('এই সময়' সংবাদপত্রে প্রবন্ধ - ২২শে সেপ্টেম্বর, ২০২১)
সোজাসাপ্টা অপ্রিয় সত্য হল যে স্কুল
আগামী সপ্তাহে খুলুক কিংবা দু-মাস পরে কিংবা সামনের বছর মে-জুনে - রাজ্যে যখনই
স্কুল খুলবে স্কুলপড়ুয়াদের মধ্যে করোনা-সংক্রমণ বাড়বে। এটাই স্বাভাবিক। এমনকি
যদি সব স্কুলপড়ুয়াদের ভ্যাকসিন দেওয়া শেষ করে স্কুল খোলা হয় তাহলেও ওদের মধ্যে
ইনফেকশন বাড়বে। কারণ ভ্যাকসিনের মূল কাজ গুরুতর অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে ভর্তি এবং
মৃত্যু ঠেকানো; সংক্রমণ থামানো নয়। তাছাড়া, যে করোনাভাইরাস অফিস-ক্লাসরুম-ব্যাঙ্ক-মল'র
বাতাসে ঘুরে বেড়াচ্ছে তাকে কোন উপায়ে ছোটদের (বা প্রাপ্তবয়স্কদের) নাকে-মুখে
ঢোকা ১০০% বন্ধ করবেন? তাই সংক্রমণ হতেই থাকবে, এবং ঠাণ্ডা লাগা
(common cold), ইনফ্লুয়েঞ্জা, হাম, যক্ষ্মা যেমন চিরকাল হয় এই সংক্রমণও আমদের
জীবনে 'স্বাভাবিক' হয়ে উঠবে। হ্যাঁ, আমরা জীবনবিজ্ঞানের এমন এক আশ্চর্য যুগের
বাসিন্দা যে একটি আনকোরা নতুন জিবানু আবিষ্কার হবার এক বছরের মধ্যেই দেশে-বিদেশে
সুস্পষ্ট প্রমাণ পাওয়া যাচ্ছে যে টিকাকরণ সম্পূর্ণ হলে আইসিইউ কেস এবং মৃত্যু অনেক
কমে যাচ্ছে।
তবে, সবচেয়ে
অপ্রিয় সত্য এই যে চতুর্থ জাতীয় সেরোসার্ভে'র ফলাফল বলছে যে ৬-১৭ বছর বয়সীদের
অন্তত ৬০%র শরীরে করোনা-অ্যান্টিবডি পাওয়া গেছে। অর্থাৎ, গত দেড় বছরে স্কুল বন্ধ
রেখে, বাচ্ছাদের 'মিশিস না, খেলিস না' করেও আমরা বাবা-মা-অবিভাবকরা করোনাভাইরাসকে
ঠেকাতে ব্যর্থ হয়েছি। না হলে ৬০-৭০% ঘরবন্দি স্কুলপড়ুয়া'র শরীরে ভাইরাস ঢুকল কি
করে? অবশ্য, এতে আতঙ্কিত হবার কিছু নেই। কারণ ছোটদের ক্ষেত্রে ভ্যাকসিন ছাড়াই আছে
আশার আলো। গত দেড় বছরে একাধিক গবেষণা পরিষ্কার দেখিয়েছে যে শিশু ও কিশোরদের
সংক্রমণ হয় এবং ওদের থেকে অন্যদের মধ্যে ভাইরাসও ছড়ায়। কিন্তু, ০-১৭ বছর বয়সীদের
মধ্যে অসুস্থতার মাত্রা খুবই কম। আমেরিকা, ইউরোপ, ভারত সর্বত্র এই trend দেখা
যাচ্ছে, এবং সাম্প্রতিক গবেষণা থেকে বিজ্ঞানীরা বুঝতেও পারছেন যে অসুখ বাড়ীর বড়দের ঘায়েল করে সে কেন
ছেলেমেয়েদের ছুঁয়েও তেমন কিছু করে না। এই জন্যেই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে করোনায়
