Sunday, April 26, 2020

কিটের কাহিনী - কেন যে কাজ করার সময় কাজ করে না !? 
(করোনা বিজ্ঞানের খুচরো খবর-৮)


''কত বার বলতে হবে??? আমি জানতে চাই কতবার আমাকে বলতে হবে যে চাইলেই ইচ্ছেমত কিট (kit) পাওয়া যায় না? আগে থেকে প্ল্যান করতে হয়...''

বছর কয়েক আগের কথা।  আমরা ৫-৬ জন থুম মেরে দাঁড়িয়ে আছি।  আমার পিএইচডি গাইড (নামকরা মলিকুলার মাইক্রোবায়োলজিস্ট - যেমন নামডাক, তেমন বাজখাঁই হাঁকডাক) সবার ওপর রাগে ফেটে পড়েছেন।

যে কথাটা বলছেন সেটা অবশ্য নতুন নয়।  আর তাই ওঁর রাগ justified ছিল।  আজ বুঝি কত বেশি justified . একেই বলে অভিজ্ঞতা।...

স্যার আবার গলা তুললেন, '' আমি হাজার বার বলেছি সায়েন্স কেমিক্যাল আর কিট অর্ডার বাজারে বা শপিং
মলে যাওয়া নয়। গেলাম-ঘুরলাম-কার্ড দিলাম-জিনিস তুলে আনলাম তা নয়। ও ভাবে হয় না। তাই যে experiment বা টেস্ট  করার প্ল্যান হচ্ছে সেটা অন্তত ১-২ মাস আগে থেকে প্ল্যান করে আমাকে জানাবে।  তখন বিভিন্ন কোম্পানি ওয়েবসাইট ঘেঁটে নিজের প্রয়োজন বুঝে, কোটেশন চাইতে হবে।  তারপর সেটা যাবে, উত্তর আসবে , কথাবার্তা হবে , তারপর দেখেশুনে অর্ডার করা হবে, একাউন্টস ডিপার্টমেন্ট জানবে, ওদিকে কোয়ালিটি চেক করে পাঠাবে  সে জিনিস প্লেনে আসবে , কাস্টমস পেরোবে (তাদেরও বলে রাখতে হবে), ডেলিভারি হবে ....'

সিনিয়র হিসেবে আমাদের জানা কথা, স্যার জুনিয়রদের জন্যে বেশি করে বলে চললেন , ''...তারপর সেই কিট ল্যাবে এসে পৌঁছলে সেটা চেক করবে তোমরা, ভাল হলে ভাল, খারাপ হলে সঙ্গে সঙ্গে রিপোর্টিং, আবার replacement. আর এসবে টাইম দিতে হয়। 'উঠলো বাই তো কিট চাই' করলে গন্ডগোল হবেই।ওরাও লাভের জন্যে তাড়াতাড়ি চেক না করে পাঠাতে পারে  ......

'কিন্তু স্যার ওরা ভুল করলে আমাদের কি দোষ ?', এক সহকর্মী একটু ডিফেন্ড করার চেষ্টা করলো।

স্যারের ইয়র্কারে স্টাম্প ছেৎরে গেল, 'টেস্ট কে করছে? তুমি না ওই কোম্পানি? এক্সপেরিমেন্ট কার? টাকা কার? তোমার না ওদের? তোমার। তাহলে দায়ও বেশি তোমার।  আর তাই আগে থেকে প্ল্যান করার দায়িত্ব তোমারই।  ...(স্যারের গলা আরো চড়ে গেল) - আরে বাবা! তাড়াহুড়ো করে জিনিস কিনলে ভুল হবার চান্স থাকে কি না? ঠকে যাবার চান্স বেশি হয় কি না ??? আর এখানেও সেই একই জিনিস। ....তখন টাকা নষ্ট, সময় নষ্ট, পন্ডশ্রম। যেটা হড়বড় করে হয় না, সেটা হয় না। ....এটা সরকারি টাকা , ফালতু নষ্ট করার নয়।  ....  মনে থাকবে  ...??!!'

