Monday, August 24, 2020



পশ্চিমবঙ্গের করোনা পরিস্থিতি : জুলাই - অগস্টে কি দাঁড়াল? 

ভারত ও পশ্চিমবঙ্গের করোনা সমাচার নিয়ে কোন update সেই জুন মাসের পরে লিখিনি। দু-তিন দিন আগে একজন বন্ধু জিজ্ঞেসও করল সে বিষয়ে।  না লেখার তিনটে কারন - ১. একটু সময়ের অভাব। ২. করোনা বিজ্ঞান নিয়ে, বিশেষত ভ্যাকসিন নিয়ে, অনেক লিখেছি এই সময়ে । ৩. দুমদাম ব্রেকিং নিউজ করে যা-ইচ্ছে-তাই লিখতে যে পারি না সেটা পাঠকরা এতদিনে বুঝে গেছেন।  তাই, এই নতুন জীবাণুসৃষ্ট-অতিমারী কি ভাবে এগোচ্ছে, কি বৈজ্ঞানিক তথ্য হাতে আসছে সেগুলো না পড়ে না বুঝে তো আপনাদের কাছে present করা যায় না, তাই না?

তবে এই  যে কয়েক মিনিট বকবক করলাম তাতে বুঝতেই পারছেন সেই সাবজেক্ট নিয়ে এখন আবার লিখছি। ২৪শে মার্চের পরে ২১ দিন নয়,  প্রায় ৫ মাস কেটে গেছে -   দেশ ও রাজ্যের কি অবস্থা দেখা যাক।

১. প্রথমেই 'চাক দে'।  আজ যখন এটা লিখছি নজরে এল ভারতে টোটাল আক্রান্ত তিরিশ লক্ষ ছাড়িয়ে গেল। তলার  ছবিটা দেখুন। প্রথম দশ লক্ষ আক্রান্ত হতে লেগেছিল ১৬৮ দিন।  সাড়ে পাঁচ মাস।  ১০ থেকে ২০ লক্ষ হতে মাত্র ২১ দিন, আর ২০ থেকে ৩০ লক্ষ হতে ১৬ দিন। কি বুঝছেন?
ছবি ১: ভারতে করোনা আক্রান্তের সংখ্যার বৃদ্ধি'র হার খুবই চিন্তার কারণ । 
সবচেয়ে বড় কথা এই যে সব দেশ - এমনকি আমেরিকা আর ব্রাজিলকে - টপকে নতুন করোনা আক্রান্তের সংখ্যায় ভারত এখন সবার ওপরে ! টোটাল আক্রান্তের সংখ্যায় ওরা অবশ্য এখনো এগিয়ে তবে যে ভাবে আমরা লাফিয়ে লাফিয়ে এগোচ্ছি ধরে ফেলব। কবির কথা টেনে এনে  'ভারত আবার জগৎ সভায়...'
ছবি ২: করোনা আক্রান্ত'র তালিকায় সবচেয়ে ওপরে যে তিনটি দেশ।  ২০শে অগস্ট অবধি প্রতি সপ্তাহে নতুন কেসের খতিয়ান।
 ভারতের অবস্থা উদ্বেগজনক। Our world in data site থেকে নেওয়া 
২. খেলার ছলে বলছি, কিন্তু এ যে কত বড়  চিন্তার  কারণ  সে বিষয়ে কোন সন্দেহ আছে কি? এবং আরো বেশি দুশ্চিন্তা এই কারণে যে পরীক্ষা বাড়লেও জনসংখ্যার নিরিখে পরীক্ষায় ভারত এখনো অনেক পিছিয়ে। সুতরাং যথেষ্ঠ টেস্ট হলে যে সংখ্যা কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে....!!?? অবশ্য,  প্ল্যান করে না  করলে কোন বিজ্ঞান যে কাজ করে না এটা বিজ্ঞানের ছাত্র মাত্রই জানেন, এবং তাই মার্চ মাসের হঠাৎ-লকডাউন যে রোগের বাড়বাড়ন্ত ঠেকাতে ব্যর্থ হয়েছে তাতে দুঃখ পেলেও, অবাক হবার বেশি কিছু নেই।

৩. অনেকেই হয়ত বলবেন - আরে আমাদের জনসংখ্যা অনেক বেশি। সেই তুলনায় কিছুই হয়নি । কিন্তু, এটা যে কোন সান্তনা নয়, সেটা চূড়ান্ত অজ্ঞ ছাড়া সবাই বুঝি। হ্যাঁ, এ কথা ঠিক যে   covid হলেও প্রায় ৮৫% লোকের এমনিতেই সেরে যায়, এবং বাকি ১২-১৫% হাসপাতালে ভর্তি হলেও তাদের মধ্যে ~ ২% ছাড়া সবাই সুস্থ হয়ে ওঠেন। ঠিক।  কিন্তু, যে  জীবাণু এত ছোয়াঁচে সেই রোগের ২-৩% ও একটা বিশাল সংখ্যা এবং তার  মানে হাজার হাজার হাসপাতাল বেড আর আইসিইউ লাগবে।  এবং আমাদের মত দেশের দীর্ঘ দিন ধরে অবহেলিত চিকিৎসা ব্যবস্থা  যে এর সঙ্গে লড়াই করতে পারবে না সে কথা সবাই বুঝি। তাছাড়া জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারি-মার্চ অন্তত দু মাসের প্রস্তুতি-পর্ব আমরা প্রায় পুরোই অবহেলা করেছি ; আজ সেই সময় তো আর ফিরবে না, তাই না?

৪. এটা শুধু কথার কথা নয়। করোনায়  আক্রান্ত কতজন মারা গেছেন এই নিয়ে আমাদের বড়াই করার কিছু নেই।  কারণ  ইতালি বা আমেরিকার থেকে সেই সংখ্যা % কম হলেও, এই গ্রাফ দেখুন -  প্রতিবেশী দেশরা অনেকেই কিন্তু আমাদের থেকে বেশি রুগীকে সুস্থ করে তুলেছেন।  ১০০০ জন আক্রান্ত হলে ১৯ ভারতীয় মারা যাচ্ছেন, এবং সমসংখ্যক আক্রান্ত হলে প্রাণ হারাচ্ছেন ১৩ জন বাংলদেশী ও ৪ জন নেপালি।আর  পাকিস্তান আর আফগানিস্তান আমাদের থেকে বেশি এটা নিশ্চয়ই গর্ব করার মত কিছু না।
ছবি ৩: ভারত ও প্রতিবেশী দেশে করোনা আক্রান্তদের মধ্যে কত শতাংশ মারা গেছেন।পরিসংখ্যানবিদ রিজো জনের টুইট থেকে নেওয়া।  
  ৫. সারা দেশেই কি এই অবস্থা? এই প্রশ্ন ওঠা স্বাভাবিক। তলার ছবি ও গ্রাফ এ বিষয়ে বেশ কিছুটা আলোকপাত করছে।দেশের বিভিন্ন অংশে আজ অবধি করোনা'র প্রাদুর্ভাব কেমন সেটা এই ছবিটা দেখাচ্ছে।
ছবি ৪: ভারতের বিভিন্ন অংশে করোনা'র প্রাদুর্ভাব। 


মহারাষ্ট্র, কর্ণাটক, তামিল নাড়ু, অন্ধ্র, তেলেঙ্গানা যে অবস্থা অত্যন্ত চিন্তাজনক তা দেখাই  যাচ্ছে। এছাড়া দিল্লি, উত্তর প্রদেশ ও বিহারের বিস্তীর্ন অঞ্চল, দক্ষিণ বঙ্গ এবং গুয়াহাটির চারপাশ যথেষ্ট সংখ্যায় রোগ ছড়িয়ে পড়েছে।

(covid19india.org,  যাঁরা এই অতিমারীতে অসাধারণ জন সংযোগের কাজ করেছেন, তাঁদের ওয়েবসাইট থেকে এই ছবিটা নেওয়া)  .










