Saturday, December 5, 2020


ভাজ্জির টুইট, ভ্যাকসিনের হিসেবে-নিকেশ আর টুকটাক কথা 

আমাদের এই হোয়াটস্যাপের্ ফরওয়ার্ড- নির্ভর  জীবনে এক একটা পোস্ট কেমন করে জানি 'ভাইরাল' হয়ে যায়।  আর অনেক সময়ই তার ফল আসল ভাইরাল ইনফেকশন বা কম্পিউটারের ভাইরাসের মতোই বাজে হয়।  অনেকগুলিই ignore করা যায়, কিন্তু এক একটাকে একটু 'দমন' করা প্রয়োজন।  

যেমন এই পোস্টটা।  নিশ্চয়ই গত ৪-৫ দিনে অনেকেই দেখেছেন  ফেসবুক, হোয়াটস্যাপ আর টুইটারে।  দেখেছেন এবং শেয়ার ও করেছেন - কেউ মজার ছলে কিন্তু অনেকেই 'সত্যিই তো' 'এ কথা তো ফেলনা নয়'  গোছের বিশ্বাস করে।  নামকরা লোকজনের মধ্যে করেছেন আমাদের হরভজন ভাজ্জি।  টুইটারে।এই যে - 


তাঁর প্রশ্ন যে ফাইজার আর বায়োটেক 'র ভ্যাকসিন তো বলছে ৯৪% সঠিক (accurate) ।  মডার্না'র টিকা হল ৯৪.৫% সঠিক, আর অক্সফোর্ড টিকা'র accuracy হল ৯০% । কিন্তু ভ্যাকসিন ছাড়াই তো ৯৩.৬% ভারতীয় করোনা হলেও সেরে উঠছেন (recovery rate)। এই পরিপ্রেক্ষিতে হরভজনের প্রশ্ন (এবং আরো অনেকের সন্দেহ) সত্যিই কি এত ঢাক ঢোল পিটিয়ে দাম দিয়ে ভ্যাকসিন কিনতে হবে? এসব আসলে বড় কোম্পানিদের মুনাফা করার চক্রান্ত নয় তো?

দুটো জিনিস করা যায়। 'হা হা' করে উড়িয়ে দেওয়া যায়, আবার ছোট্ট করে আসল সিচুয়েশন-টা  বুঝিয়ে দেওয়া যায়। আমি যখন বায়োলজিস্ট , তখন  দ্বিতীয়টাই করি।  পর পর কয়েকটা পয়েন্ট সাজিয়ে দিই, পাঠকের সুবিধে হবে মনে হয়।
  
১. প্রথমেই জানিয়ে রাখি যে 'ফাইজার আর বায়োটেক' নয়।  বায়োটেক একটি বিষয়/ সাবজেক্ট যেটা আজকাল অনেক কলেজ এবং বিশ্ব বিদ্যালয়ে পড়ানো হয়। 'বায়োটেক' নামে কোন কোম্পানি নেই।  ওটা হবে ফাইজার আর বায়োএনটেক (BioNTech) . মার্কিন বহুজাতিক কোম্পানি ফাইজার, জার্মান কোম্পানি বায়োএনটেক  এবং তাদের চীনা পার্টনার ফসুন ফার্মা'র যৌথ কাজ হল এই ভ্যাকসিন।  এই যে বিখ্যাত নিউ ইয়র্ক টাইমস'র ভ্যাকসিন ট্র্যাকার পাতায় ওঁদের কথা।বায়োএনটেক।  ছোট্ট অথচ বিচ্ছিরি ভুল -  হোয়াটস্যাপে যে কত লক্ষ ভুলে ভরা এটা তার আরেকটা উদাহরণ।  

২. এই টুইট আর পোস্টে 'accuracy' কথাটা ব্যবহার করা হয়েছে। কি জানেন Accuracy মানে হল 'সঠিক' বা 'নিখুঁত'. এক্ষেত্রে এই শব্দ-টা লাগে না।  'ক্রিকেট ব্যাট' না বলে 'ক্রিকেট স্টিক' বললে কি চলে? অনেকটা সেরকম - যেখানে যা। এক্ষেত্রে সঠিক word হল efficacy rate; বলতে পারেন 'ফলপ্রসূতা ' বা 'কার্যকারিতা'।    অর্থাৎ, একটা পরীক্ষামূলক  টিকা কতটা ভাল কাজ করে, ক'জনের মধ্যে রোগ প্রতিরোধ করে তার মাপ। 

যেমন ধরুন মডার্না কোম্পানি  ৩০,০০০ ভলান্টিয়ারকে দু দলে ভাগ করে পরীক্ষা করেছে।  এক দলকে পরীক্ষামূলক-টিকা দেওয়া হয়েছে আর অন্য দলকে শুধু স্যালাইন বা জল বা অন্য কোন রোগের টিকা ইনজেক্ট করা হয়েছে। এই দ্বিতীয় দলকে বলে প্লাসিবো গ্রূপ।  উল্লেখ্য,  কেউ জানতে পারেননি তিনি কোনটা পেলেন। কিন্তু, এর পরের কয়েক মাস (বা বছর) বিজ্ঞানীরা এঁদের সবার ওপর নজর রেখেছেন - হিসেবে করেছেন যে টিকা দেবার পরে  কোন টিমের ক'জনের করোনা হল। এবং , আনন্দের কথা, তাদের ফলাফল দেখাচ্ছে যে যেখানে প্লাসিবো দলের ১৮৫ জন করোনা-আক্রান্ত হয়েছেন, যারা পরীক্ষামূলক টিকা পেয়েছিলেন তাঁদের মধ্যে মাত্র ১১জন করোনা-আক্রান্ত হন।  অর্থাৎ, (১১/ (১১+ ১৮৫)) x ১০০ = ৫.৬%. 

তার মানে টিকা না পেয়ে যতজন আক্রান্ত হয়েছেন পরীক্ষামূলক-টিকা পেয়ে তার মাত্র ৫.৯% আক্রান্ত হয়েছেন। তাই এই টিকা  ১০০-৫.৬ = ৯৪.৪%  ক্ষেত্রে রোগ আটকাতে সফল বা কার্যকর বা effective. Efficacy rate = 94.4% . 

ভাবছেন ইংরিজি জ্ঞান দিচ্ছি ? বলতে পারেন।  কি জানেন ভুলটা নজরে এল;  এবার আমার আপনার মত বুড়ো-হাফ-বুড়ো'র হয়ত না ভাবলেও চলবে, কিন্তু স্কুল/কলেজের ছেলেমেয়েরা যদি শব্দচয়নের ওপরে জোর দেয়  লাভ আছে, ক্ষতি নেই।  তাই, আর কি ....

তাহলে কি দাঁড়াল?এই হিসেবে চললে ঠিকঠাক  টিকাকরণ হবার পরে এক হাজার জন ভাইরাসের সংস্পর্শে এলেও ৯৪১ জনের শরীরে ভাইরাস ঢুকেও রোগ করাতে পারল না; মাত্র ৫৯ জন অসুস্থ হলেন এবং সেরেও উঠলেন ।  কারণ মডার্না র হিসেব এও  বলছে যাঁরা টিকা পেয়েছিলেন তাদের কেউই মারা যাওয়া তো দূরস্থান ,  গুরুতর অসুস্থও  হননি।  প্ল্যাসিবো গ্রূপে কিন্তু ৩০ জন ইমার্জেন্সি কেস হয়েছিল। 

৩. কিন্তু,  ভাজ্জির টুইট যে বলছে যে ভ্যাকসিন কার্যকারিতা এবং ভারতে করোনা-রুগী সেরে ওঠার হার (recovery rate) দুটোই তো ৯৪-৯৫% . তাহলে টিকা নিয়ে কি এক্সট্রা লাভ হবে? আবার সেই শব্দ-জব্দ। ওখানেই দুসরা করতে গিয়ে ভাজ্জি ওয়াইড দিয়ে ফেলেছেন। কারন ভ্যাকসিনের ফলপ্রসূতা  ( efficacy rate) আর ' covid হয়ে তার থেকে সেরে ওঠার হার (recovery rate) তো একদম আলাদা জিনিস। প্রথমটা যে কি সেটা তো বললাম। দ্বিতীয়টা হল - আজ অবধি দেশে কতজনের করোনা হয়েছে এবং তার মধ্যে কতজন সেরে উঠেছেন। এবং এই পোস্ট/টুইট বলছে (মোটামুটি যা আমাদের সরকারি পরিসংখ্যান ) যে এখনো অবধি ভারতে ৯৬ লক্ষ ১৪ হাজার ৭৩৭ জনের করোনা ধরা পড়েছে এবং তার মধ্যে ৯০ লক্ষ ৬৫ হাজার ৩১২ জন সুস্থ হয়ে উঠেছেন। এই মুহূর্তে ৪ লক্ষের কিছু বেশি অসুস্থ আর করোনা-আক্রান্ত হয়ে মারা গেছেন ১ লক্ষ ৩৯ হাজার ৮০৭ জন। অর্থাৎ এই মুহূর্তে সরকারি ভাবে সেরে ওঠার হার ৯৩.৬ (ধরে নিন ৯৪) আর করোনায় মৃত্যুর হার ১.৪৫%  . এবং আক্রান্ত ও মৃতের সংখ্যা বেড়েই চলেছে।  

আবার ওই হাজারের হিসেবে যাওয়া যাক। ধরে নিন, আমরা বললাম দেশে টিকাকরণ দরকার নেই। কারণ recovery rate ৯৪%. তার মানে কিন্তু ১০০০ জন এই নতুন ভাইরাসের contactএ  এলে সবার সংক্রমণ হবে এবং সবার কম/বেশি রোগ ও হবে। অন্তত ৫০ জন আই সি ইউ তে ভর্তি হবেন এবং তার মধ্যে ১৪ জন পঞ্চভূতে বিলীন হবেন। এবার বলুন - কোনটা better ?

এবার সংখ্যাগুলি scale up করুন।ভ্যাকসিন দেওয়া হল না এবং ভাইরাস ছড়াতে থাকল। ফলস্বরূপ, পরের এক-দু বছরে ১০ কোটি ভারতীয় অসুস্থ হলে কতজন মারা যাবেন? ১.৪৫% মৃত্যু হার ধরলে ১৪ লক্ষ ৫৪ হাজার ৯০ জন শেষ হয়ে যাবেন। আর যার আপনজন অসুস্থ হবেন বা চলে যাবেন তাঁর কিন্তু তখন ৬% আর ১.৪৫% মনে আসবে না। ওটা কালান্তক ১০০% হয়েই গিলতে আসবে।  

৪) শুধু তাই নয়। টিকা যদি ঠিকঠাক কাজ করে এবং মোটামুটি সমাজের সবাইকে দেওয়া হয় তাহলে যেটা হবে সেটা হল আমাদের বহুকাঙ্কিত herd immunity. গোষ্ঠী-ভিত্তিক রোগ প্রতিরোধ। এই হার্ড ইমিউনিটি নিয়ে গত কয়েক মাসে প্রচুর বাজে কথা হয়েছে। বলা হয়েছে সমাজে ৭০% লোকের রোগ হলে আর এই সংক্ৰমণ ছড়াবে না।  Frankly বলি, এভাবে সংক্ৰমণ আটকানো যায় না। যদি যেত তাহলে এতদিনে আমাদের সমাজে ম্যালেরিয়া, কলেরা, টাইফয়েড, যক্ষা , আন্ত্রিক , ডেঙ্গি, হেপাটাইটিস সব কিছুর বিরুদ্ধে হার্ড ইমিউনিটি হয়ে যেত। এগুলি বহু পুরোনো রোগ, কয়েক হাজার বছর ধরে হচ্ছে কিন্তু এখনো হয় কারন এভাবে হার্ড ইমিউনিটি তৈরী হয় না। আর তর্কের খাতিরে যদি ধরেও নিই সবাই একবার করোনা আক্রান্ত হলে হার্ড ইমিউনিটি আপনাআপনি চলে আসবে , হিসেবে করে দেখুন ১৪০ কোটি ভারতীয়ের মধ্যে কতজন মারা যাবেন ? ১.৪৫% of ১৪০ কোটি , তাই না? 'খেলবেন' নাকি এরকম জীবন নিয়ে খেলা?     

৫) তাহলে?  যে কোন মাইক্রোবায়োলজি বা ইম্মুনোলোজি বই খুলে দেখুন -  এই medical termটি ব্যবহার হয় শুধুমাত্র একটি কার্যকরী টিকা যখন প্রস্তুত সেই পরিপ্রেক্ষিতে। সমাজে যদি ১০০% লোক টিকা নাও পান, যদি যথেষ্ট মানুষের টিকাকরণ হয়ে যায় (সেটা রোগের ওপর depend করে ; ৬০% ও হতে পারে, ৯০% ও হতে পারে) তাহলে ভাইরাসের ছড়িয়ে পড়ার পথ বারবার আটকে যেতে থাকে। তখন হার্ড ইম্মুনিটি আসতে দেরি হবার কথা নয়।  


৬. অবশ্য,  উল্টো দিকে এটাও  ঠিক যে পরীক্ষামূলক ট্রায়াল আর আসল দেশব্যাপী স্কেলে টিকাকরণের মধ্যে তফাৎ থেকেই যায় । সত্যি বলতে কি, দ্বিতীয় ক্ষেত্রে ঠিক কতটা সাফল্য আসবে কেউ জানে না, কারণ এই বিশেষ রোগের ক্ষেত্রে তো কেউ সেটা আগে করেনি।  আন্দাজ করা যায় ভালোই কাজ করবে, কিন্তু ৯৫% করবে কি না সেটার কোন নিশ্চয়তা নেই। সম্ভবত তার থেকে কিছুটা কম করবে। তবে,  বুঝতেই পারছেন যে সব ভ্যাকসিন বলছে তাঁদের সাফল্যের হার ৮০-৯০% বা তার ও বেশি, তাদের গন-ব্যবহার শুরু হলে  বেশ কিছুটা লাভ হওয়া স্বাভাবিক।  

প্রসঙ্গত,  প্রধানমন্ত্রী কিন্তু এক মাস আগে বলেছিলেন সবাই টিকা পাবে, কিন্তু ৩-৪ দিন আগে সরকারি কর্ণধার বললেন - না, দেশের সবাইকে দেবার পরিকল্পনা নেই। কোন বৈজ্ঞানিক/ব্যবসায়িক/রাজনৈতিক কারনে পা-ঘষা শুরু হল সেটা স্পষ্ট নয়।


 এখানেই দাঁড়ি টানি। শুধু একটা কথা  - দশ মাসে হয়ে গেল এই অতিমারীর। এখন আর বিন্দুমাত্র সন্দেহ নেই যে এই covidর বিচ্ছিরি সব long-term effect হচ্ছে। সেরে যাচ্ছে , কিন্তু হার্ট / ফুসফুস/ কিডনি ড্যামেজ করে দিয়ে যাচ্ছে। সেই ধাক্কা সামলাতে কম বয়েসীদেরই প্রচুর সময় যাচ্ছে, বয়স্ক বা প্রেসার/সুগার থাকলে তো বিশাল বিপদ। আমাদের সবার প্রিয় সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়কে স্মরুন করুন  - তাঁর তো করোনা হল, ইনফেকশন সেরে গেল কিন্তু ততদিনে যা ক্ষতি করার করে দিয়েছে। একই কথা এস পি বালাসুব্রামানিয়াম এবং তরুণ গগৈ'র ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য।  

আর তাছাড়া আমাদের দেশের আসল অবস্থা যে কি কে জানে? এই ছবিটা দেখুন।  পরিসংখ্যানবিদ রিজো জনের তৈরী করা। রাজ্যেদের জনসংখ্যার ভিত্তিতে কত % র করোনা ধরা পড়েছে তার হিসেব। 


ছোট রাজ্যগুলির কথা না হয় বাদ দিই।  লক্ষ্য করুন, বড় রাজ্যদের মধ্যে দক্ষিণ ভারতের রাজ্যেগুলিতে কিরকম আক্রান্তের % বেশি।  পশ্চিমবঙ্গ পাঞ্জাব  মাঝামাঝি , আর  উত্তর ও পশ্চিম ভারতের একটা বড় অংশে যেন প্রায় কারুর করোনা হয় নি?! কি করে হয় ? পশ্চিমবঙ্গবাসী না হয় এবছর দূর্গা পুজো , মহরম, কালী পুজো এবং ছট পুজোয় নিজেদের অনেক সংযত করেছিলেন,কিন্তু অন্য অনেক রাজ্য তো করেনি। তাহলে?  এত ভিড়, এত উৎসব, এত বায়ুদূষণ, এত মাস্ক না-পরা বেপরোয়া লোকজন, শীতকাল প্রায় চলে এসেছে আর আক্রান্ত নেই ? একি পিসি সরকারের ম্যাজিক ??!! ....☺

রেফারেন্স

https://www.covid19india.org/

https://www.nytimes.com/interactive/2020/science/coronavirus-vaccine-tracker.html

https://www.pbs.org/wgbh/nova/article/herd-immunity/

https://www.indiatoday.in/india/story/pm-narendra-modi-on-coronavirus-vaccine-distribution-1736090-2020-10-29

https://indianexpress.com/article/india/never-spoke-about-inoculating-entire-country-with-covid-19-vaccine-govt-7075786/

https://twitter.com/RijoMJohn/status/1334472120022179840?fbclid=IwAR0Ioe0QsVeTW9ZilhTKAE6XbmiTAkJ4c8qSwZHEB_UUtKSALhuf-FwqR34





No comments:

Post a Comment

 স্কুল খুলুক, সঙ্গে হাওয়া বাতাস খেলুক ক্লাসঘরে ('এই সময়' সংবাদপত্রে প্রবন্ধ -  ২২শে সেপ্টেম্বর, ২০২১)      সোজাসাপ্টা অপ্রিয়   সত...