Friday, April 10, 2020

হাইড্রঅক্সি-ক্লোরোকুইন ও ফরওয়ার্ডী সতর্কীকরণ
(করোনা বিজ্ঞানের খুচরো খবর - ৩) 
দেবজিত খান
(মতামত নিজস্ব)
মজারু!

একদল কোথায় ধবল সায়েবদের উদ্ধার করে নিশ্চিন্তে মহানুভবতার বহির্প্রকাশ করবেন, ভূমিকম্পধস্ত নেপালের নাকে মাইক গুঁজে দেওয়া মিডিয়ার ফ্লেক্স দেখে ফিল-গুড নেবেন, তা না প্রবল পরাক্রমী বিশ্বনেতার (কাল্পনিক?) ধমক দেওয়ার গল্প শুনে মহর্ষির নামের অপচ্চারণ আর পেত্নী-রুপী পুতের meme বানাচ্ছেন।

অন্যদিকে বিরোধী শিবির সেই (কাল্পনিক?) ধমকের গল্পে বেশ উৎফুল্ল হয়েও হাইড্রঅক্সি-ক্লোরোকুইনের ভান্ডারে টান পরবে বলে বিচলিত হয়েছেন, বেঙ্গল কেমিক্যাল বরাত না পাওয়াতে এনারা ক্ষুব্ধ (অবশ্য গুগল ইন্ডিয়া তে zydus cadila stock এর সার্চ টা ট্রেন্ডিং ছিল)। আরে দেশের সবটা কি দিয়ে দাওয়া হচ্ছে? মনে তো হয় না।

আমরা আবেগী মানুষ, চায়-পে বা ডালগোনা কফি -পে চর্চা আর ফরওয়ার্ড করেই থাকি। তাই যেটা ভাবাচ্ছে তা হলো হাইড্রঅক্সি-ক্লোরোকুইন নিয়ে আরেকধরনের ফরওয়ার্ড। যেটায় মিথ্যেটা সত্যির কাছঘেঁষা, বিজ্ঞান-ঘেঁষা টেকনিক্যাল গুলে ভর্তি আর চীন কে নিয়ে গালাগালিটা দিলে আজকাল চলবে ভালো। ভাইরাল (!) হওয়ার সব উপকরণ নিয়ে মুচমুচে উপস্থাপনা আর কি!

তাই হাইড্রঅক্সি-ক্লোরোকুইন নিয়ে কটা কথা বলার ছিল:

1: এটা মোটামুটি আমাদের সবার জানা যে ক্লোরোকুইন আর হাইড্রঅক্সি-ক্লোরোকুইন ম্যালেরিয়ার ওষুধ।

2: কোন অসুখ কোন ওষুধে সারবে সেটা যাচাই করার সর্বসম্মত পদ্ধতি হলো রোগীদের সারিয়ে তোলার ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল। এখন অবধি (এপ্রিল ৯) অন্তত ৫ টি ট্রায়ালে কোভিড-১৯ রোগে হাইড্রঅক্সি-ক্লোরোকুইনের উপকারিতা নিয়ে কিছুটা ধোঁয়াশা রয়ে গেছে। ফ্রান্সের প্রথম ট্রায়াল, যার ভিত্তিতে হঠাৎ এই শতাব্দীপ্রাচীন ড্রাগ নিয়ে নাটক, সেখানে কিছু গলদ দেখা গেছে- কিছু পেশেন্টদের ট্রায়াল চলাকালীন নথি থেকে বাদ দেওয়া, ট্রায়ালের নৈতিক অনুমোদন না নেওয়া ইত্যাদি। আরেকটি  ট্রায়ালে হাইড্রঅক্সি-ক্লোরোকুইনের উপকারিতা বা অপকারিতা কোনোটাই বোঝা যায়নি।তৃতীয়টিতে ওষুধটি দেওয়ার ৬ দিনের মাথায় পেশেন্টদের থেকে ভাইরাস টেস্ট নেগেটিভ এসেছে, তবে এটা পরিষ্কার নয় যে এনারা ৬ দিনের মাথায় এমনিতেই সুস্থ হয়ে উঠতেন কিনা, অর্থাৎ হাইড্রঅক্সি-ক্লোরোকুইন না দিলেও ভাইরাস পাওয়া যেত না কিনা। চীন থেকে দুটি ট্রায়ালের ভিন্ন ফলাফল পাওয়া গেছে। একটিতে উপকারিতা ধরা পরেনি, তার মানে হয় হাইড্রঅক্সি-ক্লোরোকুইন কাজ করেনি অথবা ট্রায়ালটি পরিকল্পনায় গলদ ছিল কারণ অনেকটা দেরিতে ড্রাগ দেওয়ার ফলাফল মাপার চেষ্টা করা হয়েছে। চীনের অন্য ট্রায়ালে হাইড্রঅক্সি-ক্লোরোকুইন খাওয়া পেশেন্টরা ড্রাগ না-খাওয়া পেশেন্টদের থেকে গড়ে একদিন আগে সুস্হ হয়ে উঠেছেন। কাজেই এখন অবধি যা আছে তা anecdotal অথবা incomplete এভিডেন্স, সবার ক্ষেত্রে সব সময় হাইড্রঅক্সি-ক্লোরোকুইন কাজ করবেই এরকম অকাট্য প্রমান এখনো নেই। তবে আশার খবর যে আরো প্রায় সত্তরটি এরকম ট্রায়াল চলছে পৃথিবী জুড়ে অনেক পেশেন্ট ও স্বাস্থ্যকর্মী নথিভুক্ত করে। সঠিক উত্তর তাড়াতাড়ি-ই পাওয়া যাবে।

