Friday, June 25, 2021

সুভাষ - হিটলার স্বাক্ষাৎ - গল্প নয়, ইতিহাস কি বলছে? 

(হিটলারের সোভিয়েত ইউনিয়ন আক্রমণের ৮০তম বর্ষ উদযাপিত হচ্ছে কারণ সেটা হয়ে দাঁড়িয়েছিল নাৎসি জার্মানির শেষের শুরু। এই প্রসঙ্গে নেতাজি সুভাষ চন্দ্র বসুর মতামত বেশ ইন্টারেস্টিং। নানা প্রতিকূলতার মধ্যেও তাঁর রাজনৈতিক প্রজ্ঞার পরিচয় দেয় )

২৯শে মে, ১৯৪২। বার্লিন। রাইখ চ্যান্সেলারি (জার্মানির সর্বাধিনায়কের দপ্তর)।

এডলফ হিটলারের সঙ্গে সুভাষ চন্দ্র বসু'র  প্রথম ও শেষ সাক্ষাৎ। এক বছরের বেশি সময় ধরে সুভাষ দেখা  করতে চেয়েছেন। সত্যি বলতে কি (বাঙালিরা হয়তো মনঃক্ষুন্ন হবে  যাবে জেনেও লিখছি ) হিটলার খুব একটা গা করেনি। কেনই বা করবে? সাহায্য তো চাইতে গেছেন সুভাষচন্দ্র , হিটলার তো নয়।  ইউরোপ জয়ী কে? হিটলার , সুভাষচন্দ্র তো নন।

আর  তাছাড়া, হিটলারের racist ইডিওলজিতে ভারতীয়দের কোনো ভাল স্থান  নেই।হিটলারের লেখা বই, ভাষণ শুধু ইহুদি নয়, স্লাভিক, এশিয়াটিক, আফ্রিকানদের প্রতি বিদ্বেষে ভরা।   ব্রিটেনের সঙ্গে যুদ্ধে জড়িয়ে পড়লেও হিটলার এখনো মনেপ্রাণে বিশ্বাস করে যে ভারত, এশিয়া ও আফ্রিকার কালো আদমিদের জন্যে শেতাঙ্গ শাসনিই ভালো - সে ইংরেজ হোক বা জার্মান।

সুভাষচন্দ্র ঘটনাচক্রে ওখানে গিয়ে পড়েছেন বলে নাৎসিরা কিছু সাহায্য করেছে - আজাদ হিন্দ কেন্দ্র  স্থাপিত হয়েছে আজাদ হিন্দ রেডিও সম্প্রচার করছে , ইন্ডিশ লিজিওন গঠিত হয়েছে (যদিও নেতাজি'র অনেক চেষ্টা সত্ত্বেও ~১৭০০০ ভারতীয়  যুদ্ধবন্দীর মধ্যে মাত্র ৪০০০ যোগ দিয়েছে) . বলতে পারেন, নাৎসিরা সুভাষকে হাতে রেখেছেন, যদি ওদের  কাজে আসতে পারেন।   কিন্তু, সুভাষচন্দ্র মূল চেষ্টা ছিল এই  যে ১) স্বাধীন ভারতের অস্থায়ী  সরকারকে হিটলার আনুষ্ঠানিক সীকৃতি দেবে, ২) সেই অস্থায়ী সরকারের ফৌজ জার্মান ও রুশ সেনাবাহিনীর সহায়তায় আফগানিস্তান দিয়ে উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশে প্রবেশ করবে।  সেই ব্যাপারে কাজ খুব একটা এগোয়নি। 

দুঃখের বিষয়, জার্মানি পৌঁছোবার কয়েক মাস পরেই যখন সুভাষ জানতে পারেন যে  হিটলার সোভিএট্ ইউনিয়ন আক্রমন করেছে তখনই তিনি বোঝেন যে আফগানিস্তান দিয়ে তাঁর ঢোকার রাস্তা বন্ধ (নাৎসিরা  লাল ফৌজের ওপর বিজয় নিয়ে নিশ্চিত হলেও ইতিহাস ও রাজনীতির অসাধারণ ছাত্র সুভাষ বুঝতে ভুল করেননি সোভিয়েতরা জার্মানির নাক রগড়ে দেবে !). তাই প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই তিনি জার্মানি ছাড়তে চেয়েছিলেন।  যদি জাপানিদের কাছে যাওয়া যায়।   কিন্তু ঠিকঠাক ব্যবস্থা কিছুতেই হয়নি।  
সুভাষ অবশ্য বসে থাকার পাত্র নন; নানা ভাবে চেষ্টা করে যাচ্ছেন। 

