অবশ্য, এটা একেবারে নতুন খবর নয়। ভ্যাকসিনের কার্যকারিতা নিয়ে ইতিমধ্যেই দেশে-বিদেশে একাধিক প্রমান পাওয়া গেছে। বিজ্ঞানের শ্রেষ্ঠ জার্নাল থেকে শুরু করে অনেক তথ্যসমৃদ্ধ রিপোর্টে বিভিন্ন দেশের এইসব ফলাফল প্রকাশিত হয়েছে ও নানাভাবে বিশ্লেষণ করা হয়েছে, হচ্ছে। ছোট-বড় বহু দেশের ফলাফল দেখে সন্দেহাতীত ভাবে বলা যায় যে প্রায় সব ভ্যাকসিনই গুরুতর কোভিড, icu কেস এবং মৃত্যু'র থেকে সুরক্ষা দিচ্ছে ।আমাদের দেশে ভ্যাকসিন সাপ্লাই'র হাল বেহাল হবার ফলে যদিও রাজ্যে'র বেশিরভাগ মানুষ এখনো ভ্যাকসিন পাননি, তা সত্ত্বেও ভ্যাকসিনের protective effectর একাধিক প্রমাণ পাওয়া গেছে। রাজ্যের এই latest সার্ভে সেই কথাই আবার জানাল। সোজা কথায় ভ্যাকসিন নেওয়ার তিন সপ্তাহ পর থেকে শরীরের রোগ-প্রতিরোধ ব্যবস্থা শক্তিশালী হয়ে ওঠে এবং যদিও বা বায়ুবাহিত করোনাভাইরাস শ্বাসনালি ও ফুসফুসে ঢুকে পড়ে তাহলেও সিরিয়াস অসুখ হবার সম্ভাবনা খুবই কম। কয়েকদিন জ্বর হতে পারে, দুর্বলতা থাকতে পারে, কিন্তু শ্বাসকষ্ট ও অন্যান্য প্রাণঘাতী অসুখ নিয়ে হাসপাতালে ভর্তির সম্ভাবনা খুবই কম।
এর থেকে এটাও স্পষ্ট যে যত দ্রুত নাগরিকদের ভ্যাকসিন দেওয়া সম্ভব হবে তত করোনা ভাইরাসের দাপট কমবে। হ্যাঁ, ভাইরাসের নতুন বংশধর ডেল্টা অনেক বেশি ছোঁয়াচে। কিন্তু ডেল্টা আক্রমণ করলেও ভ্যাকসিন তাকে ঠেকাবে ( সামাজিক মাধ্যম ও 'শোনা কথা' ফলে অনেকেই বিভ্রান্ত হয়ে ভাবছেন যে ডেল্টা'র বিরুদ্ধে এই সব টিকা কাজ করবে না। এসব দুশ্চিন্তা ডাস্টবিনে ছুঁড়ে ফেলে দিন; গবেষণা পরিষ্কার দেখাচ্ছে ডেল্টা'র বিরুদ্ধে ভ্যাকসিন কার্যকরী।
ভ্যাকসিন সংক্রান্ত আরেকটি কথা জানিয়ে রাখি। মনে হয়, সবার ভাল লাগবে। একদম সাম্প্রতিক গবেষণা এও দেখাচ্ছে যে এক ডোজ টিকা ও কিন্তু ৬০% র বেশি সুরক্ষা দিচ্ছে। সুতরাং, দ্বিতীয় ডোজ টিকা পেতে দেরি হলেও প্রচন্ড আতঙ্কিত হবেন না। প্রথম ডোজ ও আপনাকে বেশ কিছুটা প্রটেকশন দিচ্ছে, এবং দেরি হলেও ওটা কাজ করতে থাকবে।
এই প্রসঙ্গে আমাদের রাজ্যের টিকাকরণ পরিস্থিতি নিয়ে ছোট্ট করে তথ্য দিয়ে দি।
পশ্চিমবঙ্গে ১৮-বছর-বা-তার-বেশি-বয়স এমন নাগরিকের সংখ্যা আনুমানিক ৭.২ কোটি। সেই হিসেব অনুযায়ী, ২রা অগস্ট অবধি অন্তত এক ডোজ ভ্যাকসিন পেয়েছেন ৩০% নাগরিক। এর মধ্যে দুটি ডোজ ই পেয়ে গেছেন ১২.২% লোক। অর্থাৎ ~১৮% এক ডোজ পেয়েছেন, এক ডোজ বাকি। বড়-জনসংখ্যা রাজ্যদের মধ্যে এই টিকাকরণ মোটামুটি ভালোই। যে কলকাতা ও উঃ ২৪ পরগণা এ রাজ্যে অতিমারীর epicentre হয়ে থেকেছে সেখানে টিকাকরণ মন্দ হয়নি। দুই জেলায় ৫৫% নাগরিক অন্তত এক ডোজ ভ্যাকসিন পেয়েছেন। টিকার সাপ্লাই মসৃন হলে আরো বেশি লোকজন এর মধ্যে ভ্যাকসিন পেতেন।
