Wednesday, August 18, 2021

 ১৮ই অগস্ট ..... 

রহস্য নেই, আছে শ্রদ্ধা। 

আজাদ হিন্দ সর্বাধিনায়ক ও অফিসাররা - 
এ.সি. চ্যাটার্জি, মোঃ জমন কিয়ানি আর হাবিবুর রহমান'র সঙ্গে নেতাজি, ১৯৪৪।

'হাসান ! হাসান কোথায়?'

রাত ৮-৮.৩০. ১৮ই অগস্ট , ১৯৪৫। তাইহোকুর (আজকের তাইপেই, তাইওয়ানের রাজধানী) নানমন সামরিক হাসপাতালের ইমার্জেন্সি ওয়ার্ড।

সকালের প্লেন ক্রাশে তিন জন মারা গেছেন - পাইলট, সহকারী পাইলট আর জেনারেল শিডিআ।  আহতদের মধ্যে যিনি সবচেয়ে বেশি দগ্ধ -  যাঁকে জাপানি সৈনিকরা পরিচয় দিয়েছে, 'ইনি ফিল্ড মার্শালের থেকেও উঁচু পদাধিকারী' - সেই মহাযোদ্ধা মানুষটি তাঁর বহুদিনের সেক্রেটারিকে ডাকছেন। 

হাবিবুর রেহমান ও আহত, হাতের আঙ্গুল কিছুটা পুড়ে গেছে। তিনি, উঠে এসে বললেন,

'হাসান এখানে নেই, নেতাজি। আমি হাবিব। '

গোটা শরীর ব্যান্ডেজে ঢাকা, মাথা থেকে পা পর্যন্ত burnol র মতো মলম লাগানো, ঠোঁট ভয়ঙ্কর ভাবে  ফুলে উঠেছে, তবু অতি কষ্টে নেতাজি সুভাষ চন্দ্র বসু বললেন, 'হাবিব, আমি বুঝতে পারছি আমার সময় ফুরিয়ে আসছে  .... শেষ দিন অবধি আমি দেশের স্বাধীনতার জন্যে লড়েছি। দেশের মানুষকে বোলো যে ভারত শীঘ্রই স্বাধীন হবে '

দেশবাসীর উদ্দেশে এই তাঁর শেষ কথা।  কিছুক্ষন পর দোভাষী নাকামুরাকে বলেন, 'ঘুমোতে পারলে ভালো হয় '  , তারও কিছু পরে  ব্যাথা কমাবার জন্যে মরফিন চাইলেন। নাকামুরা বর্ণনায় আছে, 'উনি কয়েকবার 'মিজু ' শব্দটি বললেন' ( 'মিজু ', অর্থাৎ জাপানি ভাষায় জল।  অবশ্য 'মিজু ' না হয়ে 'মেজো ' বা 'মেজদা 'ও হতে পারে  ....কে জানে, বিদায়বেলায় হয়ত পিতৃপ্রতীম মেজদা শরৎ চন্দ্র বসুকে ডেকেছিলেন  ) ..... আর তারপর, ডাক্তারদের সব চেষ্টা ব্যর্থ করে, রাত ৯টা নাগাদ শরীরটা প্রচন্ড কাঁপুনি দিলো, আর তারপর একেবারে  স্থির হয়ে গেল।  সুভাষ চন্দ্র বসুর জীবনব্যাপী সংগ্রাম শেষ হলো।  হাবিবুর পাশে বসে দোয়া করলেন। হাসপাতালের জাপানি কর্মীরা নিহত যোদ্ধার স্মৃতির উদ্দেশ্যে এক বৌদ্ধ মন্ত্র পাঠ করলেন।  

নানমন সামরিক হাসপাতাল, তাইহোকু। ১৯৪৬র ছবি. এখন নতুন বাড়ি তৈরী হয়েছে। 

.....

১৫ দিন পর, নেতাজির চিতাভস্ম একটি সাদা কাপড়ে মোড়া চৌকো কাঠের বাক্সে টোকিওতে পৌঁছলো। দিন কয়েক সেটি রাখা হলো ইন্ডিয়ান ইনডিপেনডেন্স লীগের কর্ণধার রামমূর্তির বাড়িতে। আজাদ হিন্দের বাছাই করা চল্লিশজন 'টোকিও boys ' - যাদের নেতাজি সন্তানসম স্নেহ করতেন - তাঁরা পালা করে গার্ড দিলেন। আর শুরু হলো একটি জাপানি মন্দিরের খোঁজ,   যেখানে চিতাভস্ম সসম্মানে রক্ষিত থাকবে।

