Sunday, May 31, 2020

পশ্চিমবঙ্গের করোনা লড়াই - 
মে মাসের পরিসংখ্যান বলছে উন্নতি করেছে, কিন্তু  ....
(করোনা বিজ্ঞানের খুচরো খবর - ১০)

আপনাদের হয়েছে কিনা জানিনা, কিন্তু আমি সকাল সন্ধ্যে টিভিতে ওই 'ডাকাত পড়েছে রে '-মার্কা করোনা'র খবর দেখে (দেখিও না, কিন্তু কানে তো ঢুকছে) বিরক্ত হয়ে গেছি।এমন করে হেঁড়ে গলায় হেডলাইনে বলে যেন কোন করোনা আক্রান্ত একজন দাগী অপরাধী! আর তারপর যেন কম্পিটিশন - কে কত সংখ্যা বলতে পারল আজ। যেন আইপিএল'র খেলা হচ্ছে, রান বাড়ছে।ব্যাস, হয়ে গেল, আর কোন তথ্য নিয়ে আলোচনা নেই।আর সেই অবৈজ্ঞানিক horror story-type উপস্থাপনা দেখে সবাই ভয়ে জুজুবুড়ি হয়ে শুরু করল 'কি হবে কি হবে' ! ভয়ে হার্টফেল করে যাবার জোগাড় !   লক্ষ্য করে দেখবেন, এর জন্যে কিন্তু লোকজন  বেশ বেশি ভয় পেয়ে আছেন।

তাই ভাবলাম,  রাজ্যের covid পরিস্থিতির তথ্য একটু খুঁটিয়ে দেখা যাক। যতটা সম্ভব চলিত ভাষায় লিখে আপনাদের সঙ্গে শেয়ার করা যাক। তথ্য সব তো পাবলিক ডোমেনেই আছে। অবশ্য, আমি স্টাটিস্টিশান নই, এপিডেমিওলোজিস্টও নই, সেই M.Scর সময়ে এপিডেমিওলজি পড়েছিলাম বটে, এখন কিছুটা ভুলেও গেছে।  তাই বেশি ডিটেলে যাব না। কিন্তু কিছুটা তো বের করে সহজভাবে আপনাদেরও সঙ্গে শেয়ার করাই যায়। তারপর বিশ্বাস-অবিশ্বাস-যুক্তি-তর্ক-গপ্পো, আমার লেখার মধ্যে আমরা- ওরা রাজনীতি খোঁজা আপনার ব্যাপার। সে করবেন করুন, আমার কিছু বলার নেই ।আমার 'নেই কাজ তো খই ভাজ' কাজ হল পশ্চিমবঙ্গের covid-১৯ সংক্রান্ত কিছু তথ্য  শেয়ার করা।

