Monday, January 4, 2021

নেতাজি সুভাষ চন্দ্র বসু'র ১২৫তম জন্মবার্ষিকী নিয়ে অনেক কিছু তো হচ্ছে। কিছু ভাল, কিছু ঘোলা হবে বলাই বাহুল্য। সে হোক, আমি আমার কথা বলি। দেখুন, অনেকেই জানেন যে  ইতিহাসের ফর্মাল ছাত্র না হয়েও আমি ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রাম নিয়ে বেশ কিছুটা পড়াশোনা করেছি এবং গত কয়েক বছরে একাধিক রচনা প্রকাশিত হয়েছে। এবং, সেই পরিপ্রেক্ষিতে সুভাষ চন্দ্র 'র রাজনৈতিক সংগ্রাম জানার ও বোঝার চেষ্টা করেছি।  
তাই, ভাবছি, এই ১২৫তম জন্মবার্ষিকী উপলক্ষে  আগে-প্রকাশিত লেখাগুলি এবং নতুন কিছু লিখলে এখানে 'পুনঃপ্রকাশিত' করি। আজ 'নেতাজি সিরিজের' প্রথম রচনা। 
এ বছর অগস্ট মাসে 'ইতিহাস তথ্য ও তর্ক' ফেসবুক পত্রিকায় প্রকাশিত। 


 সর্বভারতীয় জাতীয়তাবাদ ও আজাদ হিন্দ সরকার 

২১শে অক্টবর ১৯৪৩, সিঙ্গাপুরের ক্যাথে থিয়েটার প্রেক্ষাগৃহে নেতাজি সুভাষ চন্দ্র বসু আনুষ্ঠানিক ভাবে আর্জি হুকুমাত-ই-আজাদ হিন্দ (অর্থাৎ, স্বাধীন ভারতের অস্থায়ী সরকার ; the Provisional Government of Free India) প্রতিষ্ঠা করেন, এবং তিনদিন পরে ব্রিটিশ সাম্রাজ্য ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেন। আধুনিক ভারতের ইতিহাসে এই ঘটনাপঞ্জী বহু সমাদৃত । সংবিধানের প্রথম volumeএ আজাদ হিন্দ যেমন নন্দলাল বসুর দ্বারা চিত্রিত, তেমনই এর উদযাপনে একাধিক ডাকটিকিট প্রকাশ হয়েছে। সর্বোপরি, লক্ষ লক্ষ্ ভারতবাসী আজও পরম শ্রদ্ধায় এই ইতিহাস স্মরণ করেন।

আর্জি হুকুমাত-ই-আজাদ হিন্দ (অর্থাৎ, স্বাধীন ভারতের অস্থায়ী সরকার) আনুষ্ঠানিক ঘোষণা করছেন নেতাজি।  ২১শে অক্টবর। মঞ্চে ক্যাপ্টেন লক্ষী স্বামীনাথন সহ অন্যান্য আজাদ হিন্দ মন্ত্রী ও অফিসাররা।
(অধ্যাপক সুগত বসু'র থেকে প্রাপ্ত ছবি)   


ভারতীয় সংবিধানের স্বচিত্র সংস্করণে আজাদ হিন্দ সংগ্রামকে স্মরণ। নন্দলাল বসু অঙ্কিত, ১৯৫০। বর্তমানে সংসদ ভবনের লাইব্রেরীতে হিলিয়াম কক্ষের মধ্যে সংরক্ষিত। 

আজাদ হিন্দ সরকারের ২৫তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীতে ভারতের ডাকটিকিট। ১৯৬৮। 

কিন্তু, এও অনস্বীকার্য যে নেতাজি আজ 'দেবতার' মত পূজিত হলেও আজাদ হিন্দ সরকার গঠনে কি ধরণের চিন্তাভাবনা,পরিকল্পনা ও কাজ প্রকাশ পেয়েছিল তা অনেকাংশে সাধারণ মানুষের অজানা । কিন্তু প্রামাণ্য গ্রন্থের তো অভাব নেই। লিওনার্ড গর্ডন থেকে সুগত বসুর মত নামকরা ঐতিহাসিকদের লেখা জীবনী রয়েছে, শাহনাওয়াজ, এস. এ. এয়ার ও শিশির বসুর স্মৃতিকথা আছে; নেতাজির নিজের লেখা দুটি বই, বেশ কয়েক ভলিউম চিঠি ও ভাষণ সংকলিত আছে। আগ্রহী ছাত্রছাত্রী ও গবেষকের কাছে নেতাজি সম্মন্ধে তথ্য-ভিত্তিক ঐতিহাসের অভাব হবে না। অবশ্য, এই স্বল্প পরিসরে বিস্তারিত আলোচনা করা সম্ভব নয়। কিন্তু তাও, কিছু তথ্য উপস্থাপন করে আমরা তাঁর অসামান্য দূরদৃষ্টিশক্তি ও 'সব ভারতবাসীকে নিয়ে চলার' আদর্শ অনুধাবন করতেই পারি।

প্রতীক (symbols) দিয়েই শুরু করা যাক। যে কোন রাজনৈতিক আন্দোলন ও পরিচয়ে (identity) প্রতীক'র গুরুত্ব আছেই; না হলে জাতীয় পতাকায় অশোকচক্র অথবা রামকৃষ্ণ মিশনের প্রতীকে রাজহংস স্থান পেত না। ঠিক তেমনই আজাদ হিন্দ সরকারের symbolismএ একটু নজর দেওয়া যাক।

