Monday, August 24, 2020



পশ্চিমবঙ্গের করোনা পরিস্থিতি : জুলাই - অগস্টে কি দাঁড়াল? 

ভারত ও পশ্চিমবঙ্গের করোনা সমাচার নিয়ে কোন update সেই জুন মাসের পরে লিখিনি। দু-তিন দিন আগে একজন বন্ধু জিজ্ঞেসও করল সে বিষয়ে।  না লেখার তিনটে কারন - ১. একটু সময়ের অভাব। ২. করোনা বিজ্ঞান নিয়ে, বিশেষত ভ্যাকসিন নিয়ে, অনেক লিখেছি এই সময়ে । ৩. দুমদাম ব্রেকিং নিউজ করে যা-ইচ্ছে-তাই লিখতে যে পারি না সেটা পাঠকরা এতদিনে বুঝে গেছেন।  তাই, এই নতুন জীবাণুসৃষ্ট-অতিমারী কি ভাবে এগোচ্ছে, কি বৈজ্ঞানিক তথ্য হাতে আসছে সেগুলো না পড়ে না বুঝে তো আপনাদের কাছে present করা যায় না, তাই না?

তবে এই  যে কয়েক মিনিট বকবক করলাম তাতে বুঝতেই পারছেন সেই সাবজেক্ট নিয়ে এখন আবার লিখছি। ২৪শে মার্চের পরে ২১ দিন নয়,  প্রায় ৫ মাস কেটে গেছে -   দেশ ও রাজ্যের কি অবস্থা দেখা যাক।

১. প্রথমেই 'চাক দে'।  আজ যখন এটা লিখছি নজরে এল ভারতে টোটাল আক্রান্ত তিরিশ লক্ষ ছাড়িয়ে গেল। তলার  ছবিটা দেখুন। প্রথম দশ লক্ষ আক্রান্ত হতে লেগেছিল ১৬৮ দিন।  সাড়ে পাঁচ মাস।  ১০ থেকে ২০ লক্ষ হতে মাত্র ২১ দিন, আর ২০ থেকে ৩০ লক্ষ হতে ১৬ দিন। কি বুঝছেন?
ছবি ১: ভারতে করোনা আক্রান্তের সংখ্যার বৃদ্ধি'র হার খুবই চিন্তার কারণ । 
সবচেয়ে বড় কথা এই যে সব দেশ - এমনকি আমেরিকা আর ব্রাজিলকে - টপকে নতুন করোনা আক্রান্তের সংখ্যায় ভারত এখন সবার ওপরে ! টোটাল আক্রান্তের সংখ্যায় ওরা অবশ্য এখনো এগিয়ে তবে যে ভাবে আমরা লাফিয়ে লাফিয়ে এগোচ্ছি ধরে ফেলব। কবির কথা টেনে এনে  'ভারত আবার জগৎ সভায়...'
ছবি ২: করোনা আক্রান্ত'র তালিকায় সবচেয়ে ওপরে যে তিনটি দেশ।  ২০শে অগস্ট অবধি প্রতি সপ্তাহে নতুন কেসের খতিয়ান।
 ভারতের অবস্থা উদ্বেগজনক। Our world in data site থেকে নেওয়া 
২. খেলার ছলে বলছি, কিন্তু এ যে কত বড়  চিন্তার  কারণ  সে বিষয়ে কোন সন্দেহ আছে কি? এবং আরো বেশি দুশ্চিন্তা এই কারণে যে পরীক্ষা বাড়লেও জনসংখ্যার নিরিখে পরীক্ষায় ভারত এখনো অনেক পিছিয়ে। সুতরাং যথেষ্ঠ টেস্ট হলে যে সংখ্যা কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে....!!?? অবশ্য,  প্ল্যান করে না  করলে কোন বিজ্ঞান যে কাজ করে না এটা বিজ্ঞানের ছাত্র মাত্রই জানেন, এবং তাই মার্চ মাসের হঠাৎ-লকডাউন যে রোগের বাড়বাড়ন্ত ঠেকাতে ব্যর্থ হয়েছে তাতে দুঃখ পেলেও, অবাক হবার বেশি কিছু নেই।