মৃতদের মধ্যে মাত্র ০.০০-০.২৭%র বয়স ০-১৮ বছরের মধ্যে। আমাদের দেশেও সরকারি হিসেবে
যে সাড়ে চার লক্ষ অতিমারীতে প্রাণ হারিয়েছেন তার মধ্যে ছোটদের সংখ্যা মাত্র ~১৫০০
(০.৩৩%)। একই 'স্বস্তিদায়ক' হিসেব আমাদের রাজ্যের বুলেটিন থেকেও পাওয়া যায়। বেশিরভাগ
ছেলেমেয়ে বা তাদের অবিভাবকরা টেরও পায়নি তার সংক্রমণ হয়েছে (সেই জন্যেই আমাদের
অজান্তে ৬০-৭০% ভারতীয় শিশু ও কিশোর আক্রান্ত হয়েছে)। আমাদের সৌভাগ্য যে যে
প্রকৃতি রুষ্ট হয়ে আমাদের করোনাভাইরাস 'বান মেরেছে' সেই প্রকৃতিই মানব শিশু ও
কিশোর (অর্থাৎ স্কুলপড়ুয়াদের) দিয়েছে এই জিবানুর বিরুদ্ধে লড়াই করার সহজাত 'extra'
ইমিউনিটি । এই বৈজ্ঞানিক জ্ঞানে আত্মবিশ্বাসী হয়ে আজ ১৭৫টি দেশে স্কুল খুলে গেছে!
এখন আমাদের প্রধান
লক্ষ্য হল স্কুল খোলা হলেও যেন সংক্রমিতের সংখ্যা কম থাকে। কিন্তু, আমাদের মত
জনবহুল রাজ্যে, যেখানে ক্লাসে অন্তত ৪০-৫০ জন ছাত্রছাত্রী, সেখানে শুধু
সহজাত-সুরক্ষা, ভ্যাকসিন আর মাস্কের ভরসায় থাকলে তো চলবে না; বিশেষত যখন বড়দেরই
টিকাকরণ শেষ করতে অন্তত মাস ছয়েক লাগবে এবং অনেক 'বীরশ্রেষ্ঠ' থুতনিতে মাস্ক রাখতে
বদ্ধপরিকর।
এখানেও প্রকৃতি
আমাদের সহায়। কিছু ইনফেকশন হবেই, কিন্তু একটি সহজ উপায়ে আমরা স্কুল চত্বরে সংক্রমণের
মাত্রা অনেক কমিয়ে দিতে পারি। আলাদা খরচও নেই। কি উপায় ? - সব
ক্লাসের সব জানলা-দরজা সারাক্ষন খুলে রাখা। হ্যাঁ, indoor ventilation এবং
হওয়া-বাতাস চলাচল হল এই ভাইরাসকে আটকাতে আমাদের অন্যতম বড় অস্ত্র। কারণ,
কোরোনাভাইরাস বায়ুবাহিত। এই সংক্রমণ কি করে ছড়ায় সে বিষয়ে বিজ্ঞানীমহলে
অতিমারী'র প্রথম কয়েক মাসে মতান্তর দেখা গিয়েছিল। কিন্তু, এখন সবাই নিঃসন্দেহ যে
সংক্রমিত ব্যক্তির নিঃশ্বাস-প্রশ্বাসের সময় যে এয়ারোসল (জলের ক্ষুদ্র কণা,
'ড্রপলেট নিউক্লি' ও বলা হয়) বেরোতে থাকে সেইই হল করোনাভাইরাসের বাহন। সবচেয়ে
মুশকিল হল যে এই ভাইরাস-ভরা এয়ারোসল (বিজ্ঞানীরা নতুন নামকরণ করেছেন 'virosol')
বেশ কয়েক ঘণ্টা হাওয়ায় ভেসে বেড়ায়। তাই, যদি ক্লাসে একজন ছাত্রও আক্রান্ত থাকে ওই