৬. পরের ছবি নেওয়া হয়েছে পরিসংখ্যানবিদ রিজো জনের টুইট থেকে। ওঁর উপস্থাপনা আমার খুব ভাল লাগে, এবং তাই ছবিগুলো ব্যবহারের অনুমতি চেয়ে নিয়েছি।
ছবি ৫: বিভিন্ন  রাজ্যে দৈনিক পসিটিভ (২১শে অগস্ট) আর সাপ্তাহিক বৃদ্ধি% . পশ্চিমবঙ্গের স্থান তীরচিহ্ন দিয়ে দেখানো আছে।  
বাঁদিকে দেখা যাচ্ছে যে কনফার্মড পসিটিভ কেসে  মহারাষ্ট্র, অন্ধ্র, কর্ণাটক, তামিলনাড়ু, উত্তর প্রদেশ, পশ্চিমবঙ্গ, ওড়িষ্যা এবং বিহার এগিয়ে। এর মধ্যে মহারাষ্ট্রে একাই ২০% কেস! কর্নাটকে  প্রায় ১১% ! 

কিন্তু ডানদিকে যেটা দেখা যাচ্ছে সেটা নিয়ে উদ্বেগ বেশি তবু কম নয়।  এক সপ্তাহে  করোনার প্রাদুর্ভাব ক' শতাংশ বাড়ল তার হিসেবে দিচ্ছে।এবার লক্ষ্য করুন -  ছত্তীসগঢ়, পাঞ্জাব, মেঘালয় , চন্ডিগড়, পন্ডিচেরী, কেরল, ওড়িশায় এবং ঝাড়খণ্ডে বেশ জোরে ছড়িয়ে পড়ছে করোনা।তার মানে মাত্র এক-দেড় মাস আগে যেসব রাজ্যে আক্রান্তের সংখ্যা কম ছিল তারাও এবার আর তাল সামলাতে পারছেন না। বাংলার মানুষ এই চার্ট দেখে একটু আশ্বস্ত হতে পারেন যে  সেই তুলনায় পশ্চিমবঙ্গ একটু বেটার অবস্থায় আছে, যদিও সেটা নিয়ে সন্তুষ্ঠ হবার তেমন কিছু নেই। কেন সেটা পরে বলছি।  

. তবে আরো তথ্য দেবার আগে একটা জিনিস জানাই। আমেরিকার বিখ্যাত স্ট্যানফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের একদল গবেষক (তাঁদের মধ্যে কয়েকজন ভারতীয় আছেন) সম্প্রতি সমীক্ষা চালিয়েছেন যে ভারতের বিভিন্ন রাজ্য থেকে করোনা-সংক্রান্ত রিপোর্ট কেমন করা হচ্ছে - বিশদ তথ্য দেওয়া হচ্ছে না অনেক ফাঁক-ফোকর থাকছে, ভালো ভাবে দেওয়া হচ্ছে নাকি দায়সারা ভাবে কাজ সারা হচ্ছে। তাঁদের গবেষণা পরিষ্কার দেখিয়েছে যে কিছু রাজ্য যেমন যথেষ্ট দক্ষতার ও স্বচ্ছতার সঙ্গে এই কাজ করছেন , তেমনি আরো অনেকের কাজ মোটেই সন্তোষজনক নয়।  তলায় গ্রাফ সেই গবেষণাপত্র থেকে নেওয়া। 
ছবি ৬:  ভারতীয় রাজ্যদের covid সংক্রান্ত তথ্য উপস্থাপনার ওপরে স্ট্যানফোর্ড উনিভার্সিটির গবেষকদের তৈরী 'মার্কশীট' 
দেখতেই পারছেন কর্ণাটক, কেরল, ওড়িশা বেশ 'ভাল মার্ক্স' পেয়েছে। কারন তাঁদের দৈনিক বুলেটিন এবং dashboardএ প্রচুর তথ্য দেন। পশ্চিমবঙ্গ আর মহারাষ্ট্র মোটামুটি (কারন, পশ্চিমবঙ্গ গত দু-তিন মাসে দৈনিক বুলেটিন অনেক উন্নত করলেও এখনো কোন জেলায় কটা টেস্ট হল, আক্রান্তদের মধ্যে জেলাভিত্তিক নারী-পুরুষ, বয়েসের হিসেবে, ইত্যাদি বুলেটিনে দেয় না; দেওয়া উচিত)। অবশ্য  অন্য রাজ্যেরা আরো তলার দিকে - আর খুব খারাপ 'মার্ক্স' পেয়েছে উত্তর প্রদেশ আর বিহার! স্ট্যানফোর্ড গবেষকরা আফসোস  করেছেন যে কিছু রাজ্য অফিসিয়াল বুলেটিন না করে টুইটারে কিছু সংখ্যা দিয়ে দেন !! ঠিকঠাক পরিসংখ্যানের পক্ষে, চিকিৎসা ব্যবস্থার পক্ষে সেটা মোটেই ভাল নয়। 

৮.   এর সঙ্গে আরেকটা 'সমস্যা' হয়েছে।  এতদিনে আমরা সবাই জানি যে টেস্ট মূলত হয় দু রকমের - RT-PCR আর rapid antigen test. করোনা লড়াইয়ে দুটোই প্রয়োজনীয় , কিন্তু RT-PCR হল সত্যিকারের মাপকাঠি। যাকে বলে gold standard. ঠিকঠাক করে করলে এতে >৯০% সঠিক উত্তর আসবে।  এন্টিজেন টেস্ট ও ভাল, দ্রুত করা যায়, বিশেষ ল্যাব লাগে না, কিন্তু এতে যেমন কেউ আক্রান্ত কি না বোঝা যায় (true positive) তেমনি অনেক সময় আক্রান্ত হলেও ধরা পড়ে না (false negative)। তার মানে এই নয় এন্টিজেন টেস্ট করা উচিত না।  তাই দেশ বা কোন  রাজ্য যদি এন্টিজেন টেস্ট'র ওপরে  বেশি নির্ভরশীল হয়ে পড়ে তখনই মুশকিল হতে পারে - কারন তখন অনেক পসিটিভ ধরা না পড়তে পারে। মুশকিল হচ্ছে, নানা কারণে বেশ কিছু রাজ্য এখন খুব বেশি এন্টিজেন টেস্টিং করছেন এবং  RT-PCR test সেই অনুপাতে অরে বাড়ছে না।  যেমন ওড়িশার নাকি এখন ৯০% পরীক্ষা হল এন্টিজেন টেস্ট ! কয়েকদিন আগে দিল্লীর হিসেবে বলছিল ৭০-৭২% টেস্ট এন্টিজেন টেস্ট। বিহার এবং উত্তর প্রদেশও বেশি এন্টিজেন টেস্ট করছে বলে খবর।  

