ দিলাম।

চন্দন: ৯০ কেন? ভুল কি হল?

নন্দন: কিছু না, এমনি কাটলাম  ....

চন্দন : যাহ শালা  ....আচ্ছা, আপনা টাইম আয়েগা  ....বল , তারপর বল...

নন্দন: এখানে একটা জিনিস মনে রাখতে হবে।  এমনি PCRএ double helix DNA দিয়ে কাজ শুরু হয়। কিন্তু, এখানে টেকনিকের শুরুটা একটু আলাদা। মনে করে দেখ, আমাদের এখানে কোনো দ্বিতন্ত্রী DNA এখনো নেই।  আছে, এমন একটা দ্বিতন্ত্রী মলিকিউল যা একটা strand হল RNA আর অন্য strandটা হল cDNA. এইটা দিয়েই আমরা আমাদের PCR শুরু করবো।  তবে , চিন্তা নেই - এক্ষত্রে এই RNA-cDNA হাইব্রিড আর  double helix DNA গুণাবলী'র মধ্যে কোনো তফাৎ নেই।  এখত্রেও RNA আর cDNAকে ধরে আছে হাইড্রোজেন বন্ড।  ঠিক কাজ হবে। বুঝেছিস?

চন্দন: got it . তারপর?

নন্দন: খুব সোজা।  ওই যে cDNA হল ওটার অনেক অনেক কপি তৈরী হবে PCRএ. টিউবে আগে থেকেই DNA পলিমারেস নামের উৎসেচক, ছোট ছোট ৪টে মনোমার dATP, dGTP, dCTP আর  dTTP দেওয়া আছে।  আর আছে দুটো ছোট ছোট এক তন্ত্রী (single strand ) DNA যার নাম প্রাইমার। কে কি কাজে লাগবে বলছি।  তার আগে বলে নি, মনে রাখবি, যে  PCR মেশিন টা বিভিন্ন টেম্পেরেচারে নিয়ে যাওয়া যায়।  এই ধর ৯৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস রাখলাম ২ মিনিট, তারপরেই সোজা ৪০ ডিগ্রিতে নামিয়ে দিলাম ১ মিনিট আবার ৭০ ডিগ্রি নিয়ে গিয়ে রাখলাম ৩ মিনিট।  এরকম করা যায়।  যন্ত্রের মধ্যে একটা চিপ আছে, যাতে তুই যা প্রোগ্রাম করে দিবি সেই অনুযায়ী তুই যা তাপমাত্রা আর যা সময় maintain হবে।  যা তোর ইচ্ছে।

চন্দন: বাহ্ বাহ্ বাহ্  ...তারপর?

নন্দন: এবার প্রথমেই টেম্পেরেচার ৯৫ ডিগ্রিতে নিয়ে চলে যায়। প্রায় ফুটন্ত জলের কাছাকাছি।  এতে যেটা হয় সেটা হল ওই RNA-cDNA হাইব্রিডকে যে হাইড্রোজেন বন্ড ধরে রেখেছিলো সেগুলো খুলে যায়। আর strandদুটো আলাদা হয়ে যায়।


 চন্দন: অত গরমে নষ্ট হয়ে যায় না ?

নন্দন: নঃ।  ৮০০-৯০০ ডিগ্রি না গেলে DNAর কিছু হয় না।  খুব stable মলিকিউল।  এখানে খালি RNA আরcDNA আলাদা হয়ে যায়।  আবার ঠান্ডা করলেই প্যান্ট বা ব্যাগের জিপারের মত বেসগুলো পরপর জুড়ে যাবে।  ....তবে যাক সে কথা  ....এখানে কি হয়, এইবার টেম্পেরেচার নামিয়ে আনা হয় ৫৫-৫৮ ডিগ্রিতে। এইখানে একটা মজার ব্যাপার হয়।..... মনে আছে, দুটো প্রাইমার দেওয়া আছে বলেছিলাম? এবার তাদের কাজ।  দেখ, ভাইরাসের RNAতে পরপর, একের পর এক ভাইরাল জিন গুলো বসানো আছে।  তার মানে দাঁড়ালো, সেই ভাইরাল RNA থেকে যে কপি হয়েছে তাতেও ওই ভাইরাল জিনগুলোর প্রতিলিপি একই ভাবে বসানো আছে।  ঠিক আছে?

চন্দন: হ্যাঁ ,মানে বইয়ের পাতাতে যা লেখা আছে, সেই পাতা থেকে করা জেরক্স পেজেও একই লেখা আছে।

নন্দন: একদম, দারুন বলেছিস। এইবার এই যে দুটো প্রাইমার এগুলোও তো DNA, এদেরও A T G C সাজানো আছে।  তবে এমন করে সাজানো আছে যে ঠিক একটা বিশেষ ভাইরাল জিনের যে DNA তার মুখে আর লেজে লেগে যাবে।  ওই হাইড্রোজেন বন্ড দিয়ে।  Aর সঙ্গে T, আর Gর সঙ্গে C . এটা কিন্তু প্রাইমার দুটো এমনিতে করতে পারতো না, কারণ RNA-cDNAর দুটো strand একে ওপরের সঙ্গে লেপ্টে ছিল, কিন্তু এখন ৯৫ ডিগ্রিতে গরম করতে খুলে গেছে। মানে হাইড্রোজেন বন্ডগুলো ভেঙে গেছে।

চন্দন: তাতে কি হল ?

নন্দন: প্রাইমার এরকম করে বসে গেল। এইবার শুরু হবে উৎসেচক (এনজাইম) Taq DNA পলিমারেস'র খেলা।  তার কাজ হল যেখানে গিয়ে প্রাইমার আটকেছে তার ঠিক পর থেকে পরপর ওই চারটে মনোমার dATP, dGTP, dCTP আর  dTTP জুড়তে থাকবে।  তবে যেমন ইচ্ছে তেমন নয়।  আগে থেকে যে cDNA strandটা ছিল সেটা এখানে ছাঁচ বা template. যদি ওতে A থাকে তাহলে উল্টোদিকে Taq DNA পলিমারেস T বসাবে; যদি তার পর templateএ  C থাকে তাহলে উল্টোদিকে পলিমারেস G বসাবে, আর T আর Gকে জুড়ে দেবে।  এইভাবে মনোমার জুড়তে জুড়তে Taq পলিমারেস এগোতে থাকবে আর একটা নতুন DNA স্ট্র্যান্ড তৈরী করে ফেলবে।  শুরু হয়েছিল একটা cDNA strand আর রেএকশনের এই সাইকেল শেষ হলে একটা নতুন strand পাওয়া হবে।  তার মানে একটা দিতন্ত্রী DNA মলিকিউল। এক থেকে দুই। ডবল!
চন্দন: বাহ্।  তারপর ? শেষ?

নন্দন: না রে ভাই, তবে এবার ঝটপট এগোবে সাইকেলগুলো। PCR মেশিনে এমন প্রোগ্রাম কোড করে দেওয়া থাকে যে আবার ৯৫ ডিগ্রিতে চলে যাবে। তখন আবার এই দ্বিতন্ত্রী  DNA মলিকিউলের strand আলাদা হবে, আবার টেম্পেরেচার কমিয়ে আনবে, আবার প্রাইমার গিয়ে আটকাবে, আবার Taq polymerase  এসে আগের মতোই নতুন strand তৈরী করবে। তাহলে এই সাইকেলের শেষে টোটাল হল চারটে  দিতন্ত্রী DNA মলিকিউল।  এক থেকে দুই থেকে এবার চার।



চন্দন: এটা চলতেই থাকবে?

নন্দন : একদম। এক থেকে দুই, দুই থেকে চার, চার থেকে আট, এত থেকে ষোলো, ষোলো থেকে বত্রিশ  .....যতক্ষণে ৩০-৪০ সাইকেল হয়েছে ততক্ষনে একটা ভাইরাল cDNA  মলিকিউল থেকে কোটি কোটি daughter DNA তৈরী হয়ে গেছে। বিশাআআললললল একটা amplification. এ যেন লটারির বাবা, ক্যাসিনোর জ্যাকপট।


চন্দন: আচ্ছা, প্রাইমারগুলো ভাইরাসের কোন জিনের সামনে পেছনে গিয়ে আটকাবে সেটা কে ঠিক করবে?

নন্দন: বিজ্ঞানীরা ঠিক করবেন, in fact, ঠিক করেছেন। ....যেটা  খেয়াল রাখতে হয়েছে যে এমন একটি ভাইরাল জিন বেছে নিতে হবে যেটা শুধুমাত্র এই নতুন কোরোনাভাইরাসেই আছে। মানুষের কোষে তো নয়ই, অন্য ভাইরাসেদের ও  থাকলে চলবে না।

চন্দন: তাতে ঠিক কি লাভ হবে?

নন্দন: তবেই ১০০% নিশ্চিত হওয়া যাবে যে অন্য কোনো সংক্রমণ হয়নি  ....কত রকমই ভাইরাস তো ঘুরে বেড়াচ্ছে।  .....সর্দি কাশি মানেই কি নতুন কোরোনাভাইরাস নাকি ? নতুন জীবাণু এসেছে বলে কি পুরোনোগুলো vacationএ গেছে? ........ সেই জন্যেই এমন একটা জিন নিতে হবে যেটা শুধু নতুনের আছে  ...almost যেন এর নিজের signature, অন্য কারুর নেই  ....

চন্দন: দুর্দান্ত, আমি এখনো বিশ্বাস করতে পারছি না এমন হতে পারে  ....

