Sunday, April 12, 2020

লকডাউন হল ডিফেন্স, টেস্ট হল স্ট্রাইকার 
(করোনা বিজ্ঞানের খুচরো খবর - ৪)

আজ ঠিক বিজ্ঞান নয়। ইতিহাস আর বিজ্ঞানের এক সাদৃশ্যের কথা লিখছি। দুটি যুদ্ধের কথা - একটি ইতিহাসের পাতা থেকে, এবং অন্যটি অবশ্যই আমাদের আজকের জীবন থেকে।  আপাতদৃষ্টিতে আলাদা ঘটনা, কিন্তু দেখবেন বেসিক-টা একই।  

অগস্ট ১৯৪২।
ইউরোপ জুড়ে নাৎসি সেনাবাহিনীর দাপট। একদিকে ব্রিটেন ছাড়া সমগ্র পশ্চিম ও মধ্য ইউরোপ হিটলারের দখলে। অন্যদিকে সোভিয়েত ইউনিয়ন'র বিস্তীর্ণ অঞ্চলেও জার্মান ফৌজের রাজ্যত্ব।  এই অবস্থায় বিশালকার জার্মান ষষ্ঠ সেনাবাহিনী (6th Army) দক্ষিণ রাশিয়ায় ভলগা নদীর তীরে অবস্থিত স্তালিনগ্রাদ শহর আক্রমণ করল।  শুরু হল স্তালিনগ্রাদের যুদ্ধ - এমন এক ভয়ানক লড়াই যার নাম চিরকালের মত ইতিহাসে লেখা থাকবে।
জার্মানরা কালান্তক বোমাবর্ষণ ও গোলাবর্ষণ দিয়ে আক্রমণের সূচনা করল।  শহরের বাইরে জার্মান advance সামলাতে না পেরে সোভিয়েতরা কিছুটা পিছিয়ে গিয়ে শহরে ঢোকার মূল রাস্তাগুলি বন্ধ করলেন , না না রকম ব্যারিকেড গড়ে তুললেন।শুরু হল স্তালিনগ্রাদের অবরোধ - প্রতি ইঞ্চি'র জন্যে এমন জানপ্রাণ লড়াই আর সম্ভবত ইতিহাসে কোনদিন হয়নি।আক্ষরিক অর্থেই 'বিনা যুদ্ধে নাহি দিব....' ; জার্মানদের হারাতে না পারলেও সোভিয়েতরা পরের কয়েক মাস জার্মানদের গতি অত্যন্ত শ্লথ করে দিলেন । হিটলার আশা করেছিল শীতকাল পড়ার আগেই স্তালিনের নামাঙ্কিত শহর তার দখলে আসবে। কিন্তু, জার্মান সেনাবাহিনী স্তালিনগ্রাদ ঘিরে ফেললেও, এবং এক এক জায়গায় ভলগা নদী অবধি পৌঁছে গেলেও শহর রয়ে গেল সোভিয়েত ফৌজের হাতে।
(ছবি ১: জার্মান আক্রমণ ও স্তালিনগ্রাদ শহর অবরোধ)

শহরের মধ্যে অবরুদ্ধ সোভিয়েত ডিফেন্ডাররা অবশ্য একা এই লড়াই চালিয়ে যেতে পারতেন না; প্রতিদিন-প্রতিরাত ভলগা নদী পেরিয়ে তাদের কাছে পৌঁছে যেত রসদ, খাবার, গোলাগুলি, ইত্যাদি। নেপোলিয়ন'র বিখ্যাত উপদেশ  an army moves on its stomach (সেনাবাহিনী তখনই লড়তে পারে যখন তার খাবার-দাবার রসদ ঠিকঠাক পৌঁছচ্ছে ) ভোলেননি সোভিয়েত সেনাপতিরা।  তাই তাঁরা জার্মান বোমারু বিমান ও কামান উপেক্ষা করে যে কোন মূল্যে শহরের সাপ্লাই লাইন খুলে রেখেছিলেন। শুধু তাই নয়, শহরের সাধারণ মানুষ ও সৈন্যরা যাতে একই রেশন পান সেই দিকে নজর রাখা হয়েছিল, এবং তাই প্রতিরোধে ছিল অভূতপূর্ব ঐক্য।