৮. পশ্চিমবঙ্গ ? দৈনিক বুলেটিন অনুযায়ী এ রাজ্যে এন্টিজেন টেস্ট শুরু হয়েছে ২৮শে জুলাই থেকে। এই টেবিলে আছে অগস্টের হিসেব।  দেখুন। 
টেবিল ১ : প্রতি দুদি ন অন্তর পশ্চিমবঙ্গে RT-PCR আর Antigen (Ag) testর হিসেব। অগস্ট মাসে এন্টিজেন টেস্ট হচ্ছে ~৩৮%   
তার মানে দাঁড়াল - এক, পশ্চিমবঙ্গও এন্টিজেন টেস্ট বাড়িয়েছে কিন্তু অতটা না।  ৩৭-৪০% রেঞ্জে চলছে।  কেরল ও তাই।  আর এর পাশাপাশি RT-PCR  টেস্ট ও বেড়েছে।  নতুন ল্যাবও join করেছে। অনেক জেলায় এখন ল্যাব চালু হয়েছে।  খেয়াল রাখতেই হবে এই রাজ্য যেন এন্টিজেন টেস্ট ওপর বেশি নির্ভর না করতে শুরু করে; কারণ  তাতে কিছুদিন রেসাল্ট 'ভাল দেখালেও' পরে বিপদ বাড়বে বই কমবে না !  এবং গতকালই পড়লাম যে কলকাতায় যত পরীক্ষা করা উচিত তত হচ্ছে না।  কেন হচ্ছে না, কি হচ্ছে সেই নিয়ে পুরসভা, স্বাস্থ দপ্তর, নবান্ন সবার মধ্যে কথাবার্তা চললেও মোদ্দা কথা আরো RT-PCR পরীক্ষা বাড়াতে হবে। এর মধ্যে আবার গত সপ্তাহে খবর ছিল যে NICEDএ যে নতুন COBAS-8000 মেশিন বসানো হল (প্রধানমন্ত্রী ডিজিটাল উদ্বোধন করলেন) সে গোড়াতেই কাজ করছে না!? অবশ্য, অভিজ্ঞতা থেকে জানি নতুন যন্ত্র এলেই এরকম কিছু না কিছু গন্ডগোল কিছুদিন লেগে থাকে, কিন্তু এই 'যুদ্ধকালীন' পরিস্থিতিতে সেটা যাতে দ্রুত solve হয় সেটাই বাঞ্চনীয়।  

৯. মুশকিল হয়েছে এই দুটো কারনে বিভিন্ন রাজ্যের মধ্যে তুলনামূলক analysis করা বেশ অসুবিধেজনক হয়ে উঠেছে। সবাই তো একভাবে (অথবা মোটামুটি একভাবে) তথ্য দিচ্ছে না, টেস্টও  করছে না।  তাহলে পাশাপাশি ফেলে ডিটেলে বুঝবেন কি করে? আর এটা 'আমরা ওরা' করার জন্যে  না।  ভাইরাসের গতিপ্রকৃতি বুঝতে এ খুবই  প্রয়োজনীয়।

১০. রাজ্য থেকে জেলায় আসি। এই দেখুন। ভারতের যে ৫০টি জেলায় করোনার প্রকোপ সবচেয়ে বেশি তাদের সংখ্যার ওঠা-নামা। বড় শহর ছাড়িয়ে জেলা, গ্রামগঞ্জে covid যে ছড়িয়ে পড়েছে সে বিষয়ে কোন সন্দেহ নেই। পুনে, মুম্বাই, চেন্নাই, ব্যাঙ্গালোর, লক্ষনৌ , নাগপুর, আমেদাবাদ সব জায়গায় বাড়বাড়ন্ত। দিল্লীতে আক্রান্তের সংখ্যা গত সপ্তাহ দুই তিন কম ছিল (যদিও অত বেশি এন্টিজেন টেস্ট থেকে ঠিক হিসেবে পাওয়া যায় কিনা সেই নিয়ে একদল বিশেষজ্ঞ সন্দেহ প্রকাশ করেছেন), কিন্তু, আবার সংখ্যা বাড়ছে। 
ছবি ৭ (ওপরে এবং নীচে ): ভারতের যে ৫০টি রাজ্যে করোনা আক্রান্তের সংখ্যা সবচেয়ে বেশি। রিজো জনের টুইট থেকে নেওয়া।

১১. প্রথম পঞ্চাশের মধ্যে রয়েছে পশ্চিমবঙ্গের তিন জেলা - কলকাতা, উত্তর ২৪ পরগনা আর হাওড়া। তাহলে সেই সূত্র ধরে আমরা এই রাজ্যের জেলাগুলির অবস্থা দেখি। প্রথমেই একটি টেবিল -  রাজ্যের মোট  পজিটিভের কোন জেলায় কত শতাংশ আছেন ? তিনটে সময়সীমা নেওয়া হয়েছে - ১৮ই জুলাই অবধি,  ৩রা অগস্ট অবধি আর ২২শে অগস্ট (গতকাল) অবধি। তাহলে এও দেখা যাবে যে কোন জেলায় আক্রান্তের আপেক্ষিক সংখ্যা বেড়েছে বা কমেছে বা একই রকম আছে।
টেবিল ২: রাজ্যের ২৩টি জেলায় মোট আক্রান্তের %. 


ছবি ৮: পশ্চিমবঙ্গের করোনা আক্রান্ত মূল অঞ্চল 
১২. প্রথমেই যেটা নজরে আসে যে কলকাতা এবং কলকাতা ঘিরে যে ৪টি জেলা করোনা এখনো মূলত এখানেই সীমাবদ্ধ। হ্যাঁ, এখনো। ২২শে অগস্টের হিসেবে বলছে যে কলকাতা, দুই ২৪ পরগনা, হাওড়া, পূর্ব মেদিনীপুর আর হুগলি থেকেই আছেন টোটাল আক্রান্তের ৭২% । এর মধ্যে কলকাতা + হাওড়া +  উত্তর ২৪ পরগনা মিলিয়েই হয় ৫৬% রুগী !! তার মানে আজ ছ'মাস পরেও এই অসুখ মূলত (মূলত) দক্ষিণবঙ্গের কয়েকটি জেলায় সীমাবদ্ধ। তার মানে আজও যদি এই অঞ্চলের প্রসাশন এবং সব নাগরিক  বিজ্ঞান-সচেতন হয়ে, লোভী না হয়ে, একজোট হয়ে লড়াই করেন এই রাজ্য covidকে অনেকাংশে পরাস্ত করবে। কথার কথা নয়, পরিসংখ্যান তাই বলছে।  

১৩.আর এই ট্রেন্ড তো দেশের অন্য জায়গার সাথে মিলছে - দিল্লী, মুম্বাই, চেন্নাই, ব্যাঙ্গালোর সবই তো রোগের epicentres [  হায় হায় ! ফেব্রুয়ারির শেষে ১৫টা এয়ারপোর্ট বন্ধ করে দিলে এই বিপদ আজ আসে না !!] 