নন্দন: এটাই  .....আর সবচেয়ে বড় জিনিস কি, শুধু ভাইরাল cDNAর একটা ছোট্ট অংশ, একটা মাত্র জীন থেকে,  এতো কোটি কোটি কপি হয়েছে।  আর যা যা cDNA ছিল - মনে আছে, সঙ্গে কোষের নিজের RNA থেকে তৈরী cDNA অনেক ছিল - সেগুলোকে কিন্তু  Taq polymerase আর প্রাইমার দুজন ছুঁয়ে পর্যন্ত দেখেনি।

চন্দন: মানে, একটা মোটা বই'র শুধু একটা পাতা আমি ১০০০টা জেরক্স করলাম।  অসাধারণ।

নন্দন: পারফেক্ট।  আর কোন জীন ? ভাইরাসের জীন।  যে জীন এমনিতে আমাদের কোষে নেই।  সুতরাং যাঁর সংক্রমণ হয়নি তার কোষ থেকে RNA বেরোবে, রিভার্স ট্রান্সক্রিপ্টেস তার থেকে cDNAও বানাবে, কিন্তু লাস্টে তার থেকে PCR হবে না।  শুধুমাত্র যাঁর ইনফেকশন হয়েছে, তার কোষে ভাইরাস আছে বলে PCRও কাজ করবে আর ওই নির্দিষ্ট DNA দেখা যাবে।

চন্দন: দুর্দান্ত। আচ্ছা, DNAটা যে হল সেটা দেখা যাবে কি করে?

নন্দন: ভাল প্রশ্ন করেছিস।  DNA দেখার অনেক কায়দা আছে, তবে এখানে যে কায়দা-টা লাগে সেটা হল একটা ফ্লুরোসেন্ট টেকনিক।

চন্দন: ফ্লুরোসেন্ট? মানে আমাদের ফ্লুরোসেন্ট লাইট?

নন্দন: মিল আছে , ঠিকই।  তোকে আমি বেশি ডিটেল বলব না (আর বললে ঘেঁটে যাবে ), তবে হয় কি - ওই যে টিউবে রিয়াক্সন হচ্ছিল, ওর মধ্যে একটা বিশেষ মলিকিউল দেওয়া আছে।তার নাম হচ্ছে Taqman.  সেটা এমনিতে চুপটি মেরে থাকে, কিন্তু যত PCR ঠিকঠাক হতে থাকে আর DNAর পরিমান বাড়তে থাকে ওটা সক্রিয় হয়ে ওঠে আর ফ্লুরোসেন্ট আলোর সিগন্যাল দিতে থাকে।  তখন PCR যন্ত্রের সঙ্গে যে কম্পিউটার লাগানো আছে তার স্ক্রিনেই দেখতে পাওয়া যায় ফ্লুরোসেন্ট সিগন্যাল কেমন বাড়ছে না বাড়ছে না।  যদি বাড়ে বুঝবি ভাইরাস ছিল, না বাড়লে ছিল না।  সোজা হিসেবে।  রিয়াক্সন চলাকালীন দেখা যায় বলে এর নাম রিয়েল টাইম PCR. ঠিকঠাক করলে রেসাল্ট আসবেই।

চন্দন: আচ্ছা, ইনফেকশন হবার পরের দিন টেস্ট করলেই ধরা যাবে?

নন্দন: না  ....একি ম্যাজিক নাকি? ভাইরাস ঢুকবে, একটু বংশ বৃদ্ধি করবে, আরো কয়েকটা কোষে ছড়াবে।  তবে তো কিছুটা RNA  পাওয়া যাবে।  সেই জন্যে ইনফেকশন হবার ৪-৫ বা ৬ দিনের মাথায় টেস্ট করলে ভালো।  যথেষ্ট RNA পাওয়া যাবে।তার আগে করলেও পাওয়া যাবে হয়তো  ....কিন্তু ধর পেল না, তাই একটু wait করা ভালো।  নজরে রাখ, কোয়ারেন্টাইন কর, সময় হলে টেস্ট কর।  .... 

চন্দন: হ্যাঁ, তাও বটে  ....কিন্তু, ধর সব করলো কিন্তু কোনো কারণে ভুল রেসাল্ট এল ? তাহলে?

নন্দন: দেখ, পুরোটাই বিজ্ঞানের যুক্তির ওপর দাঁড়িয়ে আছে। তাই ঠিক করে করলে ভুল হবার কথা না, তবে এটাও ঠিক কোনো না কোনো গন্ডগোল হতেই পারে।  বিরাট আর সচিন কি জীবনে দশের কমে আউট হয়নি, হয়েছে।  ভুল হতেই পারে - যন্ত্রের, কেমিক্যালের, এনজাইমের , যিনি পরীক্ষা করছেন তাঁর। ..... তবে কিছু কিছু কায়দা আছে যার থেকে বোঝা যায় রিয়াক্সন হল কি হল না।

চন্দন: কিরকম?

নন্দন: নিশ্চয়ই তোর মনে আছে কোষের নিজের RNA থেকে তৈরী cDNA অনেক ছিল।

চন্দন: ছিল  ...তো ?

নন্দন: বিজ্ঞানীদের বুদ্ধি দেখ। ওই একই টিউবে আরো দুটো প্রাইমার দিয়ে দেন।  সেগুলো কিন্তু ভাইরাল cDNAকে ছোঁয় না, তারা গিয়ে মানুষের কোষে সবসময় পাওয়া যায় এমন একটি RNA থেকে তৈরী cDNA তে গিয়ে আটকে যায়।  আর যখন রিয়েল টাইম PCR শুরু হয় , আগের রিএকশনের পাশাপাশি এই PCRও চলতে থাকে।

চন্দন: তার মানে হল , ভাইরাল RNA থাকুক বা না থাকুক এই দ্বিতীয় PCR টা হবেই।

নন্দন: Exactly ,আর একটাই প্রমান যে রিয়াক্সন কাজ করেছে।  ভাইরাল RNA থাকুক না থাকুক , কোষের নিজের RNA তো ছিলই, তাই প্রথম PCR হোক না হোক , সেকেন্ড টা হবেই।  যদি না হয় , তাহলে বুঝবি কোন গন্ডগোল। তখন আবার সব করতে হবে।

চন্দন: আচ্ছা, দুটো PCR যে একই টিউবে চলবে, ঘেঁটে যাবে না ?

নন্দন: পলিমারেস আর প্রাইমার কি মানুষ যে ঘেঁটে ফেলবে? নাঃ -চিন্তা নেই।  এরা খুব specific . যে কাজ করার কথা শুধু সেটাই করে,  অন্যদিকে ফিরেও তাকায় না।

চন্দন: তার মানে যদি কারুর ইনফেকশন না হয়ে থাকে, তাহলে একটা PCR কাজ করবে, আর যার ইনফেকশন হয়ে থাকে তাহলে দুটো PCR কাজ করবে। তাই তো?

নন্দন: হ্যাঁ , আর শুধু ইনফেকশন ধরার জন্যে নয়, যখন ট্রিটমেন্ট হচ্ছে তখনও চেক করা হয়।  ধরে, যদি ১০ দিন পরে আবার রিয়েল টাইম RT PCR করে দেখলো আর ভাইরাল RNA নেই, তাহলে বুঝবে যে সংক্রমণ সেরে গেছে, রুগী সুস্থ হয়ে উঠছেন।

চন্দন: উফফফফ।......কি দুর্দান্ত জিনিস।

নন্দন: সত্যি। বিস্ময়কর। যাকে সাধারণ মাইক্রোস্কোপে ও দেখা যায় না, তার অস্তিত্ব কি সুন্দর ভাবে দেখিয়ে দেয়।

চন্দন: দেখতে পেলে দারুন হত। 

নন্দন: সে আর কি করে দেখবি? তবে Youtube এ ভিডিও দেখতে পারিস।  যেমন এটা https://www.youtube.com/watch?v=5f_wieig4iQ

চন্দন: এটাই কি একমাত্র টেস্ট ? .....কি একটা দেখলাম সেদিন খবরে - rapid test ...? সেটা আর এটা এক?

নন্দন: না না।  ওটা অন্য, ওটা পরে আরেকদিন বলব।

চন্দন: থাঙ্কস বস।  চ' ....চা খেয়ে আসি।

নন্দন : কোথায়? বন্ধ তো  ....বাড়িতেই বসা।  ওই দেখ, একটু ঠান্ডা হওয়া দিচ্ছে, বৃষ্টি হবে।


(যন্ত্রের ছবি গুগল থেকে নেওয়া। গ্রাফের ছবি উইকিপেডিয়া থেকে। জাদুঘরের ছবিটা আমার তোলা, বছর ৩-৪ আগে। বাকিগুলোর আমার আঁকা। বললাম না, খেয়ে দিয়ে কাজ নেই) 



Sunday, April 12, 2020

লকডাউন হল ডিফেন্স, টেস্ট হল স্ট্রাইকার 
(করোনা বিজ্ঞানের খুচরো খবর - ৪)

আজ ঠিক বিজ্ঞান নয়। ইতিহাস আর বিজ্ঞানের এক সাদৃশ্যের কথা লিখছি। দুটি যুদ্ধের কথা - একটি ইতিহাসের পাতা থেকে, এবং অন্যটি অবশ্যই আমাদের আজকের জীবন থেকে।  আপাতদৃষ্টিতে আলাদা ঘটনা, কিন্তু দেখবেন বেসিক-টা একই।  

