Friday, January 1, 2021

  চৈতন্য হওয়া বা না হওয়া ....

আজ কল্পতরু উৎসব। ১৮৮৬ সালে যেদিন অসুস্থ শ্রীরামকৃষ্ণ  ১৪-১৫জন মানসপুত্রকে আনুষ্ঠানিক ভাবে সন্ন্যাসীর পোশাক দিয়ে RKMর nucleus গড়ে দিয়েছিলেন তার উদযাপন।সেদিন তাঁর ব্যবহৃত সেই দুটি কথা 'চৈতন্য হোক'। মানুষর জন্যে এর থেকে বড় আশীর্বাদ হয় কি?

মজার ব্যাপার হল, কোন বিশেষ বিষয়ে এই 'চেতনা' বা  'চৈতন্য' বা 'উপলব্ধি' ব্যাপারটা বেশ ব্যক্তিগত। আমি আমার কথা বলতে পারি।বিজ্ঞানের গবেষক হিসেবে অনেকদিন তো হল। তাই এখন বুঝি যে  নতুন আবিষ্কার বা নতুন তথ্য সমন্ধে পড়া, জানা, চিন্তাভাবনা করা, মনে রাখা এবং প্রয়োজনে recollect করা একটা জিনিস। তার সঙ্গে related অথচ বেশ কিছুটা স্বাতন্ত্র হল সেই বিষয়টা 'উপলব্ধি' বা  'আত্মস্থ' করা। ইংরিজিতে প্রথমগুলি হল  data acquisition আর দ্বিতীয়টা assimilation বা realization ; প্রথমটা না হলে দ্বিতীয়টা হবে না (অন্তত বিজ্ঞানে হবে না) , কিন্তু প্রথমটা হলেই যে দ্বিতীয়টা হতে হবে তার কোন immediate কারণ নেই।এবং কবে কখন কিভাবে হবে তারও ঠিক নেই। তক্ষুনি  হতেও পারে, পরেও হতে পারে, অনেক বছর পরে কোন অভিজ্ঞতার মাধ্যমে সেই চেতনা/উপলব্ধি আসতে পারে। তবে কিছু experience সবসমই এ ব্যাপারে সাহায্য করে। চোখের দেখা একটা দারুন জিনিস; হেভ্ভি উপলব্ধি করায়।  তাই, আজ একটা ঘটনা বলি। আজ যাঁর আশীর্বাদধন্য উৎসব তাঁকে নিয়েই; খুবই সামান্য জিনিস, কিন্তু তার মধ্যেও কিছু লুকিয়ে ছিল কে জানত? 

 মূল ঘটনায় যাবার আগে একটি quote দিয়ে শুরু করি।  অনেকেই এটি একটু  ছোটোভাবে পড়ে থাকবেন। 'During the last century the finest fruit of British intellectual eminence was, probably, to be found in Robert Browning and John Ruskin. Yet they are mere gropers in the dark compared with the uncultured and illiterate Ramakrishna of Bengal, who knowing naught of what we term ‘learning’, spoke as not other man of his age spoke, and revealed God to weary mortals'.

অর্থাৎ, 'ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষে শ্রেষ্ঠ ইংরেজ মনীষী বলতে রবার্ট ব্রাউনিং আর জন রাস্কিন'র কথা আসবে। কিন্তু,বাংলার নিবাসী নিরক্ষর রামকৃষ্ণের তুলনায় ইউরোপের এই শ্রেষ্ঠ পণ্ডিতরা অজ্ঞানী।....'

অনেকে ভাবেন এর রচয়িতা পন্ডিত ম্যাক্স মুলার। না , জার্মান ভারততাত্ত্বিক মুলার শ্রী রামকৃষ্ণে'র জীবনী রচনা করলেও এই লেখাটি ইংরেজ লেখক ভারতপ্রেমিক উইলিয়াম ডিগবাই'র (William Digby) . লেখাটির মধ্যে একটা তথ্যগত ভুল আছে। শ্রীরামকৃষ্ণ নিরক্ষর ছিলেন না। লিখতে-পড়তে পারতেন, তার প্রমান ও রয়েছে। কিন্তু, উইলিয়াম ডিগবাই'র  মূল উপলব্ধি একদম bang on target. কেন এই sentenceটা আনলাম ঘটনা এগোলেই বুঝতে পারবেন।  

William Digby (1849-1904) 