১৪. কিন্তু, খুব দ্রুত এই কাজ করতে হবে। কারণ অন্য ২০টি জেলায় আক্রান্তের সংখ্যা slow but steadily বাড়ছে। তলার টেবিল দেখুন। জেলায় জেলায়  গত ১০দিনে করোনা আক্রান্ত কত % বেড়েছে।  দেখা যাচ্ছ - দুই মেদিনীপুর, পশ্চিম বর্ধমান, বাঁকুড়া, মুর্শিদাবাদ, দক্ষিণ দিনাজপুর আর আলিপুরদুয়ার  বৃদ্ধির হার রাজ্যের গড় বৃদ্ধির তুলনায় যথেষ্ট বেশি। নদীয়া আর জলপাইগুড়ি বাড়লেও কম;  দক্ষিণ ২৪ পরগনায়, দার্জিলিং, মালদা , হুগলিতে  বৃদ্ধির হার কম হলেও যেহেতু তাদের টোটাল আক্রান্তের সংখ্যা ওপরের দিকে সেটা চিন্তার বিষয় এবং contact tracingর উন্নতি দরকার। বীরভূম, ঝাড়গ্রাম, পুরুলিয়া আর কালিমপং সংখ্যা এখনো কম - সেটা ভাল।   আর  উত্তর ২৪ পরগনা আর কলকাতা যে এখনো চিন্তার বড় কারন সে  আমাদের সবারই জানা। দুই টেবিল দেখে  মনে হচ্ছে  কলকাতা ও উত্তর ২৪ পরগনা উন্নতির পথে।  হতে পারে, তবে এই দুই জেলা যেহেতু খুবই ঘন বসতিপূর্ণ, লোকডাউন আর নেই এবং টেস্ট  এবং contact tracing বাড়লেও আরো অনেক বাড়াতে হবে,  তাই %র হ্রাস সত্যিই উন্নতি না টেস্টের লিমিটেশন সেটা অন্তত আমি ঠিক বুঝতে পারছি না, এবং জেলাভিত্তিক কত টেস্ট আর তার মধ্যে কত পসিটিভ না জানলে সেটা বলা যাবেও না।উন্নতি সম্ভবত হয়েছে না হলে ছবি ৭ ও টেবিল ২ আর ৩এ তা  ধরা   পড়ত কিন্তু 'গা ছাড়া' দেবার ভাব যেন একদম না আসে।  লক্ষ্য করুন দিল্লী কিরকম আবার বাড়ছে !  
 টেবিল ৩: গত দশ দিনে বিভিন্ন জেলায় covid আক্রান্তের বৃদ্ধির হার। 

১৫. ভাল খবর কি কিছু নেই? আছে,  হাওড়া জেলা নিজেদের কিছুটা রক্ষা করেছেন।অন্তত সাময়িক ভাবে আক্রান্তের % কমছে, এবং খবরের কাগজের রিপোর্ট ও তাই বলছে। আরো  আছে। ৭৭% রুগী সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরছেন এ যে কি আনন্দ ও স্বস্থির কারন সেটা কি লিখে বোঝাতে হবে ? আর এপ্রিল-মে মাসে যে মৃত্যুহার অস্বাভাবিক রকম বেশি ছিল ( তখনই বলেছিলাম ওটা কম টেস্ট করার জন্যে error হচ্ছে) সেই মৃত্যুহার আজ জাতীয় গড়ের মাথায় মাথায় (তলায় গ্রাফ দেখুন)। অবশ্য যে দেশের ৩০%র কম মৃত্যুর ঠিকঠাক কারণ জানা যায়, সার্টিফিকেট পাওয়া যায় সেই দেশে অতিমারীর সময় কি হয় তা নিয়ে কিছু বিশেষজ্ঞ সন্দেহ করেছেন। তবে এ কথা অনস্বীকার্য যে এত শত প্রতিকূলতার মধ্যে রাজ্যের চিকিৎসক, নার্স ও কর্মীরা আপ্রাণ চেষ্টা করে চলেছেন এবং তাঁদের  কাছে আমরা সবাই ঋণী। 
১৬. আচ্ছা, অন্য জেলায় রোগ ছড়িয়ে পড়ছে কেন? এর কিছু উত্তর আমরা সবাই জানি - ভারত প্রস্তুত ছিল না (না হলে WHO অতিমারী ঘোষণা করার দুদিন পরে  কেন্দ্রীয় স্বাস্থ মন্ত্রক কখনো বলে যে চিন্তার কারন নেই????  ) , আমাদের বিধিনিষেধ অত জোরালো নয়, সামাজিক অর্থনৈতিক সাপোর্ট নেই,  আর বহু লোকজন এখনো হিরোগিরি মেরে থুতনির তলায় মাস্ক পরেন, ইত্যাদি। তবে সেসব ছাড়াও বড় কারণ আছে।  সেটা দেখা যাক।  

১৭. এই দেখুন তলার গ্রাফে পশ্চিমবঙ্গের জেলা - মে মাস থেকে আজ অবধি।প্রথমে বাঁদিকটা দেখুন। মে মাসের শেষ অবধি সব পজিটিভের ৮৪% ছিল মাত্র ওই তিন হটস্পট জেলা থেকে। বাকি ২০ জেলা মিলিয়ে ছিল ১৬-১৭% ! ভাবতে পারেন!! সেই থেকে আজ অগস্টের শেষে এসে ওই ২০টা জেলা - যদিও এক একটি ২-৩%র বেশি হবে না - থেকে আসছেন ৪০%র বেশি করোনা আক্রান্ত। 
ছবি ৯: মে মাস থেকে অগস্ট অবধি পশ্চিমবঙ্গের জেলায় করোনা পরিস্থিতি।  
১৮. এরকম হল কেন ? মনে করে দেখুন মে'র শেষ আর জুনের গোড়ার দিকে দেশ জুড়ে কি হয়েছিল। রোজগার, থাকার জায়গা সব হারিয়ে লক্ষ লক্ষ ক্লান্ত-শ্রান্ত শ্রমিকের ভিড় ট্রেন করে, বা কয়েকশো কিলোমিটার হেঁটে হেঁটে বাড়ি ফেরাদেশভাগের পরে এমন যন্ত্রনা এতজন ভারতবাসী সহ্য করেছেন কি না জানা নেই, তবে  বিজ্ঞানী মহল তখনই সতর্ক করেছিলেন যে করোনা এবার দূরদূরান্তে, শহর আর সদর থেকে আরো গভীরে গ্রামেগঞ্জে ছড়িয়ে পড়বে। তাছাড়া, ভুললে চলবে না , এই রাজ্যের ক্ষেত্রে আরেকটি ভয়ঙ্কর জিনিস এসেছিল - সাইক্লোন আম্ফান।  এই গ্রাফ সেই কথাই বলছে।  

