Thursday, April 9, 2020

প্রকৃতির পেনড্রাইভ 
(করোনা বিজ্ঞানের খুচরো খবর -২)

''কানন-দি, ওই বাইরে থেকে প্যাকেটটা এনে টেবিলের যেখানে রাখলে ওই জায়গাটা সাবান-জল দিয়ে মুছে নাও।  ....''

''আমি এসেই হাত ধুয়েচি  গো  .....তুমি বলে দিয়েচো  তারপরে রোজ করি।''

''না না  ....সে আমি জানি , আমি বলছি ওটা তো বাইরের প্যাকেট;  কত হাত ঘুরে এসেছে।  ওই টেবিলটা সাবান-জল দিয়ে মুছে দাও।....কোনখান দিয়ে করোনা ঢুকবে কোনো ঠিক আছে? ''

এটা মার্চের মাঝামাঝির কথা। কানন-দি অনেকদিন বাড়িতে কাজ করছে।  খুবই ভাল মানুষ। তাই  আমি যে ফেব্রুয়ারি মাস থেকে হাত ধোবার ব্যাপারে কড়াকড়ি শুরু করেছি সেটা এক কথায় মেনে নিয়েছে। এবারও 'না' করলো না।  ন্যাতা নিয়ে টেবিল মুছতে মুছতে জিজ্ঞেস করলো,  ''আচ্ছা, এই  করোনা-টা কি পোকা? নতুন এয়েচে ?''

হাসা উচিত নয়।  আমার দামড়া-দামড়া ডিগ্রি দিয়ে কানন-দি'র  মত এত কাজ আমি করতে পারবো না তা আমি বিলক্ষণ জানি।  তাও  হেসে ফেললাম, ''না!  পোকা নয়, ভাইরাস''

''ভাইরাস?...সেটা কি করে? ....''

আসলে, 'হাত ধুতে হবে' এইটা বলে-বলে এখন অনেকটা মাথায় ঢুকলেও আর কোন কোন ফাঁক দিয়ে করোনাবাবাজি ঢুকে পড়তে পারে এটা এখনো সবার ঠিক বোধগম্য হয়নি। দোষও নেই। 'ভাইরাস' কথাটার সঙ্গে আমরা বহুদিন পরিচিত হলেও জিনিসটা যে ঠিক কি সেটা আমরা অনেকেই ঠিক বুঝতে পারি না ।  হ্যাঁ , জানা আছে ভাইরাস খুব বেশি ছোট (যেমন, এই নতুন করোনাভাইরাসের সাইজ ৫০-২০০ ন্যানোমিটার), কিন্তু ওইটুকুই। তাই আজও আমাদের অনেকের অবস্থা যুদ্ধে মেঘনাদকে face করার মত।  যাকে চোখে দেখা যায় না, তার থেকে চব্বিশ ঘন্টা ঘরে-বাইরে-সকালে-বিকেলে-রাত্রে নিজেকে defend করা বড্ড চাপের।  এ যেন HG Wellsর Invisible Manর বিরুদ্ধে ফুটবল খেলা! এর থেকে জুরাসিক পার্কের বড় টাইরোনোসরাস-টা রাস্তায় ঘুরে বেড়ালে সেটাকে অন্তত চোখে দেখে বিপদের একটা স্টেডি আন্দাজ পাওয়া যেত । লোকজন তখন 'এই একটু মোড়ে  দাঁড়িয়ে আসি' , 'র'কে একটু গেঁজিয়ে আসি' 'এই টুক করে যাবো আর আসবো ' করতেন না।  