শ্রী রামকৃষ্ণের লেখা ও আঁকা 



আমার বন্ধু রাজেন্দ্র (তেলুগু, একদিকে  তুখোড় বিজ্ঞানী অন্যদিকে দারুন মজার ছেলে) পুজোআচ্চার ব্যাপারে খুবই নিষ্ঠাবান। যে ফ্ল্যাটে পেয়িং-গেস্ট থাকত সেখানে একটা টেবিলে অনেকজন দেবদেবীকে প্রতিষ্ঠা করে রোজ ভাল করে পুজো করে তবে instituteএ আসত। আর এতগুলি মূর্তি ছবি'র মধ্যে ওর 'ফেভারিট' ছিল শিরিডি সাঁইবাবার একটা মূর্তি। মাঝারি সাইজ, পরিচিত স্টাইলে হাঁটুর ওপরে পা তুলে তিনি বসে আছেন।তেমন কিছু আহামরি না আমাদের যেমন চড়কের মেলা হয় তেমন কোন জায়গা থেকে কেনা, কিন্তু অজানা artist  মুখে বেশ স্নিগ্ধ ভাবটা ফুটিয়ে তুলেছিলেন। রাজেন্দ্র'র তো বটেই, আমি যে আমি প্রায় কোন ritual করি না, আমারও ওটা দেখতে খুব ভাল লাগত। 

তা এভাবেই চলছিল। একদিন রাজেন্দ্র'র ব্যাগে একটা প্লাস্টিক সাপ ঢুকিয়ে দিতে বিগ বাজারে তুলকালাম পড়ে গেসল, সিকিউরিটি দৌড়ে এসেছিল কিন্তু যাক সে কথা।  আরেক দিন রাজেন্দ্র কাজে এল একটু দেরি করে এবং দেখি খুব মনমরা। এটা খুব স্ট্রাইকিং কারণ সাধারণত ও  ঢোকা মানে এক-দু মিনিট  হৈ হুলোড় হওয়া। কিন্তু সেদিন চুপ।  একটু পরে জিজ্ঞেস করলাম, 'কি ভাই কোন মেয়ে লেঙ্গি মারল আজ? ' মুখ কাঁচু মাচু করে উত্তর দিল, 'আমার ওই সাঁইবাবার মূর্তিটা পড়ে ভেঙে গেছে।....খুব মন খারাপ।'



এবার আমার থতমত খাবার পালা। কয়েক সেকেন্ড চুপ থেকে তাৎক্ষণিক মনখারাপ কাটিয়ে জিজ্ঞেস করলাম, 'একদম ভেঙে গেছে, টুকরো টুকরো?'

রাজেন্দ্র: না না।  শুধু ঘাড় থেকে মাথা-টা খুলে গেছে। 

আমি: তারপর?

রাজেন্দ্র: টেবিলে রেখে এসেছি।

আমি: ঠিক আছে. Araldite বা ফেভিকল দিয়ে আটকে দিলেই হবে।  

রাজেন্দ্র: না না।  সে আবার কি? তুই না কিছুই বুঝিস না।  নদীতে ভাসিয়ে দিতে হবে।  কাল দেব।  

আমি: এটা একটা কথা হল।  just আটকে দিলেই হবে, এত সুন্দর একটা মূর্তি, তোর ফেভারিট জিনিস। আটকে দে. 

আরো দুয়েকজন সহকর্মী নিয়ম নিষ্ঠাবান হয়ে রাজেন্দ্র'র idea 'ঠিক ঠিক' বলছে দেখে বহু বছর আগে পড়া, মা'র কাছে শোনা শ্রী রামকৃষ্ণের জীবনী থেকে 'ব্রহ্মাস্ত্র' বের করলাম।  বললাম, 

'দেখ, ~১৮৬০-৭০র দশকে দক্ষিণেশ্বরের মন্দিরে রাধাকৃষ্ণ মূর্তির একটি পা খুলে গেসল। মন্দিরের বাকি ব্রাহ্মণ ও মাতব্বররা বিধান দিয়েছিলেন যে এই মূর্তি গঙ্গায় বিসর্জন দিতে হবে।  ...'

রাজেন্দ্র: আমিও তাই তো বললাম। ...

আমি: কিন্তু শ্রী রামকৃষ্ণ যুক্তি দেন, 'রানী রাসমণির জামাই'র পা ভেঙে গেলে তাকে কি জলে ভাসিয়ে দেব বল? না তার fractured পা জোড়া লাগিয়ে দাও? ....যে মূর্তি এত বড় আপনজন তাকে ভাসাবে কেন ? আমায় দাও আমি পা আবার জোড়া লাগিয়ে দিচ্ছি'।  

সবাই থমকে গেছে দেখে আমি বলে চললাম, ' এমন ভালোবাসা-মাখানো অকাট্য যুক্তি কাটবে কে? তাই স্থির হয় মূর্তি থাকবে। আর শ্রী রামকৃষ্ণ সেই মূর্তি নিজে হাতে মেরামত করে দেন।  এ বিষয়ে তাঁর ছোটবেলা থেকেই উৎসাহ, ন্যাচারাল ট্যালেন্ট ছিল ; ভাল মূর্তি গড়তে পারতেন, আঁকতে পারতেন।  ....এ সরানো তাঁর কাছে টেকনিক্যালি ও সোজা।  ব্যাস,  কৃষ্ণ মূর্তি আবার পা ফিরে পেল, যতদূর জানি আজও তা ওখানে পূজিত।  '