অবশ্য এই ভাবে শুধু ডিফেন্সিভ লড়লে যে হিটলার আজ না হয় কাল শহর জিতেই যাবে, এটা বুঝতে বড় সেনাপতি হতে হয় না।  ক্রিকেটে বেশি ঠুকঠুক করে খেললে যেমন কয়েক ওভার বাদে asking rate বেড়ে চাপ পড়তে বাধ্য, অনেকটা সেরকমই। অবরোধকে হারাতে হলে পাল্টা আক্রমণ করতেই হবে। এবং তাই, নভেম্বরের মাঝামাঝি  একদিন দুম করে সোভিয়েত সেনাপতি জুখভ অবরুদ্ধ স্তালিনগ্রাদ শহরের উত্তর ও দক্ষিণ দিক দিয়ে একসঙ্গে আক্রমণ করলেন অবরোধকারী জার্মানদের। মাত্র কয়েকদিনের লড়াই আর তারপর উত্তর ও দক্ষিণ থেকে আসা জুখভের দুই বাহিনী জার্মানদের ঘিরে ফেলল। তার মানে দাঁড়াল, শহরের মধ্যে সোভিয়েত ফৌজ , মাঝে জার্মানরা আর বাইরে তাদের ঘিরে ফেলা নতুন সোভিয়েত সেনা।  জার্মানরা আর আগ্রাসী নয়, অবরোধ করতে এসে  প্রতি-আক্রমণে এখন তারাই অবরুদ্ধ ! সোভিয়েত ডিফেন্স ও কাউন্টার-অফেন্স'র মাঝে জার্মানরা এবার জাঁতাকলে। যুদ্ধের মোড় ঘুরে গেছে।
(ছবি ২: সোভিয়েত প্রতি আক্রমণ। এবার জার্মানরা অবরুদ্ধ ।  

এর পরের দু মাস রাশিয়ার সেই ভয়ানক শীতে দুই সেনার মারণবাঁচন লড়াই।  কিন্তু জানুয়ারির মধ্যে জার্মান ফৌজের প্রাণবায়ু ফুরিয়ে এল।  সুদূর জার্মানি থেকে খাবারদাবার, গরম জামাকাপড়, গুলিগোলা আর এসে পৌঁছয় না।  এদিকে শহরের মধ্যে সোভিয়েতদের সাপ্লাই ঠিকই আসছে।  ফেব্রুয়ারি মাসের গোড়ায় আত্মসমপর্ণ করল জার্মানরা। ডিফেন্স-সাপ্লাই-আক্রমণ ত্রিমুখী স্ট্রাটেজি দিয়ে স্তালিনগ্রাদের অবরোধ ওঠালো সোভিয়েত ফৌজ।
(ছবি ৩: ডিফেন্স আর আক্রমণের মাঝে পিষ্ট জার্মান সেনা) 

এপ্রিল-২০২০।
 আজ, করোনাযুদ্ধের বাজারে, হঠাৎ বিশ্বযুদ্ধের এই ঘটনা নিয়ে কলম (মানে কীবোর্ড) চালালাম  কেন? তার কারণ, নতুন করোনা ভাইরাসকে হারাতে আমরা মোটামুটি ওই একই স্ট্রাটেজি নিয়েছি।এক অর্থে history repeating itself.

সোভিয়েতরা যেমন নিজেদের শহরে ঢুকে গেট বন্ধ করে ব্যারিকেড গড়ে তুলেছিলেন, তেমনি আজ আমরা
 অফিস/ব্যবসা/দোকান/বাজার/স্কুল কলেজ/ বাস/ট্রেন সব বন্ধ করে লকডাউনে বাড়িতে বসে আছি। লকডাউন হল আমাদের ডিফেন্স যার লক্ষ্য নাৎসি বাহিনীর মত আগ্রাসী ভাইরাসকে স্লো করে দেওয়া। হ্যাঁ, খুব ভালো করে প্ল্যান হয়নি বলাই বাহুল্য।  ফেব্রুয়ারির শেষেই সব ফ্লাইট বন্ধ হলে আন্তর্জাতিক যাত্রী আসাও অনেক কমানো যেত, আর বেশ কিছুটা সময় জানিয়ে লকডাউন করলে কেনাকাটার জন্যে এমন ভিড় করে হুড়োহুড়ি হত না, আর সম্ভবত লক্ষ লক্ষ শ্রমিক দিনের পর দিন কয়েকশো মাইল হেঁটে বাড়ি পৌঁছোবার আপ্রাণ চেষ্টা করতেন না। বলতে পারেন, আমাদের ব্যারিকেডে অনেকগুলি ফাঁক রয়ে গেছিল....।

ডিফেন্সের সঙ্গে অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত সাপ্লাই লাইন।ভলগা নদীর ওপর স্টিমারের পর স্টিমার হারিয়েও (এবং শীতকালে বরফ কেটে হাইওয়ে বানিয়ে ) শহরকে সাপ্লাই করেছিলেন সোভিয়েতরা।আমাদের একই অবস্থা।  শত্রু ভাইরাস তেড়ে আসছে, তাই আমরা আমাদের বাড়ির দরজা বন্ধ করে দিচ্ছি। আমরা ভেতরে, শত্রু বাইরে। আমরা ভেতরে বসে থাকলে ভাইরাস ট্রান্সমিশন বন্ধ হবে আর আমরা জিতব। কিন্তু বাড়ির ভেতরে যদি খাবার শেষ হয়ে যায় তাহলে আমাদের বেশি করে বেরোতেই হবে - ঘরে খাবার না থাকলে, ক্ষুধার্ত সন্তানকে দেখে কোন বাবা-মা অদৃশ্য ভাইরাসের ভয়ে লকডাউনের তোয়াক্কা করবেন? কিন্তু তখন যদি ভাইরাস ঢুকে পড়তে পারে?