৩. অনেকেই হয়ত বলবেন - আরে আমাদের জনসংখ্যা অনেক বেশি। সেই তুলনায় কিছুই হয়নি । কিন্তু, এটা যে কোন সান্তনা নয়, সেটা চূড়ান্ত অজ্ঞ ছাড়া সবাই বুঝি। হ্যাঁ, এ কথা ঠিক যে   covid হলেও প্রায় ৮৫% লোকের এমনিতেই সেরে যায়, এবং বাকি ১২-১৫% হাসপাতালে ভর্তি হলেও তাদের মধ্যে ~ ২% ছাড়া সবাই সুস্থ হয়ে ওঠেন। ঠিক।  কিন্তু, যে  জীবাণু এত ছোয়াঁচে সেই রোগের ২-৩% ও একটা বিশাল সংখ্যা এবং তার  মানে হাজার হাজার হাসপাতাল বেড আর আইসিইউ লাগবে।  এবং আমাদের মত দেশের দীর্ঘ দিন ধরে অবহেলিত চিকিৎসা ব্যবস্থা  যে এর সঙ্গে লড়াই করতে পারবে না সে কথা সবাই বুঝি। তাছাড়া জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারি-মার্চ অন্তত দু মাসের প্রস্তুতি-পর্ব আমরা প্রায় পুরোই অবহেলা করেছি ; আজ সেই সময় তো আর ফিরবে না, তাই না?

৪. এটা শুধু কথার কথা নয়। করোনায়  আক্রান্ত কতজন মারা গেছেন এই নিয়ে আমাদের বড়াই করার কিছু নেই।  কারণ  ইতালি বা আমেরিকার থেকে সেই সংখ্যা % কম হলেও, এই গ্রাফ দেখুন -  প্রতিবেশী দেশরা অনেকেই কিন্তু আমাদের থেকে বেশি রুগীকে সুস্থ করে তুলেছেন।  ১০০০ জন আক্রান্ত হলে ১৯ ভারতীয় মারা যাচ্ছেন, এবং সমসংখ্যক আক্রান্ত হলে প্রাণ হারাচ্ছেন ১৩ জন বাংলদেশী ও ৪ জন নেপালি।আর  পাকিস্তান আর আফগানিস্তান আমাদের থেকে বেশি এটা নিশ্চয়ই গর্ব করার মত কিছু না।
ছবি ৩: ভারত ও প্রতিবেশী দেশে করোনা আক্রান্তদের মধ্যে কত শতাংশ মারা গেছেন।পরিসংখ্যানবিদ রিজো জনের টুইট থেকে নেওয়া।  
  ৫. সারা দেশেই কি এই অবস্থা? এই প্রশ্ন ওঠা স্বাভাবিক। তলার ছবি ও গ্রাফ এ বিষয়ে বেশ কিছুটা আলোকপাত করছে।দেশের বিভিন্ন অংশে আজ অবধি করোনা'র প্রাদুর্ভাব কেমন সেটা এই ছবিটা দেখাচ্ছে।
ছবি ৪: ভারতের বিভিন্ন অংশে করোনা'র প্রাদুর্ভাব। 


মহারাষ্ট্র, কর্ণাটক, তামিল নাড়ু, অন্ধ্র, তেলেঙ্গানা যে অবস্থা অত্যন্ত চিন্তাজনক তা দেখাই  যাচ্ছে। এছাড়া দিল্লি, উত্তর প্রদেশ ও বিহারের বিস্তীর্ন অঞ্চল, দক্ষিণ বঙ্গ এবং গুয়াহাটির চারপাশ যথেষ্ট সংখ্যায় রোগ ছড়িয়ে পড়েছে।

(covid19india.org,  যাঁরা এই অতিমারীতে অসাধারণ জন সংযোগের কাজ করেছেন, তাঁদের ওয়েবসাইট থেকে এই ছবিটা নেওয়া)  .










৬. পরের ছবি নেওয়া হয়েছে পরিসংখ্যানবিদ রিজো জনের টুইট থেকে। ওঁর উপস্থাপনা আমার খুব ভাল লাগে, এবং তাই ছবিগুলো ব্যবহারের অনুমতি চেয়ে নিয়েছি।
ছবি ৫: বিভিন্ন  রাজ্যে দৈনিক পসিটিভ (২১শে অগস্ট) আর সাপ্তাহিক বৃদ্ধি% . পশ্চিমবঙ্গের স্থান তীরচিহ্ন দিয়ে দেখানো আছে।  
বাঁদিকে দেখা যাচ্ছে যে কনফার্মড পসিটিভ কেসে  মহারাষ্ট্র, অন্ধ্র, কর্ণাটক, তামিলনাড়ু, উত্তর প্রদেশ, পশ্চিমবঙ্গ, ওড়িষ্যা এবং বিহার এগিয়ে। এর মধ্যে মহারাষ্ট্রে একাই ২০% কেস! কর্নাটকে  প্রায় ১১% ! 

