Tuesday, April 21, 2020


ভাইরাস কি ফিনিক্স পাখি যে ডেডবডি থেকে উড়ে বেরিয়ে আসবে? 
(করোনা বিজ্ঞানের খুচরো খবর -৭)


নন্দন: কিরে ? মুখটা এরকম থমথমে কেন? ....

চন্দন (মোবাইল দেখতে দেখতে) : এই একটা বিচ্ছিরি খবর  .....

নন্দন: আরে দূর! বলছি এত মোবাইলে সারাক্ষন করোনা করোনা করিস না।  শরীর খারাপ হবে।

চন্দন: না না। সেটা আজকাল কমিয়ে দিয়েছি।  কিন্তু এই খবরটা বড্ড বাজে রে - চেন্নাইতে একজন ডাক্তার , নাম ডঃ সাইমন হারকিউলিস, মারা গেছেন, তাঁকে কবর পর্যন্ত দিতে দিল না লোকজন।  ফ্যামিলি, বন্ধুবান্ধব , এমনকি পুলিশকে লোকজন মারতে এসেছে। পরে অনেক রাত্রে বন্ধুরা সমাধিস্থ করেছে। ....এই দ্যাখ, জুনিয়র ডাক্তার কাঁদতে কাঁদতে বলছে - এই কি এঁর মত সেবা-নিবেদিত মানুষের প্রাপ্য ছিল ? ....

নন্দন: কি বলব ভাই। ....থালা বাজিয়ে যে সত্যি শ্রদ্ধা অনেকেরই আসে না বুঝতেই তো পারছিস।  চাপের মুখে দূর্দিনে যে বন্ধু সেই আসল  .....

চন্দন: কিন্তু, এরকম তো রোজ দেখছি।  এই তো যে দমদমের ভদ্রলোক মারা গেলেন দিন দশেক আগে - নিমতলায় তাঁর দাহ হচ্ছিলো না। ....কালকেও তো খবরে দেখলাম নর্থ বেঙ্গলে কোন জায়গায় যেন একজনকে কবর দিতে গিয়ে লোকজনের কি রাগ  .....ভাঙচুর  .....

নন্দন: অত্যন্ত অন্যায়। ক্রিমিনাল  অভদ্রতা।  ....আর এর মূলে আছে চূড়ান্ত অজ্ঞতা।

চন্দন: আচ্ছা, সত্যি কি ভাইরাস ডেড বডি থেকে ছড়ায়?

নন্দন: তাই কখনো হয় ? এতো সামান্য BSc বা এমনকি হাইস্কুলের বিদ্যে একটু ভাবলেই দেখা যাবে এটা হতে পারে না।

চন্দন: একটু খুলে বল।

নন্দন: দেখ, একেই ভাইরাস জিনিসটা বড্ড ছোট, তার ওপর জড় আর প্রাণের মাঝখানে অবস্থিত একটি অদ্ভুত জিনিস।  তার ওপর আমাদের এই 'সব বিষয়ে সব কিছু জানি' সমাজে আসলে যে কোন জিনিস সম্পর্কে জ্ঞান খুবই কম। আর তাই, যে আমরা দিব্বি সকাল বিকেল পাড়ায় আড্ডা মারছি, 'আমি তো বড় রাস্তা দিয়ে যাবো না, টুক করে গলি দিয়ে ঘুরে আসবো' বলে একটু ফাঁকা রাস্তায় বেড়িয়ে  আসছি, সেই আমরা কোনো মৃতদেহ দেখলে 'ওরে গেল গেল' করে উঠছি।  যেন ডেডবডি থেকে  লক্ষ লক্ষ কোটি কোটি ভাইরাস লাফিয়ে লাফিয়ে কিলবিল করে বেরিয়ে এসে আমাদের এই 'ধন ধান্যে পুষ্পে ভরার' তেরোটা বাজিয়ে দেবে!!!

চন্দন: হা হা হা  ...

নন্দন: হাসির কথা না। আগে কুষ্ঠ বা ওলাউঠো রুগীকে দেখলে যা করা হত এটা  তার repeat কি না , না কি আমাদের এই জাতপাত-বিদীর্ন দেশের রন্ধ্রে-রন্ধ্রে ঢুকে যাওয়া cool অমানবিকতার আরেকটা নিদর্শন তা সমাজতাত্ত্বিকরাই বলতে পারবেন। তবে এটা যে বিজ্ঞানের ডিগ্রীধারী ভরা দেশে বেশ বেমানান সেটা বলতে পারি।  

চন্দন: প্রশ্ন হল - কোন মৃতদেহ থেকে কোরোনাভাইরাস সংক্রমণের সম্ভাবনা আছে কি?