১। জাতীয় পতাকা - তিরঙ্গা , মাঝখানে গান্ধীবাদী চরকা। ১৯২০ থেকে যে জাতীয় গণআন্দোলন শুরু হয়েছিল তার প্রধান প্রতিবাদী প্রতীক ছিল এই ত্রিবর্ণরঞ্জিত পতাকা এবং ও চরকা (ওপরের ছবি) ।পরের দুই দশকে আপামর ভারতবাসী এই দুই প্রতীককে নিজেদের হৃদয়ে স্থান দিয়েছিলেন। তাই, দেশের বাইরে গঠিত আজাদ হিন্দ যে দেশের অভ্যন্তরীণ আন্দোলনের এক extension সে কথা সহযোদ্ধা ও বিপক্ষ , দেশ ও জগৎ, সবার কাছে প্রমান করতে নেতাজি বদ্ধপরিকর ছিলেন।১,২ 
রণাঙ্গনের পথে আজাদ হিন্দ সেনা।  জাতীয় পতাকা লক্ষ্য করুন। 


উল্লেখ্য ,এই পতাকা ব্যবহৃত হয় দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায়। তার আগে , জার্মানিতে ইন্ডিসচ লিজিওন (Indisch Legion -ভারতীয় রেজিমেন্ট, যা জার্মান সেনাবাহিনীর সঙ্গে যুক্ত ছিল) পতাকা ছিল তিরঙ্গা; কিন্তু, চরকা'র বদলে সেখানে ছিল আক্রমণে উদ্ধত বাঘ(springing tiger) । মহীশুরের 'বাঘ' টিপু সুলতানের প্রতীক স্থান পেয়েছিলো সুভাষচন্দ্রের পরিকল্পিত প্রথম পতাকায় । যেন, এক ইংরেজ সাম্রাজ্য -বিরোধী বীর নৃপতিকে আরেক বীর নেতার সম্মান (১৭৯৯এ টিপু ইংরেজদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে প্রাণ হারান। ভারতীয় রাজাদের মধ্যে এমন 'সম্মান' দুর্লভ; স্বাভাবিকভাবেই স্বাধীনতা সংগ্রামীদের তিনি 'কাছের মানুষ' ছিলেন। এছাড়াও 'টিপুর বাঘ' আজাদী সৈন্যদের insignia ( কাঁধে বা হাতে উনিফর্মের ওপর পড়া সামরিক পরিচয়চিহ্ন) শোভা পেত।

১৯৪২এ জার্মানিতে ইন্ডিসচ লিজিওন'র পতাকা উত্তোলন।  

তিরঙ্গা ও টিপুর বাঘ: ইন্ডিসচ লিজিওন'র shoulder-piece, জার্মানি, ১৯৪২।  



আজাদ হিন্দের আর কি কি প্রতীক ছিল?
২. জাতীয় নীতিবাক্য (motto): ইত্তেফাক-ইতমাদ-কুরবানী। উর্দুতে একতা- বিশ্বাস - ত্যাগ। আজাদ হিন্দের সংগ্রামের মন্ত্র।৩,*
কলকাতার 'নেতাজি ভবনে' সিঙ্গাপুরের আজাদ হিন্দ মেমোরিয়ালের রেপ্লিকা। (ছবি : লেখক)

৩। জাতীয় অভিবাদন (স্লোগান): 'জয় হিন্দ'।

৪। জাতীয় সঙ্গীত:সাব সুখ চেইন (সহজ হিন্দুস্তানিতে 'জন গণ মন') ।

এই তিনটি প্রতীকের মধ্যেই নেতাজির জাতীয়বাদী পরিকল্পনা প্রকাশ পায়। সুভাষচন্দ্র যে বিশেষভাবে উর্দু ও হিন্দুস্তানী (সহজ হিন্দি ও উর্দু মিশ্রনে যে ভাষা) ভালোবাসতেন সে কথা শিশির বসুর 'বসুবাড়ি' গ্রন্থে উল্লেখিত। কংগ্রেস সভাপতি থাকাকালীন তাঁর এক পন্ডিতজি-শিক্ষক ছিলেন যিনি সভাপতির সঙ্গে দূর প্রদেশেও যেতেন। ট্রেনেই চলত 'ক্লাস' । শুধু তাই নয়, কোন সভা বা মিটিংয়ে কেউ উর্দু বা হিন্দুস্তানিতে বক্তব্য রাখলে সুভাষচন্দ্র মন দিয়ে শুনতেন এবং ভাল শব্দ চয়ন করে নিজের বক্তৃতায় ব্যবহারের চেষ্টা করতেন । তবে ব্যক্তিগত পছন্দ-অপছন্দের ওপরে ছিল এমন একটি ভাষামাধ্যম'র আশা যেটা আজাদ হিন্দের অনেককে এক সূত্রে বেঁধে ফেলবে। যেমন 'জয় হিন্দ' স্লোগান। নেতাজির সেক্রেটারি, সাবমেরিনে সহযাত্রী ও স্নেহভাজন আবিদ হাসান (যিনি পরে ডেনমার্ক ও মিশরে ভারতের রাষ্ট্রদূত নিযুক্ত হন) লিখেছেন যে নেতাজি তাঁকে একটি 'সব ভারতীয়ের কাছে গ্রোহনযোগ্য' অভিবাদন ঠিক করতে বলেন। আবিদ প্রথমে ভেবেচিন্তে এসে বলেন যে 'হ্যালো' বেশ ভালো একটি অভিবাদন। নেতাজি দিয়েছিলেন এক ধমক ! ব্যর্থ হয়ে আবিদ আবার চেষ্টা করতে থাকেন, এবং তখন তাঁর নজরে আসে যে আজাদ হিন্দ ক্যাম্পে অনেকেই বলে 'জয় রামজি কি '। এই ধর্মীয় অভিবাদনকে ভিত্তি করেই আবিদ প্রথমে লেখেন 'জয় হিন্দুস্তান কি '; কিন্তু সেটা বড্ড বড় শোনাচ্ছিল বলে ছোট করতেই 'জয় হিন্দ' একটি আশ্চর্য ধ্বনিমাধুর্য নিয়ে চলে আসে। নেতাজিও খুশি হন।সেই শুরু, আজও তার জনপ্রিয়তা অম্লান