কিন্তু ডানদিকে যেটা দেখা যাচ্ছে সেটা নিয়ে উদ্বেগ বেশি তবু কম নয়।  এক সপ্তাহে  করোনার প্রাদুর্ভাব ক' শতাংশ বাড়ল তার হিসেবে দিচ্ছে।এবার লক্ষ্য করুন -  ছত্তীসগঢ়, পাঞ্জাব, মেঘালয় , চন্ডিগড়, পন্ডিচেরী, কেরল, ওড়িশায় এবং ঝাড়খণ্ডে বেশ জোরে ছড়িয়ে পড়ছে করোনা।তার মানে মাত্র এক-দেড় মাস আগে যেসব রাজ্যে আক্রান্তের সংখ্যা কম ছিল তারাও এবার আর তাল সামলাতে পারছেন না। বাংলার মানুষ এই চার্ট দেখে একটু আশ্বস্ত হতে পারেন যে  সেই তুলনায় পশ্চিমবঙ্গ একটু বেটার অবস্থায় আছে, যদিও সেটা নিয়ে সন্তুষ্ঠ হবার তেমন কিছু নেই। কেন সেটা পরে বলছি।  

. তবে আরো তথ্য দেবার আগে একটা জিনিস জানাই। আমেরিকার বিখ্যাত স্ট্যানফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের একদল গবেষক (তাঁদের মধ্যে কয়েকজন ভারতীয় আছেন) সম্প্রতি সমীক্ষা চালিয়েছেন যে ভারতের বিভিন্ন রাজ্য থেকে করোনা-সংক্রান্ত রিপোর্ট কেমন করা হচ্ছে - বিশদ তথ্য দেওয়া হচ্ছে না অনেক ফাঁক-ফোকর থাকছে, ভালো ভাবে দেওয়া হচ্ছে নাকি দায়সারা ভাবে কাজ সারা হচ্ছে। তাঁদের গবেষণা পরিষ্কার দেখিয়েছে যে কিছু রাজ্য যেমন যথেষ্ট দক্ষতার ও স্বচ্ছতার সঙ্গে এই কাজ করছেন , তেমনি আরো অনেকের কাজ মোটেই সন্তোষজনক নয়।  তলায় গ্রাফ সেই গবেষণাপত্র থেকে নেওয়া। 
ছবি ৬:  ভারতীয় রাজ্যদের covid সংক্রান্ত তথ্য উপস্থাপনার ওপরে স্ট্যানফোর্ড উনিভার্সিটির গবেষকদের তৈরী 'মার্কশীট' 
দেখতেই পারছেন কর্ণাটক, কেরল, ওড়িশা বেশ 'ভাল মার্ক্স' পেয়েছে। কারন তাঁদের দৈনিক বুলেটিন এবং dashboardএ প্রচুর তথ্য দেন। পশ্চিমবঙ্গ আর মহারাষ্ট্র মোটামুটি (কারন, পশ্চিমবঙ্গ গত দু-তিন মাসে দৈনিক বুলেটিন অনেক উন্নত করলেও এখনো কোন জেলায় কটা টেস্ট হল, আক্রান্তদের মধ্যে জেলাভিত্তিক নারী-পুরুষ, বয়েসের হিসেবে, ইত্যাদি বুলেটিনে দেয় না; দেওয়া উচিত)। অবশ্য  অন্য রাজ্যেরা আরো তলার দিকে - আর খুব খারাপ 'মার্ক্স' পেয়েছে উত্তর প্রদেশ আর বিহার! স্ট্যানফোর্ড গবেষকরা আফসোস  করেছেন যে কিছু রাজ্য অফিসিয়াল বুলেটিন না করে টুইটারে কিছু সংখ্যা দিয়ে দেন !! ঠিকঠাক পরিসংখ্যানের পক্ষে, চিকিৎসা ব্যবস্থার পক্ষে সেটা মোটেই ভাল নয়। 

