Sunday, September 6, 2020

 পশ্চিমবঙ্গে করোনা কি সত্যিই একটু বাগে এল? না কি ....?

১. কয়েকদিন ধরে খবরের কাগজে রিপোর্ট হচ্ছে যে পশ্চিমবঙ্গের করোনা পরিস্থিতিতে বেশ কিছু উন্নতি দেখা গেছে। বেশি সংখ্যায় লোকজন সুস্থ হয়ে ফিরছেন, আক্রান্তের মধ্যে মৃত'র হারও হ্রাস পেয়েছে, আক্রান্ত বৃদ্ধির হার কমেছে ইত্যাদি।

২. এত মাস নানা ভাবে সংগ্রাম আর ক্ষয়ক্ষতির পরে এ সব খবর শুনলে মনে-প্রাণে-কানে আরাম লাগে।হাসপাতালে ভর্তি বেশি শতাংশ রুগী সুস্থ হয়ে উঠছেন এতে কোন সন্দেহ নেই এবং আগেও বলেছি যে ডাক্তার-নার্স-স্বাস্থ কর্মী সবার প্রচেষ্টায় তা সম্ভব হয়েছে। তবে, যেহেতু ফেলুদা শিখিয়েছে যে সব কিছু ভেরিফাই করে নিতে হয়, তাই সরকারি স্বাস্থ বুলেটিন যে সব তথ্য আছে সেগুলির দিকে ছোট্ট করে নজর দেওয়া যাক।

৩. ছবিটা দেখুন। রাজ্যের ২৩টি জেলায় করোনার প্রাদূর্ভাব।যে জেলার যত গাঢ় রং সেখান থেকে তত বেশি আক্রান্ত।    লক্ষ্য করুন শুরু থেকে গতকাল  ৪ঠা সেপ্টেম্বর অবধি হিসেবে ধরলে কলকাতা + হাওড়া + দুই ২৪ পরগণা + হুগলি থেকে এসেছেন রাজ্যের টোটাল আক্রান্তের ৬৪%। তার মানে অতিমারীর শুরুর সাড়ে পাঁচ মাস পরেও এখনো covid-আক্রান্ত  এসেছেন মূলত কলকাতা এবং তার সংলগ্ন ৪টি জেলা থেকে।


৪. আরো বিশদ ভাবে জেলাভিত্তিক তথ্য দেখতে হলে তলার টেবিল দেখুন। দেখতেই পারছেন, অন্য ১৯টি জেলা থেকে এখনো ২-৩%'র  বেশি আক্রান্ত আসেননি। তার মানে, এখনো (হ্যাঁ এখনো) দক্ষিণবঙ্গের এই অঞ্চলে (ওপরের ছবিতে সার্কেলের মধ্যে) করোনাকে পরাস্ত করতে পারলে রাজ্য বেশ কিছুটা বিপদমুক্ত হবে।  
৫. অবশ্য এই সময় দ্রুত কমে আসছে। পশ্চিমবঙ্গের ক্ষেত্রে জুন মাস গোড়া  অবধি কলকাতা+ হাওড়া+ উত্তর ২৪ পরগণা এই তিন জেলা থেকে এসেছিলেন ৮০% আক্রান্ত। আজ সেই % নেমে গেছে ৬০%র কাছাকাছি , কারন অল্প অল্প করেও বাকি জেলায় করোনা slow but steady বেড়ে চলেছে। এ রাজ্য অবশ্য ব্যতিক্রম কিছু না।  দেশের অন্যান্য অংশের মত করোনার থাবা বড় শহর (দিল্লী, মুম্বাই, ব্যাঙ্গালোর, চেন্নাই, আহমেদাবাদ, কলকাতা, হায়দরাবাদ, পাটনা, চন্ডিগড়। ...) দূরদূরান্তের জেলা ও গ্রামে গঞ্জে ছড়িয়ে পড়ছে। এ বিষয়ে কোন সন্দেহ নেই। এই যে- এই অতিমারীর সময়ে বেশ নির্ভরযোগ্য দুই সোর্স থেকে নেওয়া ছবি।  

