১৮ই অগস্ট .....
রহস্য নেই, আছে শ্রদ্ধা।
'হাসান ! হাসান কোথায়?'
রাত ৮-৮.৩০. ১৮ই অগস্ট , ১৯৪৫। তাইহোকুর (আজকের তাইপেই, তাইওয়ানের রাজধানী) নানমন সামরিক হাসপাতালের ইমার্জেন্সি ওয়ার্ড।
সকালের প্লেন ক্রাশে তিন জন মারা গেছেন - পাইলট, সহকারী পাইলট আর জেনারেল শিডিআ। আহতদের মধ্যে যিনি সবচেয়ে বেশি দগ্ধ - যাঁকে জাপানি সৈনিকরা পরিচয় দিয়েছে, 'ইনি ফিল্ড মার্শালের থেকেও উঁচু পদাধিকারী' - সেই মহাযোদ্ধা মানুষটি তাঁর বহুদিনের সেক্রেটারিকে ডাকছেন।
হাবিবুর রেহমান ও আহত, হাতের আঙ্গুল কিছুটা পুড়ে গেছে। তিনি, উঠে এসে বললেন,
'হাসান এখানে নেই, নেতাজি। আমি হাবিব। '
গোটা শরীর ব্যান্ডেজে ঢাকা, মাথা থেকে পা পর্যন্ত burnol র মতো মলম লাগানো, ঠোঁট ভয়ঙ্কর ভাবে ফুলে উঠেছে, তবু অতি কষ্টে নেতাজি সুভাষ চন্দ্র বসু বললেন, 'হাবিব, আমি বুঝতে পারছি আমার সময় ফুরিয়ে আসছে .... শেষ দিন অবধি আমি দেশের স্বাধীনতার জন্যে লড়েছি। দেশের মানুষকে বোলো যে ভারত শীঘ্রই স্বাধীন হবে '
দেশবাসীর উদ্দেশে এই তাঁর শেষ কথা। কিছুক্ষন পর দোভাষী নাকামুরাকে বলেন, 'ঘুমোতে পারলে ভালো হয় ' , তারও কিছু পরে ব্যাথা কমাবার জন্যে মরফিন চাইলেন। নাকামুরা বর্ণনায় আছে, 'উনি কয়েকবার 'মিজু ' শব্দটি বললেন' ( 'মিজু ', অর্থাৎ জাপানি ভাষায় জল। অবশ্য 'মিজু ' না হয়ে 'মেজো ' বা 'মেজদা 'ও হতে পারে ....কে জানে, বিদায়বেলায় হয়ত পিতৃপ্রতীম মেজদা শরৎ চন্দ্র বসুকে ডেকেছিলেন ) ..... আর তারপর, ডাক্তারদের সব চেষ্টা ব্যর্থ করে, রাত ৯টা নাগাদ শরীরটা প্রচন্ড কাঁপুনি দিলো, আর তারপর একেবারে স্থির হয়ে গেল। সুভাষ চন্দ্র বসুর জীবনব্যাপী সংগ্রাম শেষ হলো। হাবিবুর পাশে বসে দোয়া করলেন। হাসপাতালের জাপানি কর্মীরা নিহত যোদ্ধার স্মৃতির উদ্দেশ্যে এক বৌদ্ধ মন্ত্র পাঠ করলেন।
.....