৮.   এর সঙ্গে আরেকটা 'সমস্যা' হয়েছে।  এতদিনে আমরা সবাই জানি যে টেস্ট মূলত হয় দু রকমের - RT-PCR আর rapid antigen test. করোনা লড়াইয়ে দুটোই প্রয়োজনীয় , কিন্তু RT-PCR হল সত্যিকারের মাপকাঠি। যাকে বলে gold standard. ঠিকঠাক করে করলে এতে >৯০% সঠিক উত্তর আসবে।  এন্টিজেন টেস্ট ও ভাল, দ্রুত করা যায়, বিশেষ ল্যাব লাগে না, কিন্তু এতে যেমন কেউ আক্রান্ত কি না বোঝা যায় (true positive) তেমনি অনেক সময় আক্রান্ত হলেও ধরা পড়ে না (false negative)। তার মানে এই নয় এন্টিজেন টেস্ট করা উচিত না।  তাই দেশ বা কোন  রাজ্য যদি এন্টিজেন টেস্ট'র ওপরে  বেশি নির্ভরশীল হয়ে পড়ে তখনই মুশকিল হতে পারে - কারন তখন অনেক পসিটিভ ধরা না পড়তে পারে। মুশকিল হচ্ছে, নানা কারণে বেশ কিছু রাজ্য এখন খুব বেশি এন্টিজেন টেস্টিং করছেন এবং  RT-PCR test সেই অনুপাতে অরে বাড়ছে না।  যেমন ওড়িশার নাকি এখন ৯০% পরীক্ষা হল এন্টিজেন টেস্ট ! কয়েকদিন আগে দিল্লীর হিসেবে বলছিল ৭০-৭২% টেস্ট এন্টিজেন টেস্ট। বিহার এবং উত্তর প্রদেশও বেশি এন্টিজেন টেস্ট করছে বলে খবর।  

৮. পশ্চিমবঙ্গ ? দৈনিক বুলেটিন অনুযায়ী এ রাজ্যে এন্টিজেন টেস্ট শুরু হয়েছে ২৮শে জুলাই থেকে। এই টেবিলে আছে অগস্টের হিসেব।  দেখুন। 
টেবিল ১ : প্রতি দুদি ন অন্তর পশ্চিমবঙ্গে RT-PCR আর Antigen (Ag) testর হিসেব। অগস্ট মাসে এন্টিজেন টেস্ট হচ্ছে ~৩৮%   
তার মানে দাঁড়াল - এক, পশ্চিমবঙ্গও এন্টিজেন টেস্ট বাড়িয়েছে কিন্তু অতটা না।  ৩৭-৪০% রেঞ্জে চলছে।  কেরল ও তাই।  আর এর পাশাপাশি RT-PCR  টেস্ট ও বেড়েছে।  নতুন ল্যাবও join করেছে। অনেক জেলায় এখন ল্যাব চালু হয়েছে।  খেয়াল রাখতেই হবে এই রাজ্য যেন এন্টিজেন টেস্ট ওপর বেশি নির্ভর না করতে শুরু করে; কারণ  তাতে কিছুদিন রেসাল্ট 'ভাল দেখালেও' পরে বিপদ বাড়বে বই কমবে না !  এবং গতকালই পড়লাম যে কলকাতায় যত পরীক্ষা করা উচিত তত হচ্ছে না।  কেন হচ্ছে না, কি হচ্ছে সেই নিয়ে পুরসভা, স্বাস্থ দপ্তর, নবান্ন সবার মধ্যে কথাবার্তা চললেও মোদ্দা কথা আরো RT-PCR পরীক্ষা বাড়াতে হবে। এর মধ্যে আবার গত সপ্তাহে খবর ছিল যে NICEDএ যে নতুন COBAS-8000 মেশিন বসানো হল (প্রধানমন্ত্রী ডিজিটাল উদ্বোধন করলেন) সে গোড়াতেই কাজ করছে না!? অবশ্য, অভিজ্ঞতা থেকে জানি নতুন যন্ত্র এলেই এরকম কিছু না কিছু গন্ডগোল কিছুদিন লেগে থাকে, কিন্তু এই 'যুদ্ধকালীন' পরিস্থিতিতে সেটা যাতে দ্রুত solve হয় সেটাই বাঞ্চনীয়।  

৯. মুশকিল হয়েছে এই দুটো কারনে বিভিন্ন রাজ্যের মধ্যে তুলনামূলক analysis করা বেশ অসুবিধেজনক হয়ে উঠেছে। সবাই তো একভাবে (অথবা মোটামুটি একভাবে) তথ্য দিচ্ছে না, টেস্টও  করছে না।  তাহলে পাশাপাশি ফেলে ডিটেলে বুঝবেন কি করে? আর এটা 'আমরা ওরা' করার জন্যে  না।  ভাইরাসের গতিপ্রকৃতি বুঝতে এ খুবই  প্রয়োজনীয়।

