Thursday, December 17, 2020

 ইতিহাসের গপ্প: স্বাধীন ভারতের শ্রেষ্ঠ সেনানায়ক 

' আপনি জানেন, পর্তুগালের রাস্তায় রেস্তোরাঁয় আপনার নাম পোস্টার পড়েছে। আপনাকে ধরে দিতে পারলে ১০ হাজার ডলার না কত যেন পুরস্কার দেবে ওদের সরকার।' 

১৯৬১র শেষের দিকের কথা। লিসবন ইত্যাদি ঘুরে ভারতে বেড়াতে আসা এক মার্কিন টুরিস্ট এই 'খবর' দেন।  আর যাঁর নামে ওই দূর দেশে পোস্টার পড়েছিল তিনি সগত সিং। লেফট্যানেন্ট জেনারেল সগত সিং (১৯৯১-২০০১)।  সম্ভবত স্বাধীন ভারতের শ্রেষ্ট, একটিও-লড়াই-না-হারা সেনাপতি। অনেকে তাঁকে ভারতের একমাত্র সামরিক জিনিয়াস বলে থাকেন। ধুরন্ধর বুদ্ধিসম্পন্ন এবং সবসময় নিজের সৈন্যদের সঙ্গে ফ্রন্টে থাকা এমন এক অনন্য সেনানায়ক যাঁর career প্রায় রূপকথার মত।  অথচ আমাদের এই সমাজে ঢিসুম ঢিসুম সিনেমার মারপিট যত পপুলার, ঠিক ততটাই অজানা সগত'র মত আসল আসল যুদ্ধের 'সুপারম্যান'।আজ ১৬ই ডিসেম্বর, বাংলাদেশের স্বাধীনতা দিবসে, ছোট্ট করে তাঁর কথা লিখছি। 

বিকানিরের ছেলে সগত ১৯৪১ এ নিজের রাজ্যের সেনাবাহিনীতে যোগ দিয়ে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে লড়েছিলেন। স্বাধীনতার পরে যোগ দেন ভারতীয় সেনাবাহিনীতে। পদোন্নতি হতে থাকে - ১৯৫৫ তিন নম্বর গুর্খা রাইফেল রেজিমেন্টের কম্যান্ড এবং তারপর ১৯৬১ সালে তাঁকে ৫০ নম্বর প্যারাশুট ব্রিগেডের ভার দেওয়া হয়।এই দ্বিতীয় ব্যাপারটা নজর কাড়ে কারণ সেনাবাহিনীতে এক রেজিমেন্টে ঢুকলে পরে পরিবর্তন খুব একটা হয় না। তার ওপর প্যারাশুট করে যুদ্ধক্ষেত্রে অবতরণ করতে সক্ষম প্যারাশুট ব্রিগেড সেনাবাহিনীর অন্যতম শ্রেষ্ট বাহিনী; তার নেতা হওয়া চাট্টিখানি কথা নয় । কিন্তু সগত চিরকালই outstanding. ৪২ বছর বয়েসে নতুন ট্রান্সফার পেয়ে প্যারাশুট ট্রেনিং পাশ করে ফেললেন রেকর্ড সময়ে। যুদ্ধের প্রস্তুতি নিয়ে প্রতিটা খুঁটিনাটিতে নজর, নিজের বাহিনী ও শত্রু সম্মন্ধে সবকিছু নখদর্পণে রাখা তাঁর অভ্যেস, passion - তাই চলতে লাগল। 

প্যারাশুট রেজিমেন্টের প্রতীক। 

সুযোগ ও এসে গেল দ্রুত। ১৯৬১ সালের ডিসেম্বরে নেহরু সরকার সিদ্ধান্ত নিলেন অনেক ভদ্রতা হয়েছে, এবার সবলে গোয়া'র স্বাধীনতা সংগ্রামকে সাহায্য করতে হবে। পর্তুগিজ উপনিবেশকে আরব সাগরে ফেলে দিতে হবে। উল্লেখ্য ষোড়শ শতকের গোড়া থেকে গোয়া (এবং তার সঙ্গে দমন দিউ ইত্যাদি) পর্তুগিজ কলোনি ছিল। মধ্যযুগে দক্ষিণের একাধিক রাজা সুলতান এবং পরে মুঘলদের সঙ্গে এদের খিটমিট লেগেই থাকত।  ইংরেজ আমলেও তারা নিজেদের স্বাতন্ত্র বজায় রেখেছিল। '৪৭ সালে ভারত স্বাধীন হলে এটা expected  ছিল যে পর্তুগাল এতদূরের উপনিবেশ নিজে থেকেই ছেড়ে দেবে। কিন্তু,  বিংশ শতাব্দীর মধ্যভাগে পর্তুগাল শাসন করত গোঁড়া, উগ্র দক্ষিণপন্থী এস্তদো নোভো সরকার যাদের মত স্বাধীনতা-বিরোধী অত্যাচারী ইতিহাসে খুব কম দেখা গেছে।তাই ৩০/৪০র দশক থেকে ক্রমাগত জনপ্রিয় হওয়া গোয়ার স্বাধীনতা আন্দোলনকে তারা দমন করতে বদ্ধপরিকর ছিল।  যেমন,  RSP নেতা ত্রিদিব চৌধুরী অনেকদিন গোয়ায় কারারুদ্ধ হন । 

যাই হোক,  ঠিক হয় যে ১৭ই ডিসেম্বর পূর্ব দিক থেকে ভারতীয় সেনাবাহিনীর ১৭ নম্বর ডিভিশন পানাজির দিকে এগোবে আর সগত'র ৫০ নম্বর প্যারা ব্রিগেড গোয়ায় উত্তরে অবতরণ গুরুত্বপূর্ণ ব্রিজ, রাস্তা, খাল, কালভার্ট  দখল নিয়ে ১৭ নম্বর ডিভিশন'র কাজ সহজ করে দেবেন।কিন্তু, আসল লড়াই শুরু হবার পরে দেখা যায় না না কারণে মূল ডিভিশন slow হয়ে পড়ছে আর অন্য দিকে সগতের বাহিনী প্রায়-অবিশ্বাস্য গতিতে এগোতে আরম্ভ করেছে। এ যেন এক ভারতীয় রোমেল, যাঁর সঙ্গে তাল রাখতে শত্রু তো বটেই তাঁর নিজের সিনিয়ররা হিমশিম খেয়ে যান। পর্তুগিজ প্রতিরোধ দাঁড়াতেই পারল না, দুদিনের মধ্যে যুদ্ধ শেষ। পানাজিতে প্রবেশ করল ৫০ নম্বর প্যারা ব্রিগেড এবং তার সঙ্গেই উপমহাদেশের ইউরোপীয় শাসনের সমাপ্তি। আমেরিকা ও অনেক ইউরোপীয় দেশ এ নিয়ে প্রচুর কথা শোনালেও ভারতের 'বয়ে গেছে কি করবি কর' attitudeএর সামনে তারা অসহায়। পর্তুগালের রাজধানীতে অবশ্য 'হামলাবাজ দস্যু সগত' কে ধরিয়ে দেবার পোস্টার পড়ে।  

২০শে ডিসেম্বর ১৯৬১র খবর।  গোয়া স্বাধীন। 
--- ---

পরের বড় ঘটনা ১৯৬৫-৬৭ সালের। সগত তখন ১৭ নম্বর মাউন্টেন ডিভিশনের জেনারেল অফিসার কমান্ডিং পদে উন্নত হয়েছেন। পোস্টিং সিকিমের নাথু-লা বর্ডারে। ১৯৬৫ র মাঝামাঝি সেখানেই ঘটনার সূত্রপাত।'৬৫ সালে যখন ভারত পাক সীমান্তে সংঘর্ষ বাড়তে থাকে তখন পাক বাহিনীকে সাহায্য করার জন্যে চীনা ফৌজ সিকিম বর্ডারে সৈন্য সামন্ত নিয়ে চাপ দেওয়া শুরু করে। দাবি করে জেলেপ-লা আর নাথু-লা এই দুই pass (পাহাড়ি রাস্তা) ভারতকে ছেড়ে দিতে হবে। আইন অনুযায়ী দুটোই ভারতের অঞ্চল, কিন্তু একদিকে তখন পাকিস্তানের সঙ্গে যুদ্ধ পরিস্থিতি তাই ভারতীয় সেনাবাহিনী চীনাদের ঘাঁটাতে না চেয়ে অর্ডার দেন 'পিছিয়ে এস' ।  জেলেপ-লা থেকে ভারতীয় সেনারা সরে গেলেও সবাইকে চমকে দিয়ে নাথু-লা থেকে 'যাব না' বলে বেঁকে বসেন সগত।  কারণ, তাঁর হিসেবে একটা ভাল ন্যাচারাল ফ্রন্ট, এবং সেখান থেকে বহুদূর অবধি চীনা ফৌজের পোস্ট ও রাস্তা দেখা যায় ও তাদের ওপরে নজর রাখা যায়।   ওটা হাতছাড়া হওয়া মানে আবার লড়াই লাগলে বিশাল অসুবিধে। নাঃ, সিনিয়ররা যাই বলুন সগত নিজে থেকে এমন প্রয়োজনীয় পোস্ট শত্রুকে তুলে দেবেন না।  

সিকিম সীমান্তের ম্যাপ। নাথু লা অঞ্চল যেখানে ১৯৬৭ সালে লড়াই হয়েছিল।  

চীনারা তখনকার মত ব্যাপারটা হজম করে নেয়।  দু বছর পরে ভারত নাথু-লা'র কাছে কাঁটা তারের বেড়া লাগাতে গেলে গন্ডগোল লাগে। কথা, পাল্টা কথা, এর লাউডস্পিকারে হুমকি, ওদের পাল্টা হুমকি, ধাক্কাধাক্কি চলে, আর তারপর সেপ্টেম্বর মাসে একদিন চীনারা আক্রমন করে। হঠাৎ চীনা মেশিনগানের সামনে পড়ে কয়েকজন ভারতীয় সৈন্য পোস্ট ছেড়ে পিছিয়ে আসতে গিয়ে দেখেন যে রাস্তা আটকে তাদেরই  সেনাপতি সগত। হাতে স্টেন গান।'পালতে চাইলে আমিই তোমাদের গুলি করব, ফিরে চল  - লড়তে হবে'. এটাই সগতের signature. পরিকল্পনা করেন, আবার লড়াইয়ের সময় ছাউনিতে না থেকে ফ্রন্টে নিজের সেনাদের সঙ্গে থাকেন। সেনাপতির confidenceএ উৎসাহী হয়ে ভারতীয় সেনা সত্যি এমন পাল্টা আঘাত হানে যে এবার চীনাদের অবাক হবার পালা। আক্রমণ পাল্টা-আক্রমণ চলতে থাকে। বেশ কিছুটা ক্ষয়ক্ষতি হবার পরে চীনারা তাদের গোলন্দাজ বাহিনীকে ডেকে আনে। কামানের গোলায় বেশ কয়েকজন ভারতীয় সৈন্য নিহত হতে সগত ঠিক করেন 'তবে রে ! আচ্ছা, আমিও কামান বের করছি' ! 

সিকিম সীমান্তে  সগত সিং। ৬০র দশকে।

কিন্তু, এক্ষেত্রে একটা অফিসিয়াল অসুবিধে ছিল।  চীনা সীমান্তে এমনি-এমনি কামান ব্যবহার করা যাবে না। সেটা করতে অনুমতি দিতে পারেন একমাত্র ইস্টার্ন কম্যান্ড'র সেনাপ্রধান মানেকশ। কিন্তু, তিনি আবার তখন দিল্লীতে আর ফোনে যোগাযোগ করা যাচ্ছে না। সগত অবশ্য এইসব ছুটকো নিয়মের ফেড়ে পড়ে নিজের সৈন্যদের বিপদে ফেলার বান্দা নন। নিজের এক্তিয়ার অতিক্রম করে গোলন্দাজ বাহিনীকে অর্ডার দিলেন চীনা পোস্টে কামান চালাতে।শুরু হল একটা ছোটখাট সীমান্ত-যুদ্ধ যা ইতিহাসে 'নাথু লা clash' নামে পরিচিত। কয়েকদিন লড়াই হবার পরে যখন 'যুদ্ধবিরতি' হয় তখন ৩০০-৬০০ চীনা নিহত। ভারতীয় তরফেও কয়েকশো নিহত। কিন্তু সংখ্যা মূল বিষয় কখনোই নয়। সবচেয়ে বড় কথা এই যে '৬২ সালে যাদের এমন নিদারুন পরাজয় হয়েছিল তারাই এবার এমন রুখে দেবে সেটা চীনা ফৌজ হিসেবে ধরেনি। এবার বুঝল এবং তারপর প্রায় ৫২ বছর তারা সেভাবে বর্ডারে সরাসরি লড়াই'র পথ নেয়নি। মোড় ঘুরল ২০১৭র ডোকালাম আর এ বছর লাদাখে। 

--- ---

'সামনে একমাত্র বাধা বলতে এই মেঘনা নদী , এটা পেরোতে পারলেই ঢাকা 'র রাস্তা একদম ফাঁকা ! ....এগোবো? ' 

৯ই ডিসেম্বর ১৯৭১। সাগরের মত চওড়া মেঘনা নদীর পূর্বতটে দাঁড়িয়ে লেফট্যাটেনেট জেনারেল সগত সিং। যুদ্ধ শুরুর আগে থেকে তিনি বলে আসছেন যে পূর্ব পাকিস্তান লড়াইয়ের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ objective হওয়া উচিত  ঢাকা দখল করা । কিন্তু, ইচ্ছে থাকলে অন্য সেনাপতিরা দ্বিধাগ্রস্ত থেকেছেন কারণ দুদিকে দুই সুবিশাল নদী পদ্মা আর মেঘনা থাকায় ঢাকা শহর natural defence পেয়ে গেছে। হাজার হাজার সৈন্য, ট্যাঙ্ক , কামান, রসদ নিয়ে ঠিকঠাক অতিক্রম করা সম্ভব নাও হতে পারে।নদীর ওপারে বসে থাকা পাক সেনা বাধা তো দেবেই তাই অসম্ভব না হলেও দেরি তো হবেই। তাই, প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা, সেনাধ্যক্ষ মানেকশ এবং পূর্বাঞ্চলের সেনাপ্রধান জগজিৎ সিং অরোরারা যে যুদ্ধ-পরিকল্পনা ঠিক করেছেন তাতে পূর্ব পাকিস্তানের বেশ কিছুটা অংশ পাক-মুক্ত করে স্বাধীন বাংলাদেশের সরকারকে আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি দেওয়াই লক্ষ্য হবে। সগতের অধীনস্ত ৪ নম্বর কোর (corps) দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে আগরতলা থেকে বেরিয়ে কুমিল্লা ও মেঘনা নদীর পূর্ব দিকে অঞ্চল দখলে আনতে। ( corps = একাধিক ডিভিশন নিয়ে গঠিত সেনা সমাবেশ, একটি কোরে ৮০ হাজার থেকে ১ লক্ষ সৈন্য থাকতে পারে) . 'মেঘনা অবধি তোমার কাজ, সগত। তার বেশি কিছু করতে যেও না।'

মেঘনা, পদ্মা দিয়ে ঘেরা ঢাকায় পৌঁছোবার রাস্তা। 

সগত তাই করেছেন, এবং যেমন করে থাকেন scheduleর আগেই কাজ শেষ করেছেন। একের পর এক পাক ঘাঁটি জয় করে তার ৪ নম্বর কোর এবং সঙ্গের মুক্তিবাহিনী এখন মেঘনা'র তীরে। আর মেঘনা পেরোলেই ঢাকার রাস্তা খোলা, বাধা দেবার মত তেমন কোন পাক বাহিনী আর নেই। 

পেরোলে মানেকশ আর অরোরা অসন্তুষ্ট হতে পারেন, তবে সে না হয় সগত ম্যানেজ করে নেবেন। বুঝিয়ে বলবেন যে শত্রুর ডিফেন্সে ফাঁকা পেলে গোল দেওয়া তাঁর কাজ।  কিন্তু এই চার হাজার ফুট চওড়া নদী - যার এপার থেকে ওপার দেখা যায় না -  পেরোতে তো হবে, আর পাক সেনা বুদ্ধি করে আশুগঞ্জের ব্রিজ উড়িয়ে দিয়েছে।    

একটাই উপায়। হেলিকপ্টার। জুনিয়রদের বারবার বারণ সত্ত্বেও সগত নিজেই একটি Mi4 হেলিকপ্টারে চড়ে মেঘনা পেরিয়ে বেশ কিছুটা অঞ্চল পরিদর্শন করে আসেন। নিজেই জরিপ করে নেন ঠিক কোথায় কোথায় আকাশ থেকে সৈন্য নামানো যেতে পারে। জুনিয়রদের চিন্তা অমূলক ছিল না। ভৈরব বাজারের কাছে পাক মেশিনগান তাঁর হেলিকপ্টারের জানলা ফুটো করে দিল, কাঁচের টুকরো সগতের মাথা ও হাতে ঢুকে গেল, পাইলটের উরুতে গুলি লাগল। কিন্তু, যা খুঁজছিলেন সেটা দেখতে পেলেন। Drop zones. এখানেই সবার অলক্ষ্যে মেঘনা পেরিয়ে নামবে তাঁর সেনারা। প্ল্যানটা দুর্দান্ত, কিন্তু বিপদ যে নেই তা নয় - সবচেয়ে বড় কথা প্রথম যে কয়েকশো সেনারা নামবে তাদের সঙ্গে কোন ভারী কামান বা ট্যাঙ্ক থাকবে না।  তাই বড় পাক প্রতিরোধের সামনে কোনোভাবে পড়ে গেলে বিপদ। কিন্তু, সগতের হিসেবের মূল কথা হল যে এটা অপ্রত্যাশিত শত্রু ভেবে রেখেছে যে যেহেতু তারা মেঘনার ব্রিজ ধ্বংস করে দিয়েছে, ভারতীয় সেনা নতুন ব্রিজ তৈরী করে তবে এগোবে এবং তার জন্যে অন্তত কয়েকদিন সময় লাগবে। কিন্তু তারা হিসেবেই ধরেনি যে ব্রিজ না বানিয়েও নদী পেরোনো যায়।  

ব্যাস। আর দেরি নয়।  ৯-১০ ডিসেম্বরের ভোর রাত্রে'র অন্ধকারে তৈরী হল ইতিহাসে বিখ্যাত 'মেঘনা হেলি ব্রিজ'। সাধারণ সেতু নয়, নদী পেরোতে একাধিক হেলিকপ্টার। প্রায় সাধ্যের অতীত কাজ করে বিমানবাহিনীর ১৪টি Mi4 হেলিকপ্টার পাইলটরা ৩১১ নম্বর ব্রিগেডের সৈন্যদের মেঘনা পার করিয়ে রায়পুরের কাছে নামিয়ে দিলেন। হতভম্ব পাক সেনারা প্রতিরোধ করতেই পারল না। রায়পুর দখলে এলে আবার হেলিকপ্টার করে নরসিংহি। সগতের নির্দেশে ৭৩ নম্বর ব্রিগেড এবার নৌকো আর ভেলা করে নদী পেরিয়ে গেল। উভচর PT-৭৬ ট্যাঙ্কগুলি মেঘনার গভীর জলে নামতে পারবে কি না সন্দেহ ছিল।  সগত নির্দেশ দেন, 'জলে নেমে চলতে শুরু কর। আটকে গেলে ওদিক থেকে টেনে তুলব' . তাই হল।  কয়েকটা ট্যাঙ্ক জলে আটকে গেলে সেনা ও মুক্তিবাহিনীরা সেগুলো টেনে তুললেন। মেঘনার পশ্চিম তীরে পাক সেনাদের প্রতিরোধ সেখানেই শেষ। ৩০০০ সৈন্য ও বেশ কিছু ভারী সরঞ্জাম নিয়ে ঢাকার পথে সগতে'র সেনা। 

মেঘনা হেলি ব্রিজ: ৯-১০ ডিসেম্বর ভোরবেলা ভারতীয় হেলিকপ্টার নদী পেরোতে চলছে। 

কথিত আছে, তাঁর সেনাবাহিনী  সফল ভাবে মেঘনা পেরিয়েছে শুনে ইন্দিরা গান্ধী অফিস থেকে ছুটে বেরিয়ে এসে নিজে  commuications roomএ গিয়ে সগতকে অভিনন্দন জানান।(অসামান্য কর্মদক্ষতার জন্যে ভারত সরকার ১৯৭২ সালে সগত সিংকে পদ্মভূষণ প্রদান করেন।) জেনেরাল অরোরা একটু অখুশি হয়েছিলেন কেন সগত প্ল্যান থেকে বেরিয়ে এমন ঝুঁকি নিয়ে কাজ করেছেন। সগত নাকি বলেছিলেন, 'জাগ্গি, তুমি  চেয়েছিলে আমি ভাল রেসাল্ট দেব। আর আমি তোমায় A + দিয়েছি।' 

-- ---

ভাবছেন এমন real life heroর  কথা শুনিনি ? তা বটে; কি জানেন আমাদের এই আষাঢ়ে সিরিয়াল আর আজগুবি সিনেমার দেশে যুদ্ধ/সৈন্য/দেশপ্রেম/ নিয়ে একটা অতিনাটকীয় জগাখিচুড়ি হয়।জোর গলায় চেঁচালেই যেন দেশপ্রেম হয়ে গেল, যুদ্ধে জেতা হয়ে গেল। আসলে সামরিক সংগ্রাম যে একটি ঠান্ডা মাথার প্রফেশন,  detailed পরিকল্পনা যে তার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অংশ, দেশের রাজনৈতিক উদ্দেশ্য'র সঙ্গে তার অঙ্গাঙ্গী যোগাযোগ এটা আমরা অনেকেই খেয়ালে রাখি না।আর  তাই, সগত সিং'র মত ধূর্ধষ মগজাস্ত্র-সম্পন্ন সেনাপতি আমাদের জনচেতনা থেকে বাদ পড়ে গেছেন। কিন্তু তাঁর একটা ছবি আমরা সবাই দেখেছি। স্বাধীন ভারতের খুব বিখ্যাত ফটোগ্রাফ। ১৬ই ডিসেম্বর বিকেলে ঢাকায় জেনারেল নিয়াজির আত্মসমর্পণ। বাংলাদেশ স্বাধীন। ছবিতে নিয়াজির ঠিক পেছনে দাঁড়িয়ে লেফট্যাটেনেট জেনারেল সগত সিং। সেদিন আলাপ-পরিচয়ের পরে বিজিত নিয়াজী সগতকে বলেছিলেন, 'করেছেন কি ?'

  আজ শেষ করলাম। ভাল থাকবেন।

১৬ই ডিসেম্বর, ১৯৭১। রেসকোর্স ময়দান, ঢাকা। শেখ মুজিব যেখানে স্বাধীন বাংলাদেশ গঠনের ডাক দিয়েছিলেন সেখানে পাক বাহিনীর আত্মসমর্পণ। লেঃ জেনারেল অরোরা ও জেনারেল নিয়াজির পেছনের সারিতে দাঁড়িয়ে আছেন (বাঁ দিক থেকে)  ভাইস এডমিরাল কৃষ্ণান, এয়ার মার্শাল দিওয়ান , লেঃ জেনারেল  সগত সিং ও লেঃ জেনারেল  জেকব। 

ডিসেম্বর ১৯৭১র শেষে ঢাকায় পাক অফিসারদের আনুষ্ঠানিক অস্ত্রসমর্পণে বক্তব্য রাখছেন লেঃ জেনারেল সগত সিং।পাশে লেঃ জেনারেল গন্ধর্ব নাগরা। ভিডিও দেখতে পারেন - https://www.youtube.com/watch?v=WN9aRP-TW0E 


ব্লগে প্রকাশিত হবার পরে 'ইতিহাস তথ্য ও তর্ক' ফেসবুক পত্রিকায় প্রকাশিত - https://www.facebook.com/groups/1803711656387813/permalink/3573697649389196/

রেফারেন্স : 

https://thedailyguardian.com/the-forgotten-general-who-never-lost-a-war/

https://abpunch.com/2020/05/26/lt-gen-sagat-singh-a-veritable-superhero/

https://en.wikipedia.org/wiki/Parachute_Regiment_(India)

https://www.livehistoryindia.com/history-daily/2020/12/05/sagat-singh

https://www.sify.com/news/remembering-lt-gen-sagat-singh-on-his-birth-centenary-news-columns-thprpwhjbhbdg.html

https://theprint.in/past-forward/how-india-gave-china-a-bloody-nose-close-to-doklam-50-years-ago/38330/

https://www.rediff.com/news/special/general-sagat-singh-the-creator-of-bangladesh/20161208.htm

No comments:

Post a Comment

 স্কুল খুলুক, সঙ্গে হাওয়া বাতাস খেলুক ক্লাসঘরে ('এই সময়' সংবাদপত্রে প্রবন্ধ -  ২২শে সেপ্টেম্বর, ২০২১)      সোজাসাপ্টা অপ্রিয়   সত...