১. গত মাসের মাঝামাঝি অভিযোগ ওঠে যে রাজ্যে টেস্ট অনেক কম হচ্ছে। এই নিয়ে প্রচুর চাপানউতোর চলে, রোগ চাপার অভিযোগ আসে, অকেজো কিট সাপ্লাই হয়েছে সেটা কিছুটা স্বীকারও হয়,  '১৮ না ৫৭' নিয়ে চেঁচামিচি চলে, ইত্যাদি। তারপর এক মাস কেটে গেছে। দেখা যাচ্ছে, ৩০শে  এপ্রিল অবধি রাজ্যে টেস্ট হয়েছিল ১৬,৫২৫, আর আজ ৩০শে মে টেস্ট হয়েছে ১ লক্ষ ৮৫ হাজারের কিছু বেশি। এবং যেখানে এক মাস আগে টেস্ট হত দিনে ৪০০-৫০০, সেখানে আজ ৯,০০০র বেশি পরীক্ষা হচ্ছে (ছবি ১)। এমনকি উমপুন্ সাইক্লোনের দিনেগুলিতেও ৪-৫ হাজার পরীক্ষা হয়েছিল।উন্নতি অনস্বীকার্য।
ছবি ১: ৪ঠা মে থেকে ৩০শে মে অবধি রাজ্যে প্রতিদিন কত করে করোনা পরীক্ষা হচ্ছে।  
ল্যাবের সংখ্যাও বেড়েছে।  ৪ঠা মে ১৬টি ল্যাব টেস্ট করছিল, আর আজ করছে ৪০টি।  এদের মধ্যে সিংহভাগ সরকারি।এবং তাই, গত মাসে যেখানে পশ্চিমবঙ্গে টোটাল টেস্টের সংখ্যা প্রায় সব রাজ্যের তুলনায় কম ছিল, আজ টেস্টের পরিসংখ্যানে এই রাজ্য চড়চড় করে ওপরের সারিতে উঠে এসেছে  (ছবি ২)। প্রসঙ্গত বলি, গত মাসে যখন কয়েকজন বন্ধুকে বলেছিলাম যে কম টেস্ট হচ্ছে bad science and bad public relations তখন তারা বেশ চোটে গেসল।  আজ এই প্রশংসনীয় উন্নতি দেখলে জানি তাদেরও ভালো লাগবে। 
ছবি ২: বিভিন্ন রাজ্যে সব মিলিয়ে কত করোনা পরীক্ষা হয়েছে।  

২. এর সুফল ও পেয়েছেন  রাজ্যবাসী।  কারণ, গত এক মাসে positive/test ratio (অর্থাৎ কটা টেস্ট হল আর তার মধ্যে কটা পসিটিভ এল ) ৫.০১% থেকে নেমে হয়েছে ২.৬৪% (ছবি ৩). এর থেকে দুটি ব্যাপার conclude করা যেতে পারে।  এক, আগে  মূলত রুগী (এবং গুরুতর অসুস্থ রুগী) এবং তাঁর কাছাকাছি যাঁরা আছেন তাদের পরীক্ষা হচ্ছিল।  তাই পসিটিভ বেশি ছিল। কিন্তু,  এখন আক্রান্ত খোঁজার জন্যে টেস্ট আরো বাড়ানো হয়েছে এবং খুব সম্ভবত মহারাষ্ট্র, গুজরাটের ও দিল্লীর মত এখনো এখানে ভাইরাস  সমাজে খুব বেশি ছড়িয়ে পড়েনি। তাই, অনেকের জ্বর সর্দি কাশি হলেও টেস্ট করলে দেখা যাচ্ছে তিনি নতুন করোনা ভাইরাস দ্বারা আক্রান্ত নন, রেসাল্ট নেগেটিভ আসছে আর ওই ratio কমে যাচ্ছে।
ছবি ৩: পশ্চিমবঙ্গে কত টেস্ট হয়েছে তার মধ্যে করোনা আক্রান্ত (পসিটিভ) ক'জন?  মে মাসের হিসেবে। করোনা আক্রান্তের % বেশি হলে গ্রাফ উর্ধমুখী, কমতে থাকলে নিম্নগামী। 

৩. উল্লেখযোগ্য যে মে মাসের গোড়ায় রাজ্যের এই ratio ভারতের গড় ratioর থেকে  বেশি ছিল।   কিন্তু মাসের ১৪-১৬ তারিখ নাগাদ থেকে তা কমেতে শুরু করে এবং আজ সেটা ন্যাশনাল গড়ের তুলনায় অনেকটাই কম -২.৬৪% vs ৬.৫% (ছবি ৪) ।
ছবি ৪:  পশ্চিমবঙ্গে আর ভারতে কত টেস্ট হয়েছে তার মধ্যে করোনা আক্রান্ত (পসিটিভ) ক'জন?  মে মাসের হিসেবে। করোনা আক্রান্তের % বেশি হলে গ্রাফ উর্ধমুখী, কমতে থাকলে নিম্নগামী। 