3: তার মানে কি হাইড্রঅক্সি-ক্লোরোকুইন ব্যবহার হচ্ছে না? হচ্ছে। পৃথিবী জুড়ে, ডাক্তারদের তত্বাবধানে। আমেরিকায়, চীনে, ইউরোপে কোভিড১৯ আক্রান্ত মানুষদের সুস্থ করে তোলবার আশায় শুধু হাইড্রঅক্সি-ক্লোরোকুইন নয়, অনেক রকম ওষুধ দাওয়া হচ্ছে। যেটায় প্রাণ বাঁচানো যায় তাই প্রাণদায়ী, তবে সেই বিচারটা বিশেষজ্ঞদের ওপর ছেড়ে দিন। চীনের দাবি যে কোভিড১৯ আক্রান্তদের pneumonia ও ফুসফুসের বিকার কমাতে হাইড্রঅক্সি-ক্লোরোকুইন সক্ষম। ভারতবর্ষে ২২শে মার্চ ICMR ও MoHFW হাই রিস্ক পপুলেশন, অর্থাৎ নিশ্চিতরূপে (confirmed) অথবা অনিশ্চিতরূপে (suspected) কোভিড১৯ আক্রান্তের পরিচর্যাকারী উপসর্গহীন (asymptomatic) স্বাস্থ্যকর্মীদের এবং নিশ্চিতরূপে কোভিড১৯ আক্রান্তের পরিবারের উপসর্গহীন সদস্যদের প্রতিষেধক হিসেবে হাইড্রঅক্সি-ক্লোরোকুইন অনুমোদন করেছে। এর পরবর্তী বিধিও ICMR ও MoHFW ঠিক করবে, Press Information Bureau তাই বলবে, রাজ্য সরকারের health and famly welfare department এই বিধি রূপায়ণ ও বাস্তবায়নে যুক্ত, এদের ওয়েবসাইট ও টুইটারে নজর রাখুন ও তা মেনে চলুন। ডাক্তারদের ও স্বাস্থ‍্যকর্মীদের সহযোগীতা করুন কারণ মাস্ক পরে হোক বা না পরে, ঠ্যাঙানির ভয়ে হেলমেট পরে হোক বা তার প্রতিবাদে খালি গায়ে, এপ্রোন পরে হোক বা রেইনকোট পরে, লড়াইটা ওঁরাই লড়বেন।