টোকিও শহরতলিতে ম্যহজি নামের একটি মন্দির আছে।  যুদ্ধের সময় নেতাজি সেখানে একবার প্রার্থনা-সভায় যোগ দিয়েছিলেন। তাই, সেখানেই প্রথম যাওয়া হলো।  কিন্তু , প্রধান পুরোহিত রাজি হলেন না - কারণ নেতাজি জন্মসূত্রে বিদেশী ।  একটু হতাশ হয়েই আজাদ হিন্দ ও জাপানি অফিসাররা রাস্তায় বেরিয়ে এলেন। আর তারপর ওই একই রাস্তার ওপর অবস্থিত আরেকটি মন্দির - নাম রেনকোজি মন্দির - ঢুকে পড়ে একই অনুরোধ করলেন।

রেনকোজির প্রধান পুরোহিত 'রেভারেন্ড ' মোচিজুকি এক কোথায় রাজি হয়ে গেলেন, এবং 'সুভাষ চন্দ বোস ' নাম লেখা বাক্সটি স্বসম্মানে মন্দিরের পবিত্রতম অভ্যন্তরে প্রতিষ্ঠা করলেন। ১৮ই সেপ্টেম্বর ১৯৪৫ রেনকোজিতে  বৌদ্ধ মতে 'funeral service ' হল। 

নেতাজির অস্থী গ্রহণ করে রেনকোজির পবিত্রতম 'গর্ভগৃহে' স্থাপন করেন 
প্রধান পুরোহিত রেভারেন্ড মোচিজুকি

  ....

গত ৭৬ বছর ধরে  'রেভারেন্ড ' মোচিজুকি (১৯৭৯ সালে প্রয়াত), তাঁর পুত্র (যিনি এখন মন্দিরের প্রধান পুরোহিত) এবং অন্যান্য পুরোহিতরা পরম যত্ন ও শ্রদ্ধার সঙ্গে ভারতের সেই অনন্য সন্তানকে সম্মান জানিয়ে এসেছেন। তাঁদের বিশ্বাস যে বীর যোদ্ধার বিদেহী আত্মা তাঁদের মন্দিরের সম্মানিত অতিথি। তাই, প্রতি বছর , নিয়ম করে নেতাজির জন্যে memorial service হয়।  নিহোনশু নামের একটি জাপানি পানীয় নেতাজি পছন্দ করতেন বলে সেটিও 'তাঁকে' অর্পণ করা হয়।  ভারতবাসী তাঁদের কাছে চিরঋণী। 

দেহাবসান হয়েছে, কিন্তু বীরশ্রেষ্ঠ যোদ্ধার এখনো আমাদের মন্দিরের সম্মানিত অতিথি - এই বিশ্বাস নিয়ে আজও জাপানি পুরোহিতরা নেতাজির বাৎসরিক স্মরণ করেন। 


বর্তমানে রেনকোজি মন্দিরের প্রবেশ ও অভ্যন্তর। 
গর্বগৃহে সোনার ক্যাস্কেট-র নেতাজির অস্থী (ওপরে);
বাইরে নেতাজির আবক্ষ মূর্তি (নীচে)

 বহু দশক ধরে ভারত সরকারের পররাষ্ট্র মন্ত্রক  রেনকোজি মন্দিরকে আর্থিক ভাবে সহায়তা করে এসেছেন - যাতে  নেতাজির স্মৃতি রক্ষনার্থে কোনো ত্রটি না থাকে। জাপান যাত্রা'র সময়ে নেহরু, রাজেন্দ্র প্রসাদ, ইন্দিরা, বাজপেয়ী অনেকেই মন্দিরে গিয়ে শ্রদ্ধা নিবেদন করেছেন। 


রেনকোজি মন্দিরে শ্রদ্ধা নিবেদন করছেন অটলবিহারী বাজপেয়ী (২০০১) এবং ইন্দিরা গান্ধী (১৯৭০)

একইসঙ্গে জাপানিরা বহুবার অনুরোধ করেছেন যে ভারত যেন নেতাজিকে 'ফিরিয়ে নিয়ে যায়।' নেতাজি কন্যা অনিতাও একই ইচ্ছে প্রকাশ করেছেন।

এ সব কথা উঠলে দুম করে excited হলেও বাঙালিদের এ বিষয়ে জ্ঞান সাধারণত 60 বছর পরে গঠিত মুখার্জি কমিশনের মধ্যেই সীমাবদ্ধ। কিন্তু, জানা উচিত যে একটি-দুটি নয়,  ১৯৪৫ থেকে ২০০৫ অবধি এই বিষয়ে  ১৩টি তদন্ত হয়েছে। শুধু স্বাধীন ভারত নয়, মিত্রশক্তি, ব্রিটিশ সরকার, মার্কিন সেনাবাহিনী, ইন্ডিয়ান ইন্ডেপেন্ডেন্স লীগ, জাপান সরকার, নেতাজির জীবনীকার ঐতিহাসিক লেওনার্ড গর্ডন ও সুগত বসু  এবং সাংবাদিক হারিন শাহ সবাই এ বিষয়ে তদন্ত করেছেন। 

