Thursday, July 16, 2020


করোনা বিজ্ঞানের খুচরো খবর -  ১২
Modernaর ভ্যাকসিন, স্যানিটাইজার 'গন্ডগোল', ইত্যাদি 


১. মার্কিন কোম্পানি Modernaর করোনা-বিরোধী টিকা'র প্রথম পর্যায়ের পরীক্ষা ( Phase 1 trial) সফল হয়েছে। বিখ্যাত গবেষণা পত্রিকা নিউ ইংল্যান্ড জার্নাল অফ মেডিসিনে প্রকাশিত প্রবন্ধে বিজ্ঞানীরা এই কথা জানিয়েছেন।  মে মাসে এই সংস্থা একদম প্রাথমিক সাফল্যের কথা জানিয়েছিল। এবার জানা গেল যে Phase 1 গবেষণায়  ৪৫ জন সুস্থ ভলান্টিয়ারকে দু'বার পরীক্ষামূলক টিকা ইনজেক্ট করা হয়। ফলাফল যাতে ভালভাবে বিশ্লেষণ করা যায় সেই জন্যে টিকার পরিমাণেও তফাৎ রাখা হয়েছিল।  প্রথমবার ভ্যাকসিন দেবার ২৮ দিন পরে দ্বিতীয়বার দেওয়া হয় এবং এখনো পর্যন্ত প্রায় দুমাস ধরে পরীক্ষা করে দেখা গেছে যে ভলান্টিয়ারদের রক্তে কোরোনাভাইরাস-বিরোধী এন্টিবডি ভালো তৈরী হয়েছে। এও উল্লেখযোগ্য যে হালকা মাথাব্যথা, গা- ম্যাজম্যাজ, ক্লান্তি ছাড়া আর কোন বড় সাইড এফেক্ট দেখা যায়নি, এবং তাই বিজ্ঞানীরা এবার পরের পর্যায়ে আরো অনেক লোকের ওপরে টিকা নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করবেন।

সাধারণত ভ্যাকসিন তৈরী হয় জীবাণুকে নির্জীব করে বা তার কোন একটি প্রোটিনকে পরিশোধিত করে। আজ অবধি যত টিকা আছে সবই মোটামুটি এইভাবে তৈরী। তবে , বায়োটেকনোলজির যুগে Moderna এই ভ্যাকসিন নতুন প্রযুক্তি দিয়ে তৈরী হয়েছে। বিজ্ঞানের পরিভাষায় একে বলে RNA ভ্যাকসিন।

স্কুলের পাঠ্যপুস্তকে আমরা পড়েছি যে আমাদের সবার কোষের নিউক্লিয়াসে যে ক্রোমোসোম আছে তা DNA দিয়ে তৈরী এবং তার ওপর পরপর সাজানো আছে আমাদের জিনগুলি (genes)।  এক একটি জীন আমাদের শরীরের এক একটি প্রোটিন তৈরির নির্দেশাবলী বা code বহন করে। যখন যে প্রোটিন'র দরকার পড়ে সেই জীন তখন active হয়ে ওঠে, সেই জীন'র DNA কপি করে তৈরী হয় একটা RNA আর সেই RNA ব্যবহার করে কোষ সেই প্রোটিনটি তৈরী করে। আজ হাই স্কুলের ছাত্রছাত্রীরা জানে যে মলিকিউলার বায়োলজির পরিভাষায় DNA-থেকে-RNA-থেকে-protein পথ'র নাম Central Dogma of Molecular Biology. এই হল পৃথিবীর সব প্রাণীর সব কোষের অন্যতম বড় কাজ।