ক্লাসের অন্যান্যদের (কাছে বসুক বা দূরে) নিঃশ্বাসের সঙ্গে ভাইরাস-ভরা এয়ারোসল ভেতরে
টেনে নেবার চান্স অনেক বেশী। সেই জন্যেই ক্লাসরুমের জানলা-দরজা খুলে রেখে
সিলিং-ফ্যান 'অন' করে ভাইরাস-ভরা এয়ারোসল বের করে দেওয়া উচিত। ঠিক যেমন একটি
বন্ধ ঘরে কেউ সিগারেট খেলে নিঃসৃত ধোঁয়া'র গন্ধ কয়েক ঘণ্টা ধরে নাকে আসে, কিন্তু
জানলা-দরজা খুলে দিলে সেই ধোঁয়ার বেরিয়ে যায়।
এও মনে রাখা আবশ্যক যে সংক্রমণ
একটিমাত্র ভাইরাস কণার কম্ম নয়। কোন মানুষের নাকের ভেতর ও শ্বাসনালীতে
ঠিকঠাক সংক্রমণ করতে একটি মিনিমাম সংখ্যার ভাইরাস লাগে। মাইক্রোবায়োলজি'র পরিভাষায়
একে বলে ভাইরাস-ঘনত্ব বা viral load। আর এই ভাইরাস-ঘনত্ব কমিয়ে দিয়ে সংক্রমণের
মাত্রা কমাতে চাইলে? জানলা-দরজা
খুলে ব্যাপন (diffusion) বাড়িয়ে দিতে হবে যাতে ক্লাসরুমের ভেতরের ভাইরাস
দ্রুত বেরিয়ে যায়।
মোদ্দা কথা, স্কুলপড়ুয়াদের
সংক্রমণ আটকাতে সব শ্রেণীকক্ষে(এবং স্কুলের টয়লেটে) ভাল ventilation
অপরিহার্য। বিদেশে এর জন্যে ক্লাসরুমে সেন্সর এবং হেপা-ফিলটার বসছে। আমাদের
দেশের স্কুলে ওসব পাওয়া যাবে না বলাই বাহুল্য, এবং হয়ত প্রয়োজনও নেই। তার চেয়ে
অনেক সহজ হল ventilation expertরা যেন প্রত্যেকটি স্কুল পরিদর্শন করে কি
ভাবে হওয়া-বাতাস চলাচল আরো ভাল করা যায় সে বিষয়ে পরামর্শ দেন। যেমন, যেসব
ক্লাসরুমে প্রয়োজনের তুলনায় কম জানলা সেখানে হয়ত ঘুলঘুলি এবং exhaust ফ্যান লাগাতে
হবে। শুধু স্কুল নয়, টিউটোরিয়ালদেরও একই ভাবে indoor ventilationর ওপর জোর দিতে
হবে।
আর ব্যাপারটা শুধু
স্কুলপড়ুয়াদের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়। গত ৭-৮ মাসে এই 'ভাইরাসের বাহন এয়ারোসল'
ব্যাপারটা বোঝা গেছে বলেই বিজ্ঞানীরা বুঝতে পেরেছেন কেন সারা পৃথিবীতে ৯০% করোনা
সংক্রমণ মূলত ইনডোর পরিবেশ (যেমন বাড়ীর ভেতর, অফিস, দোকান, রেস্তরাঁ, ভিড় যানবাহন,
মেট্রোরেল) থেকেই হয়েছে । কারণ, রাস্তাঘাটে বা ফাঁকা, জানলা-খোলা
বাস/ট্যাক্সি/ট্রেনে হাওয়ার পরিমান ও বাতাসের গতিবেগ এয়ারোসলদের মানুষের নাক-মুখের
চারপাশে সহজে জমতে দেয় না। কিন্তু, যে কোন ইনডোর পরিবেশ (বিশেষত যেখানে অনেক লোকের
