Tuesday, November 17, 2020

                                             করোনাকালে বায়ুদূষণ এক অশনিসঙ্কেত

১৬ই নভেম্বর 'বর্তমান' খবরের কাগজে এই লেখাটি প্রকাশিত হয়েছে। 



'আফ্রিকার রাজা, শশীবাবুর শিং , হাঙরের মুখ, এক থেকে দশ আর মগনলালের বজরা । '

বায়ুদূষণ, ফুসফুসের এসিই-২ প্রোটিন, রক্তচাপ ওঠা-নামা, করোনাভাইরাস আর হৃদযন্ত্রে ক্ষত।

ফেলুদা'র গোয়েন্দাগিরি আর বৈজ্ঞানিক গবেষণা'র মধ্যে মিল বেশি তবু কম নয়। তথ্য বিশ্লেষণ এবং প্রমান যোগাড় করে গোয়েন্দা ধরে ফেলেন অপরাধী কেমন করে অপরাধ করেছিল । জীবনবিজ্ঞানের সত্যান্বেষণ অনেকটা একই রকম, আর অতিমারি কালে 'অপরাধী' তো একজনই - করোনাভাইরাস। সে কেমন করে আমাদের শরীরে ঢুকে পড়ে সেটা গত ৯-১০ মাসে বেশ কিছুটা বোঝা গেছে। অবশ্য অনেক উত্তর এখনো অনেকাংশে অজানা - যেমন আমেরিকা, ইতালি ও চীনের যেসব অঞ্চলে বায়ুদূষণের মাত্রা বেশি সেই সব জায়গায় করোনা-আক্রান্ত হয়ে ইনটেনসিভ কেয়ারে ভর্তি ও মৃতের সংখ্যাও উল্লেখযোগ্য ভাবে বেশি । এটা কেন হচ্ছে? বায়ুদূষণে কি ভাইরাসের কোন দোসর লুকিয়ে আছে? আর করোনা তো ফুসফুসে সংক্রমণ করে; তাহলে মাঝেমধ্যেই আক্রান্তদের হৃদরোগ হচ্ছে কেন? করোনা সংক্রমণ সেরে গেল কিন্তু তার কয়েক দিন পরেই হার্টঅ্যাটাক হয়ে মৃত্যু এমন খবর তো আর ফেলনা নয়। আর অনেক করোনা রুগীর কিডনি বিকল হচ্ছে কেন? এ সবই কি কোন অজানা সুত্রে গাঁথা ?

জানা কথা দিয়েই শুরু করা যাক। এতদিনে আমরা জেনে গেছি যে গোলাকার করোনাভাইরাস থেকে যে পায়ার মত স্পাইক-প্রোটিন বেরিয়ে থাকে তা আমাদের ফুসফুস এবং শ্বাসনালী'র কোষের ঝিল্লীতে (মেমব্রেন) অবস্থিত এসিই-২ প্রোটিন'র সঙ্গে খাপে খাপ লেগে যায়।এসিই-২'র সাহায্যে ভাইরাস তারপর কোষের মধ্যে ঢুকে পড়ে এবং নিজের বংশবৃদ্ধি করতে থাকে। তারপর নতুন ভাইরাসরা চারপাশের কোষের এসিই-২ প্রোটিন'র সাহায্যে তাদের মধ্যেও ঢুকে পড়ে। অসুখ বেড়ে চলে। শুধু ফুসফুস, শ্বাসনালী, গলবিল এবং নাসিকা গহ্বরে নয়, হৃৎপিণ্ড, ধমনী-শিরা-রক্তজালক, কিডনি, ক্ষুদ্রান্ত্র বহু কোষকলায় প্রভুত পরিমানে এসিই-২ প্রোটিন আছে। তাই এই সব অঙ্গে করোনা সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়তে পারে।

কিন্তু, মনে রাখতে হবে যে ঘটনাচক্রে করোনাভাইরাস এসিই-২কে ব্যবহার করছে। শরীরে এসিইউ-২'র আসল কাজ তো ভাইরাসের 'দরজা' হওয়া নয়। তাহলে এসিই-২'র শারীরিক  কাজ কি? এর সঙ্গেই কি হার্ট, কিডনি, ফুসফুসের অসুখ জড়িয়ে আছে?