১০. রাজ্য থেকে জেলায় আসি। এই দেখুন। ভারতের যে ৫০টি জেলায় করোনার প্রকোপ সবচেয়ে বেশি তাদের সংখ্যার ওঠা-নামা। বড় শহর ছাড়িয়ে জেলা, গ্রামগঞ্জে covid যে ছড়িয়ে পড়েছে সে বিষয়ে কোন সন্দেহ নেই। পুনে, মুম্বাই, চেন্নাই, ব্যাঙ্গালোর, লক্ষনৌ , নাগপুর, আমেদাবাদ সব জায়গায় বাড়বাড়ন্ত। দিল্লীতে আক্রান্তের সংখ্যা গত সপ্তাহ দুই তিন কম ছিল (যদিও অত বেশি এন্টিজেন টেস্ট থেকে ঠিক হিসেবে পাওয়া যায় কিনা সেই নিয়ে একদল বিশেষজ্ঞ সন্দেহ প্রকাশ করেছেন), কিন্তু, আবার সংখ্যা বাড়ছে। 
ছবি ৭ (ওপরে এবং নীচে ): ভারতের যে ৫০টি রাজ্যে করোনা আক্রান্তের সংখ্যা সবচেয়ে বেশি। রিজো জনের টুইট থেকে নেওয়া।

১১. প্রথম পঞ্চাশের মধ্যে রয়েছে পশ্চিমবঙ্গের তিন জেলা - কলকাতা, উত্তর ২৪ পরগনা আর হাওড়া। তাহলে সেই সূত্র ধরে আমরা এই রাজ্যের জেলাগুলির অবস্থা দেখি। প্রথমেই একটি টেবিল -  রাজ্যের মোট  পজিটিভের কোন জেলায় কত শতাংশ আছেন ? তিনটে সময়সীমা নেওয়া হয়েছে - ১৮ই জুলাই অবধি,  ৩রা অগস্ট অবধি আর ২২শে অগস্ট (গতকাল) অবধি। তাহলে এও দেখা যাবে যে কোন জেলায় আক্রান্তের আপেক্ষিক সংখ্যা বেড়েছে বা কমেছে বা একই রকম আছে।
টেবিল ২: রাজ্যের ২৩টি জেলায় মোট আক্রান্তের %. 


ছবি ৮: পশ্চিমবঙ্গের করোনা আক্রান্ত মূল অঞ্চল 
১২. প্রথমেই যেটা নজরে আসে যে কলকাতা এবং কলকাতা ঘিরে যে ৪টি জেলা করোনা এখনো মূলত এখানেই সীমাবদ্ধ। হ্যাঁ, এখনো। ২২শে অগস্টের হিসেবে বলছে যে কলকাতা, দুই ২৪ পরগনা, হাওড়া, পূর্ব মেদিনীপুর আর হুগলি থেকেই আছেন টোটাল আক্রান্তের ৭২% । এর মধ্যে কলকাতা + হাওড়া +  উত্তর ২৪ পরগনা মিলিয়েই হয় ৫৬% রুগী !! তার মানে আজ ছ'মাস পরেও এই অসুখ মূলত (মূলত) দক্ষিণবঙ্গের কয়েকটি জেলায় সীমাবদ্ধ। তার মানে আজও যদি এই অঞ্চলের প্রসাশন এবং সব নাগরিক  বিজ্ঞান-সচেতন হয়ে, লোভী না হয়ে, একজোট হয়ে লড়াই করেন এই রাজ্য covidকে অনেকাংশে পরাস্ত করবে। কথার কথা নয়, পরিসংখ্যান তাই বলছে।  

১৩.আর এই ট্রেন্ড তো দেশের অন্য জায়গার সাথে মিলছে - দিল্লী, মুম্বাই, চেন্নাই, ব্যাঙ্গালোর সবই তো রোগের epicentres [  হায় হায় ! ফেব্রুয়ারির শেষে ১৫টা এয়ারপোর্ট বন্ধ করে দিলে এই বিপদ আজ আসে না !!] 