নন্দন: দেখ, উত্তর দিতে হলে আমার সেই 'ভাইরাস হল প্রকৃতির পেনড্রাইভ' উপমায় ফেরত যাই (এই সিরিজের দ্বিতীয় লেখা)। লিখেছিলাম - 'করোনাভাইরাসের এনভেলপের মূলত দুটো কাজ। এক, ভেতরের RNAকে রক্ষা করা, ঠিক যেমন পেনড্রাইভের কভার ভেতরের চিপ, কন্ট্রোলারকে রক্ষা করে, একসঙ্গে রাখে। দুই, এনভেলপ থেকে বেরিয়ে থাকা পায়ার মত স্পাইক প্রোটিন  মানুষের দেহকোষের সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপন করে। কোরোনাভাইরাসের স্পাইক প্রোটিন হল পেনড্রাইভের USB কনেক্টর আর আমাদের কোষের মেমব্রেনে বসে থাকা ACE২ রিসেপ্টার  প্রোটিন হল USB পোর্ট। খাপে খাপে লাগলেই ডেটা ট্রান্সফার শুরু। একটু পরে ভাইরাল RNA ক্যাপসিড আর এনভেলপের খোলস ছেড়ে বেরিয়ে আসে কোষের সাইটোপ্লাজমে (cytoplasm), আর এসেই প্লেন হাইজ্যাক করে নেয়। তখন সে কোষকে নিজের সাধারণ কাজকর্ম করতেই দেবে না - হুকুম দেবে 'তুই এখন আমার ক্রীতদাস ! আর সব কাজ বন্ধ করে শুধু আমার জন্যে ভাইরাল প্রোটিন আর RNA বানাবি। ' কোষ তাই করতে বাধ্য হয়, এবং কয়েক ঘন্টা পরে যখন ব্যাগার খেটে খেটে মরে যায় তখন ওর ঝিল্লি ফাটিয়ে বেরিয়ে আসে নতুন কোরোনাভাইরাস প্রজন্ম, তাদের মধ্যেও সেই একই RNA, একই ক্যাপসিড , একই এনভেলপ।  পেনড্রাইভ থেকে ডেটা ট্রান্সফার আর কপি করার মতো হুবহু এক না হলেও অনেকটা মিল অনস্বীকার্য।'

চন্দন: হ্যাঁ, মনে আছে।

নন্দন: তাহলে এবার বল তো - কোনোদিন দেখেছিস যে ডেস্কটপ বন্ধ বা ল্যাপটপের পাওয়ার অফ, অথচ তখনও পেনড্রাইভ data দেখাচ্ছে, data কপি করছে ??? না। এটা যে অসম্ভব সেটা তুইও জানি আমিও জানি। হয় না, হতে পারে না। আর অনেকটা একই কারণে একটি মৃতদেহ থেকে actively লক্ষ্ লক্ষ কোরোনাভাইরাস বেরিয়ে আসতে পারে না।

চন্দন: ওহ হ্যাঁ , তাই তো।  লোকটা তো মরেই গেছে, তার মানে তার কোষগুলোও মরে গেছে।  মরা কোষ থেকে আর নতুন ভাইরাস তৈরী তো হবে না।

নন্দন: exactly ! Cell Biologyর বেশি detailsএ ঢুকবো না। তবে স্কুলপাঠ্যে যেসব জিনিস প্রায় সবাই পড়েছি/ পড়ছি তা টেনে এনে বলি - ভাইরাস যে আক্রান্ত কোষে নিজের বংশবৃদ্ধি করবে, তারপর কোষের সাইটোপ্লাজম, Endoplasmic reticulum, Golgi body, cytoskeleton, vesicles ও membraneএ অবস্থিত প্রোটিনের সাহায্যে বেরিয়ে আসবে এই সব কিছু করতে বেশ কিছুটা এনার্জি লাগে।  ঠিক যেমন পেনড্রাইভ'র কাজ করতে ডেস্কটপ /ল্যাপটপ power on রাখতে হয়।  আর প্রাণীদেহে এনার্জি কোন অনু থেকে আসে আমরা প্রায় সবাই জানি - ATP .