Modernaর ভ্যাকসিনে নির্জীব করা কোরোনাভাইরাস নেই, করোনার কোন প্রোটিন নেই। কি আছে? করোনার স্পাইক প্রোটিন ( ছবিতে গোলাকার ভাইরাস থেকে পায়ের মত বেরিয়ে থাকে দেখেছেন নিশ্চয়ই ) তৈরী করার জন্যে নির্দিষ্ট RNA আছে।  এই RNAকে ইঞ্জেক্ট করে দেওয়া হয়েছে মানব দেহে। শরীরের কোষে ঢুকে পড়লে এই ভাইরাল RNA থেকে  তৈরী হয় স্পাইক প্রোটিন, এবং সেই স্পাইক প্রোটিনকে চিনে রাখে আমাদের রোগ-প্রতিরোধ ব্যবস্থা (immune system )।  প্রোটিন বানাবার কাজ শরীরকে আউটসোর্স করে দেওয়া হয়েছে বলতে পারেন।  শরীর নিজেই ভাইরাল প্রোটিন বানাবে আর বানানো হয়ে গেলে শরীরই তাকে চিনে রাখবে।  আশা করা যায় যে আসল ভাইরাস যদি কোনোদিন ঢোকে তাকে এবার দ্রুত চেনা যাবে এবং বধ করা যাবে - ঠিক অন্য টীকায় যেমন হয়।


RNA ভ্যাকসিন তৈরী করা সোজা এবং এর জন্যে আলাদা করে জীবাণু বা তার প্রোটিন বানাতে হয় না বলে বিজ্ঞানীদের আশা  ভবিষ্যতে ভ্যাকসিন তৈরীর কাজ আরো দ্রুত হবে। অবশ্য, এ একদম নতুন টেকনোলজি ; আগে কখনো ব্যবহৃত হয়নি।  তাই ভাল রকম পরীক্ষা করা হচ্ছে। সামনে বছরের গোড়ায় বাজারে টিকা ছাড়তে পারবে বলে Moderna জানিয়েছে (দাম কত করবে ?? জানি না!) ; ব্যবসা ও বিজ্ঞানের সাফল্য দুই লক্ষ্য থাকলেও ফালতু লোক-দেখানো তাড়াহুড়োর কোন জায়গা নেই। 

আন্তর্জাতিক ভ্যাকসিন 'প্রতিযোগিতায়' অবশ্য এখনো এগিয়ে চীনের কোম্পানি CanSino Biologics. চীনের একাডেমি অফ মিলিটারি মেডিক্যাল সায়েন্সর সঙ্গে একযোগে তাঁদের ভ্যাকসিন phase II পর্যায়ে পেরিয়ে গেছে। প্রজেক্টের সাফল্য দেখে চীনা সেনাবাহিনী একে 'জরুরি ওষুধ' বলে অভিহিত করেছেন এবং সম্ভবত এ বছরের শেষে চীনের সৈন্যরা এই টিকা ব্যবহার করতে পারবেন।

https://www.nejm.org/doi/full/10.1056/NEJMoa2022483?fbclid=IwAR1hGII8NpMaWWS1JuCtGbbUYtNC18WC7A6IeKJm6nnA_UJBo-luO_ID9lM
--------------- ----------------------------------------- -----------------

২. বাজারে আসা অনেক স্যানিটাইজার যে ভাল নয়, বরং ক্ষতিকারক হতে পারে এ কথা পঞ্জাবের Food and Drug Administration দপ্তর জানিয়েছে। Caravan পত্রিকা জানাচ্ছে যে জুলাই মাসের গোড়ায় প্রকাশিত  রিপোর্টে দেখা যাচ্ছে ৬৩টি স্যানিটাইজার পরীক্ষা করা হয়েছিল।  তার মধ্যে ৩৬টি জীবাণু মারতে কার্যকর হবে না, এবং ৪টিতে বিষাক্ত মিথানল পাওয়া গেছে!