৬. রাজ্যের পরিস্থিতিতে ফিরে আসি। অগস্টের আরেকটা তথ্য পূর্ণ ছবি দেখাই।  এই দেখুন, ২৪শে অগস্ট থেকে ৪ঠা সেপ্টেম্বর - অর্থাৎ গত দশ দিনে করোনা আক্রান্তের বৃদ্ধির হার।  ২৩টি জেলায়। 

দেখাই যাচ্ছে যে কলকাতা, হাওড়া, দক্ষিণ ২৪ পরগণা হুগলি, মুর্শিদাবাদ, দুই দিনাজপুর, দার্জিলিং এবং কালিম্পঙের রোগ বৃদ্ধির হার কমতির পথে। আবার টোটাল আক্রান্তের সংখ্যায় প্ৰধান চার জেলার থেকে অনেক কম হলেও, আলিপুরদুয়ার, কুচবিহার, পুরুলিয়া, পশ্চিম মেদিনীপুর, বীরভূম, নদীয়া এবং পশ্চিম বর্ধমানের আক্রান্ত-বৃদ্ধির হার (১০দিনের হিসেব) রাজ্যের গড় বৃদ্ধির (২৩%) থেকে যথেষ্ঠ বেশি। মানে, দ্রুত আরো ব্যবস্থা না হলেই দুম করে রোগ ফেটে পড়তে পারে! 

৭. অবশ্য, সবই যে দুরাশা তা নয় ।  এই দশ দিনের আগের দশ দিনের (১৪ই থেকে ২৪শে অগস্ট) হিসেবের সঙ্গে মিলিয়ে দেখুন (তলার টেবিল) । অধিকাংশ জেলায় আক্রান্ত-বৃদ্ধির হার কমেছে। ব্যতিক্রম কুচবিহার, পুরুলিয়া, আলিপুরদুয়ার, বীরভূম এবং (অল্প হলেও) নদীয়া।   রাজ্যের ও সার্বিক বৃদ্ধি ২৮.৫ % থেকে ২৩.১% এ নেমেছে। ভাল। আরো আছে - গত দু মাস রাজ্যের তিন জেলা - কলকাতা, হাওড়া আর উত্তর চব্বিশ পরগণা দেশের top-50 করোনা আক্রান্ত জেলার মধ্যে ছিল।  এই প্রথম হাওড়া সেই লিস্ট থেকে নেমে গেল।  হাওড়া প্রশাসন ও নাগরিক সবার প্রশংসা প্রাপ্য।  

৮. অবশ্য, এই সব ফলাফল আরো যথাযত হত যদি কোন জেলায় কত টেস্ট হয়েছে সেটা জানা যেত। গোটা রাজ্যে কত টেস্ট হচ্ছে সেই হিসেব বুলেটিনে আছে, কিন্তু প্রতিটি জেলার হিসেব আলাদা আলাদা করে দেওয়া নেই।  একমাত্র সেটা জানা থাকলেই জেলাভিত্তিক কটা-টেস্ট-করে-কটা-পসিটিভ সেই হিসেব পাওয়া যায়।   কিন্তু, সে প্রয়োজনীয় তথ্য বুলেটিনে নেই, তাই হিসেবে আনতে পারছি না। 

৯. তবে, যাই হোক, এই দেখে আনন্দ হওয়া স্বাভাবিক। কিন্তু, এখানে একটা 'কিন্তু' রয়ে যাচ্ছে।  সেটা হল এই - জুলাই মাসের শেষ থেকে রাজ্যে  এন্টিজেন টেস্ট শুরু হয়েছে। rapid antigen test. এবং সারা মাস জুড়ে এই টেস্ট'র সংখ্যা লাগাতার বেড়েছে।  যেমন, ২রা অগস্ট সব টেস্টের ৯% ছিল এন্টিজেন টেস্ট ; বাকি RT-PCR. আর অগস্টের শেষ সপ্তাহ থেকে আজ ৫ই সেপ্টেম্বর অবধি সেটা হয়ে দাঁড়িয়েছে ৫০%র এদিক ওদিক। পরের টেবিল দেখুন। 