অগস্ট ১৯৪২।
ইউরোপ জুড়ে নাৎসি সেনাবাহিনীর দাপট। একদিকে ব্রিটেন ছাড়া সমগ্র পশ্চিম ও মধ্য ইউরোপ হিটলারের দখলে। অন্যদিকে সোভিয়েত ইউনিয়ন'র বিস্তীর্ণ অঞ্চলেও জার্মান ফৌজের রাজ্যত্ব।  এই অবস্থায় বিশালকার জার্মান ষষ্ঠ সেনাবাহিনী (6th Army) দক্ষিণ রাশিয়ায় ভলগা নদীর তীরে অবস্থিত স্তালিনগ্রাদ শহর আক্রমণ করল।  শুরু হল স্তালিনগ্রাদের যুদ্ধ - এমন এক ভয়ানক লড়াই যার নাম চিরকালের মত ইতিহাসে লেখা থাকবে।
জার্মানরা কালান্তক বোমাবর্ষণ ও গোলাবর্ষণ দিয়ে আক্রমণের সূচনা করল।  শহরের বাইরে জার্মান advance সামলাতে না পেরে সোভিয়েতরা কিছুটা পিছিয়ে গিয়ে শহরে ঢোকার মূল রাস্তাগুলি বন্ধ করলেন , না না রকম ব্যারিকেড গড়ে তুললেন।শুরু হল স্তালিনগ্রাদের অবরোধ - প্রতি ইঞ্চি'র জন্যে এমন জানপ্রাণ লড়াই আর সম্ভবত ইতিহাসে কোনদিন হয়নি।আক্ষরিক অর্থেই 'বিনা যুদ্ধে নাহি দিব....' ; জার্মানদের হারাতে না পারলেও সোভিয়েতরা পরের কয়েক মাস জার্মানদের গতি অত্যন্ত শ্লথ করে দিলেন । হিটলার আশা করেছিল শীতকাল পড়ার আগেই স্তালিনের নামাঙ্কিত শহর তার দখলে আসবে। কিন্তু, জার্মান সেনাবাহিনী স্তালিনগ্রাদ ঘিরে ফেললেও, এবং এক এক জায়গায় ভলগা নদী অবধি পৌঁছে গেলেও শহর রয়ে গেল সোভিয়েত ফৌজের হাতে।
(ছবি ১: জার্মান আক্রমণ ও স্তালিনগ্রাদ শহর অবরোধ)

শহরের মধ্যে অবরুদ্ধ সোভিয়েত ডিফেন্ডাররা অবশ্য একা এই লড়াই চালিয়ে যেতে পারতেন না; প্রতিদিন-প্রতিরাত ভলগা নদী পেরিয়ে তাদের কাছে পৌঁছে যেত রসদ, খাবার, গোলাগুলি, ইত্যাদি। নেপোলিয়ন'র বিখ্যাত উপদেশ  an army moves on its stomach (সেনাবাহিনী তখনই লড়তে পারে যখন তার খাবার-দাবার রসদ ঠিকঠাক পৌঁছচ্ছে ) ভোলেননি সোভিয়েত সেনাপতিরা।  তাই তাঁরা জার্মান বোমারু বিমান ও কামান উপেক্ষা করে যে কোন মূল্যে শহরের সাপ্লাই লাইন খুলে রেখেছিলেন। শুধু তাই নয়, শহরের সাধারণ মানুষ ও সৈন্যরা যাতে একই রেশন পান সেই দিকে নজর রাখা হয়েছিল, এবং তাই প্রতিরোধে ছিল অভূতপূর্ব ঐক্য।

অবশ্য এই ভাবে শুধু ডিফেন্সিভ লড়লে যে হিটলার আজ না হয় কাল শহর জিতেই যাবে, এটা বুঝতে বড় সেনাপতি হতে হয় না।  ক্রিকেটে বেশি ঠুকঠুক করে খেললে যেমন কয়েক ওভার বাদে asking rate বেড়ে চাপ পড়তে বাধ্য, অনেকটা সেরকমই। অবরোধকে হারাতে হলে পাল্টা আক্রমণ করতেই হবে। এবং তাই, নভেম্বরের মাঝামাঝি  একদিন দুম করে সোভিয়েত সেনাপতি জুখভ অবরুদ্ধ স্তালিনগ্রাদ শহরের উত্তর ও দক্ষিণ দিক দিয়ে একসঙ্গে আক্রমণ করলেন অবরোধকারী জার্মানদের। মাত্র কয়েকদিনের লড়াই আর তারপর উত্তর ও দক্ষিণ থেকে আসা জুখভের দুই বাহিনী জার্মানদের ঘিরে ফেলল। তার মানে দাঁড়াল, শহরের মধ্যে সোভিয়েত ফৌজ , মাঝে জার্মানরা আর বাইরে তাদের ঘিরে ফেলা নতুন সোভিয়েত সেনা।  জার্মানরা আর আগ্রাসী নয়, অবরোধ করতে এসে  প্রতি-আক্রমণে এখন তারাই অবরুদ্ধ ! সোভিয়েত ডিফেন্স ও কাউন্টার-অফেন্স'র মাঝে জার্মানরা এবার জাঁতাকলে। যুদ্ধের মোড় ঘুরে গেছে।
(ছবি ২: সোভিয়েত প্রতি আক্রমণ। এবার জার্মানরা অবরুদ্ধ ।  

এর পরের দু মাস রাশিয়ার সেই ভয়ানক শীতে দুই সেনার মারণবাঁচন লড়াই।  কিন্তু জানুয়ারির মধ্যে জার্মান ফৌজের প্রাণবায়ু ফুরিয়ে এল।  সুদূর জার্মানি থেকে খাবারদাবার, গরম জামাকাপড়, গুলিগোলা আর এসে পৌঁছয় না।  এদিকে শহরের মধ্যে সোভিয়েতদের সাপ্লাই ঠিকই আসছে।  ফেব্রুয়ারি মাসের গোড়ায় আত্মসমপর্ণ করল জার্মানরা। ডিফেন্স-সাপ্লাই-আক্রমণ ত্রিমুখী স্ট্রাটেজি দিয়ে স্তালিনগ্রাদের অবরোধ ওঠালো সোভিয়েত ফৌজ।
(ছবি ৩: ডিফেন্স আর আক্রমণের মাঝে পিষ্ট জার্মান সেনা) 

এপ্রিল-২০২০।
 আজ, করোনাযুদ্ধের বাজারে, হঠাৎ বিশ্বযুদ্ধের এই ঘটনা নিয়ে কলম (মানে কীবোর্ড) চালালাম  কেন? তার কারণ, নতুন করোনা ভাইরাসকে হারাতে আমরা মোটামুটি ওই একই স্ট্রাটেজি নিয়েছি।এক অর্থে history repeating itself.

সোভিয়েতরা যেমন নিজেদের শহরে ঢুকে গেট বন্ধ করে ব্যারিকেড গড়ে তুলেছিলেন, তেমনি আজ আমরা
 অফিস/ব্যবসা/দোকান/বাজার/স্কুল কলেজ/ বাস/ট্রেন সব বন্ধ করে লকডাউনে বাড়িতে বসে আছি। লকডাউন হল আমাদের ডিফেন্স যার লক্ষ্য নাৎসি বাহিনীর মত আগ্রাসী ভাইরাসকে স্লো করে দেওয়া। হ্যাঁ, খুব ভালো করে প্ল্যান হয়নি বলাই বাহুল্য।  ফেব্রুয়ারির শেষেই সব ফ্লাইট বন্ধ হলে আন্তর্জাতিক যাত্রী আসাও অনেক কমানো যেত, আর বেশ কিছুটা সময় জানিয়ে লকডাউন করলে কেনাকাটার জন্যে এমন ভিড় করে হুড়োহুড়ি হত না, আর সম্ভবত লক্ষ লক্ষ শ্রমিক দিনের পর দিন কয়েকশো মাইল হেঁটে বাড়ি পৌঁছোবার আপ্রাণ চেষ্টা করতেন না। বলতে পারেন, আমাদের ব্যারিকেডে অনেকগুলি ফাঁক রয়ে গেছিল....।

ডিফেন্সের সঙ্গে অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত সাপ্লাই লাইন।ভলগা নদীর ওপর স্টিমারের পর স্টিমার হারিয়েও (এবং শীতকালে বরফ কেটে হাইওয়ে বানিয়ে ) শহরকে সাপ্লাই করেছিলেন সোভিয়েতরা।আমাদের একই অবস্থা।  শত্রু ভাইরাস তেড়ে আসছে, তাই আমরা আমাদের বাড়ির দরজা বন্ধ করে দিচ্ছি। আমরা ভেতরে, শত্রু বাইরে। আমরা ভেতরে বসে থাকলে ভাইরাস ট্রান্সমিশন বন্ধ হবে আর আমরা জিতব। কিন্তু বাড়ির ভেতরে যদি খাবার শেষ হয়ে যায় তাহলে আমাদের বেশি করে বেরোতেই হবে - ঘরে খাবার না থাকলে, ক্ষুধার্ত সন্তানকে দেখে কোন বাবা-মা অদৃশ্য ভাইরাসের ভয়ে লকডাউনের তোয়াক্কা করবেন? কিন্তু তখন যদি ভাইরাস ঢুকে পড়তে পারে?

তাহলে এই লড়াই জিততে হলে আমাদের খাবার (অথবা খাবার কেনার টাকার) supply রাখতেই হবে।এও মনে রাখা আবশ্যক যে দুর্বল অভুক্ত শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে যায়, সহজে থাবা বসায় ভাইরাস। পেটে খেলে তবে না পিঠে সয় ? রাজ্যরা এই ব্যাপারে ওয়াকিবহাল বলেই চেষ্টা করছেন রেশন-চাল-ডাল-মাছ-মাংস-ডিম্-সবজি সাপ্লাই চালু রাখতে। একই কারণে অনেক বিশেষজ্ঞ বলছেন - যাদের স্টেডি রোজগার এখন বন্ধ সেই সাধারণ মানুষের পকেটে সরাসরি টাকা দিন (যেমন কানাডা, ব্রিটেন, না না দেশ ঘোষণা করেছে );  প্রয়োজনে সেই টাকা ছাপিয়ে মানুষের হাতে দিতে বলছেন সদ্য নোবেলজয়ী বাঙালি অর্থনীতিবিদ। আপাতদৃষ্টিতে অদ্ভুত শোনালেও তিনি যেটা বলতে চাইছেন সেটা হল সাধারণ সময়ের সব নিয়মকানুন  এই অভূতপূর্ব যুদ্ধকালীন পরিস্থিতিতে খাটে না।  মানুষ না বাঁচলে অর্থনীতি কি ভূতে চালাবে? না কি শুধু কয়েক লক্ষ উচ্চবিত্ত মানুষকে নিয়ে এই দেশ?