অবশ্য কোন সন্দেহ নেই কলকাতা ও আশে পাশে বেশি, এবং জেলা সদরগুলিতে বেশি টিকাকরণ হয়েছে, গ্রামেগঞ্জে কম। তৃতীয় ঢেউকে ঠেকাতে হলে এই বৈষম্য দ্রুত দূর করা প্রয়োজন।
ফলাফল ২: উপসর্গহীন করোনা-আক্রান্ত সংখ্যা
রাজ্যে এমন কতজন আছেন যাঁরা করোনা আক্রান্ত অথচ কোন symptom নেই? এবং সেই জন্যেই তাঁরা নিজেদের অজান্তে অন্যদের মধ্যে সংক্রমণ ছড়িয়ে দিতে পারেন? সেন্টিনেল সার্ভে'র অন্যতম বড় কাজ এই দুই প্রশ্নের উত্তর খুঁজে বের করা।
 |
ছবি ২: sentinel survey ঘোষণা ও কর্মপরিকল্পনা |
এর জন্যে sentinel সার্ভে রাজ্যের ২৮টি হাসপাতাল short list করে প্রত্যেক হাসপাতাল থেকে ৪০০ জন COVIDর-উপসর্গ-নেই এমন রুগীর দেহ থেকে sample সংগ্রহ করে দেখেছেন যে ক'জনের কোরোনাভাইরাস আছে। ২৩টি জেলা থেকেই হাসপাতাল নেওয়া হয়েছে, যেমন কলকাতা অঞ্চলের জন্যে RG Kar হাসপাতালে এই কাজ হয়েছে। সবমিলিয়ে ১০ হাজারের ওপর রুগী নিয়ে এই sampling। নমুনা সংগৃহীত হয় মূলত বিভিন্ন সরকারি হাসপাতালের নন কোভিড ওয়ার্ড যেমন—চক্ষু, অর্থোপেডিক, স্ত্রীরোগ ও প্রসূতি ইত্যাদি বিভাগ থেকে। কয়েক জন আউটডোর patient র থেকেও নমুনা নেওয়া হয়েছে ।
ফলাফল দেখুন খবরের কাগজের রিপোর্ট থেকে (ছবি ৩)
 |
ছবি ৩ : সংবাদ পত্রের পাতা থেকে
|
এই ফলাফল ও আশাব্যঞ্জক। '
দেখা গেছে রাজ্যের উপসর্গহীন মানুষের মধ্যে গড়ে করোনা ধরা পড়েছে প্রতি ১০০ জনে ১.১ জনের। অবশ্য, দার্জিলিং, নদীয়া, দুই মেদিনীপুর, বিষ্ণুপুর, আলিপুরদুয়ার ইত্যাদি জেলা ও স্বাস্থ্য জেলা চিন্তায় রেখেছ।' প্রশ্ন - এখানে কি একটা sampling bias গন্ডগোল হচ্ছে?
অনেকেই এই দ্বিতীয় ফলাফল দেখে স্বস্তি পাবেন - যাক বাবা রাজ্যে করোনা নেই। কিন্তু, বলতে বাধ্য হচ্ছি এই সার্ভে ' র এই second result নিয়ে একটা খটকা লাগছে।
কেন একটু ভেঙে বলি। লক্ষ্য করুন - এক্ষেত্রে শুধু opthamology, orthopedic, gynecology & obstetrics deptএ যে patientsরা গিয়েছেন তাঁদের থেকে sample নেওয়া হয়েছে।
আমার প্রশ্ন - সমাজের সর্বস্তরে যেসব মানুষ asymptomatic করোনা আক্রান্ত হতে পারেন এই ৪-৫টি বিভাগে যাওয়া রুগীরা কি তাঁদের ভাল representative? শুধু এঁদের নমুনা সংগ্রহ কি যথেষ্ট ?