১০. অবশ্য, এমন নয় যে RT-PCR টেস্ট কমে গেছে। না, বরং সেও বেড়েছে। তবে আপেক্ষিক ভাবে এন্টিজেন টেস্ট বেড়েছে বেশি।  তার মানে, করোনায় কজন আক্রান্ত সেটা বুঝতে রাজ্য এখন এন্টিজেন টেস্টের ওপর আগের তুলনায় অনেক বেশি নির্ভরশীল।  

১১. তাতে কি হয়েছে ? দেখুন, এখানে একটু বিজ্ঞানের খুঁটিনাটি এসে পড়বে। কিন্তু, সেটা যথাসম্ভব কমিয়ে বললে মোদ্দা কথা হল এই - এন্টিজেন টেস্ট দ্রুত কাজ করে এবং করাও সহজ। যাঁদের মোটামুটি ভালভাবে সিমটম দেখা গেছে তাঁদের সত্যি covid হয়েছে কিনা দ্রুত বুঝতে সারা পৃথিবীতে ব্যবহার হচ্ছে।  কিন্তু, এন্টিজেন টেস্ট অতটা নির্ভূল নয়।  ভুল হবার চান্স বেশি।  ঠিকঠাক করে করলে RT-PCR ৯৫% সময় ঠিক উত্তর দেয়, আর এন্টিজেন টেস্ট হয়ত দেয় ৭০-৭৫% . 

১২. বিশেষত যাঁরা আক্রান্ত অথচ সিমটম তত প্রকট নয় তাঁদের অনেককে  এন্টিজেন টেস্ট করলে ভুল আসবে।  কারণ এই টেস্ট তখন অনেক সময় পসিটিভিকে চিনতে না পেরে বলবে 'এ তো নেগেটিভ' . বিজ্ঞানের পরিভাষায় একে বলে false negative. 

১৩. তার মানে এই নয় যে এন্টিজেন টেস্ট বাজে? না না, এই টেস্ট অবশ্যই দরকার।  কিন্তু, কোন দেশ বা রাজ্য যদি এন্টিজেন টেস্টের ওপর খুব বেশি নির্ভরশীল হয়ে পড়ে তখন চান্স আছে অনেক বেশি false negative হবার। এবং যেহেতু সেই আক্রান্তরা অসুখ হয়েছে না জেনে দিব্বি ঘুরে বেড়াচ্ছেন রোগ আরো ছড়িয়ে পড়তে বাধ্য।  এইটাই হচ্ছে গন্ডগোল। 

১৪. আগের ব্লগে লিখেছিলাম যে দিল্লী জুলাই মাস থেকে এন্টিজেন টেস্টের ওপর বেশি নির্ভরশীল হয়ে পড়েছিল। তখনই অনেকে সাবধান করেছিলেন যে আপাতদৃষ্টিতে মনে হচ্ছে আক্রান্তের সংখ্যা কমেছে, আসলে তা নাও হতে পারে। হয়েছেও তাই।  এই দেখুন।  পরিসংখ্যানবিদ রিজো জনের গ্রাফ। কিরকম আবার বাড়ছে দিল্লীর covid !!! আমি sure কেউ চান না যে আমাদের এখানে এই হাল হোক।  
https://twitter.com/RijoMJohn/status/1301522646924894210/photo/1

১৫. একই কথা শোনা যাচ্ছে বিহার, উত্তর প্রদেশ, কর্ণাটক ইত্যাদি রাজ্যের ক্ষেত্রে। এ বেশ চিন্তার ব্যাপার। পশ্চিমবঙ্গকে এই ব্যাপারে খুব সতর্ক থাকতে হবে। এন্টিজেন টেস্ট হচ্ছে হোক, কিন্তু covid পরীক্ষার কষ্টিপাথর হল   RTPCR. ওতে ঢিলে দিলে চলবে না। ও আরো অনেক বাড়াতে হবে।  