অনেকেই জানেন না যে ভারতের জাতীয় সঙ্গীত হিসেবে 'জন গণ মন' প্রথম আন্তর্জতিক মঞ্চে পরিবেশিত হয় ১৯৪২এ জার্মানির হামবার্গে। নেতাজি ভারত ও ভারতীয় সংগ্রাম সম্পর্কে একটি আন্তর্জাতিক কনফারেন্স'র আয়োজন করেছিলেন। আমন্ত্রিত ছিলেন জার্মানিতে বসবাসকারী নামকরা লোকজন ও বিদেশী কূটনীতিবিদরা। সেখানেই প্রথম হামবার্গের রেডিও অর্কেস্ট্রা 'জন গণ মন' পরিবেশন করেন (youtube ভিডিও আছে ) ৬,৭। ক্ষী স্বামীনাথনের স্মৃতি কথায় আছে যে গানটির সর্বভারতীয় appeal নেতাজির বিশেষ পছন্দ ছিল।তবে যেহেতু মূল গানটি সাধুভাষায় লেখা তাই  নেতাজি দক্ষিন-পূর্ব এশিয়ায় যাবার পরে গানটি বাংলা থেকে সহজ হিন্দুস্তানিতে অনুবাদিত হয় । 'সাব সুখ চৈন কি বারখা বারসে' রচনা করেন আবিদ হাসান ও মুমতাজ হুসেইন এবং সুর দেন ক্যাপ্টেন রাম সিংহ ঠাকুর। স্বাধীন ভারতের ইতিহাসে এ এক উল্লেখযোগ্য অবদান।

১১ই সেপ্টেম্বর, ১৯৪২। হামবার্গে জার্মান-ভারত সোসাইটির উদ্বোধনে নেতাজি। এখানেই প্রথম আনুষ্ঠানিক ভাবে 'জন গন মন' জাতীয় সংগীত হিসেবে পরিবেশিত হয়।  


ভাষা ও লিপি :
ভাষা নিয়ে নেতাজির বৃহৎ চিন্তাভাবনায় কিছু আলোকপাত করা যাক । যেমন, 'আজাদ হিন্দ' পত্রিকা। জার্মানির ফ্রি ইন্ডিয়া সেন্টার থেকে ইংরেজি ও জার্মান দুই ভাষায় প্রকাশিত হত (আজ নেতাজি রিসার্চ ব্যুরোতে সংখ্যাগুলি সংরক্ষিত)।তবে আরো গুরুত্বপূর্ণ ছিল আজাদ হিন্দ রেডিও। সাতটি ভারতীয় ভাষায় দৈনিক সম্প্রচার চলত - হিন্দুস্তানী, বাংলা, তামিল, তেলুগু, গুজরাটি, ফার্সি আর পুশতু আর নেতাজির ইংরেজি আর হিন্দুস্তানি ভাষণ সঙ্গে সঙ্গে তামিলে অনুবাদিত হয়ে পুনঃপ্রচারিত হত ৮,৯।যেমন প্রভিশনাল সরকারের ঘোষণা পত্র ইংরিজি, হিন্দুস্তানি ওঃ তামিল ভাষায় প্রচারিত হয়েছিল । হিসেবটা সোজা - সবার ভাষাকে সম্মান না করলে একসঙ্গে সংগ্রাম হবে কি করে? প্রকৃত নেতার এই বৈশিষ্ট্য - কাউকে দূরে ঠেলে দেন না, সবাইকে নিয়ে চলার চেষ্টা করেন।

তবে শুধু ভাষা নয়, স্বাধীন ভারতে কি ধরণের লিপি ব্যবহার হবে তা নিয়েও নেতাজি পরিকল্পনা করেছিলেন। দেবনাগরী ও আরব-ফার্সি দুই লিপি উপকারিতা স্বীকার করেও তিনি কংগ্রেস সভাপতি রূপে তাঁর বিখ্যাত হরিপুরা কংগ্রেস ভাষণে একটি অভিনব প্রস্তাব করেছিলেন - বলেছিলেন যে রোমান লিপিতে হিন্দুস্তানী একটি সর্বভারতীয় মাধ্যম হতে পারে ১০। এই ব্যাপারে নেতাজির ওপর আধুনিক তুরস্কের জাতির জনক মুস্তাফা কেমাল আতাতুর্ক'র প্রভাব লক্ষণীয় । ১৯২০র দশকে একই ভাবে আতাতুর্ক তুরস্কে রোমান লিপির জন্যে সর্বশিক্ষা অভিযান শুরু করেন । সুভাষ চন্দ্র আতাতুর্ক'র দেশ গঠনের নানারকম পরিকল্পনার গুনগ্রাহী ছিলেন। তাঁর লেখায় ও ভাষণে একাধিকবার এর প্রমান পাওয়া যায় ১১