১৯. অবশ্য এটাও ঠিক যে এখন অনেক জেলায় টেস্ট বেড়ে যাবার জন্যে ওখানকার রিপোর্ট বেশি আসছে (১০ই মে ছিল ১৮টি ল্যাব, আজ ২৩শে অগস্ট ৭০টি ল্যাব কাজ করছে ) . কিন্তু,  তা দিয়ে এই ১৫% থেকে ৪২% র ব্যাখ্যা  হয় না।  আর তাছাড়া, এত তো শুধু পশ্চিমবঙ্গে নয় -  কর্ণাটক, কেরল , বিহার নানা রাজ্যে একই চিত্র। যেখানেই যখন লোকজন বেশি ট্রাভেল করেছেন সেখানেই পসিটিভ বেড়েছে। এত সোজা হিসেবে - লোকডাউনের সময় তো কারুর চলাফেরার কথা নয়।এক রাজ্য থেকে অন্য রাজ্য নয়ই।  যাতায়াতই যদি হয়  তাহলে কিসের লোকডাউন? তাই, যাঁদের রোজগার বন্ধ তারা থাকা-খাওয়া-ইত্যাদির সব সরকারি সুবিধে পাবেন এটাই expected . নোবেল বিজয়ী অভিজিৎবাবু দেশকে সেই পরামর্শ দিয়েছিলেন। মানা হয়নি, আর আজ তার ফল দেখতেই পাচ্ছেন।

২০. তা সত্ত্বেও আবার বলব এখনো পশ্চিমবঙ্গের সিংহভাগ করোনাআক্রান্ত এই কলকাতা-কেন্দ্রিক ৫টি জেলার মধ্যে আছেন। দ্রুত টেস্ট বাড়িয়ে এবং কন্টাক্ট ট্রেসিং করে এখনো অন্য জেলাদের খুব উন্নত অবস্থায় নিয়ে যাওয়া যায়।  আর তাহলে ঐসব জেলার হাসপাতালের ওপরেও অনেক কম চাপ পড়বে। আর  কলকাতা এবং উত্তর ২৪ পরগনাকে আরো কি করা যায় সে বিষয়ে বিজ্ঞানীদের মতামত নিতে হবে বিশেষ করে।  সম্ভবত সারা রাজ্যে না করে শুধু এই দুটি জেলা নিয়ে কিছু বিশেষ ব্যবস্থা নিলে হয় কি?


 ২১. গতকাল একটা খবর পড়েছিলাম, সেটা দিয়েই শেষ করি। এই যে - 
 রিপোর্টে বলছে - 'শহরের ২০টি কনটেনমেন্ট জোনের মধ্যে ১৭টিই আবাসন। বাকিগুলির মধ্যে দু'টি বস্তি ও একটি ব্যক্তিগত বাড়ি রয়েছে।....কলকাতায় বর্তমানে করোনা আক্রান্তদের মধ্যে বিভিন্ন আবাসনের বাসিন্দারাই সংখ্যাগুরু, যা মোট আক্রান্তের প্রায় ৭২%। .... পুরসভা সূত্রে খবর, এর মধ্যে গত দু' সপ্তাহে বস্তি এলাকার মাত্র ১৫% মানুষ সংক্রামিত হয়েছেন। পরিসংখ্যানেই স্পষ্ট, আবাসনে আক্রান্তের সংখ্যাটা এর প্রায় পাঁচ গুণ।.... জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ অমিতাভ সরকার বলেছেন, 'বস্তির বাসিন্দারা আক্রান্ত হলেই পুরসভার সঙ্গে যোগাযোগ করছেন। ফলে রোগটা আর ছড়াতে পারছে না।' কিন্তু আবাসনের বাসিন্দাদের অনেকে রোগ লুকিয়ে সামাজিক মেলামেশা চালিয়ে যান বলে বিষয়টা উদ্বেগের হয়ে দাঁড়াচ্ছে। আর এক জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ স্বাতী নন্দী চক্রবর্তীর বক্তব্য, 'আবাসনের উপসর্গহীন বাসিন্দারা ছাদ কিংবা লিফট ব্যবহার করছেন। অসুখটা সম্পর্কে হয়তো অন্যদের জানাচ্ছেনই না! ....বস্তির বাসিন্দাদের অধিকাংশই দৈনিক মজুরির কাজে যুক্ত। সম্ভবত সেই কারণে দিন-আনা-দিন-খাওয়া এই মানুষরা বিধি মেনে চলার ব্যাপারে অনেক বেশি সাবধানী। তাই বেলগাছিয়ার বস্তিতে কিছু দিনের মধ্যে নিয়ন্ত্রণও করা গিয়েছে করোনার ভয়াল প্রকোপ। কিন্তু অভিজাত আবাসনে দেখা যাচ্ছে সম্পূর্ণ উল্টো ছবি। একে তো বাসিন্দাদের একটা বড় অংশ বেপরোয়া বলে মত বহু বিশেষজ্ঞের। অনেক সময়ে আবার তাঁরা পুরসভার লোককে বাড়ির চৌহদ্দিতে ঢুকতে পর্যন্ত দেন না। অর্থাৎ, নিজেরা তো বিধি মানেনই না, উল্টে পুরসভার কাজেও অসহযোগিতা করেন। পরিণাম যা হওয়ার তা-ই হচ্ছে।...'