১৬. এবং এখানেই চিন্তা। কারণ পরের টেবিল দেখুন।  অগস্ট মাসে একদিকে যেমন এন্টিজেন টেস্ট বেড়েছে তেমনই যেন কমেছে কটা-টেস্ট-করে-কটা-পসিটিভ হল। এর দুটো মানে হতে পারে।  এক, অগস্টে সত্যিই কমেছে আক্রান্তের সংখ্যা। দুই, এন্টিজেন টেস্টের ফাঁকে অনেক পসিটিভ ধরা পড়ছেন না ! দ্বিতীয়টা হলে খুব চিন্তার বিষয়। 

১৬. অবশ্য, রাজ্য'র অসুবিধে কিছুটা বোঝা যায়।  RTPCR অনেক খরচ সাপেক্ষ। এর মধ্যে সেদিন পড়লাম যে কেন্দ্র থেকে নাকি আর RT-PCR kit কেনার আর্থিক সাহায্য আসবে না। একেই GST প্রাপ্য নিয়ে চলছে তারপর এই।  কি আর  বলব  ....!! এছাড়া এত রকম কোম্পানি এখন কিট বানাবার ব্যবসায় নেমে পড়েছে যে কোন কিট র কি গুণাবলী , কোন কিট বাজে এসব তাল রাখা মুশকিল হয়ে দাঁড়িয়েছে।   বিভিন্ন কোম্পানির কিট নিয়ে অসুবিধে হচ্ছে, সমন্বয়ের অভাব হচ্ছে; রাজ্যের মলিকিউলার বায়োলজি আর ভাইরোলজি বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে আরো বেশি আলোচনা করা উচিত, মনে হয়।  

১৭.  এবার শেষ করি। Conclusion - গত ২০দিনের তথ্য দেখে মনে হয় যে পশ্চিমবঙ্গ'র কিছু কিছু জায়গায়  করোনা সম্ভবত অল্প বাগে এসেছে। তবে , এটা খুব জোর গলায় বলা যেত যদি টোটাল টেস্ট'র ৬০-৬৫% র বেশি হত  RTPCR. ৫০% এন্টিজেন টেস্ট হচ্ছে বলে চিন্তা থেকেই যাচ্ছে; কোন বিশেষজ্ঞ এটা পড়ে মতামত দিলে খুশি হব।  

১৮. ভুললে চলবে না  সামনে উৎসবের মরশুম।  এবং তারপর শীতকাল। ঠান্ডা-কাশি-সর্দি-জ্বর-ফ্লু'র সময়।  বাতাসে দূষণ আরো ঘন হয়ে আসে।  সেই সময় আসার আগে করোনা'র মাত্রা কমাতেই হবে আমাদের।  রাজ্য এবং নাগরিক প্রত্যেকের এই প্রধান কাজ। আমাদের প্রত্যেকের এটাই লক্ষ্য হওয়া উচিত।  না হলে সবার বিপদ !! 

ভাল থাকবেন। ভাল করে মাস্ক পরবেন। যে পরবে না তাকে পরিয়ে ছাড়বেন।  

রেফারেন্স 

https://www.wbhealth.gov.in/pages/corona/bulletin

https://www.covid19india.org/

https://twitter.com/RijoMJohn/status/1301522646924894210/photo/1

https://twitter.com/RijoMJohn/status/1302209472731856899/photo/1

https://indianexpress.com/article/explained/india-coronavirus-covid-19-cases-deaths-numbers-explained-september-4-new-delhi-6582769/

https://www.sangbadpratidin.in/bengal/centre-is-not-going-to-give-free-rtpce-kit-to-wb-for-corona-testing/

No comments:

Post a Comment

 স্কুল খুলুক, সঙ্গে হাওয়া বাতাস খেলুক ক্লাসঘরে ('এই সময়' সংবাদপত্রে প্রবন্ধ -  ২২শে সেপ্টেম্বর, ২০২১)      সোজাসাপ্টা অপ্রিয়   সত...