তবে শুধু ডিফেন্স দিয়ে ১৯৪২এ জেতা যেত না  এবং তাই জুখভের ফৌজ ঘিরে ফেলেছিল জার্মানদের।আজও  শুধু লকডাউন করে চট করে জেতা যাবে না।এবং তাই WHO'র ডিরেক্টর জেনারেল বলে চলেছেন - টেস্ট টেস্ট টেস্ট।লকডাউন প্রয়োজনীয় কারণ সে ভাইরাসের ট্রান্সমিশনকে স্লো করে দেয়। অন্যান্য বন্দোবস্ত করতে স্বাস্থ দপ্তরকে সময় দেয়। কিন্তু  শুধু তাই দিয়ে হবে না - তাই  বেশি করে পরীক্ষা করতে থাকুন। এই পরীক্ষা করাই আমাদের প্রতি-আক্রমণ , আমাদের স্ট্রাইকার। একমাত্র  তখনই সংক্রমণের গতিপ্রকৃতি বোঝা যাবে এবং ঠিক যাঁরা যাঁরা সংক্রমিত তাঁদের সুস্থ করে তোলা যাবে।  যেমন করেছে দক্ষিণ কোরিয়া আর জার্মানি। টেস্ট টেস্ট টেস্ট। টেস্ট আর লকডাউন একে ওপরের পরিপূরক,  ক্রিজে সৌরভ-সচিন।

জনসংখ্যার অনুপাতে ভারত যে টেস্ট বেশি করেনি সেটা এখন সবাই জানেন। এর কারণ কি এ বিষয়ে নানা মুনির নানা মত।  হতে পারে পর্যাপ্ত কিট আগে থেকে কিনে রাখা হয়নি, হতে পারে পরীক্ষার জন্যে নির্দিষ্ট ল্যাব কম, ফেব্রুয়ারি মাস থেকেই আমাদের অনেক বেশি করে প্রস্তুত হওয়া উচিত ছিল।  যাই হোক , ভাইরাস তো সে সব মানবে না।  তবে শুনে ভাল লাগল যে সামনের সপ্তাহে আমাদের রাজ্যে কয়েক হাজার rapid diagnostic kit আসছে (আচ্ছা,....এই কিট কি করে কাজ করে সেই নিয়েও লিখব ইচ্ছে আছে ) ।  এলে হয়, কারন অভিজ্ঞতা থেকে জানি ,  এইসব চাপের মুখে scientific chemical ইত্যাদি আসতে দেরি হয়। স্বাভাবিক। সব দেশই তো একই জিনিস অর্ডার দিচ্ছে।এই তো গতকাল পড়লাম যে চীন থেকে বেশ কয়েক হাজার কিট তামিলনাড়ুতে আসার কথা ছিল, সে নাকি 'পথ ভোলা পথিক' হয়ে ট্রাম্পভাই'র দেশে চলে গেছে!! বুঝে নিন.... তবে আমাদের অর্ডার সাপ্লাই হলে খুবই ভাল।  খুবই প্রয়োজন।

Meanwhile, আমাদের কাজ ডিফেন্স চালু রাখা।  লকডাউনের এই লড়াইয়ে আমরা সবাই সৈন্য। Physical distancing and social unity.




Friday, April 10, 2020

হাইড্রঅক্সি-ক্লোরোকুইন ও ফরওয়ার্ডী সতর্কীকরণ
(করোনা বিজ্ঞানের খুচরো খবর - ৩) 
দেবজিত খান
(মতামত নিজস্ব)
মজারু!

একদল কোথায় ধবল সায়েবদের উদ্ধার করে নিশ্চিন্তে মহানুভবতার বহির্প্রকাশ করবেন, ভূমিকম্পধস্ত নেপালের নাকে মাইক গুঁজে দেওয়া মিডিয়ার ফ্লেক্স দেখে ফিল-গুড নেবেন, তা না প্রবল পরাক্রমী বিশ্বনেতার (কাল্পনিক?) ধমক দেওয়ার গল্প শুনে মহর্ষির নামের অপচ্চারণ আর পেত্নী-রুপী পুতের meme বানাচ্ছেন।

অন্যদিকে বিরোধী শিবির সেই (কাল্পনিক?) ধমকের গল্পে বেশ উৎফুল্ল হয়েও হাইড্রঅক্সি-ক্লোরোকুইনের ভান্ডারে টান পরবে বলে বিচলিত হয়েছেন, বেঙ্গল কেমিক্যাল বরাত না পাওয়াতে এনারা ক্ষুব্ধ (অবশ্য গুগল ইন্ডিয়া তে zydus cadila stock এর সার্চ টা ট্রেন্ডিং ছিল)। আরে দেশের সবটা কি দিয়ে দাওয়া হচ্ছে? মনে তো হয় না।

আমরা আবেগী মানুষ, চায়-পে বা ডালগোনা কফি -পে চর্চা আর ফরওয়ার্ড করেই থাকি। তাই যেটা ভাবাচ্ছে তা হলো হাইড্রঅক্সি-ক্লোরোকুইন নিয়ে আরেকধরনের ফরওয়ার্ড। যেটায় মিথ্যেটা সত্যির কাছঘেঁষা, বিজ্ঞান-ঘেঁষা টেকনিক্যাল গুলে ভর্তি আর চীন কে নিয়ে গালাগালিটা দিলে আজকাল চলবে ভালো। ভাইরাল (!) হওয়ার সব উপকরণ নিয়ে মুচমুচে উপস্থাপনা আর কি!

তাই হাইড্রঅক্সি-ক্লোরোকুইন নিয়ে কটা কথা বলার ছিল:

1: এটা মোটামুটি আমাদের সবার জানা যে ক্লোরোকুইন আর হাইড্রঅক্সি-ক্লোরোকুইন ম্যালেরিয়ার ওষুধ।

2: কোন অসুখ কোন ওষুধে সারবে সেটা যাচাই করার সর্বসম্মত পদ্ধতি হলো রোগীদের সারিয়ে তোলার ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল। এখন অবধি (এপ্রিল ৯) অন্তত ৫ টি ট্রায়ালে কোভিড-১৯ রোগে হাইড্রঅক্সি-ক্লোরোকুইনের উপকারিতা নিয়ে কিছুটা ধোঁয়াশা রয়ে গেছে। ফ্রান্সের প্রথম ট্রায়াল, যার ভিত্তিতে হঠাৎ এই শতাব্দীপ্রাচীন ড্রাগ নিয়ে নাটক, সেখানে কিছু গলদ দেখা গেছে- কিছু পেশেন্টদের ট্রায়াল চলাকালীন নথি থেকে বাদ দেওয়া, ট্রায়ালের নৈতিক অনুমোদন না নেওয়া ইত্যাদি। আরেকটি  ট্রায়ালে হাইড্রঅক্সি-ক্লোরোকুইনের উপকারিতা বা অপকারিতা কোনোটাই বোঝা যায়নি।তৃতীয়টিতে ওষুধটি দেওয়ার ৬ দিনের মাথায় পেশেন্টদের থেকে ভাইরাস টেস্ট নেগেটিভ এসেছে, তবে এটা পরিষ্কার নয় যে এনারা ৬ দিনের মাথায় এমনিতেই সুস্থ হয়ে উঠতেন কিনা, অর্থাৎ হাইড্রঅক্সি-ক্লোরোকুইন না দিলেও ভাইরাস পাওয়া যেত না কিনা। চীন থেকে দুটি ট্রায়ালের ভিন্ন ফলাফল পাওয়া গেছে। একটিতে উপকারিতা ধরা পরেনি, তার মানে হয় হাইড্রঅক্সি-ক্লোরোকুইন কাজ করেনি অথবা ট্রায়ালটি পরিকল্পনায় গলদ ছিল কারণ অনেকটা দেরিতে ড্রাগ দেওয়ার ফলাফল মাপার চেষ্টা করা হয়েছে। চীনের অন্য ট্রায়ালে হাইড্রঅক্সি-ক্লোরোকুইন খাওয়া পেশেন্টরা ড্রাগ না-খাওয়া পেশেন্টদের থেকে গড়ে একদিন আগে সুস্হ হয়ে উঠেছেন। কাজেই এখন অবধি যা আছে তা anecdotal অথবা incomplete এভিডেন্স, সবার ক্ষেত্রে সব সময় হাইড্রঅক্সি-ক্লোরোকুইন কাজ করবেই এরকম অকাট্য প্রমান এখনো নেই। তবে আশার খবর যে আরো প্রায় সত্তরটি এরকম ট্রায়াল চলছে পৃথিবী জুড়ে অনেক পেশেন্ট ও স্বাস্থ্যকর্মী নথিভুক্ত করে। সঠিক উত্তর তাড়াতাড়ি-ই পাওয়া যাবে।