১৪. কিন্তু, খুব দ্রুত এই কাজ করতে হবে। কারণ অন্য ২০টি জেলায় আক্রান্তের সংখ্যা slow but steadily বাড়ছে। তলার টেবিল দেখুন। জেলায় জেলায়  গত ১০দিনে করোনা আক্রান্ত কত % বেড়েছে।  দেখা যাচ্ছ - দুই মেদিনীপুর, পশ্চিম বর্ধমান, বাঁকুড়া, মুর্শিদাবাদ, দক্ষিণ দিনাজপুর আর আলিপুরদুয়ার  বৃদ্ধির হার রাজ্যের গড় বৃদ্ধির তুলনায় যথেষ্ট বেশি। নদীয়া আর জলপাইগুড়ি বাড়লেও কম;  দক্ষিণ ২৪ পরগনায়, দার্জিলিং, মালদা , হুগলিতে  বৃদ্ধির হার কম হলেও যেহেতু তাদের টোটাল আক্রান্তের সংখ্যা ওপরের দিকে সেটা চিন্তার বিষয় এবং contact tracingর উন্নতি দরকার। বীরভূম, ঝাড়গ্রাম, পুরুলিয়া আর কালিমপং সংখ্যা এখনো কম - সেটা ভাল।   আর  উত্তর ২৪ পরগনা আর কলকাতা যে এখনো চিন্তার বড় কারন সে  আমাদের সবারই জানা। দুই টেবিল দেখে  মনে হচ্ছে  কলকাতা ও উত্তর ২৪ পরগনা উন্নতির পথে।  হতে পারে, তবে এই দুই জেলা যেহেতু খুবই ঘন বসতিপূর্ণ, লোকডাউন আর নেই এবং টেস্ট  এবং contact tracing বাড়লেও আরো অনেক বাড়াতে হবে,  তাই %র হ্রাস সত্যিই উন্নতি না টেস্টের লিমিটেশন সেটা অন্তত আমি ঠিক বুঝতে পারছি না, এবং জেলাভিত্তিক কত টেস্ট আর তার মধ্যে কত পসিটিভ না জানলে সেটা বলা যাবেও না।উন্নতি সম্ভবত হয়েছে না হলে ছবি ৭ ও টেবিল ২ আর ৩এ তা  ধরা   পড়ত কিন্তু 'গা ছাড়া' দেবার ভাব যেন একদম না আসে।  লক্ষ্য করুন দিল্লী কিরকম আবার বাড়ছে !  
 টেবিল ৩: গত দশ দিনে বিভিন্ন জেলায় covid আক্রান্তের বৃদ্ধির হার। 

১৫. ভাল খবর কি কিছু নেই? আছে,  হাওড়া জেলা নিজেদের কিছুটা রক্ষা করেছেন।অন্তত সাময়িক ভাবে আক্রান্তের % কমছে, এবং খবরের কাগজের রিপোর্ট ও তাই বলছে। আরো  আছে। ৭৭% রুগী সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরছেন এ যে কি আনন্দ ও স্বস্থির কারন সেটা কি লিখে বোঝাতে হবে ? আর এপ্রিল-মে মাসে যে মৃত্যুহার অস্বাভাবিক রকম বেশি ছিল ( তখনই বলেছিলাম ওটা কম টেস্ট করার জন্যে error হচ্ছে) সেই মৃত্যুহার আজ জাতীয় গড়ের মাথায় মাথায় (তলায় গ্রাফ দেখুন)। অবশ্য যে দেশের ৩০%র কম মৃত্যুর ঠিকঠাক কারণ জানা যায়, সার্টিফিকেট পাওয়া যায় সেই দেশে অতিমারীর সময় কি হয় তা নিয়ে কিছু বিশেষজ্ঞ সন্দেহ করেছেন। তবে এ কথা অনস্বীকার্য যে এত শত প্রতিকূলতার মধ্যে রাজ্যের চিকিৎসক, নার্স ও কর্মীরা আপ্রাণ চেষ্টা করে চলেছেন এবং তাঁদের  কাছে আমরা সবাই ঋণী। 
১৬. আচ্ছা, অন্য জেলায় রোগ ছড়িয়ে পড়ছে কেন? এর কিছু উত্তর আমরা সবাই জানি - ভারত প্রস্তুত ছিল না (না হলে WHO অতিমারী ঘোষণা করার দুদিন পরে  কেন্দ্রীয় স্বাস্থ মন্ত্রক কখনো বলে যে চিন্তার কারন নেই????  ) , আমাদের বিধিনিষেধ অত জোরালো নয়, সামাজিক অর্থনৈতিক সাপোর্ট নেই,  আর বহু লোকজন এখনো হিরোগিরি মেরে থুতনির তলায় মাস্ক পরেন, ইত্যাদি। তবে সেসব ছাড়াও বড় কারণ আছে।  সেটা দেখা যাক।  