আর তার সঙ্গে এখনো চেষ্টা করছেন সেই ১ নম্বর  - স্বাধীন ভারতের অস্থায়ী  সরকারকে হিটলাররের সীকৃতি। হিটলার দিলেই ইতালি জাপান আর ওদের স্যাটেলাইট দেশগুলি দেবে। 
এবং এই দুই কারণেই - জাপান যাত্রার ব্যবস্থা, আর সরকারকে স্বীকৃতি - জন্যেই আজ হিটলারের সঙ্গে দেখা করতে আসা।  

সুভাষের সঙ্গী দুই বিস্বশ্ত NG স্বামী আর আবিদ হাসান। আর আছেন জার্মান কূটনৈতিক  (ও সুভাষের বন্ধু) আদাম ভন ট্রট, যিনি আজ দোভাষীও বটে ।  জার্মান পক্ষে হিটলার ছাড়া উপস্থিত পররাষ্ট্রমন্ত্রী রিববেনট্রপ এবং সেক্রেটারি কেপলার।  

(হোয়াটসাপে এই সাক্ষাৎ নিয়ে একটা নাটকীয় গাঁজা ঘুরে বেড়ায়। ধ্যাত! ) 

বার্লিনে নেতাজি ও হিটলারের মিটিং। ২৯শে মে, ১৯৪২। পাশে ভন ট্রট। 

যাই হোক, সেই বিখ্যাত ছবি তোলার পরে আলোচনা শুরু।  

সুভাষচন্দ্রই সাহায্যপ্রাথী। তাই হয়তো একটু রং চড়িয়েই হিটলারকে 'সিনিয়র বিপ্লবী ' বলে শুরু করেছিলেন।  তার ফল হল কেলেঙ্কারি। বাতেলা মারার সুযোগ পেয়ে হিটলার একটা লম্বা বক্তৃতা দিয়ে দিলো - যুদ্ধ নিয়ে , পররাষ্ট্রনীতি নিয়ে, রাশিয়ানদের গালাগাল দিয়ে , ভারতের কি করা উচিত , সুভাষের কি করা উচিত - এক  গাদা !!!  আর এদিকে যে সুভাষচন্দ্র  বন্ধু দিলীপ রায়ের সঙ্গে, গান্ধীজির সঙ্গে, জওহরলাল'র সঙ্গে, এমনকি গুরু চিত্তরঞ্জনের সঙ্গে তর্ক-আলোচনা  করেছেন তাঁর গা জ্বলে গেছে এসব একতরফা  বকবক শুনতে শুনতে। কিন্তু, কি করা!  ট্রট আবার ইশারা করে বলছেন - কোনো কথা নয়।  বকছে , বকতে দাও।  

যাই হোক, ঝাড়া অনেকক্ষন জ্ঞান দিয়ে হিটলার একটু থামতে সুভাষ স্বীকৃতির কথাটা আবার তুললেন। 
হিটলার ঠিক সরাসরি উত্তর দিল না।তবে ঘুরিয়ে যা বলল তার মানে দাঁড়ায়  - না, দেব না, কারণ দেবার কোনো মানে হয় না ।  যদি আমার ফৌজ ভারতের দোরগোড়ায় থাকতো তাহলে আপনাদের স্বীকৃতি দেওয়ার মানে হয়।  আপনাদের দেশে একটা আলোড়ন হতে পারে যেটা  আমাদের লড়াইয়ে কাজ দেবে। কিন্তু, কোথায় আমার ফৌজ আর কোথায় ভারত।এখন দিলে  শুধুমাত্র লোকদেখানো হবে....একটু অপেক্ষা করুন। সোভিয়েতদের  কয়েক মাস পরেই হারিয়ে দেব।  তখন আমরা ভারতের অনেক কাছাকাছি। 

হতাশ হলেও সুভাষচন্দ্র এসব গ্যাস খাওয়ার পার্টিই নন।  উপস্থিত সবাইকে অবাক করে বলে দিলেন, 'সময়ই বলবে আপনারা সোভিয়েটদের কত তাড়াতাড়ি হারাতে পারবেন। ...আর আমার মতে , একসঙ্গে পূর্ব ও পশ্চিম দুই ফ্রন্টে লড়াই করে আপনি ঠিক করছেন না।' 