এসিই-২ হল অনেকগুলি প্রোটিন নিয়ে গঠিত একটি দলের সদস্য। শারীরবিদ্যা'র পরিভাষায় এর নাম রেনিন-আঞ্জিওটেনসিন-আলডোস্তেরন সিস্টেম। নাহ, এর নামের সঙ্গে আমরা অনেকেই পরিচিত নই। তবে মাথা থেকে পা শরীরের সর্বত্র এ কাজ করে চলে এবং বিকল হলে স্বাস্থ্য বিগড়বেই। কি করে এই সিস্টেম? রক্তের আঞ্জিওটেনসিনওজেন প্রোটিন থেকে আঞ্জিওটেনসিন-২ তৈরি করে। এই আঞ্জিওটেনসিন-২ শরীরের সব জায়গায় পৌঁছে প্রয়োজন মত রক্তচাপ বাড়িয়ে দেয় এবং ধমনী ও শিরার বাহসঙ্কোচন করে । তার ফলে শরীরে রক্তের পরিমাণ এবং জল ও সোডিয়াম-পটাসিয়ামের মাত্রা ঠিক থাকে; রক্ত সংবহন, কিডনি'র প্রস্রাব তৈরি, ফুসফুস ও হার্টের কাজ স্বাস্থ্যকর ভাবে চলতে থাকে। এছাড়া গত কয়েক বছরে জানা গেছে যে কোন জীবাণু বা বিষাক্ত কেমিক্যাল শরীরে ঢুকে পড়লে তার সঙ্গে  শরীরের রোগ-প্রতিরোধ ব্যবস্থার যে লড়াই লাগে তাতেও আঞ্জিওটেনসিন-২ কাজ করে। এই লড়াইয়ে কো্ষকলায় প্রদাহ বা ইনফ্লেমেশন হয়, বহিরাগত শত্রুকে ধ্বংস করতে রক্তের শ্বেত-কনিকারা ছুটে আসে। বিভিন্ন কোষকে নানারকম সিগন্যাল দেয় বলে আঞ্জিওটেনসিন-২ এই যুদ্ধের অন্যতম সেনাপতি।

অবশ্য, সব জিনিসের একটা মাত্রা আছে। ধরুন, শত্রুকে মারতে গিয়ে আপনি অতিউৎসাহী হয়ে এমন কামান দাগলেন যে আপনার নিজের বাড়িঘরও উড়ে গেল - সে তো হিতে বিপরীত! তাই আঞ্জিওটেনসিন-২'র কাজকর্মের ওপরেও শরীরকে নিয়ন্ত্রন রাখতে হয়। এবং আঞ্জিওটেনসিন-২কে নিয়ন্ত্রন করা হল এসিইউ-২'র আসল কাজ। ঠিক কি করে এসিই-২? আঞ্জিওটেনসিন-২ থেকে একটা ছোট্ট অংশ কুচ করে কেটে দেয়। তৈরি হয় আঞ্জ-১-৭। আশ্চর্য এই যে আঞ্জিওটেনসিন-২ থেকে তৈরি হলেও আঞ্জ-১-৭'র কাজকর্ম হল আঞ্জিওটেনসিন-২র বিপরীত।আঞ্জিওটেনসিন-২ রক্তচাপ, বাহসঙ্কোচন, প্রদাহ বাড়িয়ে দেয়, উল্টোদিকে আঞ্জ-১-৭ রক্তচাপ কমিয়ে দেয়, ধমনী-শিরার বাহপ্রসারণ করে, মাত্রাতিরিক্ত প্রদাহ কন্ট্রোল করে ফুসফুস, কিডনি ও হার্টের কোষকে সুরক্ষিত রাখে। তাই, আঞ্জিওটেনসিন-২ আর আঞ্জ-১-৭ দুজনের ব্যালান্স এই সবকিছুকে সুস্থ পরিধির মধ্যে রাখে। যদি কোন কারনে আঞ্জ-১-৭'র কাজ ঠিকঠাক না হয়, তখন আঞ্জিওটেনসিন-২ লাগামছাড়া হয়ে উঠতে পারে এবং শরীরকে প্রেসার, সুগার, কিডনির অসু্খের দিকে ঠেলে দেয়। অতিরিক্ত প্রদাহ থেকে হৃৎপিণ্ড, ফুসফুস ও কিডনির ক্ষতি হতে শুরু করে। এ যেন একের পর এক সেমসাইড গোল ! একাধিক মলিকিউলার বায়লজি'র গবেষণা ও রুগীদের পরীক্ষা করে এসব দেখা গেছে।