বিশদ তথ্য দিতে হলে আলাদা প্রবন্ধ হয়ে যাবে। আর তাছাড়া এ বিষয়ে ভাল গবেষণাভিত্তিক  রচনা বেরিয়েওছে। তাই এখানে এই ১৩টি তদন্তের কথা summarize করে দিলাম। 

দেশী বিদেশী তদন্তের ফলাফল।  সব মিলিয়ে ১৩টি তদন্ত 


 

বুঝতেই পারছেন একাধিক দেশের তদন্ত'র ফলাফল দ্যার্থহীন ভাবে একই ফলাফল জানাচ্ছে। দুঃখ পেলেও মেনে নিতে হবে। জানি, এ তথ্য অত্যন্ত বেদনাদায়ক,  এবং এমন মহাজীবনের ক্ষেত্রে কেমন যেন anti climax.  আর বহু দশক ধরে নানারকম গুজব চলে আসছে( ভ্যাকসিন কাজ করছে কিনা তা নিয়ে যেমন আজকাল কতকিছু whatsappএ ভেসে আসে!)  তাই,  মেনে নেওয়া সহজ নয়। 

তবে  একটা প্রশ্ন করাই যায় -  তর্কের খাতিরে যদি ধরেও নিই যে ভারত সরকার তথ্য চাপছিল, তাহলেও কেউ বলবেন কেন ব্রিটিশ মার্কিন ও সোভিয়েতরা (এবং যুদ্ধত্তোর আমেরিকা-বন্ধু জাপান) তাদের ধুরন্ধর শত্রু নেতাজিকে বারবার খুঁজে হয়রান হয়ে 'মিথ্যে রিপোর্ট বানাবেন'? আর ৭৫ বছর পরেও বিশ্বব্যাপী সব সরকার সেই কথাই বলে চলবেন??? .... 

আর 60 বছর পরে গঠিত মুখার্জি কমিশন (ততদিনে একজন মাত্র সাক্ষী জীবিত) একমত না হলেও নতুন তথ্য পেশ করতে পারেনি, রিপোর্টে বেশ কিছু অসঙ্গতি ধরা পড়ায় গ্রাহ্য হয়নি। (বিশদে পড়তে পারেন) 

আরো কিছু তথ্য দিয়ে শেষ করি।  

১. মার্চ-২০১৬তে কেন্দ্রীয় সরকার লোকসভায় জানিয়েছেন ১৯৯৭-২০১৬র মধ্যে নেতাজি সংক্রন্ত ২৩২৪টি ফাইল  প্রকাশ করা হয়ে গেছে, আর কোন দফতরে কিছু unclassified  নেই। এর মধ্যে বহু ফাইল digitized করা হয়েছে, websiteএ গিয়ে পড়তে পারেন। 

২. ব্রিটেন, আমেরিকা, রাশিয়া সরকারি ভাবে জানিয়েছে তাদের হাতে আর কোনো ফাইল নেই।

 ৩. জাপান জানিয়েছে প্রায় সব ফল প্রকাশিত, এবং অবশিষ্ট তিনটি ফাইল তারা তাঁদের বিশ্বযুদ্ধ-সংক্রান্ত নীতি মেনে যথাসময়ে প্রকাশ করবে । উল্লেখ্য, জেনারেল শিডিআ'র মত উচ্চপদস্থ সেনাপতি যে সেদিন বিমান দুর্ঘটনায় মারা গিয়েছিলেন তা নিয়ে জাপানের কোন সন্দেহ নেই। ও দেশের সরকারি রেজিস্ট্রি তাই বলছে।

৪. ভারত আরেকবার দেখতে অনুরোধ করতে, জুলাই 2019এ রাশিয়া আবার জানিয়েছে যে তাদের archives এ আর কোন তথ্য নেই।

৫. এক ব্যক্তির RTI র জবাবে কেন্দ্রীয় সরকার পরিষ্কার জানিয়েছেন  তাঁরা তথ্য ও তদন্তের ভিত্তিতে কি বিশ্বাস করেন। এই যে  - 