সেনাবাহিনী - আজাদ হিন্দ ফৌজ

অস্থায়ী ভারত সরকারের সেনাবাহিনীর নামের সঙ্গে আমরা সবাই পরিচিত - ইন্ডিয়ান ন্যাশানাল আর্মি বা আজাদ হিন্দ ফৌজ । সঠিক সৈন্যসংখ্যা নিয়ে দ্বিমত থাকলেও তিনটি সামরিক ডিভিশনে আনুমানিক ৪৫ থেকে ৫০ হাজার আজাদী সৈন্য ছিলেন।এছাড়া আরো পাঁচ ডিভিশন সৈন্য প্রস্তুত হচ্ছিলেন। এর মধ্যে প্রথম INA ডিভিশন'র অধীনস্ত ছিল ইতিহাসে-বিখ্যাত গান্ধী ব্রিগেড, নেহেরু ব্রিগেড ও আজাদ ব্রিগেড ১২,১৩। দেশীয় আন্দোলনের সঙ্গে সংযোগ দেখাতে সদা -আগ্রহী নেতাজি তাঁর প্রধান ব্রিগেডেদের নামকরণ করেছিলেন দেশের সবচেয়ে জনপ্রিয় তিন নেতার নামে #। 

উল্লেখযোগ্য ভাবে কোন 'সুভাষ ব্রিগেড' ছিল না, যদিও প্রথম ডিভিশনের বাছাই করা সৈন্যদের নিয়ে গঠিত একটি গেরিলা রেজিমেন্ট নিজেদের 'সুভাষ ব্রিগ্রেড' বলতে ভালবাসতেন। শাহনওয়াজের স্মৃতিকথায় আছে যে নেতাজি এই নামকরণ বারণ করলেও 'সুভাষ ব্রিগ্রেড' এই ব্যাপারে সর্বাধিনায়কের নির্দেশ মানতে উৎসাহী ছিলেন না ১৩। চার ব্রিগেডই জাপানের ইমফল অভিযানে সাহসী সংগ্রাম করেন। বাহাদুর গ্রুপ নামে একটি কম্যান্ডো দল ছিল। মনিপুরের মৈরাং জাপানি ও আজাদ হিন্দ ফৌজের দখলে আসার পরে ১৪ই এপ্রিল ১৯৪৪ সেই দলের কর্নেল শওকত আলী মালিক সর্বপ্রথম স্বাধীন ভারতের মাটিতে দেশের পতাকা উত্তোলন করেন ১৪। আজ এই দিনটি 'মৈরাং দিবস' হিসেবে উদযাপিত হয়।

মৈরাংয়ে জাতীয় পতাকা উত্তোলন স্মরণে ফলক।  


তবে, আজাদ হিন্দের সবচেয়ে নামকরা উনিট'র নাম বোধয় ঝাঁসির রানী রেজিমেন্ট। লক্ষী স্বামীনাথন (পরে শাহগল) এবং জানকি নাহাপ্পা'র নেতৃত্বে গঠিত ~১০০০ মহিলা সেনাদল। মধ্যবিত্ত শ্রেণী থেকে কয়েকজন হলেও, মূলত এর সদস্যারা ছিলেন নিম্নবিত্ত রবার-প্লান্টেশনে কাজ করা তামিল পরিবারের মেয়ে ১৫। ১৮৫৭'র মহাবিদ্রোহের বীরঙ্গনা রানীর নামাঙ্কিত এই রেজিমেন্ট নেতাজির এক অনন্য পরিকল্পনা। দেশবাসীর ৫০% তো মহিলা; তাঁরা কেন স্বাধীনতা সংগ্রামে যোগ দেবেন না ? এই উপলব্ধি তাঁর জীবনে প্রথম আনেন তাঁর রাজনৈতিক গুরু দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন। মূল সূত্র সেই 'সবাইকে নিয়ে চলা '।

কাজটা অবশ্য সহজ ছিল না। জার্মান ও জাপানের মত ফ্যাসিস্ট গোঁড়া সরকারি চিন্তাভাবনায় এ ছিল অভাবনীয়। হিটলার যেমন সেনাবাহিনীতে মহিলাদের যোগ দেবার তীব্র বিরোধী ছিল ১৬।জাপানেরও কোনো মহিলা সেনাবাহিনী ছিল না ।কিন্তু, সুভাষ চন্দ্র এ বিষয়ে অনড়। দেশের স্বাধীনতা লড়াইয়ে মেয়েদের ডাইরেক্ট ভূমিকা থাকবেই। রানী অফ ঝাঁসি রেজিমেন্টকে জাপানিরা রসদ ও অস্ত্র দিতে বেঁকে বসায় সিঙ্গাপুরের ইন্ডিয়ান ইনডিপেনডেন্স লীগের প্রধান আত্তাভার য়েলাপ্পা এগিয়ে এসে সব ব্যবস্থা করেন  মাস সামরিক ও নার্সিং প্রশিক্ষণের পরে 'রানী'রা বর্মা ফ্রন্টের দিকে যাত্রা করেন । কিন্তু, ততদিনে যুদ্ধের মোড় ঘুরে গেছে। ইঙ্গ-মার্কিন সেনা ও বিমানবাহিনীর কাছে পর্যদুস্ত হয়ে জাপানি ও আজাদ হিন্দ ফৌজ পিছোতে বাধ্য হয়েছেন। রানীদের প্রধান কাজ হয় যুদ্ধে আহত আজাদ হিন্দ সৈন্যদের সেবা সুশ্রষা । বর্মা থেকে রিট্রিট করার সময়, যাতে তারা কোন বেশি বিপদে না পড়েন , তাই নেতাজি নিজে তাদের সঙ্গে বেশ কয়েক দিন হেঁটে বন জঙ্গল পাহাড় পেরিয়ে আসেন। আজ ও বহু ভারতীয় মহিলা ইতিহাসের সেই আশ্চর্য অধ্যায় থেকে অনুপ্রেরণা নিতে পারেন ১৫

