Thursday, January 16, 2020

নারকেলের  তেল, ডেঙ্গির এন্টিবায়োটিক আর মশা 
(Coconut oil as antibiotic against dengue - dehoaxing a whatsapp forward)

অনির্বাণ মিত্র 

এক এক সময় এক একটা হুজুগ ওঠে।  চিরকালই ওঠে অবশ্য,  তবে আজকাল উঠলে ঝট করে ফেসবুক আর হোয়াটস্যাপ দিয়ে ছড়িয়ে যায়। যাকে বলে ভাইরাল! যেমন বছরখানেক আগে কে যেন রটিয়ে দিলো বাড়ির সদর দরজায় নীল রং মিশিয়ে জলের বোতল রাখবেন, আর কুকুর আসবে না। ব্যাস, শুরু হয়ে গেলো! বাড়ি বাড়ি সুতো দড়ি দিয়ে নীল বোতল ঝুলছে ! আর  যেহেতু ডেঙ্গি এখন বেশ হচ্ছে, তাই হোয়াটসাপে একটা 'আকাশবাণী' ঘুরছে -  'নারকেল তেল নাকি ডেঙ্গির  এন্টিবায়োটিক ! তাই ভালো করে মেখে রাখুন।  আর ডেঙ্গির মশা নাকি হাঁটুর ওপরে উড়তে পারে না। (ছবি ১)'
 (pic: Whatsapp forward)


সাধরণত এসব ব্যাপার নিয়ে কিছু বলি না।  আজকাল কিছু বললেই লোকজনের বড় বেশি অভিমান হয়।  মুখ অমনি তেলো হাঁড়ি, ফেসবুকে angry emoticon . তবে, যেহেতু সবার স্বাস্থ -সংক্রান্ত ব্যাপার তাই একটু লিখেই ফেলি। যা ঘুরে বেড়াচ্ছে সেটা কি সত্যি? না ঢপ? পুরো ঢপ  না কি কিছুটা সত্যি?

পোস্টটা দু ভাগে ভাগ করা যায়।  এক নারকেল তেলের ঔষধিক  গুন্গান।  দুই, মশা কতদূর উড়তে পারে।  দ্বিতীয়টা দিয়েই শুরু করা যাক।  ডেঙ্গির মশা নাকি হাঁটুর বেশি উড়তে পারে না- এই বলা আছে।  যা (ইচ্ছে করে ?) বলা নেই তা হলো , কার হাঁটু ? সেই ব্যক্তি তখন কোথায়? রাস্তায় ? না বাড়ির একতলায়? না দুতলায়? তিনতলায়? কারণ, হাঁটু তো সব জায়গাতেই থাকবে!  তাহলে কি ধরে নেবো যে যাঁরা দু তলায় থাকেন, তাদের ডেঙ্গি হবার চান্স শূন্য? সত্যি কি?  আর যদি দুতলায় তিনতলায় হয়, তাহলে কি মশা সিঁড়ি ভেঙে ওপরে ওঠে, উঠে আবার অবশ্য উড়তে শুরু করে , তবে বেশি নয়, ওই হাঁটু অবধি!?  ....গল্পের গরু তালগাছে ওঠার মত একটু বাড়াবাড়ি হচ্ছে না? হচ্ছেই তো - এই না হলে  'হোয়াটস্যাপ বিশ্ববিদ্যালয়ের' জ্ঞান ! ....মশারা যে চার পাঁচ তলার ফ্ল্যাটেও থাকে সেটা তো সবাই জানি , তাহলে এসব ঢপ শেয়ার করার মানে হয় কি ?

এবার নারকেল তেলের ব্যাপারটায় আশা যাক।  এটা অবশ্য নতুন নয়,  অনেকদিনের টোটকা; যাকে বলে 'সবাই জানে', 'শুনেছি'।আমাদের দেশে  কোনো কিছুর সঙ্গে একটা ভেষজ শব্দ জুড়ে দিলে আমাদের অন্তরের শ্রদ্ধা বহুগুন বেড়ে যায়।  কিন্তু, বিজ্ঞান তো সেই হিসেবে চলে না, তাহলে তো সব, ফেলুদার কথায়, 'উঠের পাকস্থলী' হয়ে যাবে ! তাই, একজন আত্মীয় যখন বললেন, ''হয় হয়, সব জানিস না ' তখন ভাবলাম একটু তলিয়ে দেখা যাক।  খুললাম গুগল, বিজ্ঞানচর্চা কিঞ্চিৎ করেছি বলে জানি যে এসব ক্ষেত্রে একদম আসল বৈজ্ঞানিক গবেষণাপত্র দেখায় সবচেয়ে ভালো।  কারণ, মিডিয়া (বিশেষত আজকের দিনে আমাদের দেশের মিডিয়া) প্রচুর ভুলভাল বকে , কোনো কিছু ভেরিফাই না করেই TRPর লোভে ছেড়ে দেয়! আর পাঠক বিভ্রান্ত হয়।  তাই বিজ্ঞানীরা নিজেরা কি লিখেছেন সেটা দেখতে পেলেই ভালো।  