ভাইরাস কি?
বেশি গুরুগম্ভীর বৈজ্ঞানিক টার্ম দেবার কোনো মানে হয় না এখানে।  তাই আমাদের আধুনিক দৈনন্দিন জীবন থেকে একটা উপমা দেবার চেষ্টা করি।  ভাইরাস জিনিসটা (সে সাধারণ সর্দি'র রাইনোভাইরাস কিংবা এখনো নাম-শুনলে-ভয়-করে পোলিও বা বসন্তরোগ'র ভাইরাস বা আমাদের বর্তমান শত্রু নতুন কোরোনাভাইরাস (পোশাকি নাম SARS-CoV-২) একটা পেনড্রাইভের মতো।  হ্যাঁ, পেনড্রাইভ। বুঝিয়ে বলছি। মনে করে দেখুন, একটা সাধারণ পেনড্রাইভে কি কি  যন্ত্রাংশ আছে? ভেতরে আছে মেমোরি স্টোরেজ চিপ, USB কন্ট্রোলার, আরো কিছু ছোট্ট ছোট্ট তার, (কিছু কিছু পেনড্রাইভে একটা পুচকু LED আলো) আর USB কানেক্টর। আর কানেক্টর বাদে সবকিছু একটা প্লাস্টিক বা ধাতব কভারের মধ্যে সুরক্ষিত। 
আর এই পেনড্রাইভের ভেতরে অনেক অনেক ডেটা , ফাইল, গান, সিনেমা, ইত্যাদি সঞ্চিত থাকতে পারে।  কিন্তু ভেতরে যাই থাকুক পেনড্রাইভের কোনো ক্ষমতা নেই সেগুলি নিজে থেকে আপনাকে দেখাবার, যতক্ষণ না পেনড্রাইভ'র USB কানেক্টর কোনো একটা ডেস্কটপ বা ল্যাপটপের USB পোর্টে গুঁজে দেওয়া হচ্ছে। একমাত্র তখনই পেনড্রাইভ 'জীবন্ত' হয়ে ওঠে।  ডেটা ট্রান্সফার হতে পারে, দেখা যেতে পারে আর এক পেনড্রাইভের data আরো অনেকগুলি পেনড্রাইভে কপি করা যেতে পারে। 

করোনাভাইরাসও অনেকটা এভাবেই কাজ করে, সংক্রমণ করে, নিজের কপি বানায়, ছড়িয়ে পড়ে।

কি করে?
তাহলে বাবাজীবনের চেহারাটা একটু দেখতে হয়।  একটা ছবি এতদিনে অবশ্য প্রায় সবাই  দেখেছেন - গোলাকার ভাইরাস, তার থেকে অনেকগুলো পায়া'র মত কি যেন বেরিয়ে আছে। তবে সেটা হল বাইরের ছবি।  ভেতরে কি আছে? ভেতরে আছে একটি সুতোর মতো RNA মলিকিউল। এই RNAই হল কোরোনাভাইরাসের মূল ডেটা স্টোরেজ আর কন্ট্রোলার।  সোজা কথায় - হেডকোয়ার্টার। এর মধ্যেই  'প্রকৃতির সাংকেতিক ভাষায়' (যার বৈজ্ঞানিক নাম genetic code; অন্যতম আবিষ্কারক নোবেলজয়ী ভারতীয় হরগোবিন্দ খোরানা) কোরোনাভাইরাসের ২৯টি প্রোটিন তৈরীর নির্দেশাবলী লেখা আছে, অনেকটা যেমন আমাদের ছোটবেলার ক্যাসেটের সুতোয় পরপর 'লেখা থাকতো' অনেকগুলি গান। এই RNA আবার ক্যাপসিড (capsid ) নামের একটি প্রোটিনের মোড়কের মধ্যে প্যাক করা আছে । আর এই ক্যাপসিড বসে আছে আরেকটি বড় ব্যাগের মধ্যে যার নাম হল এনভেলপ (envelope). এই এনভেলপ হল একটা ঝিল্লি বা  membrane,  আমাদের নিজেদের কোষের cell membraneর মত । আমাদের কোষের সেল মেমব্রেনের মত এনভেলপও  কিছু লিপিড (স্নেহ পদার্থ) ও প্রোটিন দিয়ে তৈরী।