3: তার মানে কি হাইড্রঅক্সি-ক্লোরোকুইন ব্যবহার হচ্ছে না? হচ্ছে। পৃথিবী জুড়ে, ডাক্তারদের তত্বাবধানে। আমেরিকায়, চীনে, ইউরোপে কোভিড১৯ আক্রান্ত মানুষদের সুস্থ করে তোলবার আশায় শুধু হাইড্রঅক্সি-ক্লোরোকুইন নয়, অনেক রকম ওষুধ দাওয়া হচ্ছে। যেটায় প্রাণ বাঁচানো যায় তাই প্রাণদায়ী, তবে সেই বিচারটা বিশেষজ্ঞদের ওপর ছেড়ে দিন। চীনের দাবি যে কোভিড১৯ আক্রান্তদের pneumonia ও ফুসফুসের বিকার কমাতে হাইড্রঅক্সি-ক্লোরোকুইন সক্ষম। ভারতবর্ষে ২২শে মার্চ ICMR ও MoHFW হাই রিস্ক পপুলেশন, অর্থাৎ নিশ্চিতরূপে (confirmed) অথবা অনিশ্চিতরূপে (suspected) কোভিড১৯ আক্রান্তের পরিচর্যাকারী উপসর্গহীন (asymptomatic) স্বাস্থ্যকর্মীদের এবং নিশ্চিতরূপে কোভিড১৯ আক্রান্তের পরিবারের উপসর্গহীন সদস্যদের প্রতিষেধক হিসেবে হাইড্রঅক্সি-ক্লোরোকুইন অনুমোদন করেছে। এর পরবর্তী বিধিও ICMR ও MoHFW ঠিক করবে, Press Information Bureau তাই বলবে, রাজ্য সরকারের health and famly welfare department এই বিধি রূপায়ণ ও বাস্তবায়নে যুক্ত, এদের ওয়েবসাইট ও টুইটারে নজর রাখুন ও তা মেনে চলুন। ডাক্তারদের ও স্বাস্থ‍্যকর্মীদের সহযোগীতা করুন কারণ মাস্ক পরে হোক বা না পরে, ঠ্যাঙানির ভয়ে হেলমেট পরে হোক বা তার প্রতিবাদে খালি গায়ে, এপ্রোন পরে হোক বা রেইনকোট পরে, লড়াইটা ওঁরাই লড়বেন।

4: এবার সেই নতুন ফরোয়ার্ডটা।

 অদ্ভুতুড়ে, বিজ্ঞান-ঘেঁষা ভাষায় ভাইরাস, রক্তের হিমোগ্লোবিন ও তার সাথে হাইড্রঅক্সি-ক্লোরোকুইনের উপকারিতা, তার সাথে দুই লাইন চীন কে গালাগাল, কোভিড১৯ এর সাথে সম্পর্কহীন কিছু ভুল তথ্যের সমন্বয়ে এক অভূতপূর্ব উপস্থাপনা। আর্টিকেল টি আগেই দেখেছি, পড়াশোনা করতে হয়েছে ভুলগুলো ধরতে। পরিহাস, যে এটির ভিত্তি চীনেরই একটি, এবং একটিমাত্র, computer-based study। গবেষণাটি কিন্তু pre-print, অর্থাৎ বিশেষজ্ঞরা এখনো যাচাই করেন নি। উপরন্তু শারীরবৃত্তীয় প্রাসঙ্গিকতা নিয়ে প্রশ্ন থেকেই যাচ্ছে কারণ কাজটি যাকে বলে in silico এবং forced। আজকে সকালে দেখলাম এটা whatsapp এ বেরিয়ে পড়েছে। এরম ফরওয়ার্ড গুলো ঘুরতে না দেওয়াই বোধহয় মঙ্গল। ফরওয়ার্ড button টি টিপবেন না। আজকে এটা বেরিয়েছে, হয়তো এরপর বলবে হাইড্রঅক্সি-ক্লোরোকুইন কিনে খেতে। অথবা আরো টেকনিক্যাল শুনতে কিছু হাবিজাবী বলে আরেকটা ওষুধ দাগিয়ে দেবে। এই ফরওয়ার্ড যারা করছে তারা কুচক্রী হোক বা গবেট, ক্ষতি হবে আতঙ্কিত মানুষের। ইরানে মদ খেলে কোভিড হবে না গুজবে bleach মেশানো মিথাইল এলকোহল খেয়ে চুয়াল্লিশ জন মারা গেছে।

5: হাইড্রঅক্সি-ক্লোরোকুইন প্রেসক্রিপশন ছাড়া কেনা যায়না। তা এড়িয়ে, ডাক্তারের পরামর্শ ছাড়া সাধারণ সর্দি-জ্বর-কাশি হলেই চিকলেট এর মত খেলে হিতে বিপরীত হতে পারে। কয়েক ধরনের হার্ট এবং চোখের অসুখ থাকলে, বা লিভার/কিডনি তে সমস্যা থাকলে, উল্টে আরো অসুস্থ হতে পারেন, সেইজন্যই ডাক্তার ও প্রেসক্রিপশনের বন্দোবস্ত। Self medicate করবেন না, হাইড্রঅক্সি-ক্লোরোকুইন দিয়ে তো একেবারেই না।

6: ভারতবর্ষে  হাইড্রঅক্সি-ক্লোরোকুইন essential medicine ঘোষিত হবার পরে সাধারণ ফার্মাসিতে এটার আকাল দেখা দিয়েছে। Rheumatoid arthritis এ যারা ভোগেন, তাদের অনেকের এটি প্রেসক্রিপশন মেডিসিন। হাইড্রঅক্সি-ক্লোরোকুইন এক ধরনের immune-modulator ও, এটি disease-modifying anti-rheumatic drug হিসেবেও ব্যবহার হয়, অবশ্যই প্রেসক্রিপশন সমেত। এবার ধরুন এটা মার্কেট এ ফিরে এলো আর আপনিও social media তে ফরওয়ার্ড দেখে কোনোভাবে প্রেসক্রিপশন জুটিয়ে কিনে ফেললেন। ওষুধ expire করলে আপনি স্রেফ ফেলে দেবেন কিন্তু বঞ্চিত করবেন arthritis এ ভোগা মানুষগুলোকে।

সজাগ থাকুন, সুস্থ থাকুন।

(ডঃ দেবজিত খান হল  'সাবমেরিন দেবজিত'।  'আরডিনারি বুদ্ধি নেই , এক্সট্রাআরডিনারি বুদ্ধি ' ; একটু রিসার্ভড ,আড্ডাতেও অপ্রয়োজনীয় কথা বলে না , আর কোনো আলোচনায় অনেক কিছু শোনার পরে  ধাঁ করে একটা টর্পেডো লঞ্চ করে দেয়। আর ভাইরোলজি তো ওর নিজের গবেষণার বিষয়ের সঙ্গে কিছুটা জড়িত।  তাই গতকাল যখন এটা  হোয়াটসাপে পেলাম তখন বললাম এখানে 'গেস্ট লেখক' হয়ে যা। ) 

Thursday, April 9, 2020

প্রকৃতির পেনড্রাইভ 
(করোনা বিজ্ঞানের খুচরো খবর -২)

''কানন-দি, ওই বাইরে থেকে প্যাকেটটা এনে টেবিলের যেখানে রাখলে ওই জায়গাটা সাবান-জল দিয়ে মুছে নাও।  ....''

''আমি এসেই হাত ধুয়েচি  গো  .....তুমি বলে দিয়েচো  তারপরে রোজ করি।''

''না না  ....সে আমি জানি , আমি বলছি ওটা তো বাইরের প্যাকেট;  কত হাত ঘুরে এসেছে।  ওই টেবিলটা সাবান-জল দিয়ে মুছে দাও।....কোনখান দিয়ে করোনা ঢুকবে কোনো ঠিক আছে? ''

এটা মার্চের মাঝামাঝির কথা। কানন-দি অনেকদিন বাড়িতে কাজ করছে।  খুবই ভাল মানুষ। তাই  আমি যে ফেব্রুয়ারি মাস থেকে হাত ধোবার ব্যাপারে কড়াকড়ি শুরু করেছি সেটা এক কথায় মেনে নিয়েছে। এবারও 'না' করলো না।  ন্যাতা নিয়ে টেবিল মুছতে মুছতে জিজ্ঞেস করলো,  ''আচ্ছা, এই  করোনা-টা কি পোকা? নতুন এয়েচে ?''

হাসা উচিত নয়।  আমার দামড়া-দামড়া ডিগ্রি দিয়ে কানন-দি'র  মত এত কাজ আমি করতে পারবো না তা আমি বিলক্ষণ জানি।  তাও  হেসে ফেললাম, ''না!  পোকা নয়, ভাইরাস''

''ভাইরাস?...সেটা কি করে? ....''

আসলে, 'হাত ধুতে হবে' এইটা বলে-বলে এখন অনেকটা মাথায় ঢুকলেও আর কোন কোন ফাঁক দিয়ে করোনাবাবাজি ঢুকে পড়তে পারে এটা এখনো সবার ঠিক বোধগম্য হয়নি। দোষও নেই। 'ভাইরাস' কথাটার সঙ্গে আমরা বহুদিন পরিচিত হলেও জিনিসটা যে ঠিক কি সেটা আমরা অনেকেই ঠিক বুঝতে পারি না ।  হ্যাঁ , জানা আছে ভাইরাস খুব বেশি ছোট (যেমন, এই নতুন করোনাভাইরাসের সাইজ ৫০-২০০ ন্যানোমিটার), কিন্তু ওইটুকুই। তাই আজও আমাদের অনেকের অবস্থা যুদ্ধে মেঘনাদকে face করার মত।  যাকে চোখে দেখা যায় না, তার থেকে চব্বিশ ঘন্টা ঘরে-বাইরে-সকালে-বিকেলে-রাত্রে নিজেকে defend করা বড্ড চাপের।  এ যেন HG Wellsর Invisible Manর বিরুদ্ধে ফুটবল খেলা! এর থেকে জুরাসিক পার্কের বড় টাইরোনোসরাস-টা রাস্তায় ঘুরে বেড়ালে সেটাকে অন্তত চোখে দেখে বিপদের একটা স্টেডি আন্দাজ পাওয়া যেত । লোকজন তখন 'এই একটু মোড়ে  দাঁড়িয়ে আসি' , 'র'কে একটু গেঁজিয়ে আসি' 'এই টুক করে যাবো আর আসবো ' করতেন না।  