মানুষ ঠেকে শেখে। আজ এত বছর পরে স্যারের সেই 'জ্ঞান' বারবার মনে পড়ছে আমাদের অনেকের। সপ্তাহ দুই তিন ধরে এই নিয়ে বন্ধুমহলে আলোচনাও চলছে। বলাবলি করছিলাম , 'যা আসছে কিটগুলো কাজ করলে হয়।....', আমি আগের একটা ব্লগে লিখেওছিলাম।  সবাই আশা করে আছি , বিজ্ঞানীরাও।  কিন্তু যেটুকু ট্রেনিং আছে তাতে জানি চাওয়া/না-চাওয়া/ ইচ্ছে /অনিচ্ছে/আশা / হতাশা এগুলো সব আমাদের মানবলোকের ইমোশন।  এর সঙ্গে না-মৃত-না-জীবিত করোনাভাইরাস ও কঠিন বৈজ্ঞানিক সত্যের প্রায় কোনো সম্পর্ক নেই। আর বিজ্ঞান ছাড়াও এটা তো অনেকটা ডিমান্ড-সাপ্লাই'র সোজা ব্যাপার।  ফেব্রুয়ারি আর মার্চে যদি ভারত রেডি হতে শুরু করত, ppe কিনত, export বন্ধ রাখত আর প্রোডাকশন বাড়িয়ে ফেলত, আরো অনেক কিট অর্ডার করে রাখতো তাহলে আজ কি এই অবস্থা হত ? আজ তো গন্ডগোল হবেই। ওই একই কিট সারা পৃথিবী কিনতে চাইছে। আর প্রোডাকশন যদিও বা বাড়ে তার একটা লিমিট আছে। তাই এই অবস্থায় সাপ্লাই-এ দেরি হওয়া স্বাভাবিক, কোয়ালিটি খারাপ হওয়া স্বাভাবিক,  ট্রান্সপোর্টের সময় ঠিকঠাক স্টোর হচ্ছে কি না (অনেক কিছুই ঠান্ডায় রাখতে হয় ) তাই বা কে জানে , দামও বেশি পড়তে প্রায় বাধ্য।স্যারের কথায়, '' যেটা হড়বড় করে হয় না, সেটা হয় না''!

বলতে বাধ্য হচ্ছি, এসব চলবে। তাই ওই নিয়ে বেশি কাঁদুনি গেয়ে লাভ নেই। প্রশ্ন হচ্ছে -  কোনো লং টার্ম সল্যুশন আছে? হয়ত আছে। দেখুন, সোজা করে বলার চেষ্টা করি। একটি কিট বলতে বোঝায় কিছু কেমিক্যালের সমষ্টি।সাত-আটটা কেমিক্যাল। ছোট ছোট টিউবে ভরা থাকে, আর টিউবগুলো একসঙ্গে একটা বাক্সে বা প্যাকেটে থাকে। যেমন রিয়েল টাইম RT-PCR করতে লাগে রিভার্স ট্রান্সক্রিপ্টেস আর ট্যাক পলিমারেস দুটি এনজাইম , চারটে dNTP, ট্রিস বাফার, বিশুদ্ধ জল, ট্যাকম্যান ফ্লুরেসেন্ট প্রোব, আরো টুকিটাকি। যখন টেস্ট করা হয় তখন সেগুলো পর পর মিশিয়ে চট করে শুরু করে দেওয়া যায়।  মানে ওই রান্না করতে হলে নিজে না বেটে যদি সব প্যাকেটের মশলা, বা আদাপেস্ট টুক করে কড়ায় দিয়ে দিলেন। অনেকটা সেই রকম সুবিধে।কিন্তু, তার মানে এই নয় যে কিট অপরিহার্য। কোম্পানির নামকরা গুঁড়োমশলা বা আদা-রসুন পেস্ট না থাকলে কি রান্না হয় না? তেমনি কেমিক্যালগুলো কিট ছাড়াও পাওয়া যায়, এবং  অভিজ্ঞতাসম্পন্ন বিজ্ঞানীরা কিট ছাড়াও একই রিয়াক্সন করতে পারেন। কেমিক্যালগুলো  দরকার।
কিয়াজেন কোম্পানির কিট 
আমাদের দেশে এইসব কেমিক্যাল মূলত বাইরে থেকে আসে। দেশে যে কিছু তৈরী হয় না তা নয়, তবে ভালো কোয়ালিটির জিনিস আজও বাইরে থেকে আসে।  এটাই চলে আসছে - কেন এতগুলি বিশ্ববিদ্যালয় আর ইনস্টিটিউট, এত বায়োটেক কোম্পানি এদিকে নজর দেননি সেটার সম্ভবত কোন সদুত্তর নেই। সে যাই হোক, আজ বিপদের দিনে যদি কোন রাজ্যের উনিভারিসিটি, ইনস্টিটিউট আর কোম্পানির বিজ্ঞানীরা এক হবার সুযোগ পেতেন, এবং তাঁদের আর্থিক সুবিধে দেওয়া হত, তাহলে অন্তত বেশ কয়েকটা কেমিক্যাল বানানো যাবে না এটা হতে পারে না। মনে রাখবেন ভারতের নামকরা বিজ্ঞানীরা অনেকেই পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ উনিভার্সিটি থেকে বিজ্ঞান শিখে এসেছেন। পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ বিজ্ঞান জার্নালে তাঁদের একাধিক গবেষণাপত্র প্রকাশিত হয়েছে। জ্ঞান ও অভিজ্ঞতা তাঁদের প্রচুর - আন্তর্জাতিক বিজ্ঞানের লর্ডস মাঠে তাঁরা সেঞ্চুরি হাঁকিয়ে এসেছেন। সুতরাং, এক হয়ে বসলে, সুযোগ দেওয়া হলে,  বেশ কয়েকটা কেমিক্যাল বানাতে পারবেন এতে কোন সন্দেহ নেই।  আর যে দু-একটা প্রযুক্তিগত কারণে দেশে করা সম্ভব হত না সেগুলো ইম্পোর্ট করতে হবে। এসব হবে কি হবে না সে তো পরের কথা, তবে এটা বলতে পারি করলে খরচ অনেক কমে যেত। বিদেশী ব্র্যান্ডেড কম্পিউটারের  থেকে assembled কম্পিউটার কেনা যেমন শস্তা এটা অনেকটা সেইরকম ব্যাপার।