বায়ুদূষণের ব্যাপারে আসা যাক। বেশ কয়েক মাস আগে ইতালিতে যখন অতিমারি ভয়াবহ আকার নিয়েছিল তখন ওই দেশের পো উপত্যকা ও লম্বারডি অঞ্চলে সবচেয়ে বেশি রুগী মারা যান। লক্ষণীয় যে এই দুই অঞ্চলে বায়ুদূষণের মাত্রা সবচেয়ে বেশি। তখনই প্রথম সন্দেহ দানা বাঁধে যে দূষণ যেমন অন্য অনেক ফুসফুসের রোগ বাড়িয়ে দেয়, করোনা অতিমারি'র ক্ষেত্রেও তাই হচ্ছে। এর পরে একই ধরনের রিপোর্ট আসে চীন থেকে; এবং গত সপ্তাহে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে বিভিন্ন রাজ্যে নানারকম হিসেব করে দেখা গেছে যেখানেই বায়ুদূষণের মাত্রা বেশি, সেখানেই করোনা তত ভয়ানক, তত বেশি করোনা আক্রান্ত মারা যাচ্ছেন। দূষিত বাতাসে যদি পার্টিকুলেট ম্যাটার ২.৫ (PM 2.5) অতি অল্প পরিমানেও বেড়ে যায় তাহলে করোনায় মৃত্যুহার ৮ থেকে ১১% বেড়ে যায়! অর্থাৎ, এমনিতে করোনা বেশিরভাগ লোকেরই সেরে যায়, কিন্তু বায়ুদূষণ বেড়ে গেলে যাঁদের হার্ট, ফুসফুস, কিডনি, সুগার, প্রেসারের অসুখ আছে তাঁদের জন্যে এই অতিমারির গ্রাস অনেক বেশি বিপজ্জনক হয়ে ওঠে ।

কেন এমন হয়? উত্তর নিয়ে বিজ্ঞানীমহল নিঃসন্দেহ নন, তবে বড় সন্দেহ পড়েছে আমাদের পূর্বপরিচিত আঞ্জিওটেনসিন-২, আঞ্জ-১-৭ আর এসিই-২ প্রোটিন দলের ওপরে। দেখা গেছে যে দূষিত বাতাসে যে PM 2.5, PM 1 ও নাইট্রোজেন অক্সাইড আছে তার প্রভাবে ফুসফুস, শ্বাসনালী, নাসিকা গহ্বর ইত্যাদির কোষে এসিইউ-২'র মাত্রা বেড়ে যায়।এসিইউ-২'র পরিমাণ বৃদ্ধি পেয়েছে এ অবশ্য একদম নতুন কিছু নয় - ফুসফুসে যাঁদের COPD অসুখ আছে এবং যারা সিগারেট খান তাঁদেরও অনেকের কোষে বেশি এসিইউ-২ দেখা গেছে। যাঁদের হার্টের সমস্যা আছে, তাঁদের হৃৎপিণ্ডের কোষে বেশি এসিইউ-২ থাকে।

এসিই-২ বাড়িয়ে শরীরের কি লাভ? সম্ভবত, PM 2.5, নাইট্রোজেন অক্সাইড ইত্যাদি দূষণকারী কেমিকালের বিরুদ্ধে লড়তে গিয়ে ফুসফুস ও শ্বাসনালীতে প্রদাহ (ইনফ্লেমেশন) হয় এবং তাতে আঞ্জিওটেনসিন-২'র বড় ভূমিকা আছে। এবং আঞ্জিওটেনসিন-২'র ওপর নজর রাখতে দরকার হয় আঞ্জ-১-৭, আর আঞ্জ-১-৭ তৈরি করতে লাগে এসিইউ-২। তাই, দূষণের সময় (বা সিগারেট খেলে)এসিইউ-২'র মাত্রা বাড়িয়ে দিতে হয়। সোজা কথায়, 'সাপও মরবে লাঠিও ভাঙবে না' । অনেকটা একই জিনিস হয় যাঁদের হার্ট ও প্রেসারের সমস্যা আছে তাঁদের ক্ষেত্রে - আঞ্জিওটেনসিন-২ যাতে ক্ষতি করতে না পারে সম্ভবত তাই এঁদের হৃৎপিণ্ডের কোষে বেশি এসিই-২ তৈরি হয়।