ভাইরাস কি?
বেশি গুরুগম্ভীর বৈজ্ঞানিক টার্ম দেবার কোনো মানে হয় না এখানে।  তাই আমাদের আধুনিক দৈনন্দিন জীবন থেকে একটা উপমা দেবার চেষ্টা করি।  ভাইরাস জিনিসটা (সে সাধারণ সর্দি'র রাইনোভাইরাস কিংবা এখনো নাম-শুনলে-ভয়-করে পোলিও বা বসন্তরোগ'র ভাইরাস বা আমাদের বর্তমান শত্রু নতুন কোরোনাভাইরাস (পোশাকি নাম SARS-CoV-২) একটা পেনড্রাইভের মতো।  হ্যাঁ, পেনড্রাইভ। বুঝিয়ে বলছি। মনে করে দেখুন, একটা সাধারণ পেনড্রাইভে কি কি  যন্ত্রাংশ আছে? ভেতরে আছে মেমোরি স্টোরেজ চিপ, USB কন্ট্রোলার, আরো কিছু ছোট্ট ছোট্ট তার, (কিছু কিছু পেনড্রাইভে একটা পুচকু LED আলো) আর USB কানেক্টর। আর কানেক্টর বাদে সবকিছু একটা প্লাস্টিক বা ধাতব কভারের মধ্যে সুরক্ষিত। 
আর এই পেনড্রাইভের ভেতরে অনেক অনেক ডেটা , ফাইল, গান, সিনেমা, ইত্যাদি সঞ্চিত থাকতে পারে।  কিন্তু ভেতরে যাই থাকুক পেনড্রাইভের কোনো ক্ষমতা নেই সেগুলি নিজে থেকে আপনাকে দেখাবার, যতক্ষণ না পেনড্রাইভ'র USB কানেক্টর কোনো একটা ডেস্কটপ বা ল্যাপটপের USB পোর্টে গুঁজে দেওয়া হচ্ছে। একমাত্র তখনই পেনড্রাইভ 'জীবন্ত' হয়ে ওঠে।  ডেটা ট্রান্সফার হতে পারে, দেখা যেতে পারে আর এক পেনড্রাইভের data আরো অনেকগুলি পেনড্রাইভে কপি করা যেতে পারে। 

করোনাভাইরাসও অনেকটা এভাবেই কাজ করে, সংক্রমণ করে, নিজের কপি বানায়, ছড়িয়ে পড়ে।

কি করে?
তাহলে বাবাজীবনের চেহারাটা একটু দেখতে হয়।  একটা ছবি এতদিনে অবশ্য প্রায় সবাই  দেখেছেন - গোলাকার ভাইরাস, তার থেকে অনেকগুলো পায়া'র মত কি যেন বেরিয়ে আছে। তবে সেটা হল বাইরের ছবি।  ভেতরে কি আছে? ভেতরে আছে একটি সুতোর মতো RNA মলিকিউল। এই RNAই হল কোরোনাভাইরাসের মূল ডেটা স্টোরেজ আর কন্ট্রোলার।  সোজা কথায় - হেডকোয়ার্টার। এর মধ্যেই  'প্রকৃতির সাংকেতিক ভাষায়' (যার বৈজ্ঞানিক নাম genetic code; অন্যতম আবিষ্কারক নোবেলজয়ী ভারতীয় হরগোবিন্দ খোরানা) কোরোনাভাইরাসের ২৯টি প্রোটিন তৈরীর নির্দেশাবলী লেখা আছে, অনেকটা যেমন আমাদের ছোটবেলার ক্যাসেটের সুতোয় পরপর 'লেখা থাকতো' অনেকগুলি গান। এই RNA আবার ক্যাপসিড (capsid ) নামের একটি প্রোটিনের মোড়কের মধ্যে প্যাক করা আছে । আর এই ক্যাপসিড বসে আছে আরেকটি বড় ব্যাগের মধ্যে যার নাম হল এনভেলপ (envelope). এই এনভেলপ হল একটা ঝিল্লি বা  membrane,  আমাদের নিজেদের কোষের cell membraneর মত । আমাদের কোষের সেল মেমব্রেনের মত এনভেলপও  কিছু লিপিড (স্নেহ পদার্থ) ও প্রোটিন দিয়ে তৈরী।

 করোনাভাইরাসের  এনভেলপের মূলত দুটো কাজ। এক, ভেতরের RNAকে রক্ষা করা, ঠিক যেমন পেনড্রাইভের কভার ভেতরের চিপ, কন্ট্রোলারকে রক্ষা করে, একসঙ্গে রাখে। দুই, এনভেলপ থেকে বেরিয়ে থাকা পায়ার মত স্পাইক প্রোটিন  মানুষের দেহকোষের সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপন করে। কোরোনাভাইরাসের স্পাইক প্রোটিন হল পেনড্রাইভের USB কনেক্টর আর আমাদের কোষের মেমব্রেনে বসে থাকা ACE২ রিসেপ্টার  প্রোটিন হল USB পোর্ট। খাপে খাপে লাগলেই ডেটা ট্রান্সফার শুরু। একটু পরে ভাইরাল RNA ক্যাপসিড আর এনভেলপের খোলস ছেড়ে বেরিয়ে আসে কোষের সাইটোপ্লাজমে (cytoplasm), আর এসেই প্লেন হাইজ্যাক করে নেয়। তখন সে কোষকে নিজের সাধারণ কাজকর্ম করতেই দেবে না - হুকুম দেবে 'তুই এখন আমার ক্রীতদাস ! আর সব কাজ বন্ধ করে শুধু আমার জন্যে ভাইরাল প্রোটিন আর RNA বানাবি। ' কোষ তাই করতে বাধ্য হয়, এবং কয়েক ঘন্টা পরে যখন ব্যাগার খেটে খেটে মরে যায় তখন ওর ঝিল্লি ফাটিয়ে বেরিয়ে আসে নতুন কোরোনাভাইরাস প্রজন্ম, তাদের মধ্যেও সেই একই RNA, একই ক্যাপসিড , একই এনভেলপ।  পেনড্রাইভ থেকে ডেটা ট্রান্সফার আর কপি করার মতো হুবহু এক না হলেও অনেকটা মিল অনস্বীকার্য। 
আর এখানেই আসে সাবান বা হ্যান্ডওয়াশ বা স্যানিটাইজারের  (উফফ! একটা নতুন কথা ঢুকে পড়েছে বাংলায় এবার!) উপকারিতা।এদের সবার একটাই কাজ -  কোরোনাভাইরাসের এনভেলপ আর স্পাইক প্রোটিনকে ধ্বংস করা। 
আর যেমন কোনো কারণে বাইরের কভার আর USB কানেক্টর ফেটে গেলে বা দুমড়ে গেলে পেনড্রাইভ আর কাজ করে না, ঠিক তেমনি এনভেলপ আর স্পাইক প্রোটিন নষ্ট হয়ে গেলে করোনা ব্যাটাও নিজের RNAকে সুরক্ষিত রাখতে পারবে না, কোনো কোষের USB port ACE২ প্রোটিনের সঙ্গে গিয়ে আটকাতে পারবে না (RNA জিনিসটা এমনি এমনি এসব পারে না? না। যে কাজের যা।  চিপ কি নিজে থেকে পোর্টে জুড়ে যেতে পারে? না কিডনি দিয়ে ভাত হজম হয় ? ) 

সাবান ইত্যাদি কি করে কাজ করে ?
একবার সাবানের প্যাকেট বা হ্যান্ডওয়াশ'র গায়ে লেখাটা দেখে নিন।  ওতে যেসব উপাদান আছে তার মধ্যে সোডিয়াম লাউরিল সালফেট, স্টিয়ারিক অ্যাসিড,  কিছু তেল , কোকামিডপ্রোপাইল বিটেন ইত্যাদির নাম পাবেন।  এই সব কেমিক্যালের গঠন এমনই যেন এদের দুটো হাত আছে।  এক হাত দিয়ে করোনার এনভেলপকে ধরে, আর অন্য হাত দিয়ে জল।  তাই যখন সাবান-জল দিয়ে (২০ সেকেন্ড) ধরে হাত রগড়াচ্ছেন তখন সাবান একদম ভাইরাসের বাইরের চামড়াটাকে টেনে হিঁচড়ে দফারকা করে দেয়।  ব্যাস ! এনভেলপ খতম, স্পাইক প্রোটিন খতম। স্যানিটাইজার? হ্যাঁ , সেও পারবে কারণ তাতে বেশ কিছুটা এলকোহল থাকে এবং এলকোহলও একইরকম কাজ করে পারে।তবে এক মিলিলিটারের একশো ভাগের এক ভাগ হাতে ঢাললে কাঁচকলা হবে। ভালো করে বেশ কিছুটা স্যানিটাইজার হাতে নিয়ে মুছলে তবেই না সব ভাইরাস গলে যাবে। তবে সাবান জল দিয়ে হাত ধোয়া হচ্ছে সবচেয়ে ভালো,  ভাইরাস ধ্বংসও  হল আবার তাদের 'লাশ' ধুয়ে একদম সাফ হয়ে গেল। একই কারণে দোকান-অফিস-ব্যাঙ্ক-পোস্টঅফিস কাউন্টার টেবিল এক-দু ঘন্টা অন্তর ডিটারজেন্ট-জল দিয়ে মুছে নেওয়া ভালো। এই হল ব্যাপার।  সহজ সরল বিজ্ঞান কিন্তু গত দেড়শো বছরে  কত কোটি কোটি যে প্রাণ বাঁচিয়েছে তার কোনো ইয়ত্তা নেই।