শুধু তাই নয়, বেশি পরীক্ষা হবার ফলে গত একমাসে এই রাজ্যের tests per million (অর্থাৎ প্রতি দশ লক্ষ জনসংখ্যার কতজনের টেস্ট হয়েছে) সেটাও লাগাতার বৃদ্ধি পেয়েছে (ছবি ৫)।  সোজা কথায়, পশ্চিমবঙ্গের তুলনায় ভারতের অনেক রাজ্যে করোনা-আক্রান্ত  সংখ্যা বেশ বেশি, এবং পশ্চিমবঙ্গে 'খুব কম পরীক্ষা হয়েছে তাই আক্রান্তের সংখ্যা পাওয়া যাচ্ছে না' এই অভিযোগ আর আগের মত অতটা খাটে না।  অবশ্য, এর মধ্যে কিছু টেস্ট আছে যেগুলি যাঁরা আক্রান্ত তাঁদের re-টেস্ট করার সময় করা হয়েছে। শুনেছি, চিকিৎসাধীন থাকার সময় দুটি টেস্ট করা হয়।কিন্তু exact re-test সংখ্যা আমার পক্ষে জানা সম্ভব নয়। যাই হোক, এতে কোন সন্দেহ নেই যে আগের থেকে অনেক বেশি টেস্ট হয়েছে এবং তা সত্ত্বেও এই পরিসংখ্যান রাজ্যের পক্ষে আশাব্যাঞ্জক।

ছবি ৫: প্রতি ১০ লক্ষ্য জনসংখ্যায় কতজনের করোনা পরীক্ষা হল? এই রাজ্যের মে মাসের হিসেবে।উন্নতি করেছে।   

৪. বিজ্ঞানী, টেস্ট সেন্টারের কর্মী, ডাক্তার, চিকিৎসাকর্মী, কর্পোরেশনের কর্মী (যাঁরা রোজ এখন বাড়ি-বাড়ি গিয়ে খোঁজ নিচ্ছেন) - এঁদের সবার যৌথ প্রচেষ্টা যে গত মাসের 'পথ ভোলা পথিক' attitude থেকে পশ্চিমবঙ্গকে ফিরিয়ে এনেছে তা অবশ্যই প্রশংসনীয়। তবে, এতে আত্মতুষ্টি'র কোন কারণ নেই। তার একটি কারণ  - রাজ্যের tests per million বাড়লেও অন্য অনেক রাজ্যের তুলনায় তা এখনো কম (ছবি ৬)।
ছবি ৬: প্রতি ১০ লক্ষ্য জনসংখ্যায় কতজনের করোনা পরীক্ষা হল? সব রাজ্যের পরিসখ্যান।   

এর একটা কারণ অবশ্য রাজ্যের জনসংখ্যা - আয়তনে ছোট রাজ্য হলেও, এবং জনসংখ্যা বৃদ্ধির হারে দেশের মধ্যে সবচেয়ে কম হলেও, মোট জনসংখ্যা'র বিচারে পশ্চিমবঙ্গ ভারতের চতুর্থ। তাছাড়া, বেশ কিছু রাজ্য টেস্ট বিষয়ে গোড়া থেকেই সচেতন ছিলেন, এবং তাই তাঁরা আজ tests per millionএ এগিয়ে। সে তো ভালোই। এক সূত্রে গাঁথা আমরা সবাই,  আর ভাইরাসের গতি-প্রকৃতি বুঝতে  সবার রেসাল্ট সবার কাজে আসছে - প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ ভাবে। কিন্তু, যতটা সম্ভব কম খরচে নিপুন ভাবে অনেক টেস্ট করে যেতেই হবে।  ভাইরাস কোথায় আছে সেটা দেখতে এই টেস্ট হল আমাদের 'চোখ'। এও মনে রাখতে হবে টেস্ট হল 'টেস্টিং এবং ট্রেসিং'র অন্তর্গত। epidemiologyর নিয়ম অনুযায়ী টেস্ট করলে কম সংখ্যক টেস্টেও একটি রাজ্য করোনা যুদ্ধে বেশি সফল হতে পারে - বেস্ট প্রমান এখন কেরলা।