 করোনাভাইরাসের  এনভেলপের মূলত দুটো কাজ। এক, ভেতরের RNAকে রক্ষা করা, ঠিক যেমন পেনড্রাইভের কভার ভেতরের চিপ, কন্ট্রোলারকে রক্ষা করে, একসঙ্গে রাখে। দুই, এনভেলপ থেকে বেরিয়ে থাকা পায়ার মত স্পাইক প্রোটিন  মানুষের দেহকোষের সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপন করে। কোরোনাভাইরাসের স্পাইক প্রোটিন হল পেনড্রাইভের USB কনেক্টর আর আমাদের কোষের মেমব্রেনে বসে থাকা ACE২ রিসেপ্টার  প্রোটিন হল USB পোর্ট। খাপে খাপে লাগলেই ডেটা ট্রান্সফার শুরু। একটু পরে ভাইরাল RNA ক্যাপসিড আর এনভেলপের খোলস ছেড়ে বেরিয়ে আসে কোষের সাইটোপ্লাজমে (cytoplasm), আর এসেই প্লেন হাইজ্যাক করে নেয়। তখন সে কোষকে নিজের সাধারণ কাজকর্ম করতেই দেবে না - হুকুম দেবে 'তুই এখন আমার ক্রীতদাস ! আর সব কাজ বন্ধ করে শুধু আমার জন্যে ভাইরাল প্রোটিন আর RNA বানাবি। ' কোষ তাই করতে বাধ্য হয়, এবং কয়েক ঘন্টা পরে যখন ব্যাগার খেটে খেটে মরে যায় তখন ওর ঝিল্লি ফাটিয়ে বেরিয়ে আসে নতুন কোরোনাভাইরাস প্রজন্ম, তাদের মধ্যেও সেই একই RNA, একই ক্যাপসিড , একই এনভেলপ।  পেনড্রাইভ থেকে ডেটা ট্রান্সফার আর কপি করার মতো হুবহু এক না হলেও অনেকটা মিল অনস্বীকার্য। 
আর এখানেই আসে সাবান বা হ্যান্ডওয়াশ বা স্যানিটাইজারের  (উফফ! একটা নতুন কথা ঢুকে পড়েছে বাংলায় এবার!) উপকারিতা।এদের সবার একটাই কাজ -  কোরোনাভাইরাসের এনভেলপ আর স্পাইক প্রোটিনকে ধ্বংস করা। 
আর যেমন কোনো কারণে বাইরের কভার আর USB কানেক্টর ফেটে গেলে বা দুমড়ে গেলে পেনড্রাইভ আর কাজ করে না, ঠিক তেমনি এনভেলপ আর স্পাইক প্রোটিন নষ্ট হয়ে গেলে করোনা ব্যাটাও নিজের RNAকে সুরক্ষিত রাখতে পারবে না, কোনো কোষের USB port ACE২ প্রোটিনের সঙ্গে গিয়ে আটকাতে পারবে না (RNA জিনিসটা এমনি এমনি এসব পারে না? না। যে কাজের যা।  চিপ কি নিজে থেকে পোর্টে জুড়ে যেতে পারে? না কিডনি দিয়ে ভাত হজম হয় ? ) 