বেশি খুঁজতে হলো না , ২০১৮য় প্রকাশিত একটি গবেষণাপত্র পেয়ে গেলাম, প্রকাশিত হয়েছিল আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন জার্নাল SCIENTIFIC REPORTSএ।  নামকরা বিজ্ঞান পত্রিকা, প্রকাশক আধুনিক বিজ্ঞানের সবচেয়ে নামকরা NATURE PUBLICATIONS . সব কিছুই যাচাই করে নিতে হয়, তবে এসব পত্রিকায় প্রকাশ মানে একদম ভুলভাল  হবে না এটা জানা কথা।  
এই সেই পেপার বা গবেষণাপত্র।  
 নাম -  Better than DEET Repellent Compounds Derived from Coconut Oil
Volume 8, Article number: 14053 (2018)   
প্রকাশিত হয়েছিল  19 September 2018
২০জন বিজ্ঞানী মিলে  গবেষণা করেছেন, লিখেছেন, প্রকাশ করেছেন। তাঁদের রচনার নাম দিয়েছেন  'DEETর চেয়ে বেশি কার্যকরী পতঙ্গ বিতাড়ক যৌগিক পদার্থ নারকেল তেল থেকে পাওয়া যায়।' 
(DEET হল diethyltoluamide, যা আজকের দুনিয়ার সবচেয়ে  ব্যবহৃত  insect repellant বা পতঙ্গ বিতাড়ক ) পড়তে পড়তে দেখলাম প্রথম পাতার শেষে বিজ্ঞানীরা লিখেছেন , '...In the present paper, we report that medium chain length fatty acids derived from coconut oil that provide strong repellency to four different types of insect vectors (mosquitoes, ticks, biting flies and bed bugs)...'

অনেকদিন এই ধরণের পেপার দেখেছি বলে চট 'fatty acids derived from'এ নজর আটকে গেল।  এঁরা লিখছেন , 'নারকেল তেল থেকে পাওয়া যায়'; তার মানে  'নারকেল তেল' নয়। চলিত ভাষায় অনেক সময় বোঝা না গেলেও বিজ্ঞানে এই দুইয়ের মধ্যে অনেকটা ফারাক ।   আরেকটু পড়তেই আসল জায়গায় পৌঁছে গেলাম , Bioassays using modified K&D module showed that coconut oil itself had little repellency against stable flies, Stomoxy calcitrans (Fig. 1A). In contrast, the coconut fatty acid mixture, lauric acid, and methyl laurate provided strong repellency against the stable flies.

সোজা করে অনুবাদ করলে যার মানে দাঁড়ায় - 'K and D জৈব্যপরীক্ষা করে প্রমাণিত হল যে নারকেল তেলের নিজের প্রায় কোনো মশা/মাছি  বিতাড়ন-ক্ষমতা নেই। কিন্তু, উল্লেখযোগ্য ভাবে নারকেল তেল থেকে পরিশোদন করে যে fatty acids পাওয়া যায় , যেমন lauric acid ও methyl laureate, তাদের প্রভাবে বেশ কিছু মশা মাছি পতঙ্গ কাছে আসে না।  

এই জৈব্য পরীক্ষা ব্যাপারটা কি? সোজা কথায় এ হল একধরণের এক্সপেরিমেন্ট যাতে রক্তের একটি ছোট্ট কৌটোর কাছাকাছি কোন যৌগিক পদার্থ রেখে দেওয়া হয়।  তারপর দেখা হয় রক্তচোষা মশা /মাছিরা সেখানে রক্ত খেতে আসে, না আসে না।  যদি না আসে, বা কম আসে , তাহলে বোঝা যায় যে ওই সব কম্পাউন্ড কোনো না কোনো ভাবে এই পতঙ্গদের আসতে দিচ্ছে না - হয়তো ওই কম্পউন্ডের জন্যে  রক্তের গন্ধ ঢাকা পরে যাচ্ছে, অথবা ওই বিশেষ গন্ধ মশা মাছির সহ্য হয় না।  

শুধু লিখে না , গবেষণার ফলাফল bar ডায়াগ্রাম করে দেখিয়েওছেন বিজ্ঞানীরা (ছবি ২) ।  এই যে, একদম বাঁ দিকের bar আর একদম ডানদিকের bar মিলিয়ে দেখুন।  কোনো কম্পাউন্ড  না থাকলে ১০০% মশা রক্ত খেতে আসে, আর শুধু নারকেল তেল রক্তের কাছাকাছি রেখে দিলেও ১০০% মশা আসে।  কিন্তু, যদি কাছাকাছি রেখে দেন পরিশোধিত     lauric acid ও methyl laureate ইত্যাদি তাহলে মশা খিদে পেলেও ও পথ মাড়াবে না।  

গবেষণা পত্রের আরো গভীরে যাবো না।ওরা আরো অনেক এক্সপেরিমেন্ট করেছেন।  মোদ্দা কথা, আমাদের যতটা দরকার ছিল সেটা পড়ে কি দাঁড়ালো?  নিজে থেকে নারকেল তেল মশাকে আটকাতে পারে না।  যদি না একদম তৈলাক্ত হয়ে হাতে-পায়ে জামায়-প্যান্টে তেল জ্যাবজ্যাব করে লাগিয়ে থাকেন।   কিন্তু, নারকেল তেল থেকে পরিশোধিত কিছু কম্পাউন্ডের এই ক্ষমতা আছে। স্বাভাবিক ভাবে প্রশ্ন উঠবে -   তাহলে শুধু তেল পারে না কেন? কারণ, সম্ভবত যে পরিমান কম্পাউন্ড  থাকলে মশা আসবে না তার থেকে এই সব কেমিক্যাল তেলে  অনেক কম থাকে। মানে, নারকেল তেলে তো শুধু  lauric acid  নেই, আরো অন্য অনেক কিছু আছে (যারা মশা মাছি তাড়ায় না, এই গবেষকরাই দেখিয়েছেন). সেই সব  অন্য কেমিক্যাল হটিয়ে একে  purify করে আরো ঘন করলে তবেই কাজ দেবে। আরো কিছু ব্যাপার আছে, তবে, বুঝতেই পারছেন, সেটা আমার আপনার কাজ নয়, পারবোও না।    

আরো একটা কথা।  antibiotic কথাটি কিছু বিশেষ কেমিক্যালের  ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য, যারা কিছু নির্দিষ্ট উপায়ে বিশেষ বিশেষ ব্যাকটেরিয়াকে মেরে ফেলতে পারে বা তাদের বংশবৃদ্ধি বন্ধ করতে পারে।  যেমন পেনিসিলিন, টেট্রাসাইক্লিন , এরিথ্রোমাইসিন , ক্লোরামফেনিকল , স্ট্রেপ্টোমাইসিন।  মনে রাখতে হবে , ডেঙ্গি কিন্তু ব্যাকটেরিয়াজাত রোগ নয়, এর কারন হল ডেঙ্গি ভাইরাস।  জগতের কোন ভাইরাল অসুখ এন্টিবায়োটিক দিয়ে সারে না, আর বলাই বাহুল্য নারকেল তেল  কোন এন্টিবায়োটিক আজ অবধি আবিষ্কার হয়নি। 

তাহলে এই ভুলটা এল কথা থেকে? সম্ভবত মিডিয়া বুঝতে ও  লিখতে ভুল করেছে। বৈজ্ঞানিক ক্ষেত্রে রিপোর্টিং করতে গেলে প্রায়ই এসব করে, বিশেষত আমাদের দেশের মিডিয়া। 
যেমন ধরুন, বিদেশী কাগজ Independent . দেখুন,  ঠিক লিখেছে - BUG REPELLENT MADE FROM COCONUT OIL COULD WORK BETTER THAN CHEMICALS  https://www.independent.co.uk/life-style/coconut-oil-benefits-health-insect-bug-repellent-deet-study-chemicals-a8613841.html. একদম প্রথমেই 'made from ' . আর রিপোর্টের প্রথম লাইন হল Compounds derived from coconut oil are more effective at repelling insects than chemicals, a new study has revealed. অর্থাৎ, আবার সেই 'derived from' . 
আর এদিকে আমাদের লোকজন ছড়িয়ে লাট !
Coconut oil is better than repellents in preventing insects: Study
এ তো তও ভালো।  ভেতরে বলেছে compoundsর কথা।  এরা আরো বাজে বকে।  Coconut Oil An Effective Mosquito Repellent: 4 Other All-Natural Oils To Prevent Mosquito Bites

হুজুগে জাত আমরা, আর কোনো কিছুর সঙ্গে 'দেশি', 'ভেষজ', 'গাছ গাছড়া' জুড়ে দিলেই মেতে উঠি।  সাংবাদিকরা তো একই সমাজের মানুষ।  আর আজকাল কে আর মন দিয়ে পড়াশোনা করে? করা অবশ্যই উচিত, না হলে বড় বিজ্ঞানী, ঐতিহাসিক,  ইঞ্জিনিয়ার ডাক্তার, অর্থনীতিবিদ , হবে কি করে? তাই স্কুলের ম্যাগাজিনে , বিশেষত ছাত্র ছাত্রীদের জন্যে , এইটুকু লিখলাম।  নমস্কার।  

(ঘাটাল গুরুদাস উচ্চ বিদ্যালয়েরসুবর্ণ জয়ন্তী স্মরণিকা, ২০২০, পৃ. ১১৭-১১৯ এ প্রকাশিত। )

No comments:

Post a Comment

 স্কুল খুলুক, সঙ্গে হাওয়া বাতাস খেলুক ক্লাসঘরে ('এই সময়' সংবাদপত্রে প্রবন্ধ -  ২২শে সেপ্টেম্বর, ২০২১)      সোজাসাপ্টা অপ্রিয়   সত...