৫. আচ্ছা, টেস্ট তো হচ্ছে - কিন্তু সংখ্যা তো বেড়েই চলেছে? রাজ্যে কতজন করোনা আক্রান্ত ? টা আমাদের সবারই একটা বড় প্রশ্ন।  এবং এই মিথ্যে-সোশ্যাল মিডিয়ার যুগে কতরকম গাঁজা যে ঘুরে বেড়াচ্ছে তার ইয়ত্তা নেই।  দেখুন,প্রথমেই বলে রাখা ভাল যে এই সংখ্যা সঠিক ভাবে কেউ জানে না , জানলে তো টেস্ট করতেই হত না। কিন্তু,বিজ্ঞানভিত্তিক কিছুটা আন্দাজ করা যায়।কোথা থেকে ? অনেকভাবে theoretical modeling করা যায়, কিন্তু একটা সোজা উপায় হল  করোনায় আক্রান্ত হয়ে কতজন মারা গেছেন সেই হিসেব থেকে।

প্রশ্ন ১:  দেশে যতজন আক্রান্ত  তাঁদের মধ্যে কত শতাংশ মারা গেছেন (করোনা-আক্রান্ত আর co-morbidity যোগ করে )? উত্তর - ২.০৫% . 
প্রশ্ন ২: সব রাজ্যে কি এই একই  শতাংশ প্রাণ হারিয়েছেন? উত্তর - না।  কোন কোন রাজ্যে ১% র কম লোক মারা গেছেন।  কোথায় সেই সংখ্যায় জাতীয় গড় ২% আশেপাশে, কোথাও ৩% র ওপরে। ব্যতিক্রম দুটি রাজ্য - গুজরাট এবং পশ্চিমবঙ্গ, যাঁদের দুজনেরই covid-19 mortality rate (i.e. death/positives) ৬% র বেশি।  গুজরাটে কি হয়েছে সেই আলোচনায় যাব কিনা, কিন্তু এই  রাজ্যের আরেকটা পরিসংখ্যান দিই - 

৪ঠা মে - রাজ্যে টোটাল আক্রান্ত ১২৫৯ জন, মারা গেছেন ১৩৩ জন।  mortality rate ১০.৫%. 
১১ই  মে - রাজ্যে টোটাল আক্রান্ত ২০৬৩ জন, মারা গেছেন  ১৯০ জন।  mortality rate ৯.২ %. 
১৮ই মে - রাজ্যে টোটাল আক্রান্ত ২৮৪৫ জন, মারা গেছেন  ২৪৪ জন।  mortality rate ৮.৬ %. 
২৫শে মে - রাজ্যে টোটাল আক্রান্ত ৩৮১৬ জন, মারা গেছেন  ২৭৮ জন।  mortality rate ৭.২ %. 
৩০শে মে (গতকাল)- রাজ্যে টোটাল আক্রান্ত ৫১৩০ জন, মারা গেছেন  ৩০৯ জন।  mortality rate ৬ %. 