সাবান ইত্যাদি কি করে কাজ করে ?
একবার সাবানের প্যাকেট বা হ্যান্ডওয়াশ'র গায়ে লেখাটা দেখে নিন।  ওতে যেসব উপাদান আছে তার মধ্যে সোডিয়াম লাউরিল সালফেট, স্টিয়ারিক অ্যাসিড,  কিছু তেল , কোকামিডপ্রোপাইল বিটেন ইত্যাদির নাম পাবেন।  এই সব কেমিক্যালের গঠন এমনই যেন এদের দুটো হাত আছে।  এক হাত দিয়ে করোনার এনভেলপকে ধরে, আর অন্য হাত দিয়ে জল।  তাই যখন সাবান-জল দিয়ে (২০ সেকেন্ড) ধরে হাত রগড়াচ্ছেন তখন সাবান একদম ভাইরাসের বাইরের চামড়াটাকে টেনে হিঁচড়ে দফারকা করে দেয়।  ব্যাস ! এনভেলপ খতম, স্পাইক প্রোটিন খতম। স্যানিটাইজার? হ্যাঁ , সেও পারবে কারণ তাতে বেশ কিছুটা এলকোহল থাকে এবং এলকোহলও একইরকম কাজ করে পারে।তবে এক মিলিলিটারের একশো ভাগের এক ভাগ হাতে ঢাললে কাঁচকলা হবে। ভালো করে বেশ কিছুটা স্যানিটাইজার হাতে নিয়ে মুছলে তবেই না সব ভাইরাস গলে যাবে। তবে সাবান জল দিয়ে হাত ধোয়া হচ্ছে সবচেয়ে ভালো,  ভাইরাস ধ্বংসও  হল আবার তাদের 'লাশ' ধুয়ে একদম সাফ হয়ে গেল। একই কারণে দোকান-অফিস-ব্যাঙ্ক-পোস্টঅফিস কাউন্টার টেবিল এক-দু ঘন্টা অন্তর ডিটারজেন্ট-জল দিয়ে মুছে নেওয়া ভালো। এই হল ব্যাপার।  সহজ সরল বিজ্ঞান কিন্তু গত দেড়শো বছরে  কত কোটি কোটি যে প্রাণ বাঁচিয়েছে তার কোনো ইয়ত্তা নেই।

একটা ছোট্ট funda দিয়ে শেষ করি - অনেকেই বলছেন 'ভাইরাস মারতে হবে।' বৈজ্ঞানিক দিক থেকে কথাটা ঠিক নয়।  ভাইরাস তো প্রাণী নয়,তাকে 'আনবিক পরজীবী' বলতে পারেন।  তার নিজের কোনো কোষ নেই।  অন্যের কোষে ঢুকে সে মস্তানি করে। আর তাই যার প্রাণ নেই তাকে মারবেন কি করে? তাকে মারা যায় না, তাকে ধ্বংস করা যায়।  এন্টিভাইরাল দিয়ে, ভ্যাকসিন দিয়ে, এবং সাবান-জল স্যানিটাইজার দিয়ে।প্রথম দুটি এখনো তৈরী হয়নি, হচ্ছে, হয়ে যাবে।  তৃতীয়টি হাতের কাছেই আছে।

 ভাল থাকবেন।

pic: https://www.premiumusb.com/blog/whats-inside-a-usb-drive; লেখকের আঁকা, লেখকের তোলা 

4 comments:

  1. আপনার তথ্য সমৃদ্ধ প্রবন্ধ মনোযোগ দিয়ে পড়ি। কয়েকজন সমমনস্ক বন্ধুকে পড়াই। একটা অনুরোধ, এই ভাইরাসের ভ্যাকসিন প্রস্তুতির বিষয়ে একটি প্রবন্ধ লিখুন। কৃতজ্ঞ থাকব। নমস্কারান্তে, বরুন সিকদার, varunsikdar@gmail.com

    ReplyDelete
    Replies
    1. ধন্যবাদ।  হ্যাঁ, ওই বিষয় নিয়ে আমারও লেখার ইচ্ছে আছে। তবে আমাকে নিজেকেও একটু details এ পড়তে হবে, updated হতে হবে। প্রচুর চেষ্টা হচ্ছে এটা বলতে পারি,  গত দুশো বছরে আর কোনো অসুখ নিরাময়ের জন্যে এরকম বিশাল (এবং এত দ্রুত ) বৈজ্ঞানিক প্রচেষ্টা হয়েছে কি না আমার সন্দেহ আছে।   

      Delete
  2. Khuub valo laglo.... R o arkm lekha expect krbo... (Portia)

    ReplyDelete

 স্কুল খুলুক, সঙ্গে হাওয়া বাতাস খেলুক ক্লাসঘরে ('এই সময়' সংবাদপত্রে প্রবন্ধ -  ২২শে সেপ্টেম্বর, ২০২১)      সোজাসাপ্টা অপ্রিয়   সত...