১৭. এই দেখুন তলার গ্রাফে পশ্চিমবঙ্গের জেলা - মে মাস থেকে আজ অবধি।প্রথমে বাঁদিকটা দেখুন। মে মাসের শেষ অবধি সব পজিটিভের ৮৪% ছিল মাত্র ওই তিন হটস্পট জেলা থেকে। বাকি ২০ জেলা মিলিয়ে ছিল ১৬-১৭% ! ভাবতে পারেন!! সেই থেকে আজ অগস্টের শেষে এসে ওই ২০টা জেলা - যদিও এক একটি ২-৩%র বেশি হবে না - থেকে আসছেন ৪০%র বেশি করোনা আক্রান্ত। 
ছবি ৯: মে মাস থেকে অগস্ট অবধি পশ্চিমবঙ্গের জেলায় করোনা পরিস্থিতি।  
১৮. এরকম হল কেন ? মনে করে দেখুন মে'র শেষ আর জুনের গোড়ার দিকে দেশ জুড়ে কি হয়েছিল। রোজগার, থাকার জায়গা সব হারিয়ে লক্ষ লক্ষ ক্লান্ত-শ্রান্ত শ্রমিকের ভিড় ট্রেন করে, বা কয়েকশো কিলোমিটার হেঁটে হেঁটে বাড়ি ফেরাদেশভাগের পরে এমন যন্ত্রনা এতজন ভারতবাসী সহ্য করেছেন কি না জানা নেই, তবে  বিজ্ঞানী মহল তখনই সতর্ক করেছিলেন যে করোনা এবার দূরদূরান্তে, শহর আর সদর থেকে আরো গভীরে গ্রামেগঞ্জে ছড়িয়ে পড়বে। তাছাড়া, ভুললে চলবে না , এই রাজ্যের ক্ষেত্রে আরেকটি ভয়ঙ্কর জিনিস এসেছিল - সাইক্লোন আম্ফান।  এই গ্রাফ সেই কথাই বলছে।  

১৯. অবশ্য এটাও ঠিক যে এখন অনেক জেলায় টেস্ট বেড়ে যাবার জন্যে ওখানকার রিপোর্ট বেশি আসছে (১০ই মে ছিল ১৮টি ল্যাব, আজ ২৩শে অগস্ট ৭০টি ল্যাব কাজ করছে ) . কিন্তু,  তা দিয়ে এই ১৫% থেকে ৪২% র ব্যাখ্যা  হয় না।  আর তাছাড়া, এত তো শুধু পশ্চিমবঙ্গে নয় -  কর্ণাটক, কেরল , বিহার নানা রাজ্যে একই চিত্র। যেখানেই যখন লোকজন বেশি ট্রাভেল করেছেন সেখানেই পসিটিভ বেড়েছে। এত সোজা হিসেবে - লোকডাউনের সময় তো কারুর চলাফেরার কথা নয়।এক রাজ্য থেকে অন্য রাজ্য নয়ই।  যাতায়াতই যদি হয়  তাহলে কিসের লোকডাউন? তাই, যাঁদের রোজগার বন্ধ তারা থাকা-খাওয়া-ইত্যাদির সব সরকারি সুবিধে পাবেন এটাই expected . নোবেল বিজয়ী অভিজিৎবাবু দেশকে সেই পরামর্শ দিয়েছিলেন। মানা হয়নি, আর আজ তার ফল দেখতেই পাচ্ছেন।

২০. তা সত্ত্বেও আবার বলব এখনো পশ্চিমবঙ্গের সিংহভাগ করোনাআক্রান্ত এই কলকাতা-কেন্দ্রিক ৫টি জেলার মধ্যে আছেন। দ্রুত টেস্ট বাড়িয়ে এবং কন্টাক্ট ট্রেসিং করে এখনো অন্য জেলাদের খুব উন্নত অবস্থায় নিয়ে যাওয়া যায়।  আর তাহলে ঐসব জেলার হাসপাতালের ওপরেও অনেক কম চাপ পড়বে। আর  কলকাতা এবং উত্তর ২৪ পরগনাকে আরো কি করা যায় সে বিষয়ে বিজ্ঞানীদের মতামত নিতে হবে বিশেষ করে।  সম্ভবত সারা রাজ্যে না করে শুধু এই দুটি জেলা নিয়ে কিছু বিশেষ ব্যবস্থা নিলে হয় কি?