তার মানে পশ্চিমবঙ্গের mortality rate একসময় আজব রকমের বেশি ছিল।  পৃথিবীর সব দেশের average mortality rateর দেড়গুণ! এ আবার হয় নাকি ? তাহলে কি 'পৃথিবীর সবচেয়ে ভয়ানক কোরোনাভাইরাস একমাত্র পশ্চিমবঙ্গেই এসেছে'? না  'এই রাজ্যের চিকিৎসা ব্যবস্থা সবচেয়ে সবচেয়ে সবচেয়ে খারাপ' ??!! এইসব আষাঢ়ে গপ্পো ফেলে দিন, কারন পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে, যবে থেকে টেস্ট সংখ্যার উন্নতি হয়েছে এই রাজ্যে মৃত্যুহারও উল্লেখযোগ্য ভাবে steadily কমেছে। কি ব্যাখ্যা দেবেন? সম্ভবত দুটি - এক, আগে পরীক্ষা মূলত রুগী (এবং গুরুতর অসুস্থ রুগী) এবং তাঁর কাছাকাছি যাঁরা আছেন তাদের টেস্ট হচ্ছিল; তাই positive to death conversion বেশি ছিল।  এখন সামাজিক লেভেলে টেস্ট বেড়ে যাওয়াতে (এবং যেহেতু এই অসুখের ৮০%র বেশি এমনিতেই সেরে যান, ৯০%র বেশি হাসপাতালের ধারেকাছেও যেতে হয় না - এটা ভুললে চলবে না ) করোনা'য় মৃতের টোটাল সংখ্যা বাড়লেও সেই rate নিম্নগামী। দুই,  তাছাড়া, একটি নতুন অসুখ এলে সেটার গতিপ্রকৃতি বুঝতে কিছুটা সময় তো লাগেই। স্বাভাবিক, এত ম্যাজিক নয় রে বাবা, মছলিবাবাও নয় ! তাই, মনে হয়, অনেক প্রতিকূলতা সত্ত্বেও রাজ্যের ডাক্তার ও স্বাস্থকর্মীরা এখন এই লড়াইয়ে আরো experienced হয়ে উঠেছেন। আমরা তাঁদের কাছে ঋণী।

৬. আচ্ছা, রাজ্যে ৬%ই বা কেন? এটাও তো এখনো যথেষ্ট বেশি । সত্যি, এর উত্তর আমার জানা নেই, আর তেমন খুঁটিয়ে পরিসংখ্যান দেখিনি।  তবে , একটা hypothesis দিতে পারি। যাঁরা মারা গেছেন তাঁদের ৬৫% কলকাতাবাসী। এদ্দিনে আমরা জেনে গেছি যে এই অসুখ মূলত বয়স্কদের জন্যে fatal, এবং কলকাতা শহরটা যে অনেকটা 'বৃদ্ধাশ্রম' হয়ে গেছে সেটা কি আমাদের অজানা ? এই সামাজিক পরিস্থিতির সঙ্গে করোনায় মৃত্যুর একটা যোগাযোগ থাকলে অবাক হবেন না।

৬. তাহলে এবার আগের প্রশ্নে ফিরে যাই।  রাজ্যে কতজন করোনা আক্রান্ত?  দেশের মৃত্যুহার ২.০৫% ধরলে  (৩০৯/২.০৫)x ১০০ = ১৫ হাজারের কিছু বেশি।  যদি রাজ্যের মৃত্যুহার ধরে হিসেবে করেন তাহলে (৩০৯/৬)x ১০০ = ৫১৫০ (যে সংখ্যা আজই অতিক্রান্ত হবে, সুতরাং হতে পারে না ) । তার ওপর মহামারীর হিসেবে ঠিক পাটিগণিতের সহজ পথে চলে না। তবে, এই দুই সংখ্যার মাঝামাঝি ধরলে বলতে হয় আজ অবধি হয়ত ১০ হাজার পশ্চিমবঙ্গবাসী আক্রান্ত হয়েছেন। এদের মধ্যে ৫০০০র কিছু বেশি সন্ধান পাওয়া গেছে টেস্ট করে, অনেকে কোয়ারেন্টাইন হয়েছেন, অনেকে হাসপাতালে।  বাকিদের দ্রুত খোঁজাই হল আসল কথা। কারন, তাঁদের মধ্যে ৭০%র বেশি জানেন ও না যে তাঁরা আক্রান্ত।  এবং তাই তাঁরা এই ভাইরাসের মূল ধারক-বাহক।  