তাহলে এই লড়াই জিততে হলে আমাদের খাবার (অথবা খাবার কেনার টাকার) supply রাখতেই হবে।এও মনে রাখা আবশ্যক যে দুর্বল অভুক্ত শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে যায়, সহজে থাবা বসায় ভাইরাস। পেটে খেলে তবে না পিঠে সয় ? রাজ্যরা এই ব্যাপারে ওয়াকিবহাল বলেই চেষ্টা করছেন রেশন-চাল-ডাল-মাছ-মাংস-ডিম্-সবজি সাপ্লাই চালু রাখতে। একই কারণে অনেক বিশেষজ্ঞ বলছেন - যাদের স্টেডি রোজগার এখন বন্ধ সেই সাধারণ মানুষের পকেটে সরাসরি টাকা দিন (যেমন কানাডা, ব্রিটেন, না না দেশ ঘোষণা করেছে );  প্রয়োজনে সেই টাকা ছাপিয়ে মানুষের হাতে দিতে বলছেন সদ্য নোবেলজয়ী বাঙালি অর্থনীতিবিদ। আপাতদৃষ্টিতে অদ্ভুত শোনালেও তিনি যেটা বলতে চাইছেন সেটা হল সাধারণ সময়ের সব নিয়মকানুন  এই অভূতপূর্ব যুদ্ধকালীন পরিস্থিতিতে খাটে না।  মানুষ না বাঁচলে অর্থনীতি কি ভূতে চালাবে? না কি শুধু কয়েক লক্ষ উচ্চবিত্ত মানুষকে নিয়ে এই দেশ?

তবে শুধু ডিফেন্স দিয়ে ১৯৪২এ জেতা যেত না  এবং তাই জুখভের ফৌজ ঘিরে ফেলেছিল জার্মানদের।আজও  শুধু লকডাউন করে চট করে জেতা যাবে না।এবং তাই WHO'র ডিরেক্টর জেনারেল বলে চলেছেন - টেস্ট টেস্ট টেস্ট।লকডাউন প্রয়োজনীয় কারণ সে ভাইরাসের ট্রান্সমিশনকে স্লো করে দেয়। অন্যান্য বন্দোবস্ত করতে স্বাস্থ দপ্তরকে সময় দেয়। কিন্তু  শুধু তাই দিয়ে হবে না - তাই  বেশি করে পরীক্ষা করতে থাকুন। এই পরীক্ষা করাই আমাদের প্রতি-আক্রমণ , আমাদের স্ট্রাইকার। একমাত্র  তখনই সংক্রমণের গতিপ্রকৃতি বোঝা যাবে এবং ঠিক যাঁরা যাঁরা সংক্রমিত তাঁদের সুস্থ করে তোলা যাবে।  যেমন করেছে দক্ষিণ কোরিয়া আর জার্মানি। টেস্ট টেস্ট টেস্ট। টেস্ট আর লকডাউন একে ওপরের পরিপূরক,  ক্রিজে সৌরভ-সচিন।

জনসংখ্যার অনুপাতে ভারত যে টেস্ট বেশি করেনি সেটা এখন সবাই জানেন। এর কারণ কি এ বিষয়ে নানা মুনির নানা মত।  হতে পারে পর্যাপ্ত কিট আগে থেকে কিনে রাখা হয়নি, হতে পারে পরীক্ষার জন্যে নির্দিষ্ট ল্যাব কম, ফেব্রুয়ারি মাস থেকেই আমাদের অনেক বেশি করে প্রস্তুত হওয়া উচিত ছিল।  যাই হোক , ভাইরাস তো সে সব মানবে না।  তবে শুনে ভাল লাগল যে সামনের সপ্তাহে আমাদের রাজ্যে কয়েক হাজার rapid diagnostic kit আসছে (আচ্ছা,....এই কিট কি করে কাজ করে সেই নিয়েও লিখব ইচ্ছে আছে ) ।  এলে হয়, কারন অভিজ্ঞতা থেকে জানি ,  এইসব চাপের মুখে scientific chemical ইত্যাদি আসতে দেরি হয়। স্বাভাবিক। সব দেশই তো একই জিনিস অর্ডার দিচ্ছে।এই তো গতকাল পড়লাম যে চীন থেকে বেশ কয়েক হাজার কিট তামিলনাড়ুতে আসার কথা ছিল, সে নাকি 'পথ ভোলা পথিক' হয়ে ট্রাম্পভাই'র দেশে চলে গেছে!! বুঝে নিন.... তবে আমাদের অর্ডার সাপ্লাই হলে খুবই ভাল।  খুবই প্রয়োজন।

Meanwhile, আমাদের কাজ ডিফেন্স চালু রাখা।  লকডাউনের এই লড়াইয়ে আমরা সবাই সৈন্য। Physical distancing and social unity.




No comments:

Post a Comment

 স্কুল খুলুক, সঙ্গে হাওয়া বাতাস খেলুক ক্লাসঘরে ('এই সময়' সংবাদপত্রে প্রবন্ধ -  ২২শে সেপ্টেম্বর, ২০২১)      সোজাসাপ্টা অপ্রিয়   সত...