একটা ছোট্ট funda দিয়ে শেষ করি - অনেকেই বলছেন 'ভাইরাস মারতে হবে।' বৈজ্ঞানিক দিক থেকে কথাটা ঠিক নয়।  ভাইরাস তো প্রাণী নয়,তাকে 'আনবিক পরজীবী' বলতে পারেন।  তার নিজের কোনো কোষ নেই।  অন্যের কোষে ঢুকে সে মস্তানি করে। আর তাই যার প্রাণ নেই তাকে মারবেন কি করে? তাকে মারা যায় না, তাকে ধ্বংস করা যায়।  এন্টিভাইরাল দিয়ে, ভ্যাকসিন দিয়ে, এবং সাবান-জল স্যানিটাইজার দিয়ে।প্রথম দুটি এখনো তৈরী হয়নি, হচ্ছে, হয়ে যাবে।  তৃতীয়টি হাতের কাছেই আছে।

 ভাল থাকবেন।

pic: https://www.premiumusb.com/blog/whats-inside-a-usb-drive; লেখকের আঁকা, লেখকের তোলা 

Tuesday, April 7, 2020

  বাঘ, পঙ্গোলিন  আর  করোনা'র গল্প 
(করোনা বিজ্ঞানের খুচরো খবর -১)


আজকাল করোনা ছাড়া খবর নেই। এটা একটু বিরক্তিকর বোকাবোকা হলেও এ তো অনস্বীকার্য  যে এই আগ্রহের মুলে আছে আমাদের প্রাণের ভয়।  ২০২০তে এসে শরৎচন্দ্রের লেখা 'ওলাউঠো বসন্ত' র মত বিপদ সশরীরে এসে উপস্থিত হবে সেটা হাতে গোনা কয়েকজন বিজ্ঞানী ছাড়া আমরা কেউ কল্পনা করিনি।  তাই যে আমরা পরীক্ষার পড়া ছাড়া বিজ্ঞানের ধারেকাছে যাইনা, সেই আমরাও প্রতি ঘন্টা নতুন খবর খুঁজছি। আসলে মাপার চেষ্টা করছি বিপদ কতদূর। 
তাই,  আজ সকাল থেকে নেট দুনিয়ায় বড় খবর - আমেরিকার ব্রঙ্ক্স চিড়িয়াখানায় একটি বাঘিনীর শরীরে ধরা পড়েছে SARS-CoV-২ ভাইরাস। শুধু 'নাদিয়া' নামের এই বাঘিনী নয়, আরো কয়েকটি বাঘ ও সিংহ/সিংহী সম্ভবত সংক্রমিত (অসুস্থ নয় কিন্তু; কাশি জ্বর কিছু হয়নি, শুধু অরুচি)। কি করে হল?  চিড়িয়াখানার  যে কর্মী ওদের দেখভাল করেন তিনি বুঝতে পারেননি যে কোরোনাভাইরাস তাঁর শরীরে বাসা বেঁধেছে।  যতদিনে বুঝলেন ততদিনে তাঁর থেকে ভাইরাস ছড়িয়ে পড়েছে তাঁর পোষ-মানা বেড়ালের মাসির কাছে।  

মানুষ থেকে অন্য জন্তুতে কোরোনাভাইরাস যাচ্ছে এটা অবশ্য একদম নতুন খবর নয়।  মার্চ মাসেই হংকং আর জার্মানিতে দুটি বাড়ির কুকুর সংক্রমিত হয়ে পড়েছিল;   তাদের মালিকদের থেকে ভাইরাস ছড়িয়ে পড়ে । আর একটি গবেষণা পত্র দেখিয়েছে যে বেড়ালদের কোষে এই নতুন কোরোনাভাইরাস ঢুকতে পারে( নিজের পোষ্যকে নিয়ে আতঙ্কিত হবেন না।  যে সংক্রমণ হয়েছিল সেটা মানুষ থেকে, উল্টো দিক থেকে কোনো মতেই নয়। আর  কুকুর-বেড়াল-বাঘ থেকে করোনা ভাইরাস ছড়াচ্ছে না, ছড়াচ্ছে এক মানুষ থেকে অন্য মানুষে)।   যাই হোক, চিড়িয়াখানার ঘটনা কেন এতো শোরগোল ফেলল বুঝতেই পারছেন - হাজার হোক বাঘ তো।  অসুস্থ না হোক, পুচকু কোরোনাবাবাজি তো বাঘিনীর মধ্যে বাসা বেঁধেছে। কি অবাক কান্ড ! এই জন্যেই এতো খবর, এত শেয়ারিং।  

  সকালে যখন খবরটা দেখলাম তখন যতটা অবাক হবার কথা ততটা হলাম না।  তার main  কারণ দুদিন আগেই একটা গবেষণাপত্র পড়ছিলাম যেখানে বিজ্ঞানীরা দেখিয়েছেন যে  SARS-CoV-২ ভাইরাস'র সবচেয়ে নিকট আত্মীয় হল পঙ্গোলিন নামের সর্বাঙ্গে triangular বর্ম-লাগানো  বিচিত্রদর্শন জন্তুটি।  মানে, ঠিক প্যাঙ্গোলিন নয়, ওর শরীরে বাসা বাঁধা কিছু ভাইরাস।  এরাও কোরোনাভাইরাস পরিবারের সদস্য,। সবচেয়ে বড় কথা বাদুড়ের কোরোনাভাইরাসের সঙ্গে  SARS-CoV-২র যত মিল তার থেকে অনেক বেশি মিল SARS-CoV-২  আর পঙ্গোলিন কোরোনাভাইরাসদের মধ্যে।  বলতে পারেন - একদিকে বাদুড়ের  ভাইরাস, অন্যদিকে  SARS-CoV-২ ভাইরাস আর মাঝখানে যোগসূত্র হল প্যাঙ্গোলিনের ভাইরাস।  

 এই আবিষ্কার আবার প্রমান করলো যে  SARS-CoV-২ ভাইরাস কোনো আধুনিক ল্যাবে তৈরী নয়। জানুয়ারি মাসেই বিজ্ঞানীরা সন্দেহ করেছিলেন যে বাদুড় থেকে  SARS-CoV-২ সরাসরি মানুষে প্রবেশ করেনি।  কোন এক অজানা প্রাণী হচ্ছে intermediate host . এখন প্রমান মিলল যে সে হল প্যাঙ্গোলিন।  এটাও নতুন নয়।  ২০০৩র সার্স মহামারী র সময়েও SARS-classic ভাইরাস প্রথমে বাদুড় থেকে  সিভেট (ভামবেড়াল'র মত প্রাণী) ও তারপর সিভেট থেকে মানুষে লাফ মেরেছিলো; আর ২০১২ MERS ভাইরাস প্রথমে বাদুড় থেকে উটের শরীরে ঢোকে, আর তারপর উট থেকে মানুষে।  জীবন-বিজ্ঞানে এই ধরণের  ঘটনা বারবার দেখা যায়।  

গবেষণাপত্রটি পড়তে পড়তে উইকিপেডিয়া'র যে তথ্যটি আকৃষ্ট করেছিল সেটি হল পঙ্গোলিন এমন এক স্তন্যপায়ী যার নিকট আত্মীয়দের মধ্যে আছে বাঘ, সিংহ, বেড়াল ও অন্যান্য ক্যানিন প্রানীরা!  আপাতদৃষ্টিতে এটা মনে না হলেও এরকমও প্রায়ই দেখা যায় বিবর্তনে।  মানুষ, বাদুড় আর তিমি সবাই যে স্তন্যপায়ী তাতে কোনো সন্দেহ আছে কি ? বহু কোটি বছর আগে পৃথিবীর কোথাও এদের এক পূর্বপুরুষ ছিল যার এক বংশধর থেকে বিবর্তিত হয় পঙ্গোলিন, আরেক বংশধর থেকে আসে বাঘ, সিংহ, বেড়ালরা। মানিকবাবুর কথায় 'শাখা প্রশাখা'।

তাহলে এখন অবধি কি দাঁড়ালো ব্যাপারটা - পঙ্গোলিন থেকে মানুষে এলো নতুন ভাইরাস।  আর মানুষ থেকে (পঙ্গোলিনদের আত্মীয় )বাঘের শরীরে ঢুকলো একই ভাইরাস। ঠিক আছে ?

(ছবি ১: স্তন্যপায়ী বিবর্তনের শাখা প্রশাখা - উইকিপেডিয়া থেকে নেওয়া ছবি )


নেই কাজ তো খই ভাজ। লকডাউনের সকালবেলা বাবার হোটেলে খেয়েদেয়ে  ভাবলাম কৌতূহল যখন হচ্ছে, একটা ছোট্ট এক্সপেরিমেন্ট করা যাক। মানে কম্পিউটারে in silico বিশ্লেষণ।  কয়েকদিন আগে পড়া আরেকটা গবেষণাপত্র'র pdf বের করলাম।  পৃথিবীর অন্যতম নামকরা বিজ্ঞান পত্রিকা 'নেচার' এ প্রকাশিত।  সেখানে বিজ্ঞানীরা বিশ্লেষণ করেছেন ঠিক কি করে  SARS-CoV-২  আমাদের কোষে প্রবেশ করে।  আগে থেকেই জানা ছিল যে এটা অনেকটা চাবি দিয়ে তালা খোলার মত। SARS-CoV-২ র যে স্পাইক প্রোটিন আছে (ছবি এতদিনে সবাই দেখেছেন - ভাইরাসের গোল শরীর থেকে রডের মত বেরিয়ে আছে )সেটা একদম  খাপে খাপ লেগে যায় আমাদের কোষের মেমব্রেন (ঝিল্লি) তে বসে থাকা ACE২ প্রোটিনের গায়ে। ACE২ হল তালা আর স্পাইক হল চাবি।  ব্যাস! চিচিং ফাঁক (অন্য ভাইরাস যেমন সমগোত্রীয় SAR-classic  বা MERS র স্পাইক ও কাজ করে,কিন্তু  SARS-CoV-২ র স্পাইক তালা খোলে একদম নিখুঁত ভাবে, অত্যন্ত দ্রুত।  আর সেই জন্যেই এই ভাইরাস এতো ছোয়াঁচে। এসব জানা ছিল, তাহলে এই গবেষণাপত্রে নতুন কি জানা গেল? এখানে বিজ্ঞানীরা দেখিয়েছেন যে  SARS-CoV-২ র  স্পাইক প্রোটিন আর ACE২ ঠিক কি ভাবে একে ওপরের সঙ্গে আটকে যায়, আর তারপর এক সেকেন্ডর ভগ্নাংশে খুলে যায় কোষের দরজা।  বলতে পারেন, এই চাবি-তালার আণবিক নাটবল্টুর ছবি তুলতে সক্ষম হয়েছেন বিজ্ঞানীরা।     