২০১৭র RTIকে কেন্দ্রীয় উত্তর 

অর্থাৎ, শুধু কংগ্রেস সরকার নয়, ঘটা করে শেষ ৩০০ ফাইল প্রকাশ করে বর্তমান কেন্দ্রীয় সরকারও এ বিষয়ে একমত। বলাই বাহুল্য, এ বিষয়ে নেহরু/গান্ধী/স্তালিন'র বিরুদ্ধে অকাট্য কোন তথ্য পাওয়া গেলে অন্তত নরেন্দ্র মোদী তাঁদের ছেড়ে কথা বলতেন না ।

সব মিলিয়ে, একথা পরিষ্কার যে  'রহস্য-রোমাঞ্চর' আর কোনো স্থান নেই। কিন্তু, এমনই হতভাগ্য দেশ যে তুচ্ছ রাজনৈতিক ও পারিবারিক ডামাডোলে আর শেষ হয় না। আর তাই, যে  মহামানবকে জাপানি সেনাপতিরা 'সত্যিকারের স্যামুরাই ' ও গান্ধীজি 'prince among  patriots ' বলে অভিহিত করেছিলেন,  তাঁর অন্তিম পার্থিব চিহ্ন এখনো একটি  gold-plated casketএ রয়ে গেছেন, দূর জাপানের ছোট্ট মন্দিরে।

The last salute .   
সায়গনে অবতরণের সময়, ১৭ই অগস্ট ।পরের দিন তাইহোকু থেকে take off র কয়েক সেকেন্ড পরে  
এই মিৎসুবিশি Ki -২১ বিমানটি ভেঙে পরে।  


রেফারেন্স :

নেতাজি সংক্রান্ত একাধিক সমাদৃত বই - 

বসু বাড়ী - শিশির কুমার বসু;  His Majesty's Opponent - সুগত বসু; Nehru and Bose: Parallel Lives- রুদ্রানশু মুখোপাধ্যায়Brothers against the Raj - লিওনার্ড গর্ডন; The Forgotten Army - পিটার ফে; The Springing tiger - হিউ টয়ে; 

 National Archives of India প্রকাশিত 'Netaji files' - http://www.netajipapers.gov.in/,

https://thewire.in/history/netaji-subhas-chandra-bose-disappearnce-part-one

https://en.japantravel.com/tokyo/renkoji-temple/1231 (রেনকোজির বর্তমান ফটো)

https://thewire.in/history/netaji-subhas-chandra-bose-japan-plane-crash

Tuesday, August 3, 2021

 পশ্চিমবঙ্গের sentinel surveyর  ফলাফল  

গত মাসের মাঝামাঝি , যখন দেখা যায় যে করণের দ্বিতীয় ঢেউ বেশ কিছুটা স্থিমিত, তখন রাজ্যের স্বাস্থ মন্ত্রক ঘোষণা করেন যে তাঁরা একটি sentinel survey শুরু করবেন যাতে করোনাভাইরাস  রাজ্যের কোথায় কিভাবে কতটা ছড়াচ্ছে সে বিষয়ে বেশ কিছুটা তথ্য জানা যায়। এর ফলে আগে থেকেই তৈরী হওয়া যাবে। কোথাও অতিমারী বেড়ে ওঠার ছোট্ট প্রবণতা দেখা গেলেও সেখানে দ্রুত ব্যবস্থা নেওয়া যাবে।

সম্প্রতি সেই সার্ভে'র প্রথম দফার কিছু ফলাফল সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে। সেগুলি নিয়ে অল্প কিছু বিশ্লেষণ আপনাদের সামনে তুলে ধরতে চাই।  

ফলাফল ১: ভ্যাকসিনের সাফল্য। 

ছবি ১: সেন্টিনেল সার্ভে'র রিপোর্ট। খবরের কাগজে

সার্ভে পরিষ্কার দেখাচ্ছে যে ভ্যাকসিন কোরোনাকে আটকাতে ভালোই কাজ করছে। বর্তমান সংবাদপত্রের রিপোর্ট অনুযায়ী 'সেন্টিনাল সার্ভেতে ৪২৭৬ জন নিজেদের টিকাকরণ সংক্রান্ত তথ্য সমীক্ষাকারীদের জানিয়েছিলেন। দেখা গিয়েছিল, এই ৪২৭৬ জনের মধ্যে টিকা নেননি বলে জানান ৩৬৫৩ জন। আর টিকা নিয়েছিলেন ৬২৩ জন। টিকা না নেওয়া এই ৩৬৫৩ জনের মধ্যে কোভিড হয়েছিল ৪৩ জনের। অন্যদিকে টিকা নেওয়া ৬২২ জনের মধ্যে কোভিড হয়েছিল মাত্র একজনের। তুল্যমূল্য বিচার করে দেখা যায়, টিকা নিলে ৮৬.৪ শতাংশ প্রতিরোধী ক্ষমতার অধিকারী হচ্ছেন মানুষজন'। 