৭. এই  বিষয়ে আরেকটা সংখ্যা দেখা যাক। প্রতিদিন কত টেস্ট হয়, এবং তাতে প্রতিদিন কতজন নতুন আক্রান্তের সন্ধান পাওয়া যায়? এই গ্রাফটা দেখুন (ছবি ৭) - Y axisএ positives/tests PER DAY. গ্রাফটা ওঠা-নামা করছে বটে (সেটা স্বাভাবিক, দিনকে দিন variation যে কোন বৈজ্ঞানিক তথ্যেই হয়ে থাকে; না হলেই সন্দেহজনক), কিন্তু মে'র প্রথমদিকে যত জন আক্রান্তের সন্ধান পাওয়া যেত ১০-১১র তারিখের পর থেকে একই সংখ্যার টেস্ট করলেও তার থেকে অনেক কম পাওয়া  গেছে। তার মানে রাজ্য কিন্তু রোগের ছড়িয়ে পড়া কিছুটা হলেও আটকেছে ।
ছবি ৭: প্রতিদিন কত টেস্ট এবং প্রতিদিন কজন নতুন করে আক্রান্ত।  মে মাসের পরিসংখ্যান।  কমছিল, কিন্তু এবার কি সাইক্লোন আর শ্রমিকদের ফেরায় উর্ধমুখী? 

আমার  ধারণা এই ratio আরো নিচে নামতো। বাধ সাধল দুটি ঘটনা - ঘূর্ণিঝড় উমপুন্ আর ক্লান্ত শ্রান্ত শ্রমিকদের অমানুষিক কষ্ট করে বাড়ি ফেরা। মানুষ বিপদের দিনে, খাবার-দাবার থাকার জায়গা, পকেটে পয়সা না থাকলে বাড়ি ফিরবেই; আমি-আপনি হলেও তাই করতাম। আর ঝড় তো আমাদের নাগালের বাইরে।  এই দুই  থেকে করোনা লড়াইয়ে যে ক্ষতি হল তার আন্দাজ সম্ভবত আমরা এই এখন বুঝতে শুরু করব।আশাকরি আমার এই লেখা যেন ভুল প্রমাণিত হয়, তবে লক্ষ্য করুন গ্রাফ কিন্তু আবার অল্প হলেও চড়তে আরম্ভ করেছে  .....অবশ্য এটাও  শুনেছি, যে অনেক জেলায় নতুন টেস্ট সেন্টার তৈরী হচ্ছে। খুবই প্রয়োজনীয় - শুধু কলকাতা-based টেস্টিং তো কমাতেই হবে।  অবশ্য, তার সঙ্গে সংখ্যাও বাড়বে।চিন্তা হওয়া স্বাভাবিক তবে, আঁতকে ওঠার কিছু নেই - দু মিনিট আগেই তো দেখলেন অন্তত আরো ৫০০০ আক্রান্তের সন্ধান পেতে হবে।

৮. জানি, এসব দেখে কেউ কেউ বলবেন এসব তথ্য ভুলভাল।  সেই ক্ষেত্রে তাঁরই প্রমানের দায়িত্ব কেন তথ্যগুলি ভুল, এবং তিনি অন্য কোন data source ব্যবহার করছেন। সে যে বলবে তার ব্যাপার। বিজ্ঞানের ছাত্র হিসেবে সব জিনিসেই আমার একটা healthy skepticism আছে (এই সন্দেহবাতিকের জন্যে আমার রাজনীতি-করা বন্ধুরা বেশ ক্ষেপে যায় ), এবং সারা পৃথিবীই যে নানা ভাবে 'গুপী' দিচ্ছে এটাও অনেকেই সন্দেহ করেছেন। কিন্তু, তাই বলে 'সব বাজে' বলে ফেলে দেব বা শুধু এই রাজ্য মিথ্যে আর সবাই যুধিষ্ঠির প্লাস হরিশ্চন্দ্র তা তো হয় না। তাহলে তো বলতে হয় 'সূর্য পৃথিবীর চারপাশে ঘোরে '।