১৫ দিন পর, নেতাজির চিতাভস্ম একটি সাদা কাপড়ে মোড়া চৌকো কাঠের বাক্সে টোকিওতে পৌঁছলো। দিন কয়েক সেটি রাখা হলো ইন্ডিয়ান ইনডিপেনডেন্স লীগের কর্ণধার রামমূর্তির বাড়িতে। আজাদ হিন্দের বাছাই করা চল্লিশজন 'টোকিও boys ' - যাদের নেতাজি সন্তানসম স্নেহ করতেন - তাঁরা পালা করে গার্ড দিলেন। আর শুরু হলো একটি জাপানি মন্দিরের খোঁজ, যেখানে চিতাভস্ম সসম্মানে রক্ষিত থাকবে।
টোকিও শহরতলিতে ম্যহজি নামের একটি মন্দির আছে। যুদ্ধের সময় নেতাজি সেখানে একবার প্রার্থনা-সভায় যোগ দিয়েছিলেন। তাই, সেখানেই প্রথম যাওয়া হলো। কিন্তু , প্রধান পুরোহিত রাজি হলেন না - কারণ নেতাজি জন্মসূত্রে বিদেশী । একটু হতাশ হয়েই আজাদ হিন্দ ও জাপানি অফিসাররা রাস্তায় বেরিয়ে এলেন। আর তারপর ওই একই রাস্তার ওপর অবস্থিত আরেকটি মন্দির - নাম রেনকোজি মন্দির - ঢুকে পড়ে একই অনুরোধ করলেন।
রেনকোজির প্রধান পুরোহিত 'রেভারেন্ড ' মোচিজুকি এক কোথায় রাজি হয়ে গেলেন, এবং 'সুভাষ চন্দ বোস ' নাম লেখা বাক্সটি স্বসম্মানে মন্দিরের পবিত্রতম অভ্যন্তরে প্রতিষ্ঠা করলেন। ১৮ই সেপ্টেম্বর ১৯৪৫ রেনকোজিতে বৌদ্ধ মতে 'funeral service ' হল।
গত ৭৬ বছর ধরে 'রেভারেন্ড ' মোচিজুকি (১৯৭৯ সালে প্রয়াত), তাঁর পুত্র (যিনি এখন মন্দিরের প্রধান পুরোহিত) এবং অন্যান্য পুরোহিতরা পরম যত্ন ও শ্রদ্ধার সঙ্গে ভারতের সেই অনন্য সন্তানকে সম্মান জানিয়ে এসেছেন। তাঁদের বিশ্বাস যে বীর যোদ্ধার বিদেহী আত্মা তাঁদের মন্দিরের সম্মানিত অতিথি। তাই, প্রতি বছর , নিয়ম করে নেতাজির জন্যে memorial service হয়। নিহোনশু নামের একটি জাপানি পানীয় নেতাজি পছন্দ করতেন বলে সেটিও 'তাঁকে' অর্পণ করা হয়। ভারতবাসী তাঁদের কাছে চিরঋণী।
বহু দশক ধরে ভারত সরকারের পররাষ্ট্র মন্ত্রক রেনকোজি মন্দিরকে আর্থিক ভাবে সহায়তা করে এসেছেন - যাতে নেতাজির স্মৃতি রক্ষনার্থে কোনো ত্রটি না থাকে। জাপান যাত্রা'র সময়ে নেহরু, রাজেন্দ্র প্রসাদ, ইন্দিরা, বাজপেয়ী অনেকেই মন্দিরে গিয়ে শ্রদ্ধা নিবেদন করেছেন।
একইসঙ্গে জাপানিরা বহুবার অনুরোধ করেছেন যে ভারত যেন নেতাজিকে 'ফিরিয়ে নিয়ে যায়।' নেতাজি কন্যা অনিতাও একই ইচ্ছে প্রকাশ করেছেন।
এ সব কথা উঠলে দুম করে excited হলেও বাঙালিদের এ বিষয়ে জ্ঞান সাধারণত 60 বছর পরে গঠিত মুখার্জি কমিশনের মধ্যেই সীমাবদ্ধ। কিন্তু, জানা উচিত যে একটি-দুটি নয়, ১৯৪৫ থেকে ২০০৫ অবধি এই বিষয়ে ১৩টি তদন্ত হয়েছে। শুধু স্বাধীন ভারত নয়, মিত্রশক্তি, ব্রিটিশ সরকার, মার্কিন সেনাবাহিনী, ইন্ডিয়ান ইন্ডেপেন্ডেন্স লীগ, জাপান সরকার, নেতাজির জীবনীকার ঐতিহাসিক লেওনার্ড গর্ডন ও সুগত বসু এবং সাংবাদিক হারিন শাহ সবাই এ বিষয়ে তদন্ত করেছেন।
বিশদ তথ্য দিতে হলে আলাদা প্রবন্ধ হয়ে যাবে। আর তাছাড়া এ বিষয়ে ভাল গবেষণাভিত্তিক রচনা বেরিয়েওছে। তাই এখানে এই ১৩টি তদন্তের কথা summarize করে দিলাম।
দেশী বিদেশী তদন্তের ফলাফল। সব মিলিয়ে ১৩টি তদন্ত |
বুঝতেই পারছেন একাধিক দেশের তদন্ত'র ফলাফল দ্যার্থহীন ভাবে একই ফলাফল জানাচ্ছে। দুঃখ পেলেও মেনে নিতে হবে। জানি, এ তথ্য অত্যন্ত বেদনাদায়ক, এবং এমন মহাজীবনের ক্ষেত্রে কেমন যেন anti climax. আর বহু দশক ধরে নানারকম গুজব চলে আসছে( ভ্যাকসিন কাজ করছে কিনা তা নিয়ে যেমন আজকাল কতকিছু whatsappএ ভেসে আসে!) তাই, মেনে নেওয়া সহজ নয়।
তবে একটা প্রশ্ন করাই যায় - তর্কের খাতিরে যদি ধরেও নিই যে ভারত সরকার তথ্য চাপছিল, তাহলেও কেউ বলবেন কেন ব্রিটিশ মার্কিন ও সোভিয়েতরা (এবং যুদ্ধত্তোর আমেরিকা-বন্ধু জাপান) তাদের ধুরন্ধর শত্রু নেতাজিকে বারবার খুঁজে হয়রান হয়ে 'মিথ্যে রিপোর্ট বানাবেন'? আর ৭৫ বছর পরেও বিশ্বব্যাপী সব সরকার সেই কথাই বলে চলবেন??? ....