অবশ্য, এটা একেবারে  নতুন খবর নয়। ভ্যাকসিনের কার্যকারিতা নিয়ে ইতিমধ্যেই দেশে-বিদেশে একাধিক প্রমান পাওয়া গেছে। বিজ্ঞানের শ্রেষ্ঠ জার্নাল থেকে শুরু করে অনেক তথ্যসমৃদ্ধ রিপোর্টে বিভিন্ন দেশের এইসব ফলাফল প্রকাশিত হয়েছে ও নানাভাবে বিশ্লেষণ করা হয়েছে, হচ্ছে। ছোট-বড় বহু দেশের ফলাফল দেখে সন্দেহাতীত ভাবে বলা যায় যে প্রায় সব ভ্যাকসিনই গুরুতর কোভিড, icu কেস এবং মৃত্যু'র থেকে সুরক্ষা দিচ্ছে ।আমাদের দেশে ভ্যাকসিন সাপ্লাই'র হাল বেহাল হবার ফলে যদিও রাজ্যে'র বেশিরভাগ মানুষ এখনো ভ্যাকসিন পাননি, তা সত্ত্বেও ভ্যাকসিনের protective effectর একাধিক প্রমাণ পাওয়া গেছে। রাজ্যের এই latest সার্ভে সেই কথাই আবার জানাল। সোজা কথায় ভ্যাকসিন নেওয়ার তিন সপ্তাহ পর থেকে শরীরের রোগ-প্রতিরোধ ব্যবস্থা শক্তিশালী হয়ে ওঠে এবং যদিও বা বায়ুবাহিত করোনাভাইরাস শ্বাসনালি ও ফুসফুসে ঢুকে পড়ে তাহলেও সিরিয়াস অসুখ হবার সম্ভাবনা খুবই কম।  কয়েকদিন জ্বর হতে পারে, দুর্বলতা থাকতে পারে, কিন্তু শ্বাসকষ্ট ও অন্যান্য প্রাণঘাতী অসুখ নিয়ে হাসপাতালে ভর্তির সম্ভাবনা খুবই কম। 

এর থেকে এটাও স্পষ্ট যে যত দ্রুত নাগরিকদের ভ্যাকসিন দেওয়া সম্ভব হবে তত করোনা ভাইরাসের দাপট কমবে। হ্যাঁ, ভাইরাসের নতুন বংশধর ডেল্টা অনেক বেশি ছোঁয়াচে।  কিন্তু ডেল্টা আক্রমণ করলেও ভ্যাকসিন তাকে ঠেকাবে ( সামাজিক মাধ্যম ও 'শোনা কথা' ফলে  অনেকেই  বিভ্রান্ত হয়ে ভাবছেন যে ডেল্টা'র বিরুদ্ধে এই সব টিকা কাজ করবে না।  এসব দুশ্চিন্তা ডাস্টবিনে ছুঁড়ে ফেলে দিন;  গবেষণা পরিষ্কার দেখাচ্ছে ডেল্টা'র বিরুদ্ধে ভ্যাকসিন কার্যকরী।  

ভ্যাকসিন সংক্রান্ত আরেকটি কথা জানিয়ে রাখি। মনে হয়, সবার ভাল লাগবে। একদম সাম্প্রতিক গবেষণা এও দেখাচ্ছে যে এক ডোজ টিকা ও কিন্তু ৬০% র বেশি সুরক্ষা দিচ্ছে। সুতরাং, দ্বিতীয় ডোজ টিকা পেতে দেরি হলেও প্রচন্ড আতঙ্কিত হবেন না।  প্রথম ডোজ ও আপনাকে বেশ কিছুটা প্রটেকশন দিচ্ছে, এবং দেরি হলেও ওটা কাজ করতে থাকবে। 

এই প্রসঙ্গে আমাদের রাজ্যের টিকাকরণ পরিস্থিতি নিয়ে ছোট্ট করে তথ্য দিয়ে দি। 

পশ্চিমবঙ্গে ১৮-বছর-বা-তার-বেশি-বয়স এমন নাগরিকের সংখ্যা আনুমানিক ৭.২ কোটি। সেই হিসেব অনুযায়ী, ২রা অগস্ট অবধি অন্তত এক ডোজ ভ্যাকসিন পেয়েছেন ৩০%  নাগরিক। এর মধ্যে দুটি ডোজ ই পেয়ে গেছেন ১২.২% লোক।  অর্থাৎ ~১৮% এক ডোজ পেয়েছেন, এক ডোজ বাকি। বড়-জনসংখ্যা রাজ্যদের মধ্যে এই টিকাকরণ মোটামুটি ভালোই। যে কলকাতা ও উঃ ২৪ পরগণা এ রাজ্যে অতিমারীর epicentre হয়ে থেকেছে সেখানে টিকাকরণ মন্দ হয়নি। দুই জেলায়  ৫৫% নাগরিক অন্তত এক ডোজ ভ্যাকসিন পেয়েছেন।  টিকার সাপ্লাই মসৃন হলে আরো বেশি লোকজন এর মধ্যে ভ্যাকসিন পেতেন। 