তাছাড়া যেমন বিভিন্ন কোম্পানির মোবাইল বা টিভি বা গুঁড়ো সাবান মোটামুটি এক হলেও অল্পস্বল্প তফাৎ থাকে, তেমনই বিভিন্ন কোম্পানির কিটের মধ্যে কিছু তফাৎ থাকে। থাকবেই।  আর সেই জন্যে প্রতিটা কিটের গুণমান আলাদা করে মাপতে হয়। না হলে যে রিয়াক্সন এতদিন দিব্যি হচ্ছিল, সেটা নতুন কিটে কাজ করা বন্ধ করে দেয়।  পসিটিভ হয়ে যায় নেগেটিভ!  আসলে নেগেটিভ নয়, বিজ্ঞানের পরিভাষায় false নেগেটিভ।এবার বোঝো ঠ্যালা। তখন আবার নতুন করে সব চেক কর রে, আগাপাস্তলা কোয়ালিটি দেখ রে - সময় নষ্ট,  পরিশ্রম, ওদিকে আসল রুগীদের টেস্ট জমে যাচ্ছে ! কিন্তু, একটাই স্টেডি সাপ্লাইয়ের ব্যবস্থা হলে সেই ঝামেলা বাইপাস হয়ে যায়। আর যাঁরা টেস্ট করছেন আর যাঁরা কেমিক্যাল তৈরী করছেন তারা একই রাজ্যে বা পাশাপাশি রাজ্যে হলে তাদের মধ্যে কথাবার্তা, আলোচনা rapport অনেক better হত।  ধরুন, কোন একটা কেমিক্যাল কাজ করছে না বলে সন্দেহ, দ্রুত কথা বলে নেওয়া যেত।  আর তার দুদিন পরে শুধু ওই বিশেষ কেমিক্যালটাই চলে এল, গোটা কিট কিনতে হল না। একই টিমের লোক কাছাকাছি থাকলে আর ভালো যোগাযোগে হলে যা হয়, আর কি। কোয়ালিটির তফাৎ হবে না ? হতে পারে, গুনগত মানে  বিশ্বের একদম শ্রেষ্ঠ কেমিক্যাল নাও হতে পারে।  কিন্তু মোদ্দা কথা হচ্ছে ঠিকঠাক রেসাল্ট দিচ্ছে কি না।দিলেই তো হল। ....

এ অসুখ যে চট করে যাবার নয় বুঝতেই পারছেন। ভ্যাকসিন আসবে, এন্টিভাইরাল আসবে, কিন্তু সেসব তো ম্যাজিক বা তুকতাক নয় - কিছুটা সময় তো দিতেই হবে। তাই কিট বা কেমিক্যাল আমাদের লাগবেই। কতদিন আর বিদেশের মুখাপেক্ষী হয়ে থাকবেন? তারাই বা সবসময় নিজেদের দেশ ছেড়ে আমাদের হয় কোয়ালিটি জিনিস দেবে কে গ্যারান্টি দিয়েছে? তাই শুরু করলে আজ নয়, কিন্তু মাস খানেকের মধ্যে বেশ কিছুটা এগোনো যাবে। হয়তো এমন একদিন এল যেদিন সেই কেমিক্যাল অন্য রাজ্যদেরও সরবরাহ করা গেল। রাজ্যের নামও হল , কিছু আর্থিক লাভও হল। ইচ্ছে থাকলে উপায় হয়, অন্তত কিছুটা তো হয়। ....

এই হল ব্যাপার। আর কি বলব ? এখানে রিয়েল টাইম RTPCR কিটের কথা আলোচনা করেছি। আন্টিবডি টেস্ট কিট আলাদা হলেও ওপরের সব কথাই কম বেশি প্রযোজ্য। আর জানেনই তো, দুদিন ব্যবহারের পরে এখন সারা দেশে ওই কিট দিয়ে টেস্ট স্থগিত রাখা হয়েছে।

সবাই ভাল থাকবেন।  সুস্থ থাকবেন। আবার কথা হবে।



(ছবি : https://www.qiagen.com/in/products/discovery-and-translational-research/pcr-qpcr/real-time-pcr-enzymes-and-kits/probe-based-one-step-qrt-pcr/quantitect-probe-rt-pcr-kit/?clear=true#orderinginformation)








  

No comments:

Post a Comment

 স্কুল খুলুক, সঙ্গে হাওয়া বাতাস খেলুক ক্লাসঘরে ('এই সময়' সংবাদপত্রে প্রবন্ধ -  ২২শে সেপ্টেম্বর, ২০২১)      সোজাসাপ্টা অপ্রিয়   সত...