গল্প শেষ করে আমি থামলাম। সবাই চুপ. মুখ দেখে বুঝতে পারছি পশ্চিম ভারতীয় মহিলা ও দক্ষিণ ভারতীয় ছেলে কারুরই কথাটা খুব একটা পছন্দ হয়নি, কিন্তু শ্রী রামকৃষ্ণের যুক্তিটা এত বেশি স্ট্রং যে কথা খুঁজে পাচ্ছে না। পাশে বসা উত্তর ভারতীয় ছেলেটি এমন বৈপ্লবিক গল্প'র core হজম করার চেষ্টা করছে।  মনে রাখতে হবে এরা  যে-সে ছেলেমেয়ে নয়।  দেশের শ্রেষ্ঠ পরীক্ষায় পাস্ করে সবচেয়ে নামকরা বিজ্ঞান কেন্দ্রের গবেষক।মগনলালের কথায়  ordinary nehi, extraordinary intelligence। দেশে বিদেশে নানা কনফারেন্সে এরা অনেককে টেক্কা দিয়ে আসে, কিন্তু আজ কথার খেই খুঁজে পাচ্ছে না। আমিও সেই কবে ডিগবাই'র লেখা উক্তিটি পড়েছিলাম During the last century the finest fruit of British intellectual eminence was, probably, to be found in Robert Browning and John Ruskin. Yet they are mere gropers in the dark compared with the uncultured and illiterate Ramakrishna of Bengal.  সেদিন এর সত্যতা উপলব্ধি করলাম বলতে পারেন। .....

রাজেন্দ্র সেদিন আর এ বিষয়ে বেশি কিছু বলেনি। আর আমিও নিশ্চিত ছিলাম যে যা ডোজ দিয়েছি ও মূর্তি ফেভিকল দিয়ে আটকে দেবে। দুদিন পরে - 

আমিঃ কি রে? মূর্তিটা লাগিয়েছিস?

রাজেন্দ্রঃ না না , পুজো করে বিসর্জন দিলাম তো গতকাল। 

আমি: সে কি???? কেন? 

রাজেন্দ্র: আমাদের বাড়ির পন্ডিত মশাই বললেন যে।  

আমি (সত্যিই বিরক্ত): আর সেদিন যে রামকৃষ্ণ দেবের ঘটনা তা বললাম সেটা তো কাটতে পারলি না? তার বেলা? আপন বলা মূর্তিকে কেউ ফেলে দেয় ? বাড়ির কেউ হলে ফেলে দিতিস?

রাজেন্দ্র: ....সেটা ঠিক। ...কিন্তু কিছু নিয়ম মানতেই হয়। এসব  ব্যাপারে। ....

অনেকদিন আগের ঘটনা। আজ মনে পড়ল।  সেদিন (এবং তারপরে যা পড়েছি, যা দেখেছি) তার থেকে   - 

উপলব্ধি- ১ : শ্রী  রামকৃষ্ণ'র logic কাটে কার সাধ্য? (সত্যি বলতে কি স্বামীজীর কথায় অল্পস্বল্প কিছু loose comment পাওয়া যায়। সেটা দোষ নয়, মহাপুরুষ হলেও কি সব বিষয়ে সর্বজ্ঞ না কি ? আর তাঁর অকাল মৃত্যু'র পরে ইতিহাস বিজ্ঞান কত এগিয়েছে। সব জিনিস তো তাঁর পক্ষে জানা সম্ভব ছিল না।  আর সে ঠিক আছে - সে তো তিনি বলেই গেছেন, যাচাই করে নিবি ) কিন্তু, শ্রী রামকৃষ্ণর জাগতিক বিষয়ে যা জ্ঞান ও উপলব্ধি তা just অকাট্য। 

উপলব্ধি-২: মহাপুরুষরা যাই বলুন, মানুষ সাধারনত আচার-বিচার নিয়েই থাকে। যুগাবতেরর বারণও শোনে না, কায়দা করে অগ্রাহ্য করে।    

--- ---

পুনশ্চ: 

 গত এক-দেড় বছর দেশে ও জগতে যা হয়েছে তা অনেকভাবে অনেক কিছু বেশ উপলব্ধি করিয়েছে। ইতিহাসের বই বা বিজ্ঞানের জার্নালে যা থাকে তাকে live n colour সামনে এনে দেখিয়ে দিয়েছে।    

 রাজেন্দ্র এখন বিলেতে। ফেসবুকে বা whatsapp এ অবশ্য প্রায়ই দেখা আড্ডা হয়।  

2 comments:

  1. Wonderful anecdote. The best part was the reaction of the erudite colleagues from different parts of the country. Diversity enriches science and philosophy for sure, as for the rest, not so sure. Loosing the essence of faith in rituals and dogmatism is faith lost.

    ReplyDelete

 স্কুল খুলুক, সঙ্গে হাওয়া বাতাস খেলুক ক্লাসঘরে ('এই সময়' সংবাদপত্রে প্রবন্ধ -  ২২শে সেপ্টেম্বর, ২০২১)      সোজাসাপ্টা অপ্রিয়   সত...