 রাশি রাশি ডিগ্রী নিয়ে যদি এই হয়  .....!!! আর সবাই তো করেন না;  অনেকই  সব নিয়ম মেনে চলেন, কিন্তু যাঁরা পাকামো মেরে মানেন না তাদের জন্যেই বিপদ ছড়ায়। আমিও তো সাধারণ নাগরিক , কি আর বলতে পারি - তবে এটা সাবধান করতে পারি যে এক, সারা পৃথিবীতে অতিমারীর দ্বিতীয় ঢেউ কম বেশি শুরু হয়েছে বা হচ্ছে, আর দুই, পুজো আসছে, পূজোর ভিড় আসছে আর সর্দি-কাশি-জ্বর অসুখের মরশুম শীতকালও বেশি দূরে নেই।   

রেফারেন্স 







Wednesday, August 12, 2020


করোনা বিজ্ঞানের খুচরো খবর - পুটিনের ভ্যাকসিন।
ব্যাপারটা ঠিক কি দাঁড়াল ? 
পুটিন-দা পারেন ও বটে।  এই গত মাসেই আমাদের এখানে কত লাফালাফি হল যে ১৫ই অগস্ট নতুন ভ্যাকসিন আসছে। রে রে পড়ে গেল। মনে আছে নিশ্চয়ই তখন সবাই - এমনকি যে বিজ্ঞানী মহল সাধারণত কোন কথাই বলেন না এমনকি তাঁরাও - প্রতিবাদ করলেন, বোঝালেন যে 'না না এভাবে হতে পারে না। এরকম তাড়াহুড়ো করে টেস্ট না করে ভ্যাকসিন ছাড়া যায় না।  ...হাত চালিয়ে  ব্যাটিং করা যেতেই পারে, কিন্তু চোখ-কান বুজে দুম-দ্বাড়াক্কা ব্যাট চালালে লং অনে ক্যাচ দেবার চান্স প্রায় অবধারিত'। তা ভাল, চাপে পড়ে বা যাই হোক সেই লাফালাফি একটু থেমেছে অমনি রাশিয়া থেকে খবর এল যে ভ্যাকসিন প্রস্তুত।
কয়েকদিন ধরেই অবশ্য এরকম খবর বাজারে চলছিল। মানে ওরা টুকটুক করে news feelers ছাড়ছিল।  গত এক সপ্তাহে অন্তত ৪ জন আমায় এটা জিজ্ঞেস করেছেন। আমি বলেছি - না সম্ভব না, এবং এখনো বলছি সম্ভব না।  মানে, বিজ্ঞানের ঠিকঠাক নিয়ম মেনে সম্ভব না, নিয়ম না মানলে, আমার-দেশ-আমার-ল্যাবরেটরি-আমার-যা-ইচ্ছে-করব করলে তো  অন্য কথা - সে তো রাজনীতির ব্যাপার, শুধু তো বিজ্ঞান নয়। ' তবে, আজ পুটিন-দা সেটা নিজে ঘোষণা করার পরে ব্যাপারটা একটা আলাদা মাত্রা পেয়েছে বইকি।
তাহলে খবরটা ঠিক কি দেখে নেওয়া  যাক।  রাশিয়ার রাষ্ট্রপতি ভ্লাদিমির পুটিন নিজে জানিয়েছেন যে মস্কোর বিখ্যাত গামালেয়া ইনস্টিটিউট অফ এপিডেমিওলোজি এন্ড মাইক্রোবায়োলোজি যে করোনাবিরোধী ভ্যাকসিন তৈরী করছিল সেগুলি এখন পরীক্ষিত,  রোগ প্রতিরোধে সফল , নিরাপদ এবং তাই তিনি এটি অনুমোদন করছেন - এবার প্রোডাকশন অনেক বাড়ানো হবে , অক্টবর মাস নাগাদ এই টিকা রাশিয়ার সাধারণ মানুষ ব্যবহার করতে পারবেন, বিদেশেও রপ্তানি হবে। রুশ আধিকারিকরা জানাচ্ছেন অন্তত ২০টি দেশ এই ভ্যাকসিন চেয়েছে।
ভ্যাকসিন যে নিরাপদ সেটা বোঝাবার জন্যে পুটিন জানিয়েছেন যে তাঁর নিজের মেয়ে এই ভ্যাকসিন পরীক্ষার একজন ভলিন্টিয়ার হয়েছিলেন, এবং সে ভালোই আছে।
ভ্যাকসিনটা সম্পর্কে একটু বলে দিই।গবেষণার সময় এর কোড নাম ছিল Gam-Covid-Vac-Lyo।  এখন পোশাকি নাম  'স্পুটনিক ভি'।   দুটি সাধারণ ঠান্ডা লাগা (common cold) ভাইরাস Adenovirus Ad5 এবং Adenovirus Ad26র মধ্যে নতুন কোরোনাভাইরাসের জীন ঢুকিয়ে এই ভ্যাকসিন তৈরী করার চেষ্টা হয়েছে। গত মাসে যে দুটি ভ্যাকসিন নিয়ে খুব আলোচনা হল Oxford/AstraZeneca এবং Cansino তারাও মোটামুটি একই পদ্ধতিতে গবেষণা করেছেন।
তাহলে অসুবিধেটা কি? সমস্যা হল - যে কোন ভ্যাকসিন তৈরির কয়েকটা সুনির্দিষ্ট পর্যায়  থাকে। যাকে বলা হয় phase 1 , phase 2, phase 3....সেগুলো ঠিকঠাক বিজ্ঞানসম্মত ভাবে অতিক্রান্ত করলে,  এবং সব ফলাফল নিজে পর্যালোচনা করে সেই রেসাল্ট কোন প্রতিষ্ঠিত বিজ্ঞানের জার্নালে পাঠাতে হয়। সেই জার্নালের সম্পাদক তখন ওই বিষয়ের অন্য এক্সপার্টদের অনুরোধ করেন, 'এই ফলাফল অমুক ল্যাবরেটরি থেকে এসেছে। আপনারা নিজে থেকে দেখুন যা পাঠিয়েছে সেসব ঠিক তো, বৈজ্ঞানিক যুক্তি আছে তো, হিসেবে সব মিলছে তো'; একে বলে peer review বা ওই বিষয়ের জ্ঞানী ব্যক্তিকে দিয়ে মূল্যায়ন করা। সাধারণত দুই বা তিনজন রিভিউ করেন, তাঁদের মতামত জানান। হয়ত বললেন,  'দেখেছি, ঠিক আছে। লজিক আছে, গুল-তাপ্পি মারেনি।  আপনি নিশ্চিন্তে পাবলিশ করতে পারেন।', অথবা বললেন, 'না, আরো এক্সপেরিমেন্ট করতে হবে, রেসাল্ট আছে তবে আরো প্রমান চাই' . তখন সম্পাদক জানিয়ে দেবেন সেই কথা।  মোদ্দা কথা - আপনি যে বৈজ্ঞানিক ভাবে ঠিক বলছেন তার প্রমান দিন, আরো অনেকে দেখবে, তবে সেটা গ্রহণ করা হবে। আপনি যতই বড় হনু হন শুধু মুখের কথা, বিশ্বাস অবিশ্বাস দিয়ে কাজ চলবে না, গবেষণার ফল দেখতে চাই।  এই ভাবে সারা পৃথিবীতে সব বিজ্ঞানী কাজ করেন।
কিন্তু এত নতুন গবেষণা ? এক্সপার্ট জানছেন কি করে ঠিক কি ভুল? উপমা দিলে - গাভস্কারকে কি মাঠে নেমে টি-২০ খেলে বুঝতে হয় খেলাটার মূল গতিপ্রকৃতি, ঠিক ভুল কি হচ্ছে? না শ্রীকান্ত আচার্য যখন গানের কম্পিটিশনের জজ হন তখন উনি হিন্দি গান নিয়ে সুচিন্তিত মতামত দেন না? জ্ঞান, অভিজ্ঞতা থেকে ধাঁচ গতিপ্রকৃতি বোঝা যায়। এখানেও একই ব্যাপার।
তবে এতে কি ভুল হবার সম্ভবনা নেই? নিশ্চই আছে; বিজ্ঞানীরাও তো মানুষ। ভুল হতে পারে, পরে আরো ভাল গবেষণা হতে পারে এবং তখন আগের রেসাল্ট কিছুটা পাল্টে যেতে পারে, আবার 'তুই আমার পেপার দেখে দিস আমিও তোরটা নিয়ে বেশি চুলকোবো না' সেসব তো হতে পারে। তবে, ঠিক যেমন কেউ শুধু সিলেক্টরের সাপোর্ট পেয়ে বছরের পর বছর আন্তর্জাতিক ক্রিকেট বা ফুটবল খেলতে পারে না, এখানেও তাই।  The scientific process is not 100% efficient, but it is certainly the most efficient of human processes. ভুল ভাল বকলে ধরা পড়বেই। বিজ্ঞানের এই পথ কঠোর ভাবে সত্যনিষ্ঠার পথ।  এখনো। 
ভ্যাকসিনের কথায় ফিরে আসি।  ভ্যাকসিন গবেষণার ক্ষেত্রে তাহলে বোঝাই যাচ্ছে ওই  phase1-3র ফলাফল রিভিউআররা দেখতে চাইবেন। তবেই  জার্নালে ছাপা হবে -  ঠিক যেমন Oxford/AstraZeneca এবং Cansinoর ভ্যাকসিন গবেষণা বিখ্যাত ল্যানসেট পত্রিকায় হয়েছিল। প্রথম দুই পর্যায়ের রেসাল্ট সারা পৃথিবী দিয়ে পাশ করিয়ে তবে তাঁরা জানিয়েছেন যে তৃতীয় পর্যায়ের কাজ শুরু হয়েছে/হচ্ছে। গামালেয়া'র ক্ষেত্রে মুশকিল হচ্ছে সেই সব কোন তথ্য নেই।
রুশ রেসাল্ট যে নেই বলছি কেন?
১. কারন কোন জার্নালে বেরোয়নি, বেরোলে তো জানা যেত।
২. এই স্ক্রিনশট-টা দেখুন। বিখ্যাত বিজ্ঞান লেখক কার্ল জিমার গত কয়েক মাস ধরে নিউ ইয়র্ক টাইমস সংবাদপত্রে ভ্যাকসিন আপডেট দিচ্ছেন। কোন ভ্যাকসিন গবেষণার কি পর্যায়ে তা জানার জন্যে এ বেশ নির্ভরযোগ্য  সোর্স। সেখানে কি লেখা আছে দেখুন।রুশ ভ্যাকসিন  জুন মাসে মাত্র প্রথম পর্যায়ের কাজ শুরু হয়েছে। জুলাই মাসেও রুশ পার্লামেন্ট আশা করেছিল যে এই বছরের শেষ নাগাদ ভ্যাকসিন তৈরী শুরু হবে, কিন্তু ১০ই অগস্ট পুটিন জানিয়েছেন যে তিনি অনুমোদন করেছেন।  জিমার জানাতে ভোলেননি যে গুরুত্বপূর্ন তৃতীয় পর্যায়ের ট্রায়াল এখনো বাকি।  কি বুঝলেন?
৩. শুধু জিমার নন, কোন ভ্যাকসিন কি পর্যায়ে কাজ চলছে সেটা WHO একটি টেবিল করে বুঝিয়ে দেয়।  এই যে, সেই টেবিলের কিছুটা অংশ কাট-পেস্ট করে দিলাম। দেখছেন , একই ব্যাপার। গামলায়ার টিকা  phase 1/2র বেশি এগিয়েছে বলে দু দিন আগে পর্যন্ত কোন আপডেট নেই।