এতে খুব একটা অবাক হবার কিছু নেই।  প্রচুর স্যানিটাইজারে বাজার ছেয়ে গেছে সবাই দেখতে পারছেন। আমাদের দেশে যে সব কিছুর কোয়ালিটি কন্ট্রোল হবে না সেটা বলে দিতে হয় না।  আর যে দেশে বিষাক্ত মদ খেয়ে প্রতি বছর বহু মানুষ প্রাণ হারান সে দেশে কেউ কেউ সানিটাইজারে ইথানলের জায়গায় মিথানল মেশাবেন তাতে খুব অবাক হবার কিছু আছে কি? তাহলে উপায়? ভাল কোম্পানির স্যানিটাইজার দেখে শুনে কিনবেন। আর তাছাড়া,  সাবান দিয়ে হাত ধোয়া তো সবচেয়ে ভাল।আজ অবধি এমন  কোন স্যানিটাইজার বেরোয়নি যা কষ কষ করে সাবান জল দিয়ে হাত ধোয়ার থেকে ভাল।

https://caravanmagazine.in/health/with-no-government-oversight-profiteering-industries-flood-indian-markets-with-toxic-sanitisers
 ------------------------------------- -----------------------------------------

৩. একটা ছোট্ট কথা বলে শেষ করি।সবাই তো ভ্যাকসিন ওষুধ ভেন্টিলেটর নিয়ে ভেবে ভেবে কুলকিনারা পাচ্ছেন না।
কিন্তু, এ প্রসঙ্গে শারীরবিদ্যা ও চিকিৎসা বিজ্ঞানের গোড়ার একটা কথা মনে করিয়ে দিই।

শরীরে জীবাণু ঢুকলে তাকে মারতে কোষদের (যেমন রক্তের শ্বেতকণিকা) কি লাগে? এনার্জি।
জীবাণুর বিরুদ্ধে আন্টিবডি তৈরী করতে কি লাগে? এনার্জি।
টিকা নিলে যাতে সেটা জীবাণুকে ঠিকঠাক চিনতে সাহায্য করে তার জন্যে কি লাগে? এনার্জি।
ওষুধ শরীরে ঢুকলে তাকে ঠিকঠাক কোষে পৌঁছে দিতে এবং অনেক সময় সেই ওষুধকে active করতে কি লাগে? এনার্জি। ... ইত্যাদি ইত্যাদি।
এই এনার্জি শরীর পায় কোথা থেকে? খাবার থেকে। পুষ্টিকর পর্যাপ্ত খাবার।

তাই এত এত ওষুধ/ভ্যাকসিন/ হাসপাতাল বিশেষ কাজে আসবে না একটি জিনিস কমতি পড়লে-  পুষ্টিকর পর্যাপ্ত খাবার।মনে রাখতেই হবে, টিকা বা ওষুধ শরীরকে সাহায্য করে জীবাণুকে পরাস্ত করতে, কিন্তু আসল লড়াই লড়ে শরীর নিজে। শরীর নিজেই সৈন্য, টিকা বা ওষুধ তার হাতের হাতিয়ার। শরীরের রোগ-প্রতিরোধ ব্যবস্থা'র  মুলে হচ্ছে পর্যাপ্ত পরিমানে কার্বোহাইড্রেট + প্রোটিন + ফ্যাট + ভিটামিন + জল + ইত্যাদি নিয়ে খাওয়া। ওই জ্বালানি না পেলে ইঞ্জিন চলবে না। তাই আজ কোটি কোটি ভারতবাসী  যদি আধপেটা খেয়ে থাকেন তাহলে রোগ অনেক দ্রুত ছড়াবে। দুর্বল, অভুক্ত শরীরে অনেক সহজেই বাসা বাঁধে ভাইরাস, ছড়িয়েও পড়ে।

ভাল থাকবেন। সাবধানে থাকবেন কিন্তু আতঙ্কিত হবেন না, তাতে কোন এক্সট্রা লাভ নেই ।
মাস্ক ভাল করে পরবেন।  

No comments:

Post a Comment

 স্কুল খুলুক, সঙ্গে হাওয়া বাতাস খেলুক ক্লাসঘরে ('এই সময়' সংবাদপত্রে প্রবন্ধ -  ২২শে সেপ্টেম্বর, ২০২১)      সোজাসাপ্টা অপ্রিয়   সত...