 ২১. গতকাল একটা খবর পড়েছিলাম, সেটা দিয়েই শেষ করি। এই যে - 
 রিপোর্টে বলছে - 'শহরের ২০টি কনটেনমেন্ট জোনের মধ্যে ১৭টিই আবাসন। বাকিগুলির মধ্যে দু'টি বস্তি ও একটি ব্যক্তিগত বাড়ি রয়েছে।....কলকাতায় বর্তমানে করোনা আক্রান্তদের মধ্যে বিভিন্ন আবাসনের বাসিন্দারাই সংখ্যাগুরু, যা মোট আক্রান্তের প্রায় ৭২%। .... পুরসভা সূত্রে খবর, এর মধ্যে গত দু' সপ্তাহে বস্তি এলাকার মাত্র ১৫% মানুষ সংক্রামিত হয়েছেন। পরিসংখ্যানেই স্পষ্ট, আবাসনে আক্রান্তের সংখ্যাটা এর প্রায় পাঁচ গুণ।.... জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ অমিতাভ সরকার বলেছেন, 'বস্তির বাসিন্দারা আক্রান্ত হলেই পুরসভার সঙ্গে যোগাযোগ করছেন। ফলে রোগটা আর ছড়াতে পারছে না।' কিন্তু আবাসনের বাসিন্দাদের অনেকে রোগ লুকিয়ে সামাজিক মেলামেশা চালিয়ে যান বলে বিষয়টা উদ্বেগের হয়ে দাঁড়াচ্ছে। আর এক জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ স্বাতী নন্দী চক্রবর্তীর বক্তব্য, 'আবাসনের উপসর্গহীন বাসিন্দারা ছাদ কিংবা লিফট ব্যবহার করছেন। অসুখটা সম্পর্কে হয়তো অন্যদের জানাচ্ছেনই না! ....বস্তির বাসিন্দাদের অধিকাংশই দৈনিক মজুরির কাজে যুক্ত। সম্ভবত সেই কারণে দিন-আনা-দিন-খাওয়া এই মানুষরা বিধি মেনে চলার ব্যাপারে অনেক বেশি সাবধানী। তাই বেলগাছিয়ার বস্তিতে কিছু দিনের মধ্যে নিয়ন্ত্রণও করা গিয়েছে করোনার ভয়াল প্রকোপ। কিন্তু অভিজাত আবাসনে দেখা যাচ্ছে সম্পূর্ণ উল্টো ছবি। একে তো বাসিন্দাদের একটা বড় অংশ বেপরোয়া বলে মত বহু বিশেষজ্ঞের। অনেক সময়ে আবার তাঁরা পুরসভার লোককে বাড়ির চৌহদ্দিতে ঢুকতে পর্যন্ত দেন না। অর্থাৎ, নিজেরা তো বিধি মানেনই না, উল্টে পুরসভার কাজেও অসহযোগিতা করেন। পরিণাম যা হওয়ার তা-ই হচ্ছে।...'

 রাশি রাশি ডিগ্রী নিয়ে যদি এই হয়  .....!!! আর সবাই তো করেন না;  অনেকই  সব নিয়ম মেনে চলেন, কিন্তু যাঁরা পাকামো মেরে মানেন না তাদের জন্যেই বিপদ ছড়ায়। আমিও তো সাধারণ নাগরিক , কি আর বলতে পারি - তবে এটা সাবধান করতে পারি যে এক, সারা পৃথিবীতে অতিমারীর দ্বিতীয় ঢেউ কম বেশি শুরু হয়েছে বা হচ্ছে, আর দুই, পুজো আসছে, পূজোর ভিড় আসছে আর সর্দি-কাশি-জ্বর অসুখের মরশুম শীতকালও বেশি দূরে নেই।   

রেফারেন্স 







No comments:

Post a Comment

 স্কুল খুলুক, সঙ্গে হাওয়া বাতাস খেলুক ক্লাসঘরে ('এই সময়' সংবাদপত্রে প্রবন্ধ -  ২২শে সেপ্টেম্বর, ২০২১)      সোজাসাপ্টা অপ্রিয়   সত...