4: এবার সেই নতুন ফরোয়ার্ডটা।

 অদ্ভুতুড়ে, বিজ্ঞান-ঘেঁষা ভাষায় ভাইরাস, রক্তের হিমোগ্লোবিন ও তার সাথে হাইড্রঅক্সি-ক্লোরোকুইনের উপকারিতা, তার সাথে দুই লাইন চীন কে গালাগাল, কোভিড১৯ এর সাথে সম্পর্কহীন কিছু ভুল তথ্যের সমন্বয়ে এক অভূতপূর্ব উপস্থাপনা। আর্টিকেল টি আগেই দেখেছি, পড়াশোনা করতে হয়েছে ভুলগুলো ধরতে। পরিহাস, যে এটির ভিত্তি চীনেরই একটি, এবং একটিমাত্র, computer-based study। গবেষণাটি কিন্তু pre-print, অর্থাৎ বিশেষজ্ঞরা এখনো যাচাই করেন নি। উপরন্তু শারীরবৃত্তীয় প্রাসঙ্গিকতা নিয়ে প্রশ্ন থেকেই যাচ্ছে কারণ কাজটি যাকে বলে in silico এবং forced। আজকে সকালে দেখলাম এটা whatsapp এ বেরিয়ে পড়েছে। এরম ফরওয়ার্ড গুলো ঘুরতে না দেওয়াই বোধহয় মঙ্গল। ফরওয়ার্ড button টি টিপবেন না। আজকে এটা বেরিয়েছে, হয়তো এরপর বলবে হাইড্রঅক্সি-ক্লোরোকুইন কিনে খেতে। অথবা আরো টেকনিক্যাল শুনতে কিছু হাবিজাবী বলে আরেকটা ওষুধ দাগিয়ে দেবে। এই ফরওয়ার্ড যারা করছে তারা কুচক্রী হোক বা গবেট, ক্ষতি হবে আতঙ্কিত মানুষের। ইরানে মদ খেলে কোভিড হবে না গুজবে bleach মেশানো মিথাইল এলকোহল খেয়ে চুয়াল্লিশ জন মারা গেছে।

5: হাইড্রঅক্সি-ক্লোরোকুইন প্রেসক্রিপশন ছাড়া কেনা যায়না। তা এড়িয়ে, ডাক্তারের পরামর্শ ছাড়া সাধারণ সর্দি-জ্বর-কাশি হলেই চিকলেট এর মত খেলে হিতে বিপরীত হতে পারে। কয়েক ধরনের হার্ট এবং চোখের অসুখ থাকলে, বা লিভার/কিডনি তে সমস্যা থাকলে, উল্টে আরো অসুস্থ হতে পারেন, সেইজন্যই ডাক্তার ও প্রেসক্রিপশনের বন্দোবস্ত। Self medicate করবেন না, হাইড্রঅক্সি-ক্লোরোকুইন দিয়ে তো একেবারেই না।

6: ভারতবর্ষে  হাইড্রঅক্সি-ক্লোরোকুইন essential medicine ঘোষিত হবার পরে সাধারণ ফার্মাসিতে এটার আকাল দেখা দিয়েছে। Rheumatoid arthritis এ যারা ভোগেন, তাদের অনেকের এটি প্রেসক্রিপশন মেডিসিন। হাইড্রঅক্সি-ক্লোরোকুইন এক ধরনের immune-modulator ও, এটি disease-modifying anti-rheumatic drug হিসেবেও ব্যবহার হয়, অবশ্যই প্রেসক্রিপশন সমেত। এবার ধরুন এটা মার্কেট এ ফিরে এলো আর আপনিও social media তে ফরওয়ার্ড দেখে কোনোভাবে প্রেসক্রিপশন জুটিয়ে কিনে ফেললেন। ওষুধ expire করলে আপনি স্রেফ ফেলে দেবেন কিন্তু বঞ্চিত করবেন arthritis এ ভোগা মানুষগুলোকে।

সজাগ থাকুন, সুস্থ থাকুন।

(ডঃ দেবজিত খান হল  'সাবমেরিন দেবজিত'।  'আরডিনারি বুদ্ধি নেই , এক্সট্রাআরডিনারি বুদ্ধি ' ; একটু রিসার্ভড ,আড্ডাতেও অপ্রয়োজনীয় কথা বলে না , আর কোনো আলোচনায় অনেক কিছু শোনার পরে  ধাঁ করে একটা টর্পেডো লঞ্চ করে দেয়। আর ভাইরোলজি তো ওর নিজের গবেষণার বিষয়ের সঙ্গে কিছুটা জড়িত।  তাই গতকাল যখন এটা  হোয়াটসাপে পেলাম তখন বললাম এখানে 'গেস্ট লেখক' হয়ে যা। ) 

No comments:

Post a Comment

 স্কুল খুলুক, সঙ্গে হাওয়া বাতাস খেলুক ক্লাসঘরে ('এই সময়' সংবাদপত্রে প্রবন্ধ -  ২২শে সেপ্টেম্বর, ২০২১)      সোজাসাপ্টা অপ্রিয়   সত...