উত্তর - সম্ভবত না। কারণ, হাসপাতাল ডিপার্টমেন্টে তাঁরাই যান যাঁদের চোখ বা হাড়ে কোন সমস্যা হয়েছে। হয়ত কোন fracture হয়েছে। এমন লোকজনের পক্ষে কম চলাফেরা করা এবং বেশি সাবধানে থাকা স্বাভাবিক।
একই ভাবে দেখুন, Gynecology & obstetrics বিভাগে যে মহিলারা গেছেন তাঁরা অনেকেই pregnant । আমাদের মত জন সচেতন রাজ্যে, যেখানে প্রসূতি ও শিশু কল্যাণ বিভাগ এমনিতেই যথেষ্ঠ সক্রিয় সেখানে মহিলারা অন্য অনেক জায়গার তুলনায় সাবধানতা অবলম্বন করেন। আর এখন, অতিমারীর দেড় বছর হতে চলল, আজকের দিনে এঁরা আরো বেশী সাবধানে থাকেন।
বয়সও একটা factor. হাসপাতালের চোখের বা হাড়ের ডিপার্টমেন্টে সব বয়েসের লোকজন equally যান না। প্রসূতি বিভাগেও ও সব বয়েসের মহিলা যান না।
সব মিলিয়ে কোথায় যেন একটা statistical sampling bias নজরে আসছে। সমাজের সর্বস্তরের পরীক্ষা যেন হচ্ছে না।
অবশ্য, এই সার্ভে নিঃসন্দেহে প্রয়োজনীয়। বেশ কিছুটা তথ্য দিচ্ছে। তবে, এটাই যথেষ্ট নয়। সবচেয়ে বড় কথা- যেহেতু করোনা indoor অনেক বেশী সংক্রমণ করে এবং কমবয়েশিদের মধ্যে এর প্রকোপ কম তাই তাদের মধ্যেই asymptomatic রুগীর সংখ্যা বেশি হবার সম্ভাবনা। তাই, সমাজের এই indoor working populationএ সার্ভে করা আরও দরকার - যেমন যারা AC অফিস, ব্যঙ্ক, AC দোকান, টিউটোরিয়াল , চারদিকে ঘেরা বাজারের সঙ্গে কর্মসূত্রে যুক্ত, অথবা ধর্মীয় বা সামাজিক অনুষ্ঠানে গিয়েছিলেন, অথবা যাঁরা রেগুলার ভিড় বাস, ট্রেন বা শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত ক্যাব বা শাটলে যাতায়াত করে থাকেন ।
এঁদের epidemiologically-relevant survey করলে তবেই সমাজের আসল করোনা-চিত্র ধরা পড়বে। না হলে কিন্তু একটা 'false negative' ব্যাপার হবার সম্ভাবনা থাকছে। মনে হচ্ছে বিপদ নেই, কিন্তু আসলে বিপদ আমাদের অজান্তে কাছেপিঠেই ঘুরঘুর করছে। প্রসঙ্গত, মনে রাখা দরকার কেরালায় যে এত করোনা আক্রান্তের সংখ্যা বাড়ছে তার একটা বড় কারণ ওঁদের সার্ভে খুব ভাল করে হচ্ছে।
প্রশ্ন উঠতেই পারে - সেন্টিনেল সার্ভে যাঁরা প্ল্যান করলেন তাঁরা কি এই ব্যাপারটা overlook করে গেছেন? এটা বলা মুশকিল। আমার মনে হয় না যাঁরা সার্ভে করেছেন তাঁরা এই biasটা নজর করেননি। হয়ত, ইচ্ছে থাকলেও কিছু করা সম্ভব ছিল না, কারণ, সংবাদমাধ্যমের রিপোর্ট এও জানাচ্ছে যে 'বাড়ি বাড়ি গিয়ে পরীক্ষা করার পরিকাঠামো না থাকায় এবং আর্থিক সমস্যা থাকায় আপাতত হাসপাতালগুলোতে চিকিৎসাধীন রোগীদের পরীক্ষাতেই জোর দেওয়া হবে'।
তাই নেই-মামা'র-চেয়ে-কানা-মামা সার্ভে করে ভালই করেছেন।কিন্তু, আরো আর্থসামাজিক প্রতিনিধি-ভিত্তিক সার্ভে করলে খুব ভাল হয়।
---- ----
ছোট্ট একটা সুখবর দিয়ে শেষ করি - বলতে পারেন ' ফলাফল ৩: সংক্রমণ যখন আশার আলো' দেয়।
কিছুদিন আগে কলকাতার পার্ক সার্কাসে অবস্থিত 'ইনস্টিটিউট অফ চাইল্ড হেলথ' বাচ্ছাদের পরীক্ষামূলক টিকা'র তৃতীয় পর্যায়ের ট্রায়ালের জন্যে ১২-১৮ বছর বয়সীদের ভলান্টিয়ার হিসেবে নেবার চেষ্টা করে। একটাই শর্ত ছিল - কারুর আগে করোনা বা করোনার সিমটম থাকলে চলবে না। সেই মতোই ৮৫ জন কে নেওয়া হয়। কিন্তু, মূল ট্রায়াল শুরু হবার আগে পরীক্ষা করতে গিয়ে দেখা যায় চমকে ওঠেন ইনস্টিটিউটের বিজ্ঞানীরা। কারণ প্রাথমিক পরীক্ষায় দেখা যায় ৮৫ জনের মধ্যে ৪৫ জন (অর্থাৎ ৫৩%) র শরীরে আগে থেকেই রয়েছে করোনা ভাইরাস বিরোধী এন্টিবডি ! এ কি ?!!