৯. যাক সে কথা।  যেটা বলে শেষ করি - এর সঙ্গে যোগ হয়েছে লকডাউন চলবে না তুলে নেওয়া হবে এই নিয়ে নানা মতামত।  দেখুন, বেশি কথায় যাব না, কিন্তু ন্যাশনাল লেভেলে লকডাউন খুব যে আশাপ্রদ হয়নি সে তো ৬০০০-৭০০০-৭৫০০-৮০০০ সংখ্যাই বলে দিচ্ছে। কিন্তু, ভাইরাস না কমুক মানুষের রোজগার তলানিতে এসে ঠেকেছে। একটা ছোট্ট রেগুলার মাইনে-পাওয়া ক্লাস ছাড়া এটা সবার ক্ষেত্রে কম-বেশি সত্যি (তাদের ও পুরো মাইনে কতদিন আসবে একটু সন্দেহ আছে, টাকা তো অর্থনীতির-সাইকেলে ঘোরে। সেই সাইকেল বন্ধ হলে আসতেই থাকবে না কি?....) ৭০ দিন হতে চলল , কম তো নয়।  এই অবস্থায় আমরা সবাই 'গণশত্রু' আর 'অশনি সংকেত'র মাঝামাঝি পড়েছি ।  এবার কোন দিকে যাবেন? -

a) লক ডাউন উঠে গেল, রোজগারপাতি শুরু হল,  খাবার-দাবার বেটার হল, কিন্তু কোরোনাও বাড়তে আরম্ভ করল, b) লক ডাউন চলল আরো কয়েক সপ্তাহ বা মাস।  করোনা হয়তো কমল , কিন্তু রোজগার ? আর অনাহার? ...মনে রাখতে হবে, দুর্বল আধপেটা শরীরে রোগ সহজেই বাসা বাঁধে।  তাহলে? .....

অবশ্য আরেকটা option আছে।  তবে সে আর আমি নতুন কি বলব?  সদ্য নোবেলজয়ী বাঙালি অর্থনীতিবিদ এবং অন্যান্য এক্সপার্টরা যা বলছেন সেসব করলে তো খুবই ভাল হয়। .....

পুনশ্চ : একটা গল্প বলি, অনেকেই জানেন অবশ্য ।  ৩০০০ বছর প্রাচীন হোমারের মহাকাব্যে নায়ক উলিসিস'র জাহাজকে সমুদ্রের এমন একটা জায়গা দিয়ে যেতে হয়েছিল যার একদিকে ছিল ক্যারিবিডিস দৈত্য আর অন্যদিকে ছিল স্কাইলা দানব। উলিসিস পড়েছিল ঘোর বিপদে। কারণ,  স্কাইলাকে এড়াতে গেলে ক্যারিবিডিস জাহাজ ডুবিয়ে দেবে, আর ক্যারিবিডিসকে কাটাতে গেলে স্কাইলা ছোঁ মেরে কয়েকজন নাবিককে তুলে নিয়ে খেয়ে ফেলবে। সেখান থেকেই অমর হয়ে গেছে ইংরিজিতে phrase - between Scylla and Charybdis, between devil and the deep sea. উভয় সঙ্কট। ......আমাদের অবস্থা অনেকটা তাই।  ইশশ! ফেব্রুয়ারি মাসে যদি আমরা দেশের ২০টা এয়ারপোর্ট যদি বন্ধ করে দিতাম । .....

ভাল থাকবেন। আর ভাল করে মাস্কটা পড়বেন।  থুতনিতে নয়! ও আবার কি? হাতে হেলমেট ঝুলিয়ে বাইক চালাবার মত ....পাকামি !?

তথ্য:

https://www.covid19india.org/

https://www.wbhealth.gov.in/pages/corona/bulletin

https://ourworldindata.org/







No comments:

Post a Comment

 স্কুল খুলুক, সঙ্গে হাওয়া বাতাস খেলুক ক্লাসঘরে ('এই সময়' সংবাদপত্রে প্রবন্ধ -  ২২শে সেপ্টেম্বর, ২০২১)      সোজাসাপ্টা অপ্রিয়   সত...