হিটলারের মুখের ওপর এমন কথা কেউ বলেছে কিনা জানা নেই, তবে হিটলার কথাটা সেদিন খুব একটা পাত্তা দেয়নি। 

সুযোগ পেয়ে সুভাষ আরেকটা বোমা ঝেড়ে দিলেন। বললেন, 'আপনার বই মেইন ক্যাম্পফ'এ আপনি ভারতীয়দের 'দুর্বল, মেনিমুখো, অহিংস ' বলে তাচ্ছিল্য  করেছেন। এ আবার কি - আপনি কি ভারত সম্পর্কে কিছুই জানেন না ? ' 

মুখের ওপর এরকম সমালোচনা শুনে হয়তো অবাক হলেও হিটলার এটাও তেমন গায়ে মাখল না।  একটু পাশ কাটিয়ে বললো, 'আরে , আমি বলছিলাম আপনাদের দেশের অহিংস আন্দোলন যেন জার্মানিতে না হয়...'

যাই হোক, হিটলার নিজের আসল কথাটা ভোলেনি। শয়তান হলেও পোড়খাওয়া রাজনৈতিক।  সুভাষ এরপর যখন ভারতের কাছাকাছি জাপানে যেতে চাইলেন, হিটলার বললেন, 'নিঃশ্চই ব্যবস্থা হবে' 
সুভাষ বললেন - একটা প্লেনের ব্যবস্থা করে দিন'.

হিটলার বললো   - না, প্লেনে যাবার বোকামি করবেন না. কোথায় শত্রু গুলি করে নামবে।  আপনার জীবনের দাম অনেক।  প্লেন নয় , আমি সাবমেরিন (জার্মান ভাষায় U-boat ) দিচ্ছি। আপনি ভাস্কো দা গামার সেই পুরোনো রুট দিয়ে যান - তবে সমুদ্রের তোলা দিয়ে।  

মিটিংয়ের মোটামুটি এই শেষ।  

২ বছর ঝুলিয়ে রেখে নাৎসিরা সুভাষচন্দ্রকে তেমন কিছুই সাহায্য করলো না (তাঁর চেষ্টার শেষ নেই)।  
আর ঐতিহাসিকের দিক থেকে দেখতে গেলে  হিটলার অত  ঘুরিয়েপেঁচিয়ে বকবক করে বললেও যা বলেছিলো ঠিক বলেছিলো। নাৎসিদের স্বার্থ আর পরাধীন ভারতের স্বার্থ তো এক নয়। ( শত্রুর শত্রু  'বন্ধু' হতেও পারে আবার 'অল্প চেনাশোনাও' হতে পারে, তাই না?)   

তবে, সুভাষের সাহসী সমালোচনা শুনেও যে রেগে যায়নি সেটা আমাদের একটু সৌভাগ্যই বলতে হবে।  
সেই মিটিং আজ আমাদের favourite ইতিহাস। তবে, সুভাষের নিজের সে  মিটিং খুব একটা পছন্দ হয়নি। স্বাভাবিক।  তাই হিটলারের দপ্তরের বাইরে অপেক্ষারত স্বামী ও হাসান যখন জিজ্ঞেস করেন, 'নেতাজি, কেমন দেখলেন? হিটলার ব্যাটা বললো কি?' সুভাষ একটু রেগেমেগেই বলেন 'একটা বদ্ধ পাগল। আমাদের আফগানিস্তানের ইপির ফকিরের মত।  নিজেই বকে যায়, সামনের জন কি বললো শোনেই না....এর সঙ্গে ৫ মিনিটের বেশি কথা বলা যায় না কি??!!'

রেফারেন্স 

Brothers against the Raj - Leonard Gordon

His Majesty's Opponent - Sugata Bose

গত বছর এই লেখাটি লিখে হোয়াটসাপে বন্ধুদের পাঠিয়েছিলাম। এখান ব্লগে দিলাম। তিহাসের এই ছোট্ট খবরটি ভালো লাগলে, নতুন লাগলে শেয়ার করবেন।

3 comments:

 স্কুল খুলুক, সঙ্গে হাওয়া বাতাস খেলুক ক্লাসঘরে ('এই সময়' সংবাদপত্রে প্রবন্ধ -  ২২শে সেপ্টেম্বর, ২০২১)      সোজাসাপ্টা অপ্রিয়   সত...