ACE২ সম্মন্ধে  বলতেই হয়।পুরো নাম Angiotensin Converting Enzyme -২. আমাদের শরীরের রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা আছে কিডনি থেকে নিঃসৃত Renin হরমোন ও লিভারে তৈরী Angiotensin প্রোটিনের।  এদেরই দলের খেলোয়াড় এই ACE২ প্রোটিন।  বহু কোষের ঝিল্লিতে এর অবস্থান , তবে  বেশিমাত্রায়  ফুসফুসে পাওয়া যায়  । প্রাগৈতিহাসিক প্রোটিনদের দল।  কত কোটি বছর আগে তাদের সৃষ্টি, তখন আধুনিক মানুষের পূর্বপুরুষরাও পৃথিবীতে আসেনি, সম্ভবত রাজ্যত্ব চলছে আদি ডাইনোসরদের।তাই আজ লতাপাতা বেয়ে বহু প্রাণীর শরীরে এদের পাওয়া যায়।  

প্রোটিন-সিকোয়েন্স (Protein sequence) ব্যাপারটাও  একটু না বললেই নয়।  Sequence হল অক্ষরমালা।  অনেকগুলি  অক্ষর ব্যাকরণ  মেনে ও অর্থপূর্ণ  ভাবে  পরপর সাজালে যেমন একটি বাক্য লেখা হয়, তেমনি অনেকগুলি অ্যামিনো অ্যাসিড নির্দিষ্ট নিয়ম মেনে পর পর জুড়ে দিলে একটি প্রোটিন তৈরী হয়।  প্রকৃতিতে মাত্র ২০টি অ্যামিনো অ্যাসিড আছে।  কিন্তু এদেরই বিভিন্ন ভাবে সাজিয়ে তৈরী হয়েছে হাজার হাজার ধরণের প্রোটিন - কারুর সাইজ হয়তো ৫১ অ্যামিনো অ্যাসিড, কারুর ১৭৮ অ্যামিনো অ্যাসিড, কারুর ১৫৬৭ অ্যামিনো অ্যাসিড। কটা  অ্যামিনো অ্যাসিড আছে আর কি অর্ডারে আছে সেইটা আলাদা। ব্লাড সুগার নিয়ন্ত্রণে রাখা ইনসুলিন বা রক্তের হিমোগ্লোবিন ও এলবুমিন , বা মাথার চুলের কেরাটিন, অথবা দুধের ল্যাক্টালবুমিন, মাংসপেশির এক্টিন মায়োসিন, কার্টিলেজের কোলাজেন, রোগ প্রতিরোধের আন্টিবডি বা ওই রেনিন, ACE২ এমনকি ওই 'শয়তান' স্পাইক প্রোটিন সবাই এইভাবেই তৈরী হয়।

প্রোটিন ১ : MRTYCAAGTKASD.....
প্রোটিন ২:  MAFCGHAGVISKLRRGVQ....
প্রোটিন ৩: AFGELIDDEQMSAPGILVRAGTK.....

আজকের দিনে কম্পিউটার-ভিত্তিক জীবন বিজ্ঞান'র গবেষণা (বা বিশ্লেষণের একটা বড় সুবিধে হল চট করে হাজার হাজার প্রোটিন'র সিকোয়েন্স পাওয়া যায়।  অনেক নামকরা ওয়েব সাইট আছে। সবচেয়ে নামকরা বোধহয় আমেরিকার NCBI (ন্যাশানাল সেন্টার ফর বায়োটেকনোলোজিকাল ইনফরমেশন). আমরা যারা মলিকিউলার বায়োলজি বা মাইক্রোবায়োলজি নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটি করে থাকি তারা সবাই NCBIর কাছে কোনো না কোন ভাবে ঋণী; মোটামুটি খুঁজতে জানলেই হলো - যা সিকোয়েন্স চান তাই পাবেন। তাই কি-বোর্ডে একটু টেপাটেপি করে করে বের করে আনলাম পাঁচটা ACE২ প্রোটিন সিকোয়েন্স।  মানুষ, বাঘ, জাভার পঙ্গোলিন, বেড়াল, গবাদি পশু ও মুরগি। একই প্রোটিন পরিবারের সদস্য - বিজ্ঞানের ভাষায় homologs, সবাই লম্বায় ৮০০ অ্যামিনো এসিডের কাছাকাছি। কিছু বিশেষ কম্পিউটার প্রোগ্রাম দিয়ে এদের অল্প বিশ্লেষণ করে ফেললাম।  যাকে বলে sequence alignment - এক কোথায়, ৬টা প্রোটিনকে পাশাপাশি ফেলে দেখা কোন কোন অ্যামিনোঅ্যাসিড ওদের সবার মধ্যে একই রয়েছে, আর কোন কোন গুলো পাল্টে গেছে। একই বংশের লোকজনের মধ্যে যেমন  মিল থাকে, তেমনি মানুষের ACE ২, বাঘের ACE ২, পঙ্গোলিনের ACE ২র মধ্যেও মিল থাকা স্বাভাবিক। প্রশ্ন হচ্ছে কতটা মিল? আর কতটা অমিল ?  

বেশি detailed কথায় কাজ নেই।  যেটা নজরে এল সেটা হল  নেচার গবেষণাপত্রের বিজ্ঞানীরা যে যে অ্যামিনো অ্যাসিডগুলো ওই 'তালার'  নাটবল্টু বলে চিনিয়েছিলেন , সেগুলো কিন্তু সব homologর মধ্যে মোটামুটি অপরিবর্তিত রয়ে গেছে।  ৯-১০ অ্যামিনো অ্যাসিড আছে যারা এই ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ এবং  পাঁচটি স্তন্যপায়ীর ক্ষেত্রে এগুলি প্রায়ই সবই এক (সিকোয়েন্সগুলির অংশ বিশেষ'র ছবি দিলাম )। মুরগির ACE২ তে অল্প স্বল্প কিছু তফাৎ আছে, এবং সেটা স্বাভাবিক - ওই ছ'জনের মধ্যে ওটাই তো একমাত্র পাখি থেকে নেওয়া।  এসব মিল দেখে  অবাক হবার কিছু নেই।  ভুললে চলবে না যে এদের মূল কাজ হল রেনিন এনজিওটেনসিন সিস্টেম, এবং আগেই বলেছি সেটা এই সব প্রাণীতে কাজ করে চলেছে।  কোরোনাবাবাজি না হয় একটি 'চাবি' বাগিয়েছেন বলে তালাতে খুলে ঢুকে পড়ছেন।   

(ছবি ২: বিভিন্ন প্রাণীর ACE২ প্রোটিন সিকোয়েন্সের অংশবিশেষ।  মানুষ (H. sapiens), পঙ্গোলিন (M. javanica), বেড়াল (F. catus ), বাঘ (P. tigris) , গবাদি পশু (B. taurus ) আর মুরগি (G. gallus). স্পাইক প্রোটিনের সঙ্গে যে যে অ্যামিনো অ্যাসিড খাপে খাপ আটকে যায় সেগুলি লাল বাক্স দিয়ে দেখানো হয়েছে। )

তাহলে কি দাঁড়াল  - প্রোটিন সিকোয়েন্স থেকে একটা সহজ কারণ বোঝা গেলো কেন  আমেরিকান বাঘিনীর গলায় একদা হাড়, থুড়ি করোনা, ফুটিয়াছিল। ভাইরাস  বাবাজীবন কেমন করে   পঙ্গোলিন থেকে লাফ দিয়ে এলেন সেটাও কিছুটা আন্দাজ পাওয়া গেল।  আমাদের প্রচুর পোষা কুকুর বেড়াল আছে, সারা পৃথিবী জুড়ে খেত খামার ও ডেয়ারি শিল্পের হাজার হাজার গবাদি পশু আছে , কিন্তু  সুখের বিষয় হল যে  প্রকৃতির এমনি 'মিরাকেল' যে SARS-CoV-২ যদিও বা কোনোদিন তাদের শরীরে ঢুকে পড়ে তারা গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়ে না বা তাদের থেকে সংক্রমণ ছড়ায় না ('মিরাকেল' কথাটা অবশ্য বিজ্ঞানে খাটে না। আসলে বিভিন্ন প্রজাতির রোগ-প্রতিরোধ ক্ষমতাও আলাদা আলাদা।  তাছাড়া ভাইরাসদের ও একটা 'পছন্দ অপছন্দ' বলে ব্যাপার আছে।  যে যে hostএ থাকে সেখানেই থাকে (আর তাই নতুন ভাইরাস থেকে pandemicও কালেভদ্রে ঘটে)। যেমন  SARS-CoV-২ একটু বেশি শুধু মানুষের প্রেমে পড়ে গেছে।  আক্ষরিক অর্থেই, এতো ভালোবাসায় আমাদের প্রাণ ওষ্ঠাগত !







 স্কুল খুলুক, সঙ্গে হাওয়া বাতাস খেলুক ক্লাসঘরে ('এই সময়' সংবাদপত্রে প্রবন্ধ -  ২২শে সেপ্টেম্বর, ২০২১)      সোজাসাপ্টা অপ্রিয়   সত...