চন্দন: আরে তাই তো।  ATP . মনে আছে - কোষের এনার্জি কারেন্সি। ...

নন্দন: একদম।  এই যে খাওয়াদাওয়া করছি , খাওয়াদাওয়া যাতে করতে পারি সেই জন্যে সকাল-বিকেল-রাত্রি রোজগারের চেষ্টা করছি, সেই দুশো বছর আগের ঈশ্বরী পাটনীর 'আমার সন্তান যেন থাকে দুধে ভাতে' থেকে আজকে আমাদের 'মাল কামাতে হবে' সব কিছুর ফাইনাল লক্ষ্য হচ্ছে - ATP তৈরী। কারণ,  ATP থেকে এনার্জি না পেলে আমাদের কোষগুলি কোনো কাজই করতে পারবে না।খুব বেশি simple করে বললে 'যতক্ষণ ATP ততক্ষন জীবন' ..... আর মৃত্যুর প্রায় সঙ্গে সঙ্গে এই ATP তৈরিও প্রায় পুরোটাই বন্ধ হয়ে যায়।

চন্দন: তাই ?

নন্দন: তাই না? ATP কোথায় তৈরী হয়?  কোষের মাইটোকন্ড্রিয়ায়।  আর সেখানে কি লাগে? খাবার থেকে গ্লুকোজ , আর ফুসফুস থেকে অক্সিজেন। অক্সিজেন কে পৌঁছে দেয় ? রক্ত।  রক্ত নিজে যায় কি করে? হার্ট বিট করে চলে তাই, পাম্পের মত।  ডেড বডি'র হার্ট বিট চলতে থাকে????

চন্দন: ওহ তাই তো! হার্ট বন্ধ, মানে রক্ত সাপ্লাই বন্ধ, মানে অক্সিজেন আর পৌঁছবে না , মানে ATP আর হবে না। তাহলে আর নতুন ভাইরাস তৈরী জন্যে এনার্জি পাওয়া যাবে না।

নন্দন: ঠিক তাই।  শুধু তাই না, রক্ত সাপ্লাই বন্ধ হলে কোষ ও কলা (cell and tissues ) অন্য সব সাপ্লাইও বন্ধ হবে।  যা মালমশলা ভেতর আছে তা দিয়ে কিছুক্ষন চলবে, কিন্তু তারপর আর কোষের স্ট্রাকচার বা আধারকে ধরে রাখার ব্যবস্থা ও থাকে না।  আস্তে আস্তে সব নষ্ট হতে থাকে। নতুন ভাইরাস পাবি কোথা  থেকে?

চন্দন: কিন্তু যে ভাইরাস অলরেডি তৈরী হয়ে গেসল?

নন্দন: দেখ, ভাইরাস তৈরী হলেই তো হল না। সাইটোপ্লাজম থেকে সেটা ঝিল্লি অবধি যেতে হবে। মাঝপথে  Endoplasmic reticulum, Golgi body, cytoskeleton, vesicles ইত্যাদির কিছু কাজ আছে একটা পরিপূর্ণ ভাইরাস করতে , বেশ কিছু cellular pathways আছে এবং সেগুলোও এনার্জি টানে। আর এখন আর ATP নতুন করে তৈরী হচ্ছে না।  ফলে পুরো ব্যাপারটাই ফেল করতে থাকে।  
আক্রান্ত কোষের মধ্যে কোরোনাভাইরাস তৈরির প্রক্রিয়া।  
(Reference: Alsaadi AL and Jones IM (2019) Future Virol. pp.275-286)

চন্দন: আচ্ছা। ...

নন্দন: হ্যাঁ, এটা ঠিক যে ফুসফুস আর শ্বাসনালীর কোষগুলি যখন নষ্ট হবে তখন কিছু ভাইরাস ওই ভাঙাচোরা কোষ থেকে বেরিয়ে আসতে পারে। সম্ভবত আসেও।  কিন্তু এটাও ভেবে দেখ, মৃতদেহ তো আর নিঃশ্বাস নিচ্ছে-ছাড়ছে না যে সেই ভাইরাস হুশহুশ করে বেরিয়ে আসবে! তাই মৃতদেহ থেকে droplet ইনফেকশন হবার সম্ভাবনা প্রায় নেইই।  

চন্দন: হ্যাঁ রে, ফালতু ভয় তৈরী হয়েছে বুঝছি।  তাহলে একদম বিপদ নেই বলছিস? ..... 