অবশ্য কোন সন্দেহ নেই কলকাতা ও আশে পাশে বেশি, এবং জেলা সদরগুলিতে বেশি টিকাকরণ হয়েছে, গ্রামেগঞ্জে কম। তৃতীয় ঢেউকে ঠেকাতে হলে এই বৈষম্য দ্রুত দূর করা প্রয়োজন। 

ফলাফল ২: উপসর্গহীন করোনা-আক্রান্ত সংখ্যা 

রাজ্যে এমন কতজন আছেন যাঁরা করোনা আক্রান্ত অথচ কোন symptom নেই? এবং সেই জন্যেই তাঁরা নিজেদের অজান্তে অন্যদের মধ্যে সংক্রমণ ছড়িয়ে দিতে পারেন? সেন্টিনেল সার্ভে'র অন্যতম বড় কাজ এই দুই প্রশ্নের উত্তর খুঁজে বের করা।  


ছবি ২: sentinel survey ঘোষণা ও কর্মপরিকল্পনা 

এর জন্যে sentinel সার্ভে রাজ্যের ২৮টি হাসপাতাল short list করে প্রত্যেক হাসপাতাল থেকে ৪০০ জন COVIDর-উপসর্গ-নেই এমন রুগীর দেহ থেকে sample সংগ্রহ করে দেখেছেন যে ক'জনের কোরোনাভাইরাস আছে। ২৩টি জেলা থেকেই হাসপাতাল নেওয়া হয়েছে, যেমন  কলকাতা অঞ্চলের জন্যে  RG Kar হাসপাতালে এই কাজ হয়েছে। সবমিলিয়ে ১০ হাজারের ওপর রুগী নিয়ে এই sampling। নমুনা সংগৃহীত হয় মূলত বিভিন্ন সরকারি হাসপাতালের নন কোভিড ওয়ার্ড  যেমন—চক্ষু, অর্থোপেডিক, স্ত্রীরোগ ও প্রসূতি ইত্যাদি বিভাগ থেকে। কয়েক জন আউটডোর  patient র থেকেও নমুনা নেওয়া হয়েছে । 

ফলাফল দেখুন খবরের কাগজের রিপোর্ট থেকে (ছবি ৩)

ছবি ৩ : সংবাদ পত্রের পাতা থেকে 


এই ফলাফল ও আশাব্যঞ্জক। 'দেখা গেছে রাজ্যের উপসর্গহীন মানুষের মধ্যে গড়ে করোনা ধরা পড়েছে প্রতি ১০০ জনে ১.১ জনের।  অবশ্য, দার্জিলিং, নদীয়া, দুই মেদিনীপুর, বিষ্ণুপুর, আলিপুরদুয়ার ইত্যাদি জেলা ও স্বাস্থ্য জেলা চিন্তায় রেখেছ।'

 প্রশ্ন - এখানে কি একটা sampling bias গন্ডগোল হচ্ছে?   
অনেকেই এই দ্বিতীয় ফলাফল দেখে স্বস্তি পাবেন - যাক বাবা রাজ্যে করোনা নেই।  কিন্তু, বলতে বাধ্য হচ্ছি এই সার্ভে ' র এই second result নিয়ে একটা খটকা লাগছে।

কেন একটু ভেঙে বলি।  লক্ষ্য করুন - এক্ষেত্রে শুধু opthamology, orthopedic, gynecology & obstetrics deptএ যে patientsরা গিয়েছেন তাঁদের থেকে sample নেওয়া হয়েছে। 

আমার প্রশ্ন - সমাজের সর্বস্তরে যেসব মানুষ asymptomatic করোনা আক্রান্ত  হতে পারেন এই ৪-৫টি বিভাগে যাওয়া  রুগীরা কি তাঁদের ভাল representative? শুধু এঁদের  নমুনা সংগ্রহ কি যথেষ্ট ? 