রানী অফ ঝাঁসি রেজিমেন্টের কুচকাওয়াজে নেতাজি।  পাশে রেজিমেন্টের নেত্রী ক্যাপ্টেন লক্ষী স্বামীনাথন। 


আজাদ হিন্দ মেডেল ও আজাদ হিন্দ ব্যাঙ্ক
বীর সেনাদের সম্মান জানাতে বেশ কিছু মেডেল চালু করেছিলেন নেতাজি। রণাঙ্গনে সাহসিকতার জন্যে প্রদান করা শের-ই-হিন্দ (ভারতের বাঘ) এবং সর্দার-ই-জং (যুদ্ধে শ্রেষ্ঠ) মেডেল। ক্যাপ্টেন কুঁয়াল সিং ও ক্যাপ্টেন গনেশি লাল শের-ই-হিন্দ মেডেল দিয়ে সম্মানিত হন, শওকত মালিক ভূষিত হয়েছিলেন সর্দার-ই-জং ১৭
আজাদ হিন্দের মেডেল। শের-ই-হিন্দ ও সর্দার-ই-জঙ 


এছাড়া দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ায় বসবাসকারী যে সব ভারতীয়রা আজাদ হিন্দের অসামরিক কাজের নিরলস সংগ্রামী তাঁদের জন্যে ছিল সেবক-ই-হিন্দ মেডেল। যেমন, রেঙ্গুনের ব্যবসায়ী আব্দুল হাবিব মারফানী এবং শ্রীমতি বেতাই নিজেদের সব সম্পত্তি দেশের জন্যে দান করে দেন। নেতাজির অসাধারণ বাগ্মিতা ও আহ্বানে মুগ্ধ ভারতীয় সম্প্রদায় তাঁর হাতে আরো প্রায় কুড়ি কোটি টাকা তুলে দিলে ৫ই এপ্রিল, ১৯৪৪ প্রতিষ্ঠিত হয় 'ন্যাশনাল ব্যাঙ্ক অফ আজাদ হিন্দ' ^। জাপানিরা ব্যাপারটায় খুশি হয়নি, কিন্তু নেতাজি জাতীয় ব্যাপারে সবসময়ই কিছুটা দূরত্ব রাখতে চেষ্টা করতেন। জার্মানি ও জাপান থেকে তিনি যা আর্থিক সাহায্য নিতেন, সেটা জাতীয় ঋণ (ন্যাশনাল loan) হিসেবে নেওয়া হত , স্বাধীনতার পরে ভারত তা মিটিয়ে দেবে এই ছিল বোঝাপড়া। এক্ষেত্রে তিনি জাপানিদের জানিয়ে দিয়েছিলেন স্বাধীন ভারতের যে সব ভূখন্ড স্বাধীন হবে সেখানে প্রথম থেকেই আজাদ হিন্দ মুদ্রা চালু হবে, জাপানি ইয়েন নয় ১৮। এবং এই জন্যে টোকিওর টাঁকশালে মুদ্রিত হয়েছিল আজাদ হিন্দের নতুন টাকারsample নোট। এছাড়া জার্মানিতে মুদ্রিত হয়েছিল আজাদ হিন্দ সরকারের ডাকটিকিট। পরিকল্পনা ছিল যে ভারতের যে সব অঞ্চল থেকে ইংরেজ সরকার হটে যাবে সেখানে আজাদ হিন্দ সরকারের অসামরিক দপ্তর সঙ্গে সঙ্গে কাজকর্ম চালু করবে ১৯। অবশ্য, সমগ্র জাপান-অধিকৃত এশিয়ার সঙ্গে দৈন্দিন কাজকর্মে জাপানি সরকারের ডলার ব্যবহার করতেন আজাদ হিন্দ সরকার। যেমন, ১৯৪৪এ সিঙ্গাপুরের রামকৃষ্ণ মিশনের boys home 'বাল ভবন' নির্মাণে নেতাজি ৫০০০০ ডলার দান করেন ২০
'ন্যাশনাল ব্যাঙ্ক অফ আজাদ হিন্দ' নিজের সম্পত্তি দান করা আব্দুল হাবিব মারফানী 
আজাদ হিন্দ সরকারের পরিকল্পিত টাকার নোট  


আজাদ হিন্দ সরকারের অবশ্য সেভাবে কোনো ভারতীয় ভূখন্ড রাজ্যত্ব করতে পারেননি। জাপান আনুষ্ঠানিকভাবে আন্দামান ও নিকোবর দ্বীপপুঞ্জ নেতাজির হাতে তুলে দিয়েছিল ; নামকরণ হয়েছিল 'শহীদ'' ও 'স্বরাজ'। কিন্তু, আসল প্রশাসন জাপানি কমান্ডারদের হাতেই থেকে গিয়েছিল, এবং তাদের সন্দেহবাতিক ও অত্যাচারে আন্দামানবাসিরা অতিষ্ট ছিলেন। । আজাদ হিন্দ এই নিয়ে বারবার প্রতিবাদ করলেও তেমন ফল হয়নি ২১