৪. আর ওই টেবিল থেকেই রুশ ভ্যাকসিনের অন্দরমহলে পৌঁছে যাওয়া যায়। এবং সেখানেও দেখুন শেষ অবধি ওরা নিজেরাই যা জানিয়েছেন তা হল গবেষণা হয়েছে phase 1/2অবধি। phase 3র কোন উল্লেখ নেই।  সব মিলিয়ে পরীক্ষা হয়েছে ৩৮র জনের ওপর -  আর সেই পরীক্ষা শেষ হবার তারিখ ধরা হয়েছিল ১৫ই অগস্ট। 

৫. সবচেয়ে বড় কথা।  এই ভ্যাকসিনের জন্যে রুশীরা নিজেরাই একটি ওয়েবসাইট বানিয়েছেন।এবং তাঁদের ওয়েবসাইট বলছে যে ৩৮ জন ভলিউনটিয়ারের ওপর phase 1 and phase 2 পরীক্ষা ১লা অগস্ট সফল ভাবে শেষ হয়েছে।  , কিন্তু তারপর যে phase 3 হাজার হাজার লোকের ওপর নানা ভাবে এবং বেশ কয়েকমাস বা বছর ধরে পরীক্ষা হবার কথা তা ১২ই অগস্ট থেকে শুরু হবার কথা।   অথচ এর মধ্যে দুম করে উনি টিভিতে বসে বলে দিলেন 'সব রেডি - আমার মেয়েকে দিয়েছি, তার মানে সব সেফ' - যাববাবা  !

Summarize করলে কি দেখা যায়? 
 ১. রুশ ভ্যাকসিন প্রথম দুই পর্যায় মাত্র শেষ করেছে বলে জানিয়েছেন। তৃতীয় পর্যায় শেষ করা তো ভুলেই যান,  সেটা  যে ১২ই অগস্ট থেকে শুরু হচ্ছে তা তারা নিজেরাই জানিয়েছেন।
২।  প্রথম পর্যায়ের ফলাফল তারা কোন জার্নালে প্রিভিউ করতে এখনো পাঠায়নি।
৩।  মাত্র ৩৮জন ভলান্টিয়ার নিয়ে পরীক্ষা হয়েছে। সমপর্যায়ের অক্সফোর্ড/অস্ট্রজেনেকা এবং ক্যান সাইনো ভ্যাকসিন পরীক্ষা হয়েছিল ~১১০০ ও ~৬০০ জনের ওপর।