উত্তর - সম্ভবত  না। কারণ, হাসপাতাল ডিপার্টমেন্টে তাঁরাই যান যাঁদের চোখ বা হাড়ে কোন সমস্যা হয়েছে। হয়ত  কোন  fracture হয়েছে।  এমন লোকজনের পক্ষে  কম চলাফেরা করা এবং বেশি সাবধানে থাকা স্বাভাবিক। 

একই ভাবে দেখুন,  Gynecology & obstetrics বিভাগে যে মহিলারা গেছেন তাঁরা  অনেকেই pregnant । আমাদের মত জন সচেতন রাজ্যে, যেখানে প্রসূতি ও শিশু কল্যাণ বিভাগ এমনিতেই যথেষ্ঠ সক্রিয় সেখানে মহিলারা অন্য অনেক জায়গার তুলনায় সাবধানতা অবলম্বন করেন। আর এখন, অতিমারীর দেড় বছর হতে চলল, আজকের দিনে এঁরা আরো বেশী সাবধানে থাকেন। 

বয়সও  একটা factor. হাসপাতালের চোখের বা হাড়ের ডিপার্টমেন্টে সব বয়েসের লোকজন equally যান না।  প্রসূতি বিভাগেও ও সব বয়েসের মহিলা যান না।  

সব মিলিয়ে কোথায় যেন একটা statistical sampling bias নজরে আসছে। সমাজের সর্বস্তরের পরীক্ষা যেন হচ্ছে না।  

অবশ্য, এই সার্ভে নিঃসন্দেহে প্রয়োজনীয়। বেশ কিছুটা তথ্য দিচ্ছে। তবে, এটাই যথেষ্ট নয়। সবচেয়ে বড় কথা-  যেহেতু করোনা indoor অনেক বেশী সংক্রমণ করে এবং কমবয়েশিদের মধ্যে এর প্রকোপ কম তাই তাদের মধ্যেই asymptomatic রুগীর সংখ্যা বেশি হবার সম্ভাবনা। তাই, সমাজের এই indoor working populationএ সার্ভে করা আরও দরকার - যেমন যারা AC  অফিস, ব্যঙ্ক, AC দোকান, টিউটোরিয়াল , চারদিকে ঘেরা বাজারের সঙ্গে কর্মসূত্রে যুক্ত, অথবা ধর্মীয় বা সামাজিক অনুষ্ঠানে গিয়েছিলেন,   অথবা যাঁরা রেগুলার ভিড় বাস, ট্রেন বা শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত ক্যাব বা শাটলে যাতায়াত করে থাকেন । 

এঁদের epidemiologically-relevant survey করলে তবেই সমাজের আসল করোনা-চিত্র ধরা পড়বে। না হলে কিন্তু একটা 'false negative' ব্যাপার হবার সম্ভাবনা থাকছে। মনে হচ্ছে বিপদ নেই, কিন্তু আসলে বিপদ আমাদের অজান্তে কাছেপিঠেই ঘুরঘুর করছে। প্রসঙ্গত, মনে রাখা দরকার কেরালায় যে এত করোনা আক্রান্তের সংখ্যা বাড়ছে তার একটা বড় কারণ ওঁদের সার্ভে খুব ভাল করে হচ্ছে।  

প্রশ্ন উঠতেই পারে - সেন্টিনেল সার্ভে যাঁরা প্ল্যান করলেন তাঁরা কি এই ব্যাপারটা overlook করে গেছেন? এটা বলা মুশকিল। আমার মনে হয় না যাঁরা সার্ভে করেছেন তাঁরা এই biasটা নজর করেননি। হয়ত, ইচ্ছে থাকলেও কিছু করা সম্ভব ছিল না, কারণ, সংবাদমাধ্যমের রিপোর্ট এও জানাচ্ছে যে 'বাড়ি বাড়ি গিয়ে পরীক্ষা করার পরিকাঠামো না থাকায় এবং আর্থিক সমস্যা থাকায় আপাতত হাসপাতালগুলোতে চিকিৎসাধীন রোগীদের পরীক্ষাতেই জোর দেওয়া হবে'। 

তাই নেই-মামা'র-চেয়ে-কানা-মামা সার্ভে করে ভালই করেছেন।কিন্তু, আরো আর্থসামাজিক প্রতিনিধি-ভিত্তিক সার্ভে করলে খুব ভাল হয়।  
---- ----

ছোট্ট একটা সুখবর দিয়ে শেষ করি  - বলতে পারেন ' ফলাফল ৩: সংক্রমণ যখন আশার আলো' দেয়।  