এ সবই মোটামুটি ভাল চলছিল, কিন্তু এ বছর যে দূষণের দোসর হয়ে এসেছে করোনাভাইরাস। সে যে এসিই-২কে দরজা হিসেবে ব্যবহার করে। তার মানে কি যে সব শরীরে বেশি এসিইউ-২ আছে, সেখানে করোনাভাইরাস আরও সহজে ঢুকে যায়? প্রথমে শ্বাসনালী-ফুসফুস এবং তার পাশেই আছে হার্ট, আর তারপর রক্ত ধরে কিডনি, ক্ষুদ্রান্ত্র সব জায়গায়। বিজ্ঞানীকুল এখনো অকাট্য প্রমান পাননি তবে বেশ কিছু গবেষণার ইঙ্গিত সে দিকেই। শুধু তাই না, দেখা গেছে করোনাভাইরাস ঢুকে যাবার কিছু পর থেকে এসিইউ-২'র মাত্রা কমতে আরম্ভ করে। জটায়ু'র কথায় এ হল 'সুপার কেলেঙ্কারি'।এসিইউ-২ কমে যাওয়া মানেই তো আঞ্জিওটেনসিন-২ লাগামছাড়া হয়ে ওঠা - প্রেসার, হৃৎপিণ্ডের ওপর বেশি চাপ, বাহসঙ্কোচন, প্রদাহ সব বেড়ে যাওয়া। মানে প্রথমে এসিই-২ বেড়ে থাকায় বিপদ, তারপর এসিইউ-২ কমে যাওয়ায় ডবল বিপদ। যাঁদের শরীর এমনিতেই নানা অসুখের ধাক্কায় দুর্বল, ভাইরাল ইনফেকশন কাটিয়ে উঠলেও তাঁদের অনেকেরই হার্ট-ফুসফুস-কিডনি এই জোড়া ধাক্কা সামলাতে পারে না।

শীতকালে এমনিতেই বাতাসে দূষণের মাত্রা ঊর্ধ্বমুখী বলে রোগের প্রাদুর্ভাব বেড়ে যায়। তার সঙ্গে আসে দীপাবলির বাজি। দিল্লী, লকনউ, জামশেদপুর, শালকিয়া ও হরিয়ানার হিসারে  একাধিক গবেষণায় দেখা গেছে যে দীপাবলি'র সন্ধ্যে থেকে যত বাজি ফাটতে আরম্ভ করে তত PM 2.5, নাইট্রোজেন অক্সাইড বৃদ্ধি পায়; হুহু করে বেড়ে চলে বাতাসে ওজোন, সিশা, দস্তা, মাঙ্গানিজ'র মাত্রা। বাতাসে PM 2.5 ৮ থেকে ১৩ গুন বেড়ে ওঠে এবং হাওয়া না বইলে বাড়ি ঘরের ওপরে সেই বিষ একদিনের বেশি থেকে যায়। করোনাকালে দূষণ বাড়িয়ে নিজেদের বিপদ ডেকে আনব না তো আমরা?  


(আমি যে লেখাটি submit করেছিলাম আর যেটি প্রকাশিত হয়েছে তার মধ্যে ছোট্ট কয়েকটি তফাৎ আছে. ওই দু-একটি শব্দ এডিটিং।  আমি আমার versionটাই upload করলাম।  ...একটা typo error ছাপা হয়ে গেছে। এসিইউ-২ নয়,   এসিই-২ হবে. আমারই ভুল হয়েছিল).

 স্কুল খুলুক, সঙ্গে হাওয়া বাতাস খেলুক ক্লাসঘরে ('এই সময়' সংবাদপত্রে প্রবন্ধ -  ২২শে সেপ্টেম্বর, ২০২১)      সোজাসাপ্টা অপ্রিয়   সত...