তাহলে কি দাঁড়াল ? শেষ হল কি হল না, রেসাল্ট সব ভাল করে দেখা হল কি না , লং টার্ম পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া কি জানা হল না,  বয়স্ক লোকজন, হার্টের রুগী, ডায়াবেটিক, যাঁদের প্রেসার কিডনি ইত্যাদির সমস্যা আছে তাদের টিকা দিলে কেমন থাকবেন  জানা হল না, বাচ্ছাদের ওপর কি রেসাল্ট দেখা হল না!  মাত্র ৩৮জন লোকের ওপর গবেষণা করে , phase3  না করে উনি  'এই দেখ আমার মেয়ে দিব্যি আছে' বলে গ্যাস মেরে দিলেন? আরে পুটিনের মেয়ে হোক কি ট্রাম্পের মেয়ে কি ওবামার -  সেও তো একজন মাত্র মানুষ। তার বেশি তো কিছু না। আর একজন মানুষ, তিনি যেই হন, তিনি  তো একা ২০০০ মানুষের phase 3র  রেসাল্ট দিতে পারবেন না।তাই বলছি, ওটা জাস্ট সুড়সুড়ি। লোকে খাবে।  সব রুশ বাবা-মা (এবং সারা পৃথিবীর বহু বাবা-মা - ওই যে ২০টা দেশে রুশ ভ্যাকসিন যাবে) ভাববেন 'আহা , নিজের মেয়েকে এগিয়ে দিয়েছে। তার মানে সব ঠিক আছে।' এটা ঠিক পুটিন বাবা হিসেবে যা করেছেন সেটা খারাপ  বলছি না , এক দিক দিয়ে প্রশংসনীয় এবং অনেক বাবা মা'ই করবেন না।  তবে সেটা তো আর  সিরিয়াস  বৈজ্ঞানিক পরীক্ষানিরীক্ষা পাশ কাটাতে পারে না।এই কথাটা ভুললে চলবে না।   ( আচ্ছা একটা কথা।  পুটিনের মেয়ে।  কোন মেয়ে? পুটিনের তো দুই কন্যা  - মারিয়া আর য়েক্যাটরিনা।  কোনজন টিকা নিয়েছেন সেটা সংবাদ সংস্থা বলেনি।)
তার মানে কি এই ভ্যাকসিন কাজ করবে না? না , এমন কোন কথা নেই।  সত্যি বলতে কি, আজকের দিনে ভ্যাকসিন জিনিসটা বানানো যে খুব জটিল তা না।  সেটা কতটা ভাল কাজ করবে (মানে সংক্রমণ আটকাবে) আর বাজে সাঈড এফেক্ট হবে কি না সেটাই ভাল করে পরীক্ষা করতে হয়। সেখানেই সময় লাগে। আজকের দিনে এমন কোন ভ্যাকসিন হয় না যেটা একদম ফেল মেরে যাবে, আর সবার মারাত্মক পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া হবে।  আর গামালায়া তো বহুদিনের অভিজ্ঞতা-সম্পন্ন প্রতিষ্ঠান।  সুতরাং, এত কিছু বলার পরে ও বলছি যে এই রুশ ভ্যাকসিন দুর্দান্ত না হলেও বেশ কিছুটা কাজ করবে। এবং খুব সম্ভবত ওরা টিকাকরণ আর তার ফলাফল কি হয় সেটা পাশাপাশি দেখতে থাকবেন। তবে, ওই যে - এইভাবে হড়বড় করা বিজ্ঞানসম্মত নয়।অনেকটা সাধারণ মানুষকে গিনিপিগ করার মত ।
পুতিন এটা কেন করলেন? একজন সাংবাদিক বন্ধুকে একটু আগে জিজ্ঞেস করলাম - পুটিনের ওপর কি রাশিয়ার ভেতরে খুব চাপ চলছে? লোকজন খুব বেশি অসুন্তুষ্ট। উনি বললেন (এবং আমিও মোটামুটি তাই জানি ) যে ছোটখাট সমস্যা আছে, রাশিয়ায় অনেক লোক করোনা -আক্রান্ত হয়েছেন, কিন্তু পুটিন রাজনৈতিক ভাবে খুবই পরাক্রমশালী। এমন কিছু চাপে নেই।  তাহলে? তাহলে একটাই উত্তর হয়।  উনি সারা পৃথিবীকে দেখাতে চাইছেন - দেখ, কি তোমরা অক্সফোর্ড অক্সফোর্ড , আমেরিকা আমেরিকা , চীন চীন করছ ? সবার আগে আমরা।  আর সম্ভবত এই জন্যেই ভ্যাকসিনের নাম দিয়েছেন স্পুটনিক। মনে আছে নিশ্চই ১৯৫৭ সালে মহাকাশে যাত্রা করা  প্রথম স্যাটেলাইট ছিল  সোভিয়েত  ইউনিয়নের 'স্পুটনিক'.  আমাদের স্কুলের পরীক্ষায় সেই যে কোশ্চেন আসতো -  'নামকরণের স্বার্থকতা', সেই ব্যাপার।

আমাদের কি? তেমন কিছু মনে হয় না। তেমন কোন ডাইরেক্ট খবর নেই। তবে বহুদিনের বন্ধু দেশ রাশিয়ার থেকে কিছু ভ্যাকসিন হয়ত আসবে (এই তো কয়েকদিন আগে কিসব অস্ত্র কেনা হল, চীনের সঙ্গে কথা বলা নিয়ে রাশিয়া মধ্যস্ততা করল।  এইসব সম্পর্ক এভাবেই থাকে)  তবে সে যাই হোক,  যেটা নিয়ে একটা খেয়াল রাখতে হবে - আমাদের দেশে যা ভ্যাকসিন ছাড়া হবে সেটা যেন একদম নিয়ম মেনে ভাল করে পরীক্ষা করেই হয়। Phase 3তে যেন কোন তাড়াহুড়ো ঢিলেমি না থাকে।  'ফাটিয়ে দেব' 'সবাইকে দেখিয়ে দেব, তাক লাগিয়ে দেব' ওসব সিনেমায় হয়, চিকিৎসা বিজ্ঞানে হলে কেলেঙ্কারির চান্স খুব বেশি। একেই গবেষণা অত্যন্ত দ্রুত চলছে। কিন্তু সব কিছুর একটা লিমিট আছে - একজন মহিলার একটি সন্তানকে জন্ম দিতে ৯ মাস লাগবে।  সেটাই স্বাভাবিক, এবং আর কোন রাস্তা নেই।  ওই কাজটা একসঙ্গে ৯জন মহিলা ১ মাস ১ মাস করে parallel করে সময় বাঁচাতে পারবেন না।

রেফারেন্স :
https://www.nytimes.com/interactive/2020/science/coronavirus-vaccine-tracker.html
https://www.who.int/publications/m/item/draft-landscape-of-covid-19-candidate-vaccines
https://clinicaltrials.gov/ct2/show/NCT04437875?term=vaccine&cond=covid-19&draw=4
https://tass.com/society/1188313

https://sputnikvaccine.com/about-vaccine/clinical-trials/
https://www.reuters.com/article/us-health-coronavirus-russia-vaccine-spu-idUSKCN2571FV?fbclid=IwAR0n_Cbnif6aLq1xDiyI11DyvpE4I9CAMnvpcmtztaqCon0tWCSet_Cl-aI


 স্কুল খুলুক, সঙ্গে হাওয়া বাতাস খেলুক ক্লাসঘরে ('এই সময়' সংবাদপত্রে প্রবন্ধ -  ২২শে সেপ্টেম্বর, ২০২১)      সোজাসাপ্টা অপ্রিয়   সত...