কিছুদিন আগে কলকাতার পার্ক সার্কাসে অবস্থিত 'ইনস্টিটিউট অফ চাইল্ড হেলথ' বাচ্ছাদের পরীক্ষামূলক টিকা'র তৃতীয় পর্যায়ের ট্রায়ালের জন্যে  ১২-১৮ বছর বয়সীদের ভলান্টিয়ার হিসেবে নেবার চেষ্টা করে।  একটাই শর্ত ছিল - কারুর আগে করোনা বা করোনার সিমটম থাকলে চলবে না।  সেই মতোই ৮৫ জন কে নেওয়া হয়। কিন্তু, মূল ট্রায়াল শুরু হবার আগে পরীক্ষা করতে গিয়ে দেখা যায় চমকে ওঠেন ইনস্টিটিউটের বিজ্ঞানীরা। কারণ প্রাথমিক পরীক্ষায় দেখা যায় ৮৫ জনের মধ্যে  ৪৫ জন (অর্থাৎ ৫৩%) র শরীরে আগে থেকেই রয়েছে করোনা ভাইরাস বিরোধী এন্টিবডি ! এ কি ?!!

ছবি ৪: ১২-১৮ বয়সীদের শরীরে আগে থেকেই এন্টিবডি। 


স্বাভাবিক ভাবেই এই কিশোর কিশোরীদের দিয়ে আর ভলান্টিয়ারগিরি করা যাবে না।  আগে থেকেই এন্টিবডি আছে।  কিন্তু টিকাকরণ হয়নি অথচ already শরীরে এন্টিবডি আছে তার একটাই ব্যাখ্যা হয় - এদের সবার সংক্রমণ হয়েছিল, কিন্তু উপসর্গ হীন (বা প্রায়-উপসর্গহীন) ছিল বলে এরা নিজেরা বা বাবা-মা বা বাড়িতে কেউ বুঝতেই পারেনি যে এদের asymptomatic কোভিড হয়েছিল। 

প্রসঙ্গত বলে রাখি কলকাতার এই ফলাফল সরাসরি মিলে যাচ্ছে গত সপ্তাহে প্রকাশিত জাতীয় serosurvey রিপোর্টের সঙ্গে (ছবি ৫) .  
ছবি ৫: জাতীয় সেরোসার্ভের ফলাফল। 

এতে ভাল কি আছে? অবশ্যই আছে।  কারণ দেখা যাচ্ছে বাচ্ছাদের ইনফেকশন হতে পারে, কিন্তু সিরিয়াস অসুখ প্রায় নেইই। সেই জন্যেই দুই সার্ভের হিসেবে এত এত কম বয়সী সংক্রমিত হয়েও গুরুতর অসুস্থ হয়নি।
 
এই ফলাফলও ঠিক নতুন না।  একাধিক দেশে এর প্রতক্ষ্য পরোক্ষ প্রমান পাওয়া যাচ্ছে - বাচ্ছাদের মধ্যে কোভিড সিরিয়াস কেস উল্লেখযোগ্য ভাবে কম। তবে 'তৃতীয় ঢেউ বাচ্ছাদের বেশি ক্ষতি করবে'  এই জনশ্রুতি যখন সবাইকে চিন্তায় রেখেছে তখন এই ফলাফল বেশ কিছুটা স্বস্তি দিচ্ছে বৈকি। বিজ্ঞানীরা এমন কথা অনেকদিনই বলে আসছেন।এবার আরো কিছুটা 'স্বস্তিকর' প্রমান মিলল ।

আজ এই পর্যন্ত।   ভাল থাকবেন। সবাইকে অনুরোধ রইল = মাস্ক পরবেন।  অফিস দোকান ব্যাঙ্ক মল ইত্যাদি জায়গায় জানলা-দরজা খোলা রাখবেন। 

নমস্কার। 


রেফারেন্স:

https://bengali.news18.com/news/coronavirus-latest-news/west-bengal-government-to-start-sentinel-survey-to-fight-covid-surge-rc-627321.html

https://timesofindia.indiatimes.com/city/kolkata/sentinel-survey-to-fight-covid-surge/articleshow/84421746.cms

https://bartamanpatrika.com/home?cid=13&id=308907

https://bartamanpatrika.com/home?cid=13&id=309601

https://timesofindia.indiatimes.com/city/kolkata/cov-antibodies-found-in-50-kids-screened-for-vax-trial/articleshow/84718198.cms

https://bengali.abplive.com/news/kolkata/corona-anitibody-found-in-12-to-18-years-kid-bodies-while-vaccine-trail-in-kolkata-825629



 



 স্কুল খুলুক, সঙ্গে হাওয়া বাতাস খেলুক ক্লাসঘরে ('এই সময়' সংবাদপত্রে প্রবন্ধ -  ২২শে সেপ্টেম্বর, ২০২১)      সোজাসাপ্টা অপ্রিয়   সত...