যাতায়াত এবং এসি চলছে বলে জানলা-দরজা বন্ধ) সেখানে এই সুবিধে নেই। এখানে একজন
asymptomatic করোনা-আক্রান্ত কয়েক মিনিট থাকলেও তাঁর নিঃশ্বাস-নিঃসৃত এয়ারোসল
বহুক্ষণ ওই বদ্ধ হাওয়ায় ঘুরপাক খেতে থাকে (তিনি সেখান থেকে চলে যাবার পরেও) এবং
অনেকে সংক্রমিত হতে পারেন। এই জন্যেই asymptomaticরা কোভিড-১৯র প্রধান বাহক এবং
স্কুলে না গিয়েও ৬০-৭০% ভারতীয় স্কুলপড়ুয়া করোনা-আক্রান্ত হয়েছে।
এসব কোন কঠিন বিজ্ঞান নয়, একদম সাধারণ
জ্ঞান। কিন্তু, দুঃখজনক ব্যাপার হল যে বিজ্ঞানী মহলের বাইরে এই গুরুত্বপূর্ণ
বিষয় নিয়ে সতর্কবার্তা প্রায় শোনাই যায় না। শুধু আমাদের দেশে না, এ ব্যাপারে
বিদেশেও গতবছর কম চর্চা হয়েছিল। এই দেরির জন্যে অবশ্য কিছুটা WHOর প্রাথমিক গাইডলাইন
দায়ী। অথচ indoor ventilationএ জোর না দিয়ে হাজার সানিটাইজ করলেও কাজের কাজ
কিছু হবে না। কারণ এক বছরের ওপর গবেষণা করে বিজ্ঞানীরা এখন অনেকটাই নিশ্চিত যে
বায়ুবাহিত করোনাভাইরোস রাস্তাঘাট/ বাড়ী বা অফিসের মেঝে/ দেওয়াল / টেবিল / চেয়ার / বেঞ্চি
/ টাকাপয়সা / জামাকাপড় ইত্যাদি থেকে সংক্রমণ করে না। অবশ্য, সব কিছু
সানিটাইজ করা এখন একটি 'সামাজিক অভ্যাসে' দাঁড়িয়ে গেছে বলে হয়ত এক্ষুনি এটা ছাড়া
যাবে না, কিন্তু বিজ্ঞান-সম্মতভাবে ইনফেকশন কমাতে চাইলে ভ্যাকসিন ও মাস্কের
পাশাপাশি ঘরে/ ক্লাসে / অফিসে / ব্যাঙ্কে/ মলে / দোকানে-বাজারে হাওয়া-বাতাস
চলাচলের ওপরেই মূল জোর দিতে হবে। এত চেষ্টা করেও সংক্রমণ যে সেভাবে বাগে আসছে না তার
বড় কারণ হল আমাদের এই 'বজ্র আঁটুনির ফস্কা গেরো' ।
তবে আশার কথা এই যে বিজ্ঞানের অগ্রগতি'র সঙ্গে সামঞ্জ্যস্য রেখে ইদানীং অনেক দেশের
নিয়মাবলী স্কুল ও বাড়িতে হওয়া-বাতাস চলাচলের ওপরে জোর দিয়েছে। এমনকি আমাদের
স্বাস্থ্যমন্ত্রকের নতুন নিয়মাবলীও ছবি দিয়ে dos and donts বোঝানো হয়েছে। কিন্তু,
জনমানসে প্রচার যে খুব বেশী হয়নি সেটা অনস্বীকার্য। সেই জন্যেই স্কুল-কলেজ খোলার
আগে এই ব্যাপারে বিজ্ঞানভিত্তিক-পরিকল্পনা খুবই জরুরী। বিশেষত যখন একদম সাম্প্রতিক
গবেষণা আভাস দিচ্ছে যে সময়ের সাথে বিবর্তিত হয়ে করোনাভাইরাসের নতুন বংশধরদের
বায়ুবাহিত হবার ক্ষমতা বৃদ্ধি পাচ্ছে।