নন্দন: একটা ব্যাপার আছে। অসুস্থ দেহ যা এখন মৃত তার থেকে নানারকম রস, যেমন কিছুটা লালা, সর্দি, শ্লেষা , রক্ত বেরোতে পারে।  সেই সবে ভাইরাস থাকতেই পারে।  তাই WHO আর স্বাস্থ মন্ত্রক একদম নিয়ম করে দিয়েছেন যে মৃতদেহ গ্লাভস PPE পরে হ্যান্ডেল করতে হবে।  কিভাবে কি করতে হবে ওদের ওয়েবসাইটেই আছে। সেসব নিয়ম পালন ও হচ্ছে। 

চন্দন: তাহলে লোকজন এত ভয় পাচ্ছে কেন? 

নন্দন: হুজুগ। অন্তত WHO অথবা সেন্ট্রাল বা রাজ্য হেলথ মিনিস্ট্রি ওয়েবসাইট দেখলে কাজ হত, তা না করে হোয়াটস্যাপ গাঁজা পড়লে শেয়ার করলে যা হয়। আরে তুই বল না - বডিব্যাগ করে যদি বডি শ্মশানের চুল্লিতে ঢুকিয়ে দেয় তাহলে ৮০০-১০০০ ডিগ্রীতে তাহলে ওই temperatureএ কোন ভাইরাসের বাপের চোদ্দ পুরুষ টিকবে ? এতো সবচেয়ে সোজা কথা ! নিয়ম মত কবর দিলেও কি মাটি থেকে কিলবিল করে ভাইরাস বেরিয়ে আসবে??? পা আছে ওদের???? 

চন্দন: এটা দারুন বলেছিস  .....সত্যি তো    ....আর তা না করে বডি ফেলে রেখে লোকজন ঝগড়া হাতাহাতি করছে।  

নন্দন: বেশি বুদ্ধি হলে যা হয় আর কি !

চন্দন: আপনজনেরা এক একবার শেষ দেখা দেখতে পাবে না ?

নন্দন: কেন পাবে না? তবে হাত দেওয়া, জড়িয়ে ধরা, আদর করা বারণ। খুবই দুঃখজনক কিন্তু কি করা যাবে বল ? ....দেখ, শোলে'র সেই ডায়লগ -টা মনে আছে? সঞ্জীব কুমার বলছেন, 'samaj aur biradariwale insaan ko akelepan se banchane ke liye bane hai....' একই ব্যাপার  এখানেও - সেই নিয়ম কোনো নিয়মই নয়, যেখানে মনুষত্ব নেই। সেই বিজ্ঞান কোনো বিজ্ঞানই নয়, যেখানে মানুষের জন্যে দরদ নেই।  ...সাবধানে নিয়ম মানলেই হল  .....

চন্দন: তা বটে  .....বিদ্যে বোঝাই বাবুমশাই হয়ে কি লাভ? 

নন্দন: এই দুর্দিনে  যদি নিজেদের মধ্যে বিজ্ঞান সম্মত ভাবে নিজেদের মধ্যে cooperate না করি চলবে? ভাব তো - যদি আমেরিকা ইতালির মত যদি এখানে হয় সবাই কি একে ওপরের গলা টিপতে যাব ? তাতে লাভ হবে, না রুল মেনে পাশে থাকলে কাজ দেবে ? Physical distancing and social unity. 





https://www.indiatoday.in/information/story/coronavirus-death-india-how-handle-covid-19-dead-bodies-1657799-2020-03-20
https://www.wbhealth.gov.in/uploaded_files/corona/COVID19GuidelinesonDeadbodymanagement.pdf
https://thewire.in/rights/chennai-simon-hercules-doctor-covid-19
https://www.futuremedicine.com/doi/pdf/10.2217/fvl-2018-0144



  





No comments:

Post a Comment

 স্কুল খুলুক, সঙ্গে হাওয়া বাতাস খেলুক ক্লাসঘরে ('এই সময়' সংবাদপত্রে প্রবন্ধ -  ২২শে সেপ্টেম্বর, ২০২১)      সোজাসাপ্টা অপ্রিয়   সত...