 |
ছবি ৪: ১২-১৮ বয়সীদের শরীরে আগে থেকেই এন্টিবডি। |
স্বাভাবিক ভাবেই এই কিশোর কিশোরীদের দিয়ে আর ভলান্টিয়ারগিরি করা যাবে না। আগে থেকেই এন্টিবডি আছে। কিন্তু টিকাকরণ হয়নি অথচ already শরীরে এন্টিবডি আছে তার একটাই ব্যাখ্যা হয় - এদের সবার সংক্রমণ হয়েছিল, কিন্তু উপসর্গ হীন (বা প্রায়-উপসর্গহীন) ছিল বলে এরা নিজেরা বা বাবা-মা বা বাড়িতে কেউ বুঝতেই পারেনি যে এদের asymptomatic কোভিড হয়েছিল।
প্রসঙ্গত বলে রাখি কলকাতার এই ফলাফল সরাসরি মিলে যাচ্ছে গত সপ্তাহে প্রকাশিত জাতীয় serosurvey রিপোর্টের সঙ্গে (ছবি ৫) .
ছবি ৫: জাতীয় সেরোসার্ভের ফলাফল।
এতে ভাল কি আছে? অবশ্যই আছে। কারণ দেখা যাচ্ছে বাচ্ছাদের ইনফেকশন হতে পারে, কিন্তু সিরিয়াস অসুখ প্রায় নেইই। সেই জন্যেই দুই সার্ভের হিসেবে এত এত কম বয়সী সংক্রমিত হয়েও গুরুতর অসুস্থ হয়নি।
এই ফলাফলও ঠিক নতুন না। একাধিক দেশে এর প্রতক্ষ্য পরোক্ষ প্রমান পাওয়া যাচ্ছে - বাচ্ছাদের মধ্যে কোভিড সিরিয়াস কেস উল্লেখযোগ্য ভাবে কম। তবে 'তৃতীয় ঢেউ বাচ্ছাদের বেশি ক্ষতি করবে' এই জনশ্রুতি যখন সবাইকে চিন্তায় রেখেছে তখন এই ফলাফল বেশ কিছুটা স্বস্তি দিচ্ছে বৈকি। বিজ্ঞানীরা এমন কথা অনেকদিনই বলে আসছেন।এবার আরো কিছুটা 'স্বস্তিকর' প্রমান মিলল ।
আজ এই পর্যন্ত। ভাল থাকবেন। সবাইকে অনুরোধ রইল = মাস্ক পরবেন। অফিস দোকান ব্যাঙ্ক মল ইত্যাদি জায়গায় জানলা-দরজা খোলা রাখবেন।
নমস্কার।
রেফারেন্স:
https://bengali.news18.com/news/coronavirus-latest-news/west-bengal-government-to-start-sentinel-survey-to-fight-covid-surge-rc-627321.html
https://timesofindia.indiatimes.com/city/kolkata/sentinel-survey-to-fight-covid-surge/articleshow/84421746.cms
https://bartamanpatrika.com/home?cid=13&id=308907
https://bartamanpatrika.com/home?cid=13&id=309601
https://timesofindia.indiatimes.com/city/kolkata/cov-antibodies-found-in-50-kids-screened-for-vax-trial/articleshow/84718198.cms
https://bengali.abplive.com/news/kolkata/corona-anitibody-found-in-12-to-18-years-kid-bodies-while-vaccine-trail-in-kolkata-825629
.
No comments:
Post a Comment