পোর্ট ব্লেয়ারে আজাদ হিন্দের পতাকা উত্তোলন, ৩০শে ডিসেম্বর, ১৯৪৩।


ক্যাবিনেট:
এই বিশাল সংগ্রামের হৃদয়-কেন্দ্র ছিল আজাদ হিন্দ ক্যাবিনেট। নেতাজির নিজস্ব মন্ত্রিসভা ও উপদেষ্টাগণ।
ক্যাবিনেটে সদস্য ছিলেন -
সুভাষ চন্দ্র বসু - রাষ্ট্রপ্রধান, প্রধানমন্ত্রী, যুদ্ধ ও বিদেশ মন্ত্রক । **
লেঃ কর্নেল এ সি চ্যাটার্জি (পরে এন. রাঘবন) - অর্থ মন্ত্রক ।
ডঃ: লক্ষী স্বামীনাথন - মহিলা বিষয়ক মন্ত্রক (minister for women affairs )
এ এম সহায় - প্রধান সচিব
এস এ আয়ার - প্রচার ও জন সংযোগ মন্ত্রক।
রাসবিহারী বসু - সর্বোচ্চ উপদেষ্টা (আজাদ হিন্দের সংগ্রাম এবং পুরোনো বিপ্লবীরা যেন একই পথের পথিক)
করিম গিয়ানি , জন থিবি , দেবনাথ দাস, সর্দার ইশার সিংহ, ডি.এম. খান, আত্তাভার য়েলাপ্পা - বর্মা , থাইল্যান্ড, সিঙ্গাপুর এবং হংকং থেকে উপদেষ্টা।
লেঃ কর্নেল জে কে ভোঁসলে , লেঃ কর্নেল গুলজারা সিং , লেঃ কর্নেল শাহ নাওয়াজ খান , লেঃ কর্নেল আজিজ আহমেদ, লেঃ কর্নেল মোহাম্মদ জামন কিয়ানি, লেঃ কর্নেল এন.এস. ভগত, লেঃ কর্নেল এহসান কাদির এবং লেঃ কর্নেল এ.সি লোগানাথান - আজাদ হিন্দ ফৌজের প্রতিনিধি।
এ এন সরকার - আইন বিষয়ক উপদেষ্টা ২২,+
আজাদ হিন্দ ক্যাবিনেট, সিঙ্গাপুর, ১৯৪৩/৪৪.


যেটা বলার অপেক্ষা রাখে না তা হল ক্যাবিনেট গঠনেও ভারতের সব সম্প্রদায় ও প্রদেশের সুস্পষ্ট উপস্থিতি। এবং শুধু উচ্চতম পর্যায়েই নয়। ব্রিটিশ ইন্ডিয়ান আর্মির ধর্ম- ও জাত-ভিত্তিক গঠনের সম্পূর্ণ বিপরীত দিকে গিয়ে আজাদ হিন্দ ফৌজের ক্ষুদ্রতম উনিটেও সব ভারতীয়রা জাত ধর্ম নির্বিশেষে থাকবেন, এই প্রতিদিনের-জাতীয়তাবাদই ছিল নেতাজির আদর্শ ও লক্ষ্য। এর ফলাফল বর্ণনা করেছেন আবিদ হাসান, '' আমাদের মধ্যে ছিলেন বালুচিরা, যেমন ছিলেন অসমীয়া, কাশ্মীরি আর মালায়লীরা, পাঠান এবং শিখ, আর গুজরাটিরা। ভারতের প্রতিটি অঞ্চলের অধিবাসী ছিলেন, ছিলেন প্রতি ধর্ম ও জাতের লোকজন, এবং বড় ডিভিশন থেকে শুরু করে সবচেয়ে ছোট পল্টনের মধ্যেও সবাই হাতে হাত মিলিয়ে কাজ করতেন । এইভাবে প্রত্যেকটি ইউনিট হয়ে দাঁড়িয়েছিল ভারতের একতার প্রতীক।'' ২৩

আবিদ যোগ করতে ভোলেননি, ''আমাদের সবার কিন্তু নিজ নিজ ধর্ম এবং নিজস্ব ভাষা ছিল। কিন্তু, রাজনৈতিক লক্ষে আমরা ছিলাম এক, প্রতিজ্ঞাবদ্ধ এবং অবিভাজ্য ।'' নেতাজি তাঁদের কাউকেই নিজের ধর্ম, সংস্কৃতি, ভাষা ত্যাগ করতে বলেননি। তবে এই সব পরিচয়ের উর্ধে যে দেশের পরিচয়(identity) সেই পরিচয়ের জন্যে একত্র হতে বলেছিলেন। জাতীয় ঐক্যের ব্যাপার সবার ওপরে এবং সেখানে তিনি অনমনীয়। যেমন, রেঙ্গুনের ধনী দক্ষিণ ভারতীয় চেট্টিয়ার সম্প্রদায় ছিলেন আজাদ হিন্দ সরকারের বড় পৃষ্টপোষক। তাঁদের প্রধান মন্দিরে official visit করলে আর্থিক সমর্থন আরো বাড়বে, এটাই অনুমেয়। নেতাজি কিন্তু স্পষ্ট জানিয়ে দেন যে মন্দিরের পুরোহিতগণ যদি তাঁর ক্যাবিনেটের হিন্দু ও ও-হিন্দু সকল মন্ত্রীকে মন্দিরে প্রবেশ করতে দেন তবেই তিনি যাবেন! আমরা- ওরা কোনোমতেই চলবে না। শেষ পর্যন্ত চেট্টিয়ার মন্দির কর্তৃপক্ষ সবাইকে আমন্ত্রণ জানান। হিন্দু-মুসলমান-শিখ-ক্রিস্টান সকল ভারতীয় মিলে সেদিন এক আশ্চর্য জনসমাগম হয়েছিল ২৪

মনে রাখা আবশ্যক, নেতাজি কিন্তু ভগৎ সিং, চদ্রশেখর আজাদ'র মত ঘোষিত-নাস্তিক, কিংবা জওহরলাল নেহরুর মত এগ্নস্টিক ছিলেন না। বিশ্বজননী-রূপে তিনি ঈশ্বরে বিশ্বাস করতেন। যুদ্ধের ভয়ানক ব্যস্ততার মধ্যে সারাদিনের কাজের শেষে অনেক রাত্রে সিঙ্গাপুরের রামকৃষ্ণ মিশনে গিয়ে মিলিটারি পোশাক ছেড়ে একটি সিল্কের ধুতি পরে ঘন্টা দুই ধ্যানমগ্ন হতেন। এই ছিল তাঁর 'রিচার্জ' ২৫। তবে সেটা তাঁর ব্যক্তিগত জীবন। আয়ার'র বর্ণনা থেকে আমরা জানতে পারি , '' একদিনের জন্যেও তাঁকে দেখিনি প্রকাশ্যে, জনসমক্ষে কোনো ধার্মিক আচরণ করতে। তাঁর কর্মই ছিল তাঁর ধর্ম, জীবনের প্রতি মুহূর্ত সংগ্রামের মধ্যে দিয়ে সেই ধর্ম তিনি পালন করতেন''২৬  
 এবং এই জীবনাদর্শ ও বিশ্বব্যাপী অভিজ্ঞতা থেকেই আসে আজাদ হিন্দ সরকারের ঘোষণাপত্রের শেষ অনুচ্ছেদে নেতাজির দ্যর্থহীন ঘোষণা - ''...[স্বাধীন ভারতের অস্থায়ী সরকার] প্রত্যেক ভারতবাসীকে নিজ নিজ ধর্ম পালন করার স্বাধীনতা দিতে অঙ্গীকারবদ্ধ , এবং সবাইকে সমান অধিকার ও সুযোগসুবিধা প্রদান করতেও দ্বায়িত্ববদ্ধ । বিদেশী ঔপনিবেশিক সরকারের দ্বারা প্রতিপালিত সব ভেদ, দূরত্ব ও তফাৎ'র উর্ধে গিয়ে প্রত্যেক ভারতীয়ের সুখ ও সমৃদ্ধির জন্যে সংগ্রাম করা এই সরকারের প্রথম এবং প্রধান কাজ হবে ।'' ২৭

একটি ঘটনা দিয়ে শেষ করি।' His Majesty's Opponent' বইতে পড়েছি।  ১৯৪৫র শেষে যখন লাল কেল্লায় তিন আজাদ হিন্দ অফিসারের মিলিটারি বিচার চলছে তখন কেল্লায় আরো অনেক অফিসার ও সৈন্য বন্ধি ছিলেন। গান্ধীজি একদিন তাঁদের দেখতে যান, কেমন আছেন খোঁজ নেন।  আজাদ হিন্দ সৈন্যরা গান্ধীজির কাছে নালিশ করেন যে 'নেতাজি আমাদের শিখিয়েছিলেন কোন ধর্ম সম্প্রদায়ের বিভাজন রাখবে না।  কিন্তু, এখানে ইংরেজরা সারাক্ষন আমাদের হিন্দু-মুসলমান ভাগ করতে উঠে পড়ে লেগেছে। দেখুন, সকালের চা ও দে দুটো আলাদা 'হিন্দু চা' আর 'মুসলমান চা' লেখা আলাদা কেটলিতে।' মুচকি হেসে গান্ধীজি দেন, 'ওরা দেয় তো দেয় তোমরা মানো কেন?  আজাদ হিন্দ সেনারা জবাব দেন, 'মানি না তো। আমরা দুই কেটলির চা মিশিয়ে নিয়ে তারপর খাই' . জোরে হেসে ওঠেন গান্ধীজি।  বলেন,  'দারুন এই তো চাই ' .

এই চিরন্তন সদুপদেশ আজ হয়তো ভারতবাসীর কাছে বেশি করে প্রাসঙ্গিক।

 সদ্য মুক্তিপ্রাপ্ত আজাদ হিন্দ অফিসার ও সেনারা গান্ধীজিকে জন গন মন গেয়ে শোনাচ্ছেন। বেহালা বাজাচ্ছেন ব্যান্ডমাস্টার  ক্যাপ্টেন রাম সিং ঠাকুর। সম্ভবত লালকেল্লায়। ১৯৪৫/৪৬

------------- ---------------
প্রকাশিত - https://www.facebook.com/groups/1803711656387813/permalink/3230153960410235

টিকা
*সিঙ্গাপুর ছেড়ে যাওয়ার কয়েকদিন আগে নেতাজি তাঁর বিশ্বস্ত অফিসার সিরিল জন স্ট্রেসিকে নির্দেশ দেন, আজাদ হিন্দের শহীদ সৈন্যদের জন্যে একটি স্মৃতিস্তম্ভ তৈরী করতে হবে। অল্প কয়েকদিনেই মধ্যেই সিঙ্গাপুরের সমুদ্রতটে স্ট্রেসি যে সৌধ নির্মাণ করেন তাতে খোদাই করা ছিল এই motto। কিন্তু, চরম অনৈতিকভাবে বিজয়ী মিত্রশক্তি সেই সৌধ ডিনামাইট দিয়ে উড়িয়ে দেয়! বহু দশক পরে সিঙ্গাপুরে বসবাসকারী কয়েকজন ভারতীয় একটি আধুনিক সৌধ করেছেন ; আরেকটি প্রতিরূপ আছে কলকাতার নেতাজি ভবনে।

গান্ধীজি প্রসঙ্গে বলা অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক যে স্বাধীন ভারত কোনোদিন সরকারিভাবে তাঁকে 'জাতির জনক' উপাধি দেয়নি। এই সম্মানের উৎস নেতাজি সুভাষ চন্দ্র বসু'র আজাদ হিন্দ রেডিও ভাষণ(৬ই জুলাই, ১৯৪৪)। শুধু তাই নয়, পুনার জেলে কস্তুরবা গান্ধীর মৃত্যর পরে বেতার ভাষণে নেতাজি সেই অসামান্যা নারীকে 'mother of the Indian people' বলে অভিহিত করেন।

^ সব অনাবাসী ভারতীয় যে টাকা পয়সা দিতে অতটা উৎসাহী ছিলেন না। শেষ পর্যন্ত আজাদ হিন্দ সিদ্ধান্ত নেয় যে অনিচ্ছুকরা ১০% দিলেই হবে।

** তাহলে কি নেতাজি ভারতের প্রথম প্রধানমন্ত্রী? না , কারণ নেতাজি তাঁর ভাষণে নিজেই স্পষ্ট করে দিয়েছেন যে আজাদ হিন্দ হল 'অস্থায়ী সরকার ', এবং ভারত স্বাধীন হবার পরেই এই সরকারের কাজ শেষ। তারপরে কি সরকার গঠিত হবে তা ঠিক করবেন স্বাধীন ভারতের মানুষ।
+ জার্মানি, ইতালি, জাপান ও অক্ষশক্তি-সমর্থিত ৬টি সরকার আজাদ হিন্দকে স্বীকৃতি দিয়েছিল। আয়ারল্যান্ডের রাষ্ট্রপতি ইমন ডি'ভালেরা শুভেচ্ছা বার্তা পাঠিয়েছিলেন।



সহায়ক গ্রন্থ
১,২,৩ - Sugata Bose, His Majesty 's Opponent, 2011, Penguin Books p. 210, 257, 299
৪ - শিশির কুমার বসু, বসুবাড়ি, ১৯৮৫, আনন্দ পাবলিশার্স , পৃ.৮২-৮৩
৫, ৬ - Leonard Gordon, Brothers against the Raj, 1990, Rupa Publications, pp. 459-460; Bose, His Majesty 's Opponent, 2011, Penguin Books pp.210-211
৭ - https://www.youtube.com/watch?v=9Cn34HFZ8tc
৮, ৯ - Leonard Gordon, Brothers against the Raj, 1990, Rupa Publications, p. 454-455; Sugata Bose, His Majesty 's Opponent, 2011, Penguin Books p. 225, 245
১০ - Sugata Bose, His Majesty 's Opponent, 2011, Penguin Books p. 140; Crossroads, being the works of Subhas Chandra Bose 1938-40, published by Netaji Research Bureau, 1962, Asia Publishing House. pp.13-14
১১- Congress President: Speeches, Articles, and Letters January 1938–May 1939, p. 61; Hugh Toye, The Springing Tiger, Jaico Publishing House, p. 179.
১২, ১৩ - Leonard Gordon, Brothers against the Raj, 1990, Rupa Publications, p. 498; Sugata Bose, His Majesty 's Opponent, 2011, Penguin Books pp.251-252
১৪- Sugata Bose, His Majesty 's Opponent, 2011, Penguin Books p.275
১৫, ১৬ - Leonard Gordon, Brothers against the Raj, 1990, Rupa Publications, p. 496-497; Sugata Bose, His Majesty 's Opponent, 2011, Penguin Books p.246-247; William L. Shirer, Rise and Fall of the Third Reich, 1960, Arrow Books, p. 975
১৭ - https://en.wikipedia.org/wiki/Sher-e-Hind ; https://en.wikipedia.org/wiki/Sardar-e-Jung
১৮, ১৯ - Leonard Gordon, Brothers against the Raj, 1990, Rupa Publications, p. 510; Sugata Bose, His Majesty 's Opponent, 2011, Penguin Books p.272-73
২০- https://www.facebook.com/.../permalink/715524075604174/
২১ - Leonard Gordon, Brothers against the Raj, 1990, Rupa Publications, p. 502, Unto Him a Witness, SA Ayer, 1951, Thacker and Co Ltd, p. 249
২২ - Selected speeches by Subhas Chandra Bose, introduction by S.A. Ayer, Publications Division, Ministry of Information and Broadcasting, Government of India. pp. 219-220; Sugata Bose, His Majesty 's Opponent, 2011, Penguin Books p.255
২৩-Sugata Bose, His Majesty 's Opponent, 2011, Penguin Books pp.281-82
২৪ -Sugata Bose, His Majesty 's Opponent, 2011, Penguin Books p.256
২৫-Leonard Gordon, Brothers against the Raj, 1990, Rupa Publications, p.502;
Sugata Bose, His Majesty 's Opponent, 2011, Penguin Books p.253
২৬- Unto Him a Witness, SA Ayer, 1951, Thacker and Co Ltd, p. 269
২৭-Selected speeches by Subhas Chandra Bose, introduction by S.A. Ayer, Publications Division, Ministry of Information and Broadcasting, Government of India. pp. 218-220
------------------ ------------------

1 comment:

  1. গবেষণাধর্মী লেখা । পড়ে সমৃদ্ধ হলাম । নেতাজিকে নিয়ে অনেক ক্ষেত্রেই ব‍্যক্তিপূজার বা ব‍্যক্তিনিন্দার উর্ধে উঠতে পারে না । কিন্তু এই লেখাটি সেই পরিচিত গতে বাঁধা নয় । নেতাজির অমর আত্মাকে সশ্রদ্ধ প্রণাম জানাই ।

    ReplyDelete

 স্কুল খুলুক, সঙ্গে হাওয়া বাতাস খেলুক ক্লাসঘরে ('এই সময়' সংবাদপত্রে প্রবন্ধ -  ২২শে সেপ্টেম্বর, ২০২১)      সোজাসাপ্টা অপ্রিয়   সত...