আর 60 বছর পরে গঠিত মুখার্জি কমিশন (ততদিনে একজন মাত্র সাক্ষী জীবিত) একমত না হলেও নতুন তথ্য পেশ করতে পারেনি, রিপোর্টে বেশ কিছু অসঙ্গতি ধরা পড়ায় গ্রাহ্য হয়নি। (বিশদে পড়তে পারেন)
আরো কিছু তথ্য দিয়ে শেষ করি।
১. মার্চ-২০১৬তে কেন্দ্রীয় সরকার লোকসভায় জানিয়েছেন ১৯৯৭-২০১৬র মধ্যে নেতাজি সংক্রন্ত ২৩২৪টি ফাইল প্রকাশ করা হয়ে গেছে, আর কোন দফতরে কিছু unclassified নেই। এর মধ্যে বহু ফাইল digitized করা হয়েছে, websiteএ গিয়ে পড়তে পারেন।
২. ব্রিটেন, আমেরিকা, রাশিয়া সরকারি ভাবে জানিয়েছে তাদের হাতে আর কোনো ফাইল নেই।
৩. জাপান জানিয়েছে প্রায় সব ফল প্রকাশিত, এবং অবশিষ্ট তিনটি ফাইল তারা তাঁদের বিশ্বযুদ্ধ-সংক্রান্ত নীতি মেনে যথাসময়ে প্রকাশ করবে । উল্লেখ্য, জেনারেল শিডিআ'র মত উচ্চপদস্থ সেনাপতি যে সেদিন বিমান দুর্ঘটনায় মারা গিয়েছিলেন তা নিয়ে জাপানের কোন সন্দেহ নেই। ও দেশের সরকারি রেজিস্ট্রি তাই বলছে।
৪. ভারত আরেকবার দেখতে অনুরোধ করতে, জুলাই 2019এ রাশিয়া আবার জানিয়েছে যে তাদের archives এ আর কোন তথ্য নেই।
৫. এক ব্যক্তির RTI র জবাবে কেন্দ্রীয় সরকার পরিষ্কার জানিয়েছেন তাঁরা তথ্য ও তদন্তের ভিত্তিতে কি বিশ্বাস করেন। এই যে -
![]() |
২০১৭র RTIকে কেন্দ্রীয় উত্তর |
![]() |
The last salute . সায়গনে অবতরণের সময়, ১৭ই অগস্ট ।পরের দিন তাইহোকু থেকে take off র কয়েক সেকেন্ড পরে এই মিৎসুবিশি Ki -২১ বিমানটি ভেঙে পরে। |
রেফারেন্স :
নেতাজি সংক্রান্ত একাধিক সমাদৃত বই -
বসু বাড়ী - শিশির কুমার বসু; His Majesty's Opponent - সুগত বসু; Nehru and Bose: Parallel Lives- রুদ্রানশু মুখোপাধ্যায়; Brothers against the Raj - লিওনার্ড গর্ডন; The Forgotten Army - পিটার ফে; The Springing tiger - হিউ টয়ে;
National Archives of India প্রকাশিত 'Netaji files' - http://www.netajipapers.gov.in/,
https://thewire.in/history/netaji-subhas-chandra-bose-disappearnce-part-one
https://en.japantravel.com/tokyo/renkoji-temple/1231 (রেনকোজির বর্তমান ফটো)
https://thewire.in/history/netaji